somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সূতীর খালের হাওয়া ২১ - শহরের স্বেচ্ছা তড়িতাহত আত্মারা

০৯ ই এপ্রিল, ২০২১ সন্ধ্যা ৬:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



"অমানী অক্রোধী দিন, অপ্রবাসী ভাড়ার বাড়িতে
পিছনে উচ্ছেদপত্র, দুয়ারে প্রস্তুত ঠেলাগাড়ি
তবুও ছপ্পর ফুঁড়ে প্রেম আসে গরিবের বাড়ি।"
(জয় গোস্বামী, আত্মপরিচয়)
....

- 'এখানেই আমাদের প্রথম দেখা, স্যার। এই জায়গায়। এই লেকের পাড়ে। '

- 'ওহ!' ছোট করে বললাম, ' আমি ভেবেছিলাম ফেসবুকে, হয়তো।'

গত সপ্তাহে, লকডাউনের আগে, বইমেলা ফেরত আমি আর আমার ছাত্র, বসে আছি ধানমণ্ডি লেকের পাড়ে। আমার সঙ্গের ছাত্রটি আমার আগের কর্মস্থল / ইউনিভার্সিটির সদ্য গ্রাজুয়েট। ছাত্র থাকা অবস্থায় মাঝেমাঝেই একটা বা দুটো সেমিস্টার ড্রপ দিয়ে হঠাৎ উধাও হয়ে যেতো। তারপরের সেমিস্টার থেকে আবার কন্টিনিউ করতো। খুব একটা ঘনিষ্ঠও ছিল না তখন আমার সঙ্গে। কিন্তু, মনে পড়ে, বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির সেমিনার - কনফারেন্সে প্রায়ই উপস্থিত দেখতাম ওকে। আর কোন ছাত্রছাত্রীকে এতটা আগ্রহ নিয়ে কোন সেমিনারে উপস্থিত থাকতে দেখি নি।

- 'তোমার বাসার সবাই কেমন আছে, সেটা বলো।'

- 'বাবার দোকানে বেচাবিক্রি কম। বাকি সব ভালোই, আলহামদুলিল্লাহ।'

প্রেম সংক্রান্ত পরামর্শ চাইতে আসা আমার এই সদ্য গ্রাজুয়েট ছাত্রের বাবা একটি চায়ের টং দোকান দিয়ে পুরো পরিবার টেনেছেন।
ছাত্র নিজে টিউশন করে করে একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েশনের পুরো খরচ টেনেছে। বাসার থেকে নেয়া সাহায্যের পরিমাণ প্রায় শূন্য।

- 'তোমার চাকরী বাকরির পড়াশোনার কি অবস্থা?'

-'চলছে স্যার। তবে খালি গ্রাজুয়েশনের ডিগ্রী নিয়ে ভালো কোন চাকরী জোটানো মুশকিল।'

- 'মাস্টার্স?'

- 'আরও লাখ দেড়েক টাকা লাগবে।' ওর কণ্ঠ ম্রিয়মাণ শোনায়। 'এই মুহূর্তে তাই শুরু করতে পারছি না।'

একটু থেমে ও আবার যোগ করে,

- 'টিউশনি, চাকরীর পড়া, এই নিয়েই চলতেসিল ভালোই, কিন্তু ... কিন্তু মধ্যখান থেকে হুট করে এই মেয়ের সঙ্গে পরিচয় ...'

- 'বলো, ঘটনা খুলে বলো একদম শুরু থেকে ...' আমি পরিস্থিতি হালকা করার চেষ্টা করি।

- 'আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব একটা একটিভ না, স্যার। তবে সকাল বেলা লেকের পাড়ে হাঁটতে আসা আমার নিয়মিত একটা অভ্যাস। ওকে প্রায় দুইমাস আগে এই সিটেই বসা অবস্থায় দেখি। হাতে বই। পড়ছিল একা, এখানে বসে বসে।'

ওর শুরুয়াদের গল্প শুনে আমার ভালো লাগে।

- 'লেকের পাশে বসে বসে বই পড়ছে একটা মেয়ে, এই দৃশ্যকি রেগুলার বেসিসে দেখা যায়?'

ছাত্রের প্রশ্নের জবাবে আমার না বলা ছাড়া উপায় থাকে না।

- 'বই পড়ছিল বলেই নিজে থেকে গিয়ে আমি ওর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি। অনুমতি চেয়ে নিই বেঞ্চে ওর পাশে বসে কথা বলার। এভাবেই প্রথম দিনের পরিচয়, কথাবার্তার শুরু।'

সামনে বাদাম বিক্রেতা ঘুরঘুর করছে। করোনা উপদ্রুত সময়ে রাস্তার খাবার খাওয়া ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না।

- 'ওর ব্যাকগ্রাউন্ড কি?' মুরুব্বীরা সচরাচর যে প্রশ্নটি করে এমন একটি প্রশ্ন করে নিজের কাছেই খারাপ লাগছিল, কিন্তু এটা না জেনে পরবর্তী সিচুয়েশনগুলো মেজার করাও তো মুশকিল আমার জন্যে।

- 'এ লেভেলস দিলো মাত্র। ইউনিভার্সিটির অ্যাডমিশন টেস্টের প্রস্তুতি নিতেসে এখন।'

- 'ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষার্থী?' আমি পুনরায় নিশ্চিত হবার জন্যে প্রশ্ন করলাম।

-'হ্যাঁ স্যার।' একটু থেমে আবারো যোগ করে ও 'হোয়াটসঅ্যাপেই সারাদিন কথা হত। বাবা মা ব্যস্ত চাকুরীজীবী। মেয়েকে সময় দিতে পারেন কম।'

বাবা - মা দুজনেই চাকুরীজীবী হলেই সন্তান বখে যায় - এই ধরনের টিপিক্যাল জাজমেন্টে আমি যাই না। আমার নিজেরও বাবা মা দুজনেই চাকরী করতেন। বখে যাওয়া বলতে যেটা বুঝায়, সেটা আমার ক্ষেত্রে হয় নাই।

- 'কিন্তু হাসান, তুমি তোমার অবস্থা জানো...'

- 'জানি স্যার।' আমার ছাত্র নীচে তাকিয়ে থাকে।

ছাত্রজীবনে হাসান ঘুণাক্ষরেও নিজের কোন আর্থিক কষ্টের কথা আমাদের শিক্ষকদের কাউকেই জানতে দেয় নাই। পড়াশোনা শেষ হবার পর যখন ও আমাকে ওর এই আর্থিক সংগ্রামের কথা জানালো, তারপর শিক্ষক হয়েও আমার এই ছাত্রের প্রতি আমার সম্মান অনেকগুণ বেড়ে গিয়েছিল। আমি জীবনে প্রচুর মানুষ, নিজের ছাত্রজীবনে, শিক্ষক হিসেবেও দেখেছি, যারা দারিদ্র্যকে এক্সকিউজ হিসাবে বার বার উপস্থাপন করে। আমার এই ছাত্র একবারের জন্যেও তা করে নি। বিভাগ থেকে কোন স্টাইপেন্ডও চায় নি। রেজাল্টের উপর অল্পকিছু স্কলারশিপ ছিল হয়তো।

- 'তুমি তো জানো, তুমি এখন যে আর্থিক অবস্থায় আছো, এখানে তোমার পক্ষে কোন সময়, বা দশটা টাকাও অপচয় করা সম্ভব না।'

- 'স্যার অপচয় বইলেন না প্লিজ। জীবনে প্রথমবারের মতো প্রেমের অনুভূতি টের পাইসি।'

আমার ছাত্রের মুখে লাজুক, কিন্তু ম্লান হাসি।

- 'আপনাকে আগেও বলসি স্যার, নিজের অবস্থা চিন্তা করেই, হীনমন্যতা থেকে কখনো কারুর প্রতি ভালোলাগার ফিলিংস আগে বাড়তে দিই নাই। ... এইবারও হয়তো দিতাম না। সব এই ধানমণ্ডি লেকের সকালবেলাগুলির দোষ। এতো রোম্যান্টিক!'

আমি আর হাসান, দুজনেই সজোরে হেসে উঠি। ও পুরো ঘুরে আমার দিকে তাকানোর পর, ওর ডানচোখের সাইডে কালচে লাল হয়ে ফুলে থাকা অংশটা বিশেষভাবে আমার চোখে পড়ে। আমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতে ও নিজেই উত্তর দেয়,

- ' এরমধ্যে মারামারিও করে ফেলসি স্যার, ঐ মেয়ের জন্যে!'

আমি অবাক! এতো স্বল্প সময়ে মারামারিও হয়ে গেছে! হাসানের মুখে অবশ্য সলজ্জ হাসি। মারামারি করে ওর আফসোস নেই বোঝা যাচ্ছে। একদম শান্ত - স্বল্পবাক আমার এ ছাত্রের এতো পরিবর্তন হয়ে গেলো কবে? তাও স্রেফ দু'মাসের প্রেমেই?

- 'ও যেই অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং এ থাকে, সেই বিল্ডিং এ ওদের উপরের ফ্ল্যাটে একটা ডিভোর্সি ব্যাটা থাকে। সেই লোকটার সঙ্গেও ওর ভালো খাতির। অনেক চ্যাট হয় ম্যাসেঞ্জারে।'

- 'তো?'

আমি হিসাব মেলানোর চেষ্টা করি। কার সঙ্গে কার মারামারির ফলে আমার বীরপুরুষ প্রেমিকপ্রবর ছাত্রের মারামারি করে চোখ ফুলিয়ে ফেলা।

- 'ঐ ব্যাটারে নিয়ে আসলো ও একদিন। আমারে বলল, তিনজন মিলে আমরা আইসক্রিম খাইতে যাবো কোথাও।'

আমাদের অদূরেই দাঁড়ানো ইগলু আইসক্রিমের ভ্যান দেখে আমার মনে হল, আইসক্রিম খেতে আইসক্রিম পার্লারে যাওয়ার কি প্রয়োজন। এই লেকের পাড়ে বসেই তো খাওয়া যায়।

- 'তারপর?' আমি প্রশ্ন করলাম।

- 'আমি ঐ মেয়েরে বললাম, এই বুড়া লোকের সঙ্গে আমাদের কেন যাইতে হবে আইসক্রিম খাইতে?'

আমি এবার একাই এসে উঠলাম।

- 'কেন, বয়স্ক মানুষদের সঙ্গে আইসক্রিম খ্তেে যাওয়া কি সমস্যা?'

- 'স্যার, আপনিও জানেন আমি কেন যেতে চাই নাই ওর সঙ্গে। এই বুড়া ব্যাটার সঙ্গে ওর এতো কিসের দহরম মহরম?'

আমি চুপ রইলাম, যার অর্থ, আমার ছাত্র যৌক্তিক কথা বলেছে।

- 'তারপরে ধাক্কাধাক্কি। ধাক্কাধাক্কি থেকে হাতাহাতি সেখান থেকে এই ঘটনা।' আমার ছাত্র চোখের পাশে ইঙ্গিত করে দেখায়।

- 'আমি তারপরেও ওকে, মানে মেয়েটাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করসি, এই বুড়ো বদমাইশের কাছ থেকে সরায়ে আনতে। একটা ডিভোর্সি ব্যাটার ওর মতো বাচ্চা মেয়ের কাছে কি চাওয়ার থাকতে পারে স্যার, এটা কি আমি বুঝি না?'

পজেসিভনেস। আমি মনে মনে বলি। শুধু প্রেম নয়, কঠিন রকমের পজেসিভনেসও ঢুকে পড়েছে আমার প্রেমিকপ্রবর ছাত্রের মনে।

- 'কিন্তু স্যার, ও বুঝে না কেন, ঐ ব্যাটার বাজে ইনটেনশন?'

আমি উত্তর খুঁজে পাই না। অ্যাজাম্পশনের উপরে বেইজ করে প্রেমভালোবাসা সংক্রান্ত ইস্যুতে মন্তব্য করার ফলাফল হিতে বিপরীত হয়।

আমি আর অতিরিক্ত কিছু বলি না। টুকটাক পরামর্শ দিই। চেষ্টা করি ওকে স্মরণ করায়ে দিতে যে, কলেজ আর ইউনিভার্সিটির মধ্যবর্তী অবস্থানান্তর অবস্থায় সৃষ্ট কোন সম্পর্ক সাধারণত গতিপথ খুঁজে পায় না।সতর্কতার সঙ্গে, আকারে ইঙ্গিতে চেষ্টা করি সামাজিক আর্থিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ওর এই সম্পর্কের অসামঞ্জস্যতার ব্যাপারে ওকে ধারণা দিতে। বিস্তৃত করি না। প্রেম ভালোবাসা প্রায়ই অর্থের কাছে জলের দরে বিক্রি হয়, আমার সদ্য গ্রাজুয়েট ছাত্র তা নিজে থেকে ঠেকেই না হয় শিখুক। ওর পরিবারের প্রতি ওর দায়বদ্ধতা পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিই বুড়ো মাষ্টারদের মতো। স্মরণ করিয়ে দিই নিজের প্রতি নিজের দায়বদ্ধতার কথা। তারপর, উঠে আলাদা হই ঝিগাতলা বাসস্ট্যান্ডে।

রিকশা ডাকতে ডাকতে আমার চোখ আটকায়ে যায় বিজিবি সদর গেটের পাশের বার্গার কিং এ। তারপর, তার পাশের দালানের রেস্টুরেন্ট গুলায়।

বছরখানেক আগে, ছাড়াছাড়ির পর প্রেমিকা প্রায় বাতাসের মতো ঢাকা শহরে অদৃশ্য হয়ে গেলে একটা ছেলে, অফিস শেষে প্রতিদিন সন্ধ্যায় এই ধানমণ্ডির রাস্তাগুলিতে হেঁটে বেড়াতো। সেই রাস্তায়, যাতে সে আর তার পছন্দের মানুষ একসময় হাতে হাত রেখে হাঁটতো। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গেলে প্রায়ই সেই রেস্টুরেন্টগুলিতে এককাপ কফি হাতে বসে থাকতো, এই আশায়, যে মেয়েটার সঙ্গে হুট করে তার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, সেই মেয়েটাও হয়তো একদিন দৈবক্রমে ঢুকে পড়বে এই রেস্তোরায়। কফি হাতে বসে ছেলেটা মনে মনে , একা একা সংলাপ বিনিময় করতো সে মেয়েটির সাথে। সেই মেয়েটার সঙ্গে আর কখনো দেখা হয় নি তার।

আমার রিকশা চলা শুরু করলে আমি ব্যাগ থেকে জয় গোস্বামীর কবিতার বই বের করি। কবিতার বই খুলেই প্রথম যে কবিতাটা চোখে পড়ে, আমার মনে হয়, এখুনি কবিতাটা হাসানকে শোনানো দরকার।

- 'হাসান?'

- 'জী স্যার' আমার ছাত্র ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলে।

- 'জয় গোস্বামীর একটা কবিতা পড়লাম মাত্র। ভালো লেগেছে। শুনবে?'

- 'শিওর স্যার!' ও হেসে জবাব দেয়। আমি পড়া শুরু করি।

"'সাদা আর কালো বেগুনী আর নীল
সবুজ আর বাদামী সব নাম
এর মধ্যে কোনটা আমার?

কোন নামটা ঝোলার মধ্যে নিয়ে আমি বেরোই
পকেট থেকে রাস্তায় ফেলে দিই কোন নামটা
আর দপ্তরে যাবার আগে কোন নামটাই - বা
পরে নিই টয়লেটে ঢুকে?

কোন নামটাই বা পকেটমার হয়ে যায়
আর পকেটমারই বা সামলাতে পাড়ে না কোনটাকে
পালায় রাস্তায় ফেলে তারপর অন্য সবাই আমায় বাড়ি বয়ে
পৌঁছে দিয়ে যায়
কোন নামটা?

বাঁকানো আর দাঁড় করানো
সোজা আর শুইয়ে রাখা
বাঁট লাগানো আর আঁকশি দেওয়া সব লাঠি
এর মধ্যে কোনটা আমার?

কোনটা দিয়ে পাখি তাড়াবো কোনটা নিয়ে হাওয়া খেতে যাবো
বিকেলবেলায়
কোনটা হাতে নিয়ে নামবো ফিটন থেকে
কোনটা দিয়েই বা টেনে নামাবো নাগালের বাইরের আম কাঁঠাল
কোনটা নিয়েই বা ঝড়াক সে দাঁড়াবো ঘুরে আর
আটকে দেব মাথার উপর নামতে থাকা বিপদ
কোনটা দিয়ে মাটি ঠুকে ঠুকে আমি জানতে পারি
কোথায় রয়েছে
আয়কর - বিভাগের হাত থেকে লুকিয়ে রাখা
অলঙ্কার পরানো কঙ্কাল
কোন লাঠিকেই বা মাথায় বালিশ দিয়ে ঘুম পাড়াই বিছানায়
আর নিজে সারারাত হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি দেয়ালে
যতক্ষণ না এই সমস্ত ঘটনা নিয়ে ঠাস করে দিনের ওপর
থাপ্পড়ের মতো পড়ে খবর - কাগজ
যতক্ষণ আমার মহিলা আমার মাথার ওপর
ঠাণ্ডা চা ঢেলে চান করায় ঘুম কাটানোর জন্য
আর আমায় বাজার পাঠায় ঝুঁটি ধরে
ঠক ঠক করতে করতে আমি আনাজের সামনে দাঁড়াই মাছের
সামনে দাঁড়াই
আজ বেগুন কী দর দিচ্ছো পটল কতো করে মাছ খাওয়া এবার
ছাড়িয়ে দেবে দেখছি
চারিদিক থেকে দোকানিরা ঝটপট ছাড়াতে থাকে আমার পালক
আর যোধপুর পার্কের বাজার থেকে ফেরার সময় আর
গড়িয়াহাটের বাজার থেকে ফেরার সময়, আমি
নদীয়ার কেষ্টনারায়ণ
আমার দুই ব্যাগভর্তি বাজার জ্বলতে থাকে দাউদাউ করে
বার্ষিক বেতনক্রম জ্বলতে থাকে
দুটো খুপরির জন্য আঠারোশো পঞ্চাশ টাকা জ্বলতে থাকে
আমি বাড়িওয়ালাকে মনে মনে আরও সাতটাকা বেশি দিই
আর আঠেরোশো সাতান্ন হওয়া মাত্র আমি
বিদ্রোহী সিপাহীদের একজন হয়ে যাই
দাঁত দিয়ে টোটা ছিঁড়ি আর দুই ব্যাগের মধ্যে ভ'রে জ্বালিয়ে দিই
লেকবাজার আর জগুবাজার
ছোটবাজার আর বড়বাজার
খোলা বাজার আর ফোলা বাজার
রাজাবাজার আর কাশিমবাজার
বাংলা - বিহার - উড়িষ্যা বাজার দাউ দাউ করে
হাউমাউ করে ওঠে লালবাজার আর কালোবাজার
হলুদ সবুজ নীল বেগুনী আর বাদামী সব বাজার
এর মধ্যে কোনটা আমার?

আমার দুইব্যাগের মধ্যে জ্বলছে
দুটো খুপরিঘর
যার একটাতে ফুটতে থাকে অফিসের জন্যে ভাত আর
অভিসম্পাত নিজের ভাগ্যকে
অন্যটায় খাটের ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে থাকে আমার সেই লাঠি
শুয়ে থাকে আর প্রেম যখন কোথাও নেই তখন
আমার বদলে
সেই লাঠিই প্রেমের কবিতা লিখতে শুরু করে এক
ভোরবেলায় ..."

সায়েন্সল্যাব মোড়ে , রিকশায়, জ্যামে বসে, নিবিষ্ট কবিতা পাঠ শেষে আমি যখন থামলাম, দেখি আমার সামনে সাইন্সল্যাব মোড়ে ডেইলি রিকশা আটকে পয়সা চাওয়া হিজড়া বোনটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি অল্প হেসে তার হাতে দশটা টাকা ধরিয়ে দিলে সে আপনাতেই বিদেয় হয়। চোখেমুখে তখনও সে ভ্যাবাচ্যাকা ভাব।

- 'আছো, হাসান?'

- 'আছি স্যার।'

- 'বুঝলে কিছু?'

- 'আপনি ঠিক আছেন তো স্যার? এতো লম্বা কবিতা, রিকশায় ...'

- 'রিকশা ছাড়তে ছাড়তেই জ্যামে আটক।'

- 'জয় গোস্বামী আমারও প্রিয় কবি স্যার।' একটু থেমে মাহমুদ বলে, 'তবে ওর এতো হতাশাগ্রস্থ কবিতা আমার পছন্দ না। আমার পছন্দের একটা কবিতা শোনাবো স্যার?'

হাসান শুরু করে। আবৃত্তি করতো ও ইউনিভার্সিটির ছাত্র থাকাকালে। আমার চে' নিঃসন্দেহে অনেক ভালো কবিতাপাঠের গলা ওর।

" — ‘সে যদি তোমাকে অগ্নিতে ফেলে মারে?’
বিনা চেষ্টায় মরে যাব একেবারে
— ‘সে যদি তোমাকে মেঘে দেয় উত্থান?’
বৃষ্টিতে, আমি বৃষ্টিতে খানখান
— ‘সে যদি তোমাকে পিষে করে ধুলোবালি?’
পথ থেকে পথে উড়ে উড়ে যাব খালি
— ‘উড়বে?– আচ্ছা, ছিঁড়ে দেয় যদি পাখা?’
পড়তে পড়তে ধরে নেব ওর শাখা
— ‘যদি শাখা থেকে নীচে ফেলে দেয় তোকে?’
কী আর করব? জড়িয়ে ধরব ওকেই
বলো কী বলব, আদালত, কিছু বলবে কি এরপরও?
— ‘যাও, আজীবন অশান্তি ভোগ করো!’ "


- 'সুন্দর কবিতা না স্যার?'

আমার স্বীকার না করে উপায় থাকে না যে, কবিতাটা সুন্দর। আমি এও বুঝতে পারি ও কি বলতে চাইছে। আমার স্বেচ্ছাতড়িতাহত ছাত্রকে বিদায় দিয়ে আমি ফোন রেখে দিই। আকাশে একটা রংধনু উঠেছে। তার একপ্রান্ত গিয়ে মিশেছে, হয়তো, ধানমণ্ডি লেকের পাড়ে।

ছবিসুত্রঃ দা ডেইলি স্টার
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০২১ রাত ৮:২৬
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×