শনিবারের চিঠি - পর্ব ১০
(ধারাবাহিক সাপ্তাহিক কলাম)
.
প্রায় তিন মাস গ্যাপ দিয়ে আবার লিখতে বসেছি এ কলাম। মধ্যের জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি তো বইমেলা নিয়ে দারুণ ঝঞ্ঝাটে গেলো। তাছাড়া, এ কলামের পাঠক প্রতিক্রিয়াও নিদারুণ হারে কমতে থাকা - কলামটি লেখা বন্ধ করে দেয়ার পেছনে একটা আপাত প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। যা হোক, নিজের জন্যে হলেও আবার শুরু করছি।
.
ঘটনাটা এই সেদিনের। ক্লাস শেষ হয়ে গেলো দুপুর ১টা ২০ এ। বেলা ২টো নাগাদ আমাকে দেখা গেলো আইডিয়াল স্কুলের মুগদা শাখার পার্শ্ববর্তী যাত্রী ছাউনিতে, মনোযোগ দিয়ে ঝালমুড়ি চিবানোয় ব্যস্ত অবস্থায়। কারন খুব সাধারণ। বাস আমাকে যখন কমলাপুর স্টপেজে নামিয়ে দিয়েছে, মুগদা আইডিয়াল স্কুল তখন ছুটি হয়েছে মাত্র। চারিদিকে স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চাদের হৈহৈ রৈরৈ। স্কুলের সামনের ঝালমুড়ি মামার কার্টের চারপাশে বাচ্চাদের ভিড় দেখে মনে পড়লো, অনেক দিন, অনেক অনেক দিন হয়ে গেছে - স্কুলের সামনে থেকে কিছু কিনে খাই না।
.
আমি যখন স্কুলে পড়তাম (বাংলাদেশ ব্যাংক আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, সাকিনঃ ফরিদাবাদ, ঢাকা - ১২০৪) তখন সেই স্কুলের সামনে থাকতো ঝালমুড়ি, থাকতো ঘুগনি (বিক্রেতা মামা, এবং তার অনুকরণে আমরাও, বলতাম ঘুম্নি), থাকতো টনিক, থাকতো ফুচকা - চটপটি, থাকতো কুলফি মালাই, থাকতো আচার। পকেটের হালত বুঝে কোন দিন এক আইটেম, কোনদিন দুই আইটেম খেয়ে, টিফিন টাইমে, দৌড়ে পৌঁছে যেতাম স্কুল ঘরে।
.
আজ, হিসেব করে দেখলাম, পকেটে মেলা টাকা। অন্তত ঝালমুড়ি খাওয়ার জন্যে তো মেলা টাকা - ই।
.
যাত্রী ছাউনিতে আমি ছোঁচা স্কুল বালকের মতো গপাগপ নিজের ঝালমুড়ি শেষ করছি। আমার পাশে ৭ - ৮ টা ছোট ছোট ছেলে বসা। স্কুলের ইউনিফর্মে। প্রত্যেকের মাথায় গোলটুপি। হাউহাউ, কাউকাউ।
.
আমি আমার পাশের ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম (ভয়ে ভয়ে, ছেলেধরা যাতে কেউ ঠাউরে না বসে), কোন ক্লাসে পড়ো তোমরা?
.
ছেলেটা (আমার দিকে না ফিরেই) বলল, হাউহাউ কাউকাউ, ক্লাস থ্রিতে, হাউহাউ কাউকাউ।
.
আমি আবার চুপচাপ মুড়ি খেতে থাকলাম।
.
কিছুক্ষন পর ছেলেটা আবার কি মনে করে (এবার আমার দিকে ফিরে) বলল, আমরা এই কয়জন পড়ি ক্লাস থ্রিতে আর ঐ দুইটা (শেষমাথার দুজনের দিকে আঙ্গুলের ইশারা করে) পড়ে ক্লাস ফোরে।
তারপর আবার হাউহাউ, কাউকাউ।
,
ভাবলাম, অল্প একটু তথ্যের ভুল সংশোধন করার ওর এই আকুতি কি বড় হওয়ার পরেও থাকবে?
.
অল্পএকটু পর, আরেকদিক থেকে আরেকটা একই বয়স, বা ক্লাস (বা সাইজ) এর পিচ্চি আগায়ে আসলো। ওর হাতেও, আমার মতোই ঝালমুড়ির একটা ঠোঙা।
,
আঙ্কেল, মুড়ি কতো নিছে?
.
আমি কিছুটা অবাক। আমাদের দুইজনের হাতেই মুড়ির ঠোঙা। ওর উত্তরটা জানা থাকার কথা।
.
দশটাকা, আমি বললাম।
.
পিচ্চিটা মোটামুটি হাসিমুখে আমারে কাটায়ে চলে গেলো।
.
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার ডানপাশে বসা ইমানদার পিচ্চিটা চিল্লায়ে উঠলো, এ কুলপিঅলা মামায় আইছে!
.
সঙ্গে সঙ্গে ও, এবং ওর পাশের আরও দুই পিচ্চি উঠে ভোঁ দৌড়। কুলপিঅলা মামার দিকে।
.
ক্লাস ফোরের দুই পিচ্চির মধ্যে যেটা বেশী তাগড়া, ওটা জোরে বলে উঠলো, হ, কুলপি না তর শাউয়া!
.
ওর বামপাশের ক্লাস থ্রি পড়ুয়া পিচ্চিগুলি হাততালি দিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো, এহহে, মোমেন ভাইয়ে শাউয়া কইচে!
.
ক্লাস ফোর পড়ুয়া মোমেন ভাইকে খুব একটা অপরাধবোধে আক্রান্ত বলে মনে হল না। বরং নতুন শেখা একটা গালির যথাযথ প্রয়োগে সে মোটামুটি তুষ্ট।
.
আমি কড় গুণে হিসাব করছি - ১৯৯৯ থেকে ২০২২, ২৩ বছর আগে আমি ছিলাম ওদের সাইজের। স্কুল ছুটির পর বন্ধুদের সঙ্গে এমন আড্ডা, কাড়াকাড়ি করে রাস্তার খাবার খাওয়া, নতুন নতুন শেখা গালির প্রয়োগ। বাসায় মুখ ফসকে ধরা খেয়ে মায়ের খন্তার বাড়ি। ওদের সঙ্গে পা দুলিয়ে বসে যতই ঝালমুড়ি খাই, সেই দিনগুলো আর ফিরে আসবে না।
.
কুলফি কতো? জিজ্ঞেস করলে কুলপিঅলা মামা উত্তর দিল ছোটটা দস, কাডিঅলাডা বিস।
.
আমি কাডিঅলা কুলপি মুখে পুরে চিন্তিত মুখে হাঁটতে থাকলাম মুগদা বিশ্বরোডের রাস্তা ধরে। জীবনটা খুব দ্রুত দৌড়াচ্ছে।
. .
painting: Artist Shiv Soni
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০২২ রাত ১১:৩৩