হুমায়ুন আজাদ মূলত সমালোচক__এবং এই সমালোচনার প্রবৃত্তি কেবল তাঁর মুখের ভাষাতেই নয়- যাঁরা আমরা তাঁকে সামনা সামান দেখেছি__, তাঁর প্রবন্ধের, তাঁর উপন্যাসের, গল্পের এমনকি তাঁর বহু কবিতার ভাষাতেও দেখি সর্বত্র। হুমাযুন আজাদের এই সমালোচনা প্রবৃত্তিটা মেনে নিলে আজকের বাঙলাদেশে তাঁর প্রয়োজন কোথায় এবং কেন তিনি জরুরি তা হয়ত বুঝা যাবে।
রাষ্ট্রের উন্নতির প্রয়োজনে এমন একজন সমালোচক সবসময়ই প্রয়োজন যিনি নির্দ্ধিধায় অঙ্গুলি নির্দেশ করতে পারবেন তাদের উপর, যাদের আমরা দেবতাসদৃশ বলে মনে করি। তিনিই আমাদের, আমরা যখন মফস্বলে থাকি, চোখের সামনে তুলে ধরেছিলেন সেনাশাসকদের অন্তঃসারশূণ্যতা , বুদ্ধিজীবীদের জীবিকা সর্বস্বতা, একজন সব্যসাচীর মুখোশ খুলে দিয়েছিলেন তিনিই__যাঁকে আমরা মনে করতে শুরু করেছিলাম মহৎ বলে। তিনিই আমাদের তরুণদের সজাগ করেছিলেন আমাদের দায়িত্ব সম্পর্কে, আমরা যারা দেশকে স্বনির্ভর দেখতে চাই, শুনতে চাই খেটে খাওয়া মানুষদের উন্নতির পদপে, মিছে দম্ভে কপট হয়ে আমরা যাঁরা বেড়ে উঠতে চাইনি, সময় অতিক্রম করতে যারা লজ্জিত হতাম পাঠে অমনিবাস বা কোনো হিমাংশু সমগ্রে।
তিনিই আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন উপন্যাস এবং ঔপন্যাসিকের পার্থক্য, এবং বুঝিয়ে দিয়েছিলেন একজন জনপ্রিয় অপন্যাসিক কতটাই অন্তঃসারশূণ্য হতে পারেন। তিনি আমাদের মস্তিষ্ককে আমাদের কৈশরে প্রাপ্ত বয়ষ্ক করে তুলেছিলেন। তিনিই আমাদের প্রাপ্ত বয়ষ্কতার প্রথম শিক্ষক, মফস্বল থেকে যাঁর শিক্ষা আমরা গ্রহণ করে রাজপথের দিকে অগ্রসর হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পৌঁছেছিলাম। না হলে ঝরে পড়তে পারতাম বসন্তের পাতার মত__নতুন করে না-জন্ম নেওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে।
তাঁর সমালোচনা এমন স্থলে পৌঁছেছিল, যে স্থলে আমরা তরুণ হয়ে আঘাত করতে পারতাম না। বাঙালির দুর্বলতা কোথায়, সীমাবদ্ধতার সূত্রে সে কীভাবে আবর্তিত হচ্ছে দিনকে দিন, কীভাবে নষ্ট সত্তা নষ্ট করে নিচ্ছে বাঙলার আকাশ বাতাস, নষ্টের লিঙ্গে কীভাবে গাঁথা থাকছে সৌন্দর্যের অপার্থিব দেবী__এগুলোর নির্মোহ উপস্থাপন তিনিই দ্রোহভরে করলেন আমাদের হয়ে।
বাঙালির প্রতি শ্রদ্ধা কে রা করতে পেরেছেন? বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল__কেউই বাঙালির উপর শ্রদ্ধা রাখতে পারেন নি। ‘সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী রেখেছ বাঙালি করে মানুষ কর নি’__এ কথায় কি বাঙালির প্রতি কোনোরূপ শ্রদ্ধা আছে? তারপরও রবীন্দ্রনাথ মানুষের উপর বিশ্বাস হারানোকে পাপ বলে মনে করেছেন। আমাদের হুমাযুন আজাদও রবীন্দ্রনাথের এই কথা স্বীকার করে তাঁর একটি প্রবচনে বলছেন যে ‘মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ, কিন্তু বাঙালির উপর বিশ্বাস রাখা বিপজ্জনক।’ তাঁর এই সংযোজিত বক্তব্য অর্থাৎ ‘বাঙালির উপর বিশ্বাস রাখা বিপজ্জনক’ এই কথাটির উপর বাঙালি চরিত্রের একটি নির্মম সত্য অশ্যই লুকিয়ে আছে এবং এটি জানারও প্রয়োজন আছে। বাঙালির উন্নতির জন্য বাঙালিকে অবশ্যই তার সীমাবদ্ধতা কোথায় তা জানতে হবে। জাতি যাঁরা নির্মাণ করতে চান প্রবন্ধে গল্পে উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তাঁরা এর দুর্বলতাকে চিহ্নিত না করলে, সেই জাতির মুক্তি তাঁরা বয়ে আনবেন কীভাবে? চিকিৎসকের কাছে রোগ লুকালে রোগীরই বরং মৃত্যুর ঝুঁকি বারে।
বাঙালি চরিত্র চিত্রণে তিনি খুব নির্মম ছিলেন__এটাই মনে হয় বিশেষ করে ‘বাঙালি একটি রুগ্ন জনগোষ্ঠি’ এই প্রবন্ধাটর কথা মনে করলে। পুরো প্রবন্ধে একটি শব্দ নেই যেটি বাঙালি চরিত্রের ইতিবাচক দিক উপস্থাপন করে। তার মানে বাঙালি চরিত্রে কি কোনো ইতিবাচক চরিত্র নেই? আর যদি থেকে থাকে ড. আজাদ কি জানতেন না? জানতেন অবশ্যই।
তিনি যখন প্রবন্ধ লিখছেন, তাঁর লেখায় বাঙলার যাঁরা মহান তাঁদের নাম তো বলতে তো তিনি দ্বিধা করেননি? তিনি রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, বেগম রোকেয়া, জীবনানান্দ, বুদ্ধদেব বসুর কথা শ্রদ্ধাভরে লিখেছেন। পরবর্তীকালে এই বাঙলাদেশে তিনি আহমদ শরীফ, শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান, আব্দুর রাজ্জাক এঁদেরকে নিয়ে লিখেছেন, স্বাক্ষাৎকারও গ্রহণ করেছেন। ব্যক্তিগত ভালো লাগা খারাপ লাগার উপরে তিনি নির্ভর করেন নি। যাঁদের সম্পর্কে বলতে কর্তব্যবোধে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, তাঁদর সম্পর্কে লিখেছেন। যেহেতু তিনি সবসময় তাঁর রচনায় নির্মোহ থাকতে চেয়েছেন, তাই দোষ-ত্রুটি নিয়েই তাঁরা উপস্থাপিত হয়েছে তাঁর বক্তব্যে। এই নির্মোহ ভাবটি তিনি অক্ষুন্ন রাখতে পেরেছন সবসময়ই__এমনকি যখন কারো দ্বারা অন্যায়ভাবে আক্রান্ত হয়েছেন তাঁর বেলায়ও। এ প্রসঙ্গে সৈয়দ শামসুল হকের প্রসঙ্গ বলা যেতে পারে। হুমায়ুন আজাদের কিছু প্রবচনের তীব্র অশ্লীল আক্রমণ করেছিলেন শামসুল হক। সেই সময় তিনি পাল্টা উত্তর দেওয়ার সময় ভুলে যাননি শামসুল হকের গুরুত্বের কথা:
‘‘প্রবচন নিয়ে প্রথমত মেতে, পাগল হয়ে, উঠেন বর্তমানের প্রধানতম কপট লেখক, যাঁর কোনো কোনো লেখার অত্যন্ত আমি অনুরাগী, যিনি গুরত্বপূর্ণ লেখক হওয়া সত্ত্বেও ব্যক্তিগত চরিত্রের জন্য কখনো গুরুত্ব পাননি ও পাবেন না বলেই মনে হয়।’’
বাঙালি চরিত্রের যে দিকটি সীমাবদ্ধ ও অজ্ঞতায় বিকশিত কিন্তু দাম্ভিক__সেটিকে তিনি উন্মোচিত করতে চেয়েছেন তাঁর অনবদ্য আক্রমণে; তবে দম্ভহীন অজ্ঞতাকে তিনি স্নেহের চোখে না দেখলেও আক্রমণ করেননি কখনো। বাঙালি চরিত্রের উজ্জ্বল দিকগুলো তিনি সরাসরি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরের চরিত্র রচনায় বলেছিলেন ‘বিশ্বকর্মা যেখানে চারকোটি বাঙালি তৈয়ারি করিতেছিলে সেখানে হটাৎ দুই-একজন মানুষ গড়িয়া বসেন কেন, তাহা বলা কঠিন,’__তার মানে রবীন্দ্রনাথ তখনকার চারকোটি বাঙালিদের মধ্যে মানুষ দেখতে পাননি তেমন বেশি, তারপর সেই বাঙালি সাতকোটি হলো কিন্তু মানুষ হলো না উল্লেখযোগ্য হারে। হুমায়ুন আজাদও তাঁর দেখা প্রায় পনোরো কোটি বাঙালির মধ্যে মানুষ খুব কমই দেখেছেন্ এবং যাঁদের মানুষ হিশেবে দেখেছেন তাঁদেরও সর্বাংশে মানুষ রূপে দেখেননি। মুক্তিযুদ্ধাদের সম্পর্কে তীব্র আক্রমণকারী অথচ কার্যকর ও কল্যাণকর সত্য উচ্চারণ করেছিলেন একটি প্রবচনে ‘একবারের মুক্তিযোদ্ধা চিরদিনের মুক্তিযোদ্ধা নয়’।__এই উক্তিতে আমরা প্রচলিত মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বিচারে প্রয়াসী হতে পেরেছিলাম, হতে পেরেছিলাম কপটতা উদঘাটনে অনেক সংসদ সদস্য বা মন্ত্রীদের চরিত্রের। এমনকি রবীন্দ্রনাথকে তিনি ত্রুটিমুক্ত দেখেননি, তাঁর “নারী” গ্রন্থে বিপন্ন করে তুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথের পুরুষতান্ত্র্রিক অস্তিত্বকে। আবার একই সঙ্গে তিনি ঘোষণাও করেছিলেন বাঙলার এই আকাশকে ‘রবীন্দ্রকাশ’ বলে। তাঁকে দেখতে দেখি স্তাবকতাহীন রবীন্দ্রসমালোচনা করতে, দেখেতে দেখি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তাঁর স্পষ্ট উচ্চারণ করতে যে, ‘রবীন্দ্রনাথ পৌরাণিক নন, তবে আধুনিক নন’। ব্যক্তিক ভালবাসাকে তিনি সমালোচনার আগে স্থান দেননি, যদি দিতেন তাহলে তাঁর প্রিয় রবীন্দ্রনাথের আকাশের নিচে রবীন্দ্রবিদ্রোহ করতে পারতেন না। তিনি রবীন্দ্রভক্ত ছিলেন না, ছিলেন অনুরাগী__ভক্ত ও অনুরাগীর মধ্যে তাৎপর্যে যে-পার্থক্য তা মূলত আমরা তাঁর কাছ থেকেই শিখেছি। ‘ ভক্তের শব্দের অর্থ খাদ্য। প্রতিটি ভক্ত তার গুরুর খাদ্য। তাই ভক্তরা দিনদিন জীর্ণ থেকে জীর্ণতর হয়ে আবর্জনায় পরিণত হয়।’__এই প্রবচন আমাদের মনে বাসা বেঁধে অনিকেত সত্য হয়ে আছে যাঁর কারণে তাঁর নাম হুমায়ূন আজাদ। তিনিই আমাদের শিখিয়েছেন সমালোচনার ঊর্ধে কেউ নয়, এবং একজন দেবতাকে বারবার প্রমাণিত করতে হয় তাঁর দেবত্ব। এরকম নানা বিষয়ে আমাদরে মনের ভেতর সংস্কারের যে বাঁধ ছিল, যেগুলো সম্পর্কে হয়ত অস্পষ্ট যন্ত্রনা ছিল আমাদের, তা যেন স্পষ্ট হয়ে হুমায়ুন আজদের আঘাতে ভেঙ্গে গেল।
হুমায়ুন আজাদ আক্রমণ করেছেন বাঙালির সীমাবদ্ধতায়। বা অন্যভাবে বলতে পারি তিনি চাননি বাঙালি সীমাবদ্ধ থাকুক। তাঁর ‘সীমাবদ্ধতার সূত্র’ প্রবন্ধটির কথা স্মরণ করলে সেই সত্য আমাদের চোখে ভেসে উঠবে। শিল্প-সাহিত্য-নন্দনতত্বের উদাহরণ দিয়ে তিনি অসামান্য বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন সেই উনিশ শতক থেকে বাঙলার জাগরণের ফসল হিশেবে জন্ম নেওয়া প্রবন্ধ উপন্যাস মহাকাব্য কবিতা রোমান্টিনিজম কীভাবে পশ্চিম থেকে ধার করা; ‘আধুনিক বাঙলা সাহিত্য পশ্চিমের দান’, যদিও অনুরাগী হিশেবে আমাদের আপত্তি আছে ‘দান’ শব্দটিতে কারণ উনিশি লেখক ভিক্ষে চেয়েছেন আর পশ্চিম আমাদের হাত ভরে দান করেছেন তা মেনে নিতে আমরা পারি না। তারপরও মৌলিকত্ব সৃষ্টিতে বাঙালির সীমাবদ্ধতা আমাদের মেনে নিতেই হবে। যদিও তাঁর “নারী” গ্রন্থটি তাঁর মৌলিক রচনা নয়, পশ্চিমা নারীবাদীদের দ্বারা প্রভাবিত তিনি, বিশেষ করে স্টুয়ার্ট মিল ও সিমন দ্য বোভেয়ার দ্বারা, তারপরও তাঁর উপন্যাসে যে সবকিছু ভেঙ্গে পরা তত্ত্ব আমরা দেখেছি তা মৌলিকতার দাবীদার। সীমাবদ্ধতা তিনি নিজে ভাঙতে চেয়েছেন, তাই ‘অতিবাড় বেড়ো না, ঝড়ে পরে যাবে’__এই বাঙালি প্রবাদটি তিনি মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন; তিনি পৌঁছতে চেয়েছিলেন সেখানে প্রচলিত অর্থে নির্বোধেরা যেখানে যেতে সাহস করে; বাড়তে চেয়েছিলেন অনেক দূর, যেখানে অনেকে বাড়ার সাহস করেননি। অবশ্য বেড়ে উঠার প্রযোজনে তিনি নগ্ন জনপ্রিয়তা চাননি, হতে চেয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ। তাই এমন অনেক বিষয়ে তাঁকে আমরা লিখতে দেখি, যেগুলো সুরসুরি জ্ঞাপক নয়, বা নয় স্থূল চিন্তার কোনো পলিথিন ব্যাগ! অনবদ্য ভাষা শৈলী, চিন্তার অভিনবত্ব, বক্তব্যে সরল অথচ সুদূর তাৎপর্যবাহী, যা আধুনিক গদ্যের আঁড়ালে বৃত্তবদ্ধ অকার্যকর মূল্যবোধ বহন করে না, বরং প্রগতিশীল, তাই হুমায়ুন আজাদের রচনার বৈশিষ্ট্য। তাঁর “আমার অবিশ্বাস” গ্রন্থটির কথা মূলত সেই কারনেই লেখা। ধর্ম এখানে সরাসরি আক্রান্ত হযেছে কেবল এই কারণে যে ধর্ম করে তুলে মানুষকে দায়িত্বহীন এবং সীমাবদ্ধ। সমাজের দায়িত্ব ধার্মিকের কাছে কেবল আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই এবং কেবল পরলৌকিক সম্ভোগের মধ্যেই। আজ আমরা যখন ধর্মকে জানি শোষনের হাতিয়ার রূপে, শাসক গোষ্ঠির শাসিতদের ইহকালকে গুরত্বহীন বিবেচনা করার মগজধোলাই রূপে, হুমায়ুন আজাদ এই কথা না-বললেও এই বোধটিকে সহজে বুঝতে আমদের সাহায্য করেছিলেন। ঠিক ধর্মের বিরুদ্ধে নয়, ধর্মজীবীদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড সমালোচনা প্রবন্ধে উপন্যাসে তিনি বিম্বিত করেছিলেন। আমরা হুমায়ুন আজাদ-এর পরিচয় দিতে গিয়ে তাঁকে আমরা কেবল মৌলবাদবিরোধী ও নারীবাদী বলে চিহ্নিত করতে চাই__আমাদের এই চাওয়াতে তাঁর প্রতি সুবিচার করা হয় না, তিনি মৌলবাদকে ঘৃণা করেছেন, সেই মৌলবাদ কেবল ধর্মীয় মৌলবাদ নয়, তার সঙ্গে যুক্ত আছে যে-কোনো ধরনের মৌলবাদ। “আমার অবিশ্বাস” গ্রন্থে তিনি যখন সকল বাদকেই অসুস্থতার প্রতীক বলেছেন, আমি “নারীবাদ” নিয়ে তাঁকে ফোনে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এটা অসুস্থতা কিনা, তিনি তখন পুনরোক্তি করে বলেছিলেন ‘যে-কোনো বাদই অসুস্থ যদি কেউ ওটতে অটুট থাকতে চায় চিরকাল।'। তিনি কখনো কখনো কোনো কোনো বাদের অন্তর্ভূক্ত হলেও শুধু ওখানেই তিনি সীমাবদ্ধ থাকেন নি। কোনো ধরনের বাদকেই তিনি জীবীকার আশ্রয় হিশেবে গ্রহণ করনেনি, জীবীকার আশ্রয়ে তিনি সাহিত্য রচনা করেছেন__এ কথা তাঁকে যিনি না-বুঝেন তাঁরাই বলবেন। তাঁর লেখা দিয়ে আগামী প্রকাশনী হয়ত লাভবান হতে পারে, তিনি বরং নিজে আক্রান্তই হয়েছেন। তাঁকে বুঝতে চাননি আমাদের অনেক লেখকেরা ও বুদ্ধিজীবীরা, রচনায় লেখকের নিরপে অবস্থানকে তাঁরা তাঁদের নিজের উপর ব্যক্তিগত আক্রমণ বলে বিবেচনা করেছেন। শামসুর রাহমানের উপর এমন গ্রন্থ যিনি রচনা করতে পারেন, তিনি শামসুর রাহমানের উপর ওরকম তীব্র উক্তি ‘শামসুর রাহমান বোঝেন না কার সঙ্গে পর্দায় কার সঙ্গে সয্যায় যেতে হয়’ করতে পারেন তা অনেকের কাছে বোধগম্য নাও হতে পারে, কিন্তু আমাদের কাছে তা স্বাভাবিক। কারণ মায়াময়ী মায়ের স্নেহের মত তিনি সন্তানের ত্রুটি ভুলে যান না__এটা আমরা জানি। তিনি হয়ত ভাবতেন ক্রটি মানুষকে সীমাবদ্ধ করে তাই ব্যক্তিগত প্রেম-অপ্রেমের ধার না ধেরে বৃহত্তর কোনো স্বার্থে ছোটকে ত্যাগ করতেন। তিনি যেখানে ত্রুটি দেখেছেন সেখানেই আঘাত করেছেন : ধর্ম সমাজ নারী পুরুষ শিক্ষক কবি উপন্যাসিক রাজনীতিবিদ আমলা সবাই তাঁর শাণিত আঘাতের কোনো না কোনো চিহ্ন বহন করে। এমন কি প্রতিষ্ঠানও তাঁর আক্রমণ থেকে মুক্ত নয়। বাঙলা একাডেমির কথা এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে। ‘বাঙলা একাডেমীর বই : নকল, ভুল ও বিকৃত অনুবাদের উৎস’__এই প্রবন্ধটি মূলত একে আক্রমণ করেই রচিত।
এই আক্রমণ বা সমালোচনাই হুমায়ুন আজাদের প্রায় সমস্ত রচনার মূল বিষয়বস্তু। তাঁর রচনায়, আমরা যারা তরুণ, চিনে নিতে পারি বাঙলার শত্রু এবং বাঙলার মিত্রদরে। পরিমাপ করে নিতে পারি তাঁরা কতটকু স্খলিত হলেন, দেখে নিতে পারি নন্দিত মুখোশের আঁড়ালে তাদের নিন্দিত মুখটুকু।
কোনো কর্মী যদি হুমায়ুন আজাদকে বিদ্যমান সমাজের রূপকার হিশেবে দেখেন তাহলে তিন জরুরি। কারণ সে নিজের সমাজটা বুঝতে যে সময়টুকু ব্যয় করতে হতো, হুমায়ুন আজাদ তা নির্মোহভাবে তাঁর সামনে উপস্থাপন করবেন, যা হয়ত অন্য অনেকের কাছ থেকে পাওয়া তাঁর দুঃসাধ্য হত। কিন্তু সমস্যার সমাধান যদি করতে চাই, সে ভাবনা হুমায়ুন আজাদে খোজা যাবেনা, কারণ আমরা আগেই বলেছি একজন মানুষের কাছেই আমরা তাই দাবী করবো যা তার অধিগম্য, তার চেয়ে বেশি কিছু নয়।
এপ্রিল ০৫, ২০০৮
৪১১ জগন্নাথ হল, ঢাবি
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০১০ বিকাল ৫:১৫