somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শনিবারের চিঠিঃ পর্ব পাঁচ (ধারাবাহিক সাপ্তাহিক কলাম)

০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২১ দুপুর ১:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



.
১।
.
"লেখালিখিতে কি কোন আনন্দ আছে? আমি জানি না। তবে একটা বিষয় নিশ্চিত যে, লেখালিখির জন্য কঠিন বাধ্যবাধকতা আছে, কিন্তু এই বাধ্যবাধকতা কোথা থেকে আসে, তাও আমার জানা নেই ... নানাভাবে আপনি এ ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠতে পারেন। যেমন, এটা সত্য যে - দিনের নির্ধারিত ক' পাতা লিখে উঠতে না পারলে আপনি যারপরনাই উদ্বিগ্ন হবেন। এবং লিখতে পারলে একধরনের দায়মুক্তি ঘটেছে বলে মনে করবেন, এবং তা হয়ে উঠবে দিনের সুখের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ... কিন্তু এই পদক্ষেপ খুবই নিষ্ফলা, অবাস্তব, আত্মরতিমূলক, আর তা মানুষকে নিঃসঙ্গ করে তোলে। প্রতিদিন সকালে টেবিলে বসে নির্দিষ্ট সংখ্যক সাদা কাগজের ওপর খসখস করে কলম টানার কি অর্থ আছে? দিনের বাকি সময়ের ওপর এর কোন শুভ প্রতিক্রিয়া আছে কি?"
(ক্লদ বোঁ ফো'র সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মিশেল ফুঁকো)
.
২।
.
"...আসলে আমরা খাব, পরব, বেঁচে থাকবো, এই রকম কোথা ছিল - আমরা যে বিশ্বের আদি কারন অনুসন্ধান করি, ইচ্ছেপূর্বক খুব শক্ত একটা ছন্দ বানিয়ে তারই মধ্যে খুব শক্ত একটা ভাব ব্যক্ত করবার প্রয়াস করি, আবার তার মধ্যে পদে পদে মিল থাকা চাই, আপাদমস্তক ঋণে নিমগ্ন হয়েও মাসে মাসে ঘরের কড়ি খরচ করে সাধনা বের কড়ি, এর কি আবশ্যক ছিল? ওদিকে নারায়ণ সিং দেখো ঘি দিয়ে আটা দিয়ে বেশ মোটামোটা রুটি বানিয়ে তার সঙ্গে দধি সংযোগ করে আনন্দমনে ভোজন - পূর্বক দু - এক ছিলিম তামাক টেনে দুপুর বেলাটা কেমন স্বচ্ছন্দে নিদ্রা দিচ্ছে এবং সকালে বিকালে সামান্য দু - চারটে কাজ করে রাত্রে অকাতরে বিশ্রাম লাভ করছে। জীবনটা যে ব্যারথ হল, বিফল হল, এমন কখনো তার স্বপ্নেও মনে হয় না - পৃথিবীর যে যথেষ্ট দ্রুত বেগে উন্নতি হচ্ছে না সে জন্যে সে নিজেকে কখনো দায়িক করে না। জীবনের সফলতা কথাটার কোন মানে নেই - প্রকৃতির একমাত্র আদেশ হচ্ছে 'বেঁচে থাকো'। নারায়ণ সিং সেই আদেশটির প্রতি লক্ষ রেখেই নিশ্চিন্ত আছে। আর যে হতভাগার বক্ষের মধ্যে মন - নামক একটা প্রাণী গর্ত খুঁড়ে বাসা করেছে তার আর বিশ্রাম নেই, কর্তব্যের শেষ নেই, মনের সন্তোষ নেই; তার পক্ষে কিছুই যথেষ্ট নয়, তার চতুর্দিকবর্তী অবস্থার সঙ্গে সমস্ত সামঞ্জস্য নষ্ট হয়ে গেছে..."
.
(রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রাবলীর ৯৯ নং চিঠি। ১৮৯৩)
.
৩।
.
দেখা যায়, নিজেদের সৃজনশীলতার পীড়ায় বড় আক্রান্ত ছিলেন, প্রাচ্য - পাশ্চাত্যের দুই মহারথী; রবীন্দ্রনাথ, আর মিশেল ফুঁকো। মুরাকামির আত্মজৈবনিক "হোয়াট আই টক অ্যাবাউট, হোয়েন আই টক অ্যাবাউট রানিং" - পড়লে দেখবেন, মুরাকামি আরও নিস্পৃহ ভাষায় বলছেন, তিনি লেখা শুরু করেন, কারন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী জাপানে যে সবকিছু নতুন করে গড়ে তুলবার প্রয়াসে অমানবিক পরিশ্রম, যার সূত্রে জাপান আজ সেন্ট পারসেন্ট কর্পোরেট একটা দেশ, সেই কর্পোরেট লাইফস্টাইল থেকে পালানোর জন্য। প্রথম উপন্যাসটি বের হল, সমালোচকদের প্রশংসা কুড়োলো, তিনি তার জ্যাজ মিউজিক বার বিক্রি করে দিয়ে শুরু করলেন পুরোদমে লেখা। লেখালিখির সঙ্গে শরীর সুস্থ রাখবার জন্যে শুরু করলেন ম্যারাথন দৌড়। সব মিলিয়ে তিনি ইতিহাসের সেরা রানিং নভেলিস্ট, খুব সম্ভবত।
.
৪।
.
এ বছরের জুন মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে আমি লিখবার জন্য মুডের ধরনা দেয়া বাদ দিয়েছি। অর্থাৎ, মুডের অপেক্ষায় না থেকে প্রতিদিনই লিখছি, খুব রেয়ার কিছু কেইস বাদ দিয়ে, আলহামদুলিল্লাহ। প্রথম তিনমাস, অর্থাৎ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমি লিখেছি বাদ আসর থেকে এশার আগ পর্যন্ত। অর্থাৎ, বিকেল থেকে নিয়ে সন্ধ্যা, এবং রাতের প্রথম অংশ। আমার প্রকাশিতব্য উপন্যাস শহরনামার চূড়ান্ত ভার্শন প্রস্তুত করেছি এই শিডিউলে। তারপর, অক্টোবর থেকে লিখছি ফজরের পর আর না ঘুমিয়ে। কারন, খেয়াল করেছি, যেদিন কোন মেহমান আসেন, বা যেদিন আমার কোথাও দাওয়াত থাকে, সেদিন আর বিকেল - সন্ধ্যায় লিখতে বসা হয় না। কাজেই, এমন একটা সময়ে লেখার শিডিউলকে ফিক্স করা দরকার ছিল, যখন লেখা মিস যাওয়ার সুযোগ নেই। একমাত্র কাকডাকা ভোর ছাড়া সে সুযোগ হয় না আর কখনো।
.
লেখা, আমার জন্য ধ্যানমগ্ন এক প্রক্রিয়া। দীর্ঘদিন যাবত আগে কাগজে কলমে লিখে তারপর ল্যাপটপে টাইপ করতাম। মনের আবেগ অনুভূতি হাতের কলম হয়ে গড়িয়ে পড়তো লেখার খাতায়। সেখান থেকে সরাসরি ল্যাপটপে শিফট করতে একটু সময় লেগেছে, কিন্তু এখন এভাবেই আমি হ্যাপি। যদিও, গল্প যখন লিখি, তখন এখনও আগে কাগজে কলমে লিখে তারপর টাইপ করি।
.
যাই হোক, যা বলছিলাম, যখন লিখি, তখন আমি এক ভিন্ন জগতের বাসিন্দা। যেমন, আজ আমার পাঁচ চ্যাপ্টারের নভেলা সরীসৃপতন্ত্রের চতুর্থ চ্যাপ্টারের মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে থামলাম। আমার নভেলার মুখ্যচরিত্র মোকাম মাহামুদ এখন পল্টনের একটা দোকানে শাটারের পেছনে আশ্রয় নিয়েছে। এরশাদশাহীর শেষ দিনগুলোর ঘটনা চিত্রায়িত করছি। পুলিশ ধামাধাম লাথি দিচ্ছে দোকানের শাটারে, সরকার বিরোধী মিছিল করা দুষ্কৃতিকারীর খোঁজে। মধ্যবিত্ত, ভীরু মোকামের অস্তিত্ব সংকটটুকু অনুভব করবার মতো একাগ্রতা যে মুহূর্তে হারিয়ে ফেলেছি আজকের জন্য, টের পাওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই আজকের মতো লেখা থামিয়ে দিলাম। তারমধ্যে প্রায় সাতশো শব্দ লেখা হয়ে গেছে। এখন লিখছি শনিবারের নিয়মিত এই কলাম।
.
যা হোক, লেখালিখির ব্যাপারটা আমার জন্যে পেছনের ডটগুলো কানেক্ট করবার মতো একটা বিষয়। জীবনের নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজকের যে আমি বা আপনি, চিন্তা করে দেখুন, আমরা কিন্তু বিচ্ছিন্ন কোন সত্ত্বা নই। প্রতিনিয়ত অনেকগুলো ঘটনার যোগে সংযোগে আজকের আমি বা আপনি। আমার জীবনের সেই ডটগুলোকে খুঁজে পেতে যত্ন করে রাখার জন্য আমি লিখি।
.
একটা উদাহরন দিই। আমার রিকশা যখনই টিটিপাড়া পার করে মানিকনগর বিশ্বরোড দিয়ে চলে, তখন খুব কশরত করলে একটা মসজিদের মিনার দেখা যায়, গোপীবাগ রেলগেটের পাশের। যতবার আমার রিকশা বিশ্বরোডের ওপর দিয়ে যায়, ততবার আমি লাফঝাঁপ দিয়ে ঐ মসজিদের মিনারটা দেখার চেষ্টা করি। আমার সঙ্গে রিকশায় যে থাকে, তাকে কখনো আমি বোঝাতে পারি না, এই রাস্তা দিয়ে পার হবার সময় এই নির্দিষ্ট মসজিদের মিনারটা দেখা এতো গুরুত্বপূর্ণ কেন আমার জন্য।
.
আমরা যখন ২০১৭ - ১৮ সালে গোপীবাগে ভূতের মতো অন্ধকার, আলো আসে না, দিনের বেলাতেও লাইট জ্বালিয়ে রাখা লাগে, এমন এক বাড়িতে ভাড়া থাকতাম, আমার বরাদ্দ রুমের জানালা দিয়ে তাকালে অদূরে কেবল এই মসজিদের মিনারটাই দেখা যেত, খুব সরু একটা এঙ্গেল থেকে। আমার আকাশ বিলাস ছিল ঐ সরু দৃষ্টিপাতের জায়গাটুকুই।
.
আজ যখন আমি মুক্ত একটা পরিবেশে বিচরন করি, যখন আমার খাটে শুয়ে আমি পূর্ণিমার জোছনা, এবং সূর্যোদয় দেখতে পারি, দেখতে পারি ঝুম বরষা, এবং কালবোশেখীর তাণ্ডব, আমি ভুলতে পারি না সে সাইনটাকে, যা আমার দেশলাইয়ের বাক্সের মতো অন্ধকার ভাড়া ফ্ল্যাটে ছিল মুক্তির একমাত্র চিহ্ন। যা আমাকে প্রতিনিয়ত স্মরণ করিয়ে দিত, নিজের এমন একটা ভবিষ্যতের জন্য পরিশ্রম করতে হবে, যাতে আমি আরও বৃহৎ পরিসরে তাকাতে পারি আকাশের দিকে।
.
এই মসজিদের মিনার, আমার জীবনের একটা ডট। এরকম আরও অসংখ্য, অগনিত ডটকে রেজিস্ত্রার করে রাখবার জন্য আমার লেখা।

সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২১ দুপুর ১:০৯
৫টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×