১।
কোক স্টুডিও বাংলা কাজ শুরু করবার পর নানা অ্যাঙ্গেল থেকে তাদের ক্রিটিসিজম শুনেছি। সমালোচনার এক বড় অংশ ছিল কোক স্টুডিওর কর্পোরেট স্পন্সরশিপ নিয়ে। ক্ষোভ ছিল নামকরন নিয়েও। কোক স্টুডিও ‘বাংলা’ কেন, ‘বাংলাদেশ’ কেন নয়? এ সমস্ত পয়েন্টে বেশ ইন্টারেস্টিং আলোচনা - সমালোচনা এগিয়েছে। আমিও মোটামুটি আগ্রহ নিয়ে ফলো করেছি। কোক স্টুডিও নিয়ে আমার নিজেরও সমালোচনা ছিল। সে সমালোচনা অবশ্য কোক স্টুডিও বাংলার নামকরন, বা কর্পোরেট স্পন্সরশীপ নিয়ে নয়। কোক স্টুডিও বাংলা যে মূলত 'অর্ণব অ্যান্ড ফ্রেন্ডস', এবং এই সূত্রে হঠাৎই অর্ণবদা কে বাংলাদেশের 'অবিসংবাদী সেরা' মিউজিক ডিরেক্টর বানিয়ে দিচ্ছেন কেউ কেউ, এটা আমার কাছে অসততা মনে হয়েছে। কাজের সুযোগের জন্যে, বা তার সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলার জন্যে অনেকেই এই প্রচার চালাচ্ছেন, এটা ছিল আমার মত। এছাড়াও, ‘প্রার্থনা’ গানে অধিক পরিমানে রাজস্থানি ফোক ইন্সট্রুমেন্টের ব্যবহারে আমি বিরক্ত হয়েছিলাম। দেদারসে রাজস্থানি খমক, বা সারেঙ্গির বদলে বাংলা অঞ্চলে বাউলদের ব্যবহৃত যন্ত্র দিয়েই গানটা সাজানো যেতো, আমরা বাংলা ফোক ইন্সট্রুমেন্টের কেরদানি দেখতাম, এবং সবমিলিয়ে সেটা কোক স্টুডিও ‘বাংলা’ নামের সঙ্গে আরও প্রাসঙ্গিক হত। এতো বড় একটা ফ্র্যাঞ্চাইজ কর্পোরেট স্পন্সরশিপ ছাড়া আয়োজন করা সম্ভব না। আর কোক স্টুডিও ‘বাংলাদেশ’ না হয়ে ‘বাংলা’ হলে পশ্চিম বঙ্গের শিল্পীদেরও দাওয়াত করা যাবে। অডিয়েন্স দুই বাংলায় ছড়িয়ে পড়বে। সঙ্গে ছড়িয়ে পড়বে ব্যবসাও। কর্পোরেট মাইন্ডসেট এভাবেই কাজ করার কথা। “ফালতু” ন্যাশনাল সেন্টিমেন্ট বেচে তো পয়সা আসে না।
.
যা হোক, আমি অপেক্ষায় ছিলাম আর এক গোষ্ঠীর ক্রিটিসিজমের। বাংলাদেশের সংস্কৃতির জগতে যারা পুরোহিতের ভূমিকা পালন করছেন আজ দীর্ঘ দীর্ঘ দিন যাবত। উঁচু জাতের ব্রাহ্মণ্যবাদীদের মতো সঙ্গীতের সবরকমের এক্সপিরিমেন্টাল প্রয়াসেই যারা 'বিকৃতি' র গন্ধ খুঁজে পান, ব্যতিক্রমী সমস্ত প্রচেষ্টাকে যারা হাতের এক ইশারায় বাতিল, খারিজ করে দেন। সালাফি এক্সট্রিমিস্টদের মতো যাদের বিশুদ্ধতাবাদ, সলফে সালেহিনদের অনুসরন, অনুকরন ‘আদি – অকৃত্রিম - বিশুদ্ধ’ সুরে যাদের নজরুল – রবীন্দ্র – ফোক গানের চর্চা। সংস্কৃতিকে যারা মোটামুটি জগদ্দল বোঝা পাথরের মতো অপরিবর্তনীয় বিবেচনা করেন। শ্যাওলা পড়ে গেলেও সেই পাথরের পূজাঅর্চনা তারা করেই যাবেন।
.
কোক স্টুডিও বাংলার তৃতীয় রিলিজ, বুলবুলির সূত্র ধরে ছায়ানটের শিক্ষক, আমার এক সুহৃদের সেই গতানুগতিক মতামত জানা গেলো।
.
২।
ছায়ানটের শিক্ষক সে সুহৃদের মতে, এই জেনারেশন এতোটাই নজরুল - রবীন্দ্র সঙ্গীত বিমুখ যে, বাচ্চাদের আগে যেভাবে রসগোল্লার ভেতর ওষুধ পুরে ঔষধ খাওয়ানো হত, সেভাবেই এখন জ্যাজ - রেগে - ফ্ল্যামেঙ্কো নোটেশনের ফাঁকেতালে নজরুল 'গেলানো' লাগে। শুধু তাই নয়, এই জেনারেশন এতোটাই অশিক্ষিত, এবং সাংস্কৃতিকভাবে এতোটাই পঙ্গু (তার মতে) যে, বুলবুলি গানটার কোক স্টুডিও ভার্শনের শেষে যে 'দোল দোল ...' অন্য কি একটা গান জুড়ে দেয়া হয়েছে , সেটা যে নজরুলের গানের অংশ নয়, তারা না কি তাও জানে না। ফলে অশিক্ষিত জেনারেশন ঐ অংশটুকুকেও নজরুল গীতি হিসেবেই চিনবে, জানবে, গাইবে ভবিষ্যতে।
.
শুধু তাই না, এই আধুনিক যন্ত্রের সঙ্গে, ভিন্নধাঁচের স্কেলে গাওয়া গানটাকে, তার মতে 'বিকৃত' করে ফেলা হয়েছে। একজন 'প্রকৃত শিল্পী' নাকি কখনো অমনটা করতে পারেন না। সক্ষমতা থাকলে তারা নিজেরা নতুন গান তৈরি করুক, (অথবা সাংগীতিক বিশুদ্ধতাবাদী নাজীরা যতই গানের স্বাদকে গলা টিপে হত্যা করুক) নজরুলের গানকে 'বিকৃত' করা কেন?
.
শুধু তাই না, (ছায়ানট স্বীকৃত) আদি - অকৃত্রিম সুরে না গাইলে পেট খারাপও হবে শিল্পীর।
.
একটা পুরো জেনারেশনের মিউজিক্যাল টেস্ট, ক্যালিবার নিয়ে ভয়াবহরকমের সব অফেন্সিভ , রক্ষণশীল, জঙ্গি মনোভাবাপন্ন কথাবার্তা।
.
৩।
প্রথমত, সংস্কৃতির উপাদানকে এরকমভাবে ক্যাথলিক চার্চের প্রিস্টদের মতো কুক্ষিগত করে রাখার কি যৌক্তিকতা?
সংস্কৃতি প্রবাহিত হবার জিনিস। সংস্কৃতির উপাদানসমূহ প্রবাহিত হবে, বাঁক বদলাবে, সুধা ফুরালে নিঃশেষ হয়ে যাবে। কেউ তাকে জোর করে অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে না। একই কথা খাটে নজরুল - রবীন্দ্র - পঞ্চকবির গান সহ যেকোনো গানের ব্যাপারে। যতদিন ভালো লাগে, মানুষ কেবল হারমোনিয়াম আর ডুগিতবলায় শুনবে। তারপর, মনের স্বতঃস্ফূর্ত তাড়নায় সে অন্যান্য ইন্সট্রুমেন্টের সঙ্গে গাইবে সে গান। গাইবে প্রাচ্য - পাশ্চাত্যের সাংগীতিক স্কেলের মেলবন্ধনে। ইচ্ছে হলে শুধু কথাটুকু এক রেখে সুর বদলে গাইবে। তখন হয়তো সেই প্রোডাক্টটাকে 'অমুকগীতি, তমুকগীতি' দাবী করা হবে না। বলা হবে - স্রেফ লিরিক ব্যবহার করা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের, বা নজরুলের। তাদের কবিতা সুর দিয়ে গাওয়া যায় না?
.
দ্বিতীয়ত, এই ছায়ানটপন্থী সাংস্কৃতিক উগ্রপন্থীরা যে দরদ দেখান নজরুল - রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি, একই ভক্তি, ভাব, ভালোবাসা সবাইকেই কেন দেখাতে হবে? বাংলা অঞ্চলে রবীন্দ্র - নজরুলের আগে সঙ্গীত চর্চা হয় নি? গান গাওয়া হত না বাংলায়, তার আগে? বিশুদ্ধতাবাদীরা কি সেগুলোর চর্চা করেন, একই রকম 'ধর্মীয়' জিল নিয়ে? হারিয়ে গেছে না ওসব গানের এক বড় অংশ? ২০ - ৫০ - ১০০ বছর পর, প্রজন্মান্তরে রবীন্দ্রসঙ্গীত বা নজরুলগীতি নিয়ে এরকম 'ধর্মীয়' ভক্তি থাকবে না। তারা অতীতের সুর ও কথার ওপর ইম্প্রোভাইজ করবে। করবেই। ক্যাথলিসিজম ভেঙ্গে প্রটেস্টান্টিজম বেরিয়েছে, জাতপাতভেদ ভেঙ্গে বেরিয়েছে শ্রীচৈতন্যদেবের ভাবান্দোলন। আর সাংস্কৃতিক ব্রাহ্মণ্যবাদ? ছোঃ
.
তৃতীয়ত, ছায়ানটপন্থীদের সাংগীতিক বিশুদ্ধতাবাদের চর্চার পক্ষে বিপক্ষে আমার কিছু বলার নেই। আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাবকন্টিনেন্টাল, বা পাশ্চাত্যের ক্লাসিক মিউজিক শুনতে পারি, যেমন শুনতে পারি আধুনিক সঙ্গীত। কিন্তু ছায়ানটের শিল্পী স্টেজে বসলেই আমার বিরাট বিরাট হাই ওঠে। আই ক্যান নট হেল্প। এতোটা বোরিং, এতোটাই প্রাণহীন তাদের অধিকাংশ নজরুল - রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের পরিবেশনা। শ্রোতা হিসেবে, সঙ্গীত সংশ্লিষ্টতার সূত্র ধরেও অনেক কিছু আমার বলার আছে বা থাকে, কিন্তু আমি কখনো তাদের জাজ করি না। অন্তত আগে কখনো করি নি, পাব্লিক্যালি। তাদের চর্চার প্রতি, ভক্তির প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে। কিন্তু সে শ্রদ্ধা ততক্ষণই, যতক্ষণ তারা আমাকে, আমার জেনারেশনের মিউজিক টেস্টকে পাল্টা শ্রদ্ধা দেখাবেন। কিন্তু তারা অন্যের রুচিকে, অন্যের মিউজিক্যাল টেস্ট নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার এই কাজটা হরহামেশা করেন। খুব বাজে ভাবে করেন। তাদের ব্রাম্মন্যবাদি নাক ক্রমাগত শিটকে শিটকে তারা সংগীত সংশ্লিষ্ট বাকি সবার সমস্ত প্রচেষ্টাকে বিপথগামী প্রমাণের জন্যে উঠে পড়ে লাগেন সর্বদা। তাদের এই সমস্যা তাদের অনুধাবন করতে হবে দ্রুত।তাদের সাংস্কৃতিক "বিশুদ্ধতাবাদি" মনোভাব অলরেডি আধুনিক প্রজন্মের মাঝে তাদের সাংস্কৃতিক জঙ্গি এক্সট্রিমিস্ট রুপে চিহ্নিত করে ফেলেছে।
.
৪।
শেষ করি ডঃ আহমদ শরীফের একটি বক্তব্য দিয়ে।
.
ডঃ আহমদ শরীফ, তার "নজরুল সমীক্ষাঃ অন্য নিরিখে" প্রবন্ধে বলেন -
.
“মনে রাখা প্রয়োজন, দুনিয়ায় অক্ষয় অবিনাশী কিছুই নেই। রবীন্দ্রনাথের গান যেমন কাব্য হিসেবেও সুন্দর, ভাবগর্ভ অর্থাৎ তাতে ভাব, ভাষা, ছন্দ যেমন আছে, তেমনি আছে সূক্ষ্ম গভীর বানীও। নজরুলেরও অনেক গান তেমন সব গুণে ঋদ্ধ। কিন্তু আধুনিক গানের তোড়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতই পিছিয়ে পড়ছে, নজরুলগীতিই বা কি টিকবে! কালান্তরে পুরনো সুর টেকে না বলেই গান নশ্বর। জুগে জুগে যুগোপযোগী সুরই যুগের চাহিদা মেটায় এবং কালান্তরে তা বিলীন হয় কালগর্ভে। মানুষ চিরকালই সুখে দুঃখে, কাজে অকাজে, ভয়ে ভক্তিতে, দ্বন্দ্বে সংগ্রামে গান গেয়েছে বটে, কিন্তু তা কখনো অপরিবর্তিত থাকে নি। বৈদিক বন্দি গন্ধর্বের গায়ত্রী বন্দনা থেকে আজকের আধুনিক গান অবধি সঙ্গীতের এদেশী বিবর্তন ধারাই আমাদের এ ধারণার সমর্থক। কালে কালে মানুষের মন বদলায়, বদলায় রুচি। তাছাড়া ভাষা আর সুরও বদলায়। কাজেই মনের কথা এবং ভাষার সঙ্গে সুরের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। তাই তো আমাদের কীর্তন, গাজন, গম্ভীরা, রামপ্রসাদী যেমন সাধন ভজন সংপৃক্ত হয়েও লুপ্তপ্রায়, তেমনি মানবিক সুখ দুঃখের গানও অতিক্রান্তকালে চিরদিন হয়েছে বিলুপ্ত। বাউল গান, ব্রহ্মসঙ্গীত, দ্বিজেন্দ্র – রজনী – অতুল – মুকুন্দের গানই বা আজ আর কে গায়! কাজেই মর্মান্তিক হলেও এ সত্য অস্বীকার করা চলবে না যে রবীন্দ্র – নজরুল সঙ্গীতও আগামী পঞ্চাশ বছর টিকবে না।“
.
অধ্যাপক - সমালোচক ডঃ আহমদ শরীফকে আমার সবসময় আপন মনে হয়, কারন তিনি পলিটিকাল কারেক্টনেসের ধার ধারেন না কখনো। মনে, বা বিবেচনায় যা আছে, একদম রাখঢাক ছাড়া সেটা বলে দেন। খেয়াল করে দেখুন, রবীন্দ্র - নজরুলের গানের মতো সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোও যে দিনের শেষে টিকবে না, এটা তিনি অবলীলায় বললেন। টিকবে না বলতে কি তিনি বোঝাচ্ছেন, মানুষ আর গাইবে না - এটা? আমার মনে হয় না। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, যে ফর্মে মানুষ এগুলো প্র্যাকটিস করতো, গাইত, সেভাবে গেয়ে, সেভাবে চর্চা করে মানুষ আর রিলেট করতে পারবে না একসময় এদের সঙ্গে। যদি বিলুপ্ত হয়, সাংস্কৃতিক বিশুদ্ধতাবাদীদের উন্নাসিকতা বিলুপ্ত হবে। সংস্কৃতি এগিয়ে চলবে নিজের গতিতে।
.
বুলবুলি গানটির রিমেক করে যে 'সর্বনাশ' কোক স্টুডিও করেছে, তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে ছায়ানটপন্থীরা কোক স্টুডিওর বাণিজ্যিক স্পন্সর প্রধান গাউসুল আজম শাওন বরাবর একটা মেইল করতে পারেন। দাবী করতে পারেন যে ছায়ানটের শিক্ষক - শিক্ষার্থীরা মিলে কোক স্টুডিও বাংলার বাকি গানগুলি কোন এক বটগাছের নীচে দাঁড়িয়ে শুধু হারমোনিয়াম আর ডুগিতবলা দিয়ে গাইবেন। সে গান রেকর্ড করে কোক স্টুডিওকে সেটা তাদের ইউটিউব চ্যানেলে প্রচার করতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০২২ দুপুর ১:০৮