
১।
লেখাটা এভাবে শুরু করা যাক। আপনি আর আপনার এক বন্ধু দাঁড়িয়ে আছেন একটা রুমের দরোজায়। রুমের ভেতরে কোন আসবাব নেই, দেখা যাচ্ছে। আপনার বন্ধু, সব দেখেশুনে দাবী করলো, রুমটা ফাঁকা। আপনি শুনে মুচকি হাসলেন, কোন জবাব দিলেন না। আপনার মুচকি হাসি দেখে আপনার বন্ধু বিরক্ত হল। সে রুমে ঢুকে ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেলো। দাঁড়িয়ে কোমরে হাত দিয়ে আপনার দিকে তাকিয়ে বলল, রুম তো ফাঁকা-ই। গেটে দাঁড়িয়ে, দরজার সাথের দেয়ালের আড়ালে রুমের যে অংশটুকু দেখা যাচ্ছিল না, এখন তার চোখে তাও পরিষ্কার। আপনি পুনরায় তার কথার জবাব না দিয়ে মুচকি হাসলেন। এবার সে রেগে গেলো। রেগে গিয়ে রুমজুড়ে শ্যাডোবক্সিং আরম্ভ করলো। বাতাসে ঘুষাঘুষি। তারপর সে উড়ে উড়ে ফ্লায়িং কিক মারা আরম্ভ করলো। এরকম আধাঘণ্টা লাফালাফি করার পর সে মেঝেতে বসে হাঁফাতে লাগলো। তখন আপনি রুমের ভেতরে ঢুকলেন।
রুমের মধ্যে খুব মিহি একটা সুঘ্রাণ আপনার নাসারন্ধ্রে এসে ধাক্কা দিলো। আপনি একবারেই চিনলেন , সে ঘ্রাণ। আপনার খুব পছন্দের কোন একজন এ সুঘ্রাণ ব্যবহার করতেন। আপনি সে পছন্দের মানুষটির স্মৃতিমন্থন করতে করতে রুমময় পায়চারি করে বেড়াতে লাগলেন। একটু পর, রুমের জানালা আলতো ধাক্কায় খুলতেই জানালার ওপাশটা স্পষ্ট হল। একটা দীঘি। দীঘির পাশে একটা সরু কাঁচা রাস্তা। এই কাঁচা রাস্তা ধরে আপনার পছন্দের মানুষ হেঁটে আসতো এই কক্ষে, কোন একসময়। আপনি অতীত দিনের সুন্দর সব স্মৃতির ব্যাথায় জর্জরিত হয়ে আস্তে আস্তে বসে পড়লেন রুমের মেঝেতে, দেয়ালে হেলান দিয়ে। আপনার চোখ খোলা জানালায়, আকাশে।
খুব সহজে, এই রূপক অবস্থান দুটো ব্যাখ্যা করে একজন জাজমেন্টাল এথিস্ট, এবং একজন শান্তিপ্রিয় বিশ্বাসীর অবস্থান।
একজন অবিশ্বাসী, যে শুধু স্রষ্টায় অবিশ্বাস করেই ক্ষান্ত দেয় না, তার জন্যে ঐ ফাঁকা কক্ষের ভেতরে ঢুকে শ্যাডো বক্সিং করাটা জরুরী। বিশ্বাসীর বিশ্বাসে আঘাত করা, বা তাকে হেয় প্রতিপন্ন করা। এদিকে বিশ্বাসী ঈশ্বরে বিশ্বাস কেন করে, এটা বেশীরভাগ সময় বোঝানো মুশকিল, কট্টর নাস্তিক, বা পার্টিকুলার কোন ধর্মসম্প্রদায়ভুক্ত মানুষকে ঘৃণা করে যে বা যারা, তাদের। আমাদের বিশ্বাস, ঐ হালকা এক সুঘ্রাণের মতো, যা আমাদের আলমে আরওয়াহ, বা রুহের জগতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
২।
কিন্তু বারট্রন্ড রাসেলের হোয়াই আই অ্যাম নট এ ক্রিশ্চিয়ান প্রবন্ধে জেসাস ক্রাইস্টের একটা সমালোচনা আমাকে ভাবিয়েছিল গভীরভাবে। কারণ ঐ সমালোচনাটির ভীত ছিল খুব গভীরে। ওটা নিয়ে আমার দীর্ঘদিন ভাবা লাগে। তারপর আমি নিজের মতো একটা ব্যাখ্যা দাঁড়া করাই। সেটা আমি কারো সঙ্গে শেয়ারও করি নি, প্রয়োজন বোধ করি নি বলে। কারণ, সবার জন্যে আসলে রাসেলের উত্থাপিত প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ না। সবাই এতো তলিয়ে বিশ্বাস করতে চায় না খোদায়।
রাসেলের সমালোচনা যেহেতু ক্রিশ্চিয়ানিটি কেন্দ্রিক, তিনি তাই যীশুখ্রিষ্টকে উদ্দেশ্য করে বলেন, জেসাস ক্রাইস্ট যদি ইনহ্যারেন্টলি, বা ডিপ ডাউন ইনসাইড হিউম্যানিস্ট হতেন, বা অন্তরের গভীরে মানবতাবাদী হতেন, মানুষের দুঃখ কষ্টে তিনি যদি আসলেই জর্জরিত হতেন, তবে তিনি কখনো কোন 'পাপী বান্দার' চূড়ান্ত শাস্তি, বা আজীবন দোযখে জ্বলার আইডিয়া প্রপাগেট করতে পারতেন না। অপরাধ যত কঠিনই হোক, একদিন সবাই ক্ষমা পাবে ঈশ্বরের দরবারে - এটাই চাইতেন তিনি।
ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হওয়ায়, ওয়েস্টার্ন নীতিনৈতিকতার স্কেলে গড়া মানসিক ষ্ট্যাণ্ডার্ডে আসলে আমি নিতে পারছিলাম না ব্যাপারটা। আসলেই তো, যিনি দয়ার সাগর, তারপক্ষে কীভাবে কারুর অবাধ্যতার শাস্তিস্বরূপ চিরদিনে আগুনে জ্বলতে থাকাটা মেনে নেয়া সম্ভব? একই প্রশ্ন তো সকল আব্রাহামিক ফেইথের ব্যাপারেই উত্থাপন করা যায়।
৩।
আমি সমস্যাটার একটা মেটাফিজিক্যাল সমাধান বের করি, ইতিহাসের সাহায্য নিয়ে।
ইতিহাসটা ৩৬ হিজরিতে সংঘটিত হওয়া জঙ্গে জামাল, বা উটের যুদ্ধের। ঐ যুদ্ধে, হজরত আলী (রাজিঃ) এর বিরুদ্ধ শিবিরে থাকা হজরত জুবাইর ইবনুল আওয়াম (রাজিঃ), ইবনে জরমুয নামে এক ব্যক্তির দ্বারা শহীদ হন। উল্লেখ্য যে, হজরত জুবাইর (রাজিঃ) আশারা মুবাশশারার সাহাবী (যে দশজন সাহাবীর জীবদ্দশায় তাদের ব্যাপারে জান্নাতের সুসংবাদ ঘোষণা করা হয়েছিল) ছিলেন, এবং প্রাথমিকভাবে জঙ্গে জামালে হজরত আলী (রাজিঃ) বিরুদ্ধে থাকলেও তিনি পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে অপারগতা, এবং নৈতিকভাবে অসামর্থ্য জানায়ে দেন। হজরত জুবাইর (রাজিঃ) যুদ্ধে অংশ না নিয়ে ফিরে যাওয়ার পথে তাকে একাকী পেয়ে শহীদ করে ফেলে ইবনে জরমুয নামে এক ব্যক্তি। হজরত জুবাইর (রাজিঃ) এর অস্ত্র, এবং ছিন্ন মস্তক নিয়ে যখন ইবনে জরমুয হজরত আলী (রাজিঃ) এর কাছে আসেন, তার উদ্দেশ্যে হজরত আলী (রাজিঃ)র বক্তব্য, আমি আশারা মুবাশশারা বই থেকে উদ্ধৃত করছি-
"হজরত আলী (রাজিঃ) হজরত জুবাইর (রাজিঃ) এর তরবারির দিকে বেদনাতুর দৃষ্টিতে তাকাইয়া বলিলেন, 'আহ! ইহা সেই তলোয়ার, যাহা দ্বারা হজরত জুবাইর (রাজিঃ) রাসুলুল্লাহ (সাঃ) - এর উপর হইতে বহুবার মুসীবতের পাহাড় হঠাইয়া দিয়াছেন। হে জরমুয! আমি তোমাকে সুংবাদ জানাইতেছি যে, জাহান্নাম তোমার অপেক্ষায় আছে।' (মুসনাদে আহমদ)
ইবনে জরমুয, হজরত আলী (রাজিঃ) এর কাছ থেকে জাহান্নামের খবর শুনে ক্রোধে, দুঃখে নিজের পেটে নিজে তরবারি চালনা করে আত্মহত্যা করে।
এই ঘটনার অনুরূপে, আমি জাহান্নাম কল্পনা করা শুরু করেছিলাম, স্রেফ আল্লাহর অসন্তুষ্টির মধ্যে থাকাকেই। ছোটবেলা থেকে একটা পার্টিকুলার সূফী ট্রেন্ডের সঙ্গে থাকার ফলে আমার জন্যে এরকম একটা সিচুয়েশন কল্পনা করাটা হয়তো সহজ ছিল, কিন্তু আমি যেটা বলতে চাইছি, সেটা সহজে বুঝায়ে বলা কঠিন।
আল্লাহর সন্তুষ্টি, অন্তরের ভেতরে অন্তরের ভালোবাসা, এবং হালে মগলুবোল - অর্থাৎ, যে কন্ডিশনে অনুভব করা যায় অন্তরের মধ্যে খোদার নূর, এবং রহমত আছে, এটা সূফী প্রাকটিশিওনারদের জন্যে সেমি জান্নাত। দিল্লী সিক্স মুভির আরজিয়া গানটা স্মরণ করুন। ওখানে একটা লাইন এরকম - "মোরা পিয়া ঘর আয়া , মোরা পিয়া ঘর আয়া ..."। এটার অর্থ ওটাই, যেটা বললাম মাত্র। মোরা পিয়া হচ্ছেন আল্লাহ স্বয়ং, ঘর হচ্ছে আমার অন্তর।
আর 'হালে কবজ' , অর্থাৎ - যে মুহূর্তে আমি অন্তরে খোদার উপস্থিতি টের পাচ্ছি না, মনে হচ্ছে আমার অন্তর সিলগালা করে দেয়া। আমার বড়পীর, হাকিম মুহাম্মদ আখতার সাহেবের একটি বয়েত - "তেরা জিকর হ্যায় মেরি জিন্দেগী, অর তেরি ভুলনা মেরা মওত হ্যায় ..."। অর্থাৎ , যে সময়টুকু আমার অন্তরে খোদার স্মরণ ছিল, অতটুকুই আমার হায়াত, আর বাদবাকি সব মুহূর্তে আমি আসলে মৃত ছিলাম।
বারট্রন্ড রাসেলের ঐ সমালোচনা, যে, কীভাবে যাকে আমি পরম করুণাময় বলি - তিনি তার এক সৃষ্টিকে অনন্তকালের জন্যে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করবেন, আমি এর জবাব তৈরি করেছিলাম এভাবে যে, হয়তো পুরো ঘটনাটা হবে একটা সাইকোলজিক্যাল অবস্থা। আল্লাহতালা হাশরের ময়দানে কতিপয় সৃষ্ট মানুষকে রুস্ঠ কণ্ঠে স্রেফ বলবেন - তোমাদের কাজে আমি অসন্তুষ্ট। ব্যাস, এই শোনাটা, এবং আল্লাহকে দেখার পর, আল্লাহর জাত - সিফতি জ্ঞান অর্জন করার পর তার অসন্তুষ্টির সংবাদ জানাটা, এবং এই তথ্য ব্রেইনে পারসিভ করাটাই সবচে বড় জাহান্নম।
আলমে আরওয়াহ, বা আমাদের জন্মের আগের যে অবস্থাটাকে আমরা রুহের জগত বলি, বা আলমে বরযখ, বা যে জগতটাকে আমরা কবরের জীবন বলি, এবং হাশরের ময়দান - এগুলো কি আদৌ পৃথিবীর মতো থ্রি ডাইমেনশনাল জগত? উত্তর আমরা সঠিক জানি না। হজরত আলী (রাজিঃ) কথায় যেমন এক পাপিষ্ঠ মনঃকষ্টে আত্মহত্যা করে ফেলল, হাশরের ময়দানে - ঠিক তেমনি, স্রেফ আল্লাহ নারাজ - আল্লাহকে স্বচক্ষে দেখার পর, তার শানের ব্যাপারে কিছু ধারণা হওয়ার পর, যে যে পৃথিবীতে সীমা লঙ্ঘন করেছে, সে যে মনঃকষ্টে ভুগবে, সেটাই তার জন্যে চূড়ান্ত শাস্তি হবে, যা পৃথিবীর যেকোনো শাস্তির চে কঠিন। এমনকি যে শাস্তির কথা কোরআনে , বা সহি হাদিসে এসেছে, সেটাও। একটা সাইকোলজিক্যাল শাস্তি হবে সব মিলিয়ে। এটা আমার একটা বিশ্বাস, যা অন্য কারো জন্যে প্রযোজ্য নয়, আমি প্রিচও করি না, কাউকে বিশ্বাস করতেও বলি না। জাস্ট নিজেকে নিজে বুঝ দেয়ার জন্যে।
৪।
আমার এই চিন্তা আমি রিভিজিট করি রাসেলের উত্থাপিত ইস্যুটাকে অন্য একটা অ্যাঙ্গেল থেকে অ্যাপ্রোচ করার মাধ্যমে। রাসেল ওয়েস্টার্ন হিউম্যানিটেরিয়ান ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে থেকে এই প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেন যে, খোদারে মানল না বলেই খোদা আজীবন জাহান্নামে জ্বালাবেন - এ কেমন বিচার? কিন্ত আমার মনে নতুন প্রশ্ন জাগে, তবে দুনিয়ার মজলুমদের ব্যাপারে কি রায় হবে? তাদের ব্যাপারে কি হবে - যারা দুনিয়ায় নির্মমতম অত্যাচারের সম্মুখীন হয়েছেন, এবং বিচার পান নি?
এই প্রশ্নটা সবচে শক্তভাবে উত্থাপিত হয় আমার মনে, যখন আমি পরিণত বয়সে এসে, অথবা, আরও স্পেসিফিক্যালি বললে, এই কিছুদিন আগ থেকে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) - এর পরিজনের উপর যে অত্যাচার করা হয়েছিল, তার ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি। কারবালায় রাসুল (সঃ) এর দৌহিত্র ইমাম হুসাইন (রাজিঃ) - এবং তার পরিবারকে যে নির্মমতার সঙ্গে শহীদ করে ইয়াজিদের সৈন্যরা - সে বিষয়ে জানার পর।
পৃথিবীতে হকের পথে থেকে নির্যাতিত নিপীড়িত হওয়ার চরমতম উদাহরণ ইমাম হুসাইন (রাজিঃ); অপমান, লাঞ্ছনার জীবনের বদলে সম্মানজনক শাহাদতের পথ বেছে নেয়ার উজ্জ্বলতম উদাহরণ ইমাম হুসাইন (রাজিঃ)। জীবদ্দশায়, আমাদের রাসুল (সঃ) - এর দু'চোখের প্রশান্তি আনায়নকারী সাইয়েদুশ শুহাদা এবং তার পরিবারের উপর যারা অবর্ণনীয় জুলুম - অত্যাচার করেন, তাদের শাস্তি তিনি দেখে যেতে পারেন নি। কেয়ামতের ময়দানেও যদি সে বিচার না হয় - তবে ন্যায়বিচার আর কবে প্রতিষ্ঠা হবে?
কারবালার ঘটনা সহ পৃথিবীতে যতবার মানুষ জুলুম - নির্যাতন - নিপীড়নের শিকার হয়েছে, চাই সে মুসলিম হোক কি অমুসলিম, তার সে জুলুমের বদলা - বিনিময় পাওয়ার আশা রাখে কেয়ামতের ময়দানে।
কাজেই রাসেলের খ্রিস্টীয় - পাশ্চাত্য মানবতাবাদের স্কেলকে বাদ রেখে আমি আবার শেষ বিচার কনসেপ্টে অ্যাজ ইট ইজ সেইড ইন কুরআন, সেভাবে নিজেকে মানাতে শুরু করি।
৫।
আজ কারবালার দিন। দশই মহররম। ইমাম হুসাইন (রাজিঃ), এবং রাসুলুল্লাহ (সঃ) - এর বংশধর, আহলে বায়েতদের এক বিরাট কাফেলার শাহাদতের দিন। এ সংক্রান্ত কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করবার জন্যে আজ এ লেখার অবতারনা। পেছনে যা কিছু লেখা ছিল, তা মূলত প্রারম্ভিক আলোচনা। মূল লেখা এখান থেকে শুরু।
মায়ের চাকুরি সূত্রে আমার বড় হওয়া পুরনো ঢাকার ফরিদাবাদ এলাকায়। আমার ইসলাম সংক্রান্ত যাবতীয় জ্ঞান অর্জনও ফরিদাবাদ, ঢালকানগর এলাকায়। ওখানে ১৯৫৫ সালে মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরি (রহঃ) জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম ফরিদাবাদ মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে ওখানে ছোট বড় আরও কিছু মাদরাসা হয়। হজরত ফরিদপুরি (রঃ) গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গার লোক ছিলেন। ছিলেন আমাদের বঙ্গবন্ধুর শ্রদ্ধাভাজন। ছিলেন দারুল উলুম দেওবন্দের ছাত্র, মাওলানা আশরাফ আলী থানভি (রহঃ) এর আধ্যাত্মিক শিষ্য, এবং খলিফা। সে সুবাদে ফরিদাবাদ - গেণ্ডারিয়া - ঢালকানগর এলাকায় দেওবন্দি ভাবধারার ইসলাম প্রচার হয়।
আমাদের আইজিগেইট ব্যাংক কলোনির মসজিদ সহ আশেপাশের প্রায় সমস্ত মসজিদের ইমামসাহেবরা ছিলেন দেওবন্দি ভাবধারার।
ওনাদের কাছ থেকে ইসলাম শেখায় আমার জীবনে উপকার অগণিত, এবং অভূতপূর্ব। দেওবন্দি ধারা - প্রাইমারিলি মডারেট, এবং মধ্যপন্থী। ভারতীয় উপমহাদেশের বহু ধারা - ফেরকার মুসলিমরা দেওবন্দী ধারাকে তাকফির করেছে, তাদের ইসলামত্ব খারিজ করে দিয়েছে, কিন্তু দেওবন্দ মাদরাসার আলেমদের তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান ছিল সর্বদা জ্ঞানমূলক, ইন্টেলেকচুয়াল ধারার। তারা লিখে জবাব দিতেন। এবং তাকফির করার জবাবে তারা কখনো তাকফির করতেন না সাধারণত।
আহমদ রেজা খান বেরেলভি সাহেব, যাকে বেরেলি বা সুন্নি মুসলিম জামাত আ'লা হজরত নামে অভিহিত করেন, তিনি ১৯০৬ সালে হুসামুল হারামাইন বই লিখে যখন দেওবন্দিদের কাফের ঘোষণা করেন, তার জবাবে মাওলানা খলিল আহমাদ সাহরানপুরী (দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা কাসেম নানতুবির ভাগ্নে, এবং দেওবন্দ মুভমেন্টের আরেক বড় হাস্তি, মাওলানা রশিদ আহমাদ গাঙ্গোহি রহঃ এর শিষ্য, এবং খলিফা) আল মুহান্নাদ আ'লা আল মুফান্নাদ গ্রন্থটি লিখে বেরেলভি ফিরকার অবলিগেশনের জবাব দেন। কিন্তু জবাবে দেওবন্দ থেকে বেরেলি গ্রুপের কাউকে তাকফির করা, বা কাফের ফতোয়া দেয়া হয়নি, তাদের বিরুদ্ধে আনা মিথ্যা অভিযোগের বিনিময়ে।
দেওবন্দের প্রতিষ্ঠা আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছরেরও আগে, ১৮৬৬ সালে। সেখান থেকে দেওবন্দ আন্দোলন, যেটা মূলত একটি এন্টি কলোনিয়াল, এন্টি ব্রিটিশ আন্দোলন ছিল, তা নানা পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে নানাভাবে রুপান্তরিত হয়েছে। দেওবন্দের অভ্যন্তরে সিয়াসতি অন্তঃদ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে দেশভাগের আগে ও পরে। দেওবন্দি স্কুলের যে ধারা আমাদের দেশে এসেছে, তা রুপান্তরিত হয়েছে আরও বিবিধভাবে।
৬।
কিছু হাদিস আছে, যা সহি (আমি আসলে সহি - হাসান - জয়ীফ হাদিস মূল্যায়ন করার মতো জ্ঞান রাখি না। যা আলেমদের মুখে শুনেছি, সে অনুপাতে বলা), কিন্তু আমি কওমিপন্থী, বা দেওবন্দি ধারার আলেমদের মুখে আলোচনা, একদম কম শুনেছি, বা শুনিই নি, সত্যি বলতে গেলে। তথা হজরত আলী (রাজিঃ), তার সন্তান ইমাম হাসান (রাজিঃ) , ইমাম হুসাইন (রাজিঃ), তথা আহলে বায়েত বা রাসুল (সঃ) - এর বংশধরদের নিয়ে এসমস্ত হাদিস প্রথমে আমার সম্মুখে আসে মাওলানা তারেক জামিল সাহেবের মাধ্যমে।
যেমন, একটা হাদিস হচ্ছে, 'মান কুনতুম মাওলা ফা হাজা আলীউন মাওলা' । অর্থাৎ, আমি (রাসুল সঃ) যার মাওলা, আলীও তার মাওলা।
মাওলা এখানে স্রষ্টা অর্থে না, মুনিব, প্রভু বা সর্দার অর্থে।
মাওলানা তারেক জামিল সাহেবের মুখে শোনার পর আমি আমার যৎসামান্য জ্ঞানে ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখি, তিরমিজি শরীফে সাহাবী হজরত জায়েদ ইবনে আরকাম (রাজিঃ) এর রেওয়াতে এই হাদিস বর্ণিত।
আরেকটি হাদিস হচ্ছে, কারবালার ঘটনা, ইমাম হুসাইন (রাজিঃ) এবং আহলে বায়েত (রাজিঃ) - এর শাহাদতের ঘটনায় শোক প্রকাশ নিয়ে। এটাও মাওলানা তারেক জামিল সাহেবের বক্তৃতায় শোনা।
তাফসির বিশারদ ইবনে কাথির বর্ণনা করেন মুসনাদে আহমাদ থেকে, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহঃ) বর্ণনা করেন হজরত আব্দুস সামাদ (রাজিঃ), এবং হজরত আনাস (রাজিঃ) - এর বরাতে যে, রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে উম্মুল মোমেনিন, রাসুল (সঃ) এর স্ত্রী উম্মে সালমা (রাজিঃ) দাঁড়িয়ে ছিলেন। ঘরের ভেতরে ছিলেন রাসুল (সঃ), এবং ইমাম হুসাইন (রাজিঃ)। তখন ইমাম হুসাইন নিতান্তই শিশু। হজরত উম্মে সালমা দরোজায় দাঁড়িয়ে রাসুল (সঃ) এর গুমরে গুমরে ক্রন্দনের আওয়াজ পান। উম্মুল মোমেনিন হয়রান হয়ে ভেতরে প্রবেশ করে দেখেন, রাসুল (সঃ) শিশু হুসাইন ইবন আলী (রাজিঃ) কে জড়িয়ে ধরে ক্রন্দন করছেন। রাসুল (সঃ) জানান, এক ফেরেশতার মাধ্যমে তিনি তার প্রাণপ্রিয় দৌহিত্রের শাহাদতের খবর পেয়েছেন। জেনেছেন যে তার উম্মতের একাংশ তাকে নির্মমভাবে হত্যা করবে। যে ভূমিতে তাকে শহীদ করা হবে, সেই ভূমিও উক্ত ফেরেশতা রাসুল (সঃ) কে দেখান।
৭।
আমার খারাপ লাগে, কষ্ট হয়, এটা দেখলে যে - হজরত আলী (রাজিঃ) এবং আহলে বায়েতের প্রতি ভালোবাসা দেখানোর দায়িত্ব আমরা শিয়া বন্ধুদের ওপর ছেড়ে দিয়েছি। খোলাফায়ে রাশেদিনের প্রতি, অন্যান্য সাহাবীদের প্রতি ভক্তি দেখাতে গিয়ে আহলে বায়েতের প্রতি যে অন্যায় হয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছি।
আমরা যে আধ্যাত্মিক চারটি পথের নাম করি - চিশতিয়া, কাদেরিয়া, নকশবন্দীয়া, সুহরাওয়ার্দীয়া - এক নকশবন্দীয়া বাদে তার প্রতিটা গিয়ে শেষমেশ মিলিত হয় মাওলা আলী (রাজিঃ) 'র সঙ্গে।
সালাফি আকিদার বন্ধু যারা, তারা আধ্যাত্মিকতার চর্চাকে বেদাত মনে করেন, তারা থাকুন তাদের মতো। কিন্তু দেওবন্দি ফেরকার আলেমওলামা, যারা কওমিপন্থী, বাংলাদেশে - তারা কেন তাদের চর্চায় আহলে বায়েত, এবং হজরত আলী (রাজিঃ)কে আনেন না বারবার, আমি বুঝি না।
এমন তো না যে দেওবন্দি ধারার উলামারা তাদের বয়ানে পেছনের দিকের সাহাবী - বুজুর্গদের আলোচনা করেন না। তারা তাদের আকাবেরকে প্রচুর সম্মান দেন। হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী (রহঃ) থেকে নিয়ে মাওলানা কাসেম নানুতবি (রহঃ), মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গোহি (রহঃ), হাকিমুল উম্মত মওলানা আশরাফ আলী থানভি (রহঃ), শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দি (রহঃ), হজরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি (রহঃ) - এর নাম ছাড়া আজকে কওমি - দেওবন্দি উলামাদের কোন ওয়াজ - নসিহত, বক্তৃতা শুরু বা শেষ হয় না। এই হাজরাতের নাম নিয়ে আজকাল কওমি আলেমরা বাতিল ফেরকাওয়ালাদের মতো সুর করে টান দিয়ে দিয়ে কান্না কান্না ভঙ্গীতে ওয়াজ করে। ইমামে রব্বানি মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গোহি (রহঃ) এর খলিফা ক্বারি ইবরাহিম উজানি (রহঃ) - এর বংশের পীর মাওলানা এহতেশামুল হক উজানি সাহেবের ওয়াজ মাহফিলে তার আসেপাশের মুরিদানরা লাফ দিয়ে উঠে তাকে দেখিয়ে বলে 'কিয়ের জিকির, খোদায় তো এইখানে বইসা আছে' , বা ক্বারি ইবরাহিম উজানি (রহঃ) - এর খলিফা, চরমোনাইয়ের পীরের বর্তমান গদ্দিনশিন পীরজাদা বলেন যে কেয়ামতের দিন চরমনাইয়ের পীরসাহেব নাকি হাশরের ময়দানে জাহাজে করে নিজের মুরিদানদের নিয়ে হাজির হবেন আল্লাহর দরবারে।
কথা হচ্ছে, যেই পীর পূজা, যেই মাজার পূজা, মাজারে গিয়ে শিন্নি মানত করা ইত্যাদির বিরোধী ছিলেন দেওবন্দি ধারার আলেমরা, আজ তাদের এক বড় অংশ বাংলাদেশে সেই আকাবির, বা পেছনের যুগের বুজুর্গদের স্যুডো পূজাই চালিয়ে যাচ্ছেন।
কেবল বাদ পড়ে হজরত আলী (রাজিঃ), এবং আহলে বায়েত (রাজিঃ)দের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন। তাদের নিয়ে আলোচনা। তাদের কাছ থেকে শেখার প্রত্যয়। কারণ, আহলে বায়েতকে ভালোবাসার লিজ, আমরাই ছেড়ে দিয়েছি শিয়া বন্ধুদের হাতে।
৮।
দেওবন্দি দস্তরখান থেকে মধ্যপন্থী ইসলাম শেখা এবং প্রাকটিস করা আমার মতো নগণ্য এক মানুষের শেষ কথা, আজ কারবালার দিনে, এই একটাই - সাহাবী (রাজিঃ)দের প্রাপ্য সম্মান দিতে আমার কোন আপত্তি নেই, শিয়াদের ইমামি আকিদা, বা রাসুল (সঃ) আর হজরত আলী (রাজিঃ) একই নূরে তৈরি, একই মুদ্রার এপিঠ ওপীঠ জাতীয় আকিদাও আমার নাই। আমি শতভাগ সুন্নি। কিন্তু মুসলিম হিসেবে আহলে বায়েত (রাজিঃ)গন আমার সর্দার, আমার ইজ্জত, আমার ভালোবাসা, আমার আবেগ। ইমাম হুসাইন (রাজিঃ) আমার পথ প্রদর্শক। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম, তার রুখে দাঁড়ানো আমার স্বপ্ন , আমার সকল আশার প্রতীক, আমার অন্ধকার রাতের উজ্জ্বল হেলাল। রাসুল (সঃ) আমার মুনিব, আমার মওলা, রাসুল (সঃ) এর বচনের সূত্র ধরে আলী (রাজিঃ) ও আমার মওলা।

সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০২১ সকাল ১০:৫৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




