somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আক্ষরিক

০১ লা মে, ২০১৩ রাত ১২:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আক্ষরিক
রণজিৎ সরকার


হানিফ যখন বিশ্বজগতের দর্শন নিয়ে ভাবনায় মগ্ন, তার সামনের জগত যখন তার থেকে আলোকবর্ষর মত দূরে এবং বাসসৃষ্ট কোলাহল, হেলপারের ভাড়া চাওয়ার ধরন, লোকাল বাসের অতি মন্থরগতি যখন তাকে বিচলিত করবার বিষয নয়, এমন সময় চলমান বিশ্বের সঙ্গে তার সংযোগ স্থাপন করে বসলো তার জানালা দিয়ে বুকে এসে লাগা একটি কার্ড। কার্ডটির তার অতিপিরিচিত, এর বিষয়বস্তুও তার জানা, এভাবে জানালা দিয়ে কত লিফলেট তার গায়ে এসে পড়েছে--কখনো নিউজপ্রিন্টের, কখনো শাদা কাগজের, কখনো ভিজিটিং কার্ডের আদলে,--এবার আসলো এই ভিজিটিং কার্ডের চেয়ে একটু বড় আকারে: ছাপা ভালো, ভাষা সংযত, বক্তব্য সংক্ষিপ্ত, এবং প্রতিশ্রুতি অনুক্ষেপনীয়। হানিফ এই কার্ডটির জন্য তার ভাবনাজগত থেকে হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হলো বলে বিরক্ত হল না; কতভাবেই তো তার কতভাবনা বিচ্ছিন্ন হয় তা সে জানে; এরই ফাকে হয়ত কখন সে আবার অন্য কোনো ভাবনায় চলে যাবে নিজের অজান্তে তাই পূর্বের ভাবনায় যাওযার চেষ্টা না করে, কার্ডটি ভালোভাবে পড়ে নেয় সে; আজ অবশ্য এটি পড়তে তার বাধা নেই, কারণ তার পশের সিটটা ফাকা, আর অন্য কেউ যে দেখবে অন্যপাশ থেকে তারও সম্ভাবনা কম। তারউপর যেই লোকাল বাসটিতে সে উঠেছে, সে জানে এর যাত্রীরা সচরাচর সেই শ্রেণির নয় যারা তার এটি পড়া দেখে কিছু ভাবতে পারে। এছাড়া তার চেহারা ইদানিং যেমন দেখাতে শুরু করেছে তাতে কারো মনে হওয়ার কোনো কারণ নেই যে, এরকম একটি লিফলেট পড়া তার চেহারার সাথে বেমানান! সুতরাং হানিফ নিশ্চিন্তে পড়বার সুযোগ পায়। যথারীতি প্রথম চোখে পড়ে কার্ডটির শিরোনাম; শিরোনামটিতে রয়েছে একটি ভয়াবহ প্রশ্ন! প্রশ্নটি পড়ে সে ভাবতে চায় না এর উত্তর--ভাবনাটি তার অস্বস্তিকর মনে হয়। কিন্তু উত্তরটির তৈরিপ্রক্রিয়া ততক্ষণে অনেকদূরবর্তী হয়ে পড়লে তারই মাঝে তার চোখের সামনে ভেসে উঠে তার নারী-অভিজ্ঞতার কথা; না, সেখানে কোনো ব্যর্থতার প্রমাণ তার নেই!
একে একে সবগুলো সমস্যাজর্জরিত প্রশ্ন নিবিড় মনযোগে হানিফ পড়ে নেয়, নির্বিকার পাঠকের মত নিজের জীবনকে সমস্যার আশঙ্কায় না জড়িয়ে পাঠ শেষ করতে চায় কিন্তু পারে না; উত্তরগুলো ঠিকই মুহেূর্তেই চলে আসতে থাকে। হানিফ ভাবে এটি তার জগতজীবনের দর্শন নিয়ে সবসময় ভাববারই ফল, তার সচেতন চেষ্টা দিয়ে তাই তার চিন্তাপ্রক্রিয়াকে বাধা দেওয়া সম্ভব নয়,--বিজ্ঞাপনের কোনো ফাইল কখনও না কিনলেও! সে দেখতে পায় তার এই ৩০ বছর ধরে যে জীবন বয়ে চলছে তারই কোনো এক কৈশোরকাল। রাস্তার পাশ দিয়ে হানিফ হাটছে, হাটতে হাটতে তার সামনের জগত থেকে কখন সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সে জানে না; রিকশার শব্দ, ট্রাকের হর্ন, মানুষের বিচ্ছুরিত বাক্যালাপ তার কাছে ফিকে হয়ে আসছে, অথচ সে ঠিক কী ভাবছে সে জানে না; সে এগুচ্ছে বোয়ালখালির কোনো খাল ধরে, মাটির রাস্তা ধরে, দুর্বাঘাস পেরিয়ে; চারদিকে সবুজের কোলাহল, সবুজের মাঝে লাল আলো স্কুল ফেরত তরুণতরুণির প্রাসঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিক হাসির মাঝে টুকুরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ছে অথচ এই সবকিছু সে অতিক্রম করেও, তার স্পর্শের সংলগ্ন থেকেও, সে দূরবর্তী! লোকাল বাসে বসে হানিফ হয়ত তার পুরো শৈশবকেই কাছে ডেকে আনত আজ এই সুযোগে, কিন্তু চলমান জগতের সঙ্গে তার আবার সম্পর্ক স্থাপন করলো কনডাক্টর! ‘ভাই ভাড়া দেন!’। কার্ডটি হাতে রেখেই মানিবেগ থেকে অত্যন্ত সচেতনভাবে হানিফ টেপ মারা দু টাকা বের করে দেয়, কারণ এই টাকা বাস ছাড়া অন্য কোথাও সে চালাতে পারবে না জানে। কনডাক্টর তার মুখের ও টাকার দিকে একবার তাকায়, কিছু বলবার চেষ্টা করে এবং কিছু বলবার আগেই হয়ত সে উত্তর কী হবে আন্দাজ করতে পেরে আর কিছু না বলেই সরে যায়। হানিফ এবার সত্যিসত্যিই চলমান জগতরে বাসিন্দা, সে দেখতে পায় তার বাসটি এইখানে জ্যামে পড়ে আছে; সে ভাববার অবসর পায় যতক্ষণে জ্যাম ছাড়বে ততক্ষণে পায়ে হেটেই সে তার গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারে। এই গরমে বদ্ধ লোকাল বাস, তার দুর্গন্ধ, চারপাশের কোলাহল থেকে তুলনায় নোংরা ফুটপাতও অনেক ভালো। কাজেই কার্ডটি মানিবেগে ঢুকিয়ে আর দেরি করে না হানিফ, জগতজীবন নিয়ে দার্শনিকভাবনা অবশিষ্ট রেখেই রাস্তায় নেমে সে হাটতে থাকে। হাটতে হাটতে সে কার্ডের কথা ভাবতে চায়; মানিবেগে কার্ডটিই বা কেন রাখল তার কারণ বুঝবার চেষ্টা করে; এখানের ফোননাম্বারগুলোতে কল করার কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা সে ঠিক জানে না, হয়ত তার প্রয়োজনই নেই, কিন্তু এই আপত্তিকর জিনিস সাথে রাখায় সম্ভবত কোনো গোপন সুখ আছে বলে হানিফ ওটা ফেলে দিতে পারে না।
যেখানে হানিফ নামে সেই পথ তার চিরচেনা। ফুটপাতের উপর একএকটি বিক্রির হিরিক পাশ কাটিয়ে এগুতে থাকে হানিফ; ততক্ষণে সে ভুলে যায় মানিবেগে থাকা কার্ডটিকে, এটা নিয়ে তার আগ্রহ হয়ত সে বোধ করে না। সে খেয়াল করে সে এবার দেখছে ফুটপাতের দোকানগুলো--ঠিক যে কিছু কিনবে তা নয়, ফুটপাত দিয়ে হাটছে বলেই, বা চোখের সামনে আসছে বলেই হয়ত সে দেখছে। গেঞ্জি, আম, জিলিপি, শার্ট, ফলের দোকান পার করে হানিফ চলতে থাকে তার বাড়ির দিকে। এরই মধ্যে নিজের গায়ের শার্টটির দিকে তার নজর যায়; একটা শার্ট কেনা দ্রুতই তার দরকার, তবে শার্টের চেয়ে গেঞ্জিই বোধহয় তার বেশি প্রয়োজন, এই গরমে বাইরে পরে বেরুবার গেঞ্জি তেমন নেই। তবে ফুটপাতের এই গেঞ্জিগুলো তার তেমন একটা পছন্দ হয় না, তবে পছন্দ হয় আমগুলো। এখনো আম পাওয়া যায়, হানিফ ভাবে। আমগুলো কে ভালো করে দেখে নিতে চায়, এগুলো হয়ত ফজলি আমের নকল, কেমন যেন কালচে সবুজ দেখতে। হুম্ তার ঠিক মনে আছে তার বাবার সাথে যখন ছোটবেলা বের হত, তার বাবা দোকানদারের সাথে ফজলি নাকি আশ্বীনা এই নিয়ে ঝগড়া করতেন, বলতেন বিক্রেতাদের ‘তোর বয়স যট্টুক্ তার আগের থিকা আমি আমের খেত করি, আমারে হিগাইছ না!’। হানিফ জানত তার বাবার কখনো আমের খেত ছিল না, বাড়ির সামনে ঢেড়স, মরিচ, পুইশাক, লালশাক, লাউ, মিষ্টিকুমড়ার চাষ করতেন তিনি, শীতের সময় করতেন ফাকে ফাকে মূলা চাষ; অঢ়হড় এর ডাল, সজনা, কচু এগুলোও ছিল। দোকানদারদের সাথে তার বাবার ঝগড়া হানিফের প্রতিদিনই দেখতে হতো, অবশ্য হানিফ জেনে গিয়েছিলো যে, এই ঝগড়া তার দেখা আর দশটা ঝগড়ার মত নয়, এখানে এই গলা ফাটিয়ে রাগের সঙ্গে বাক্যবিনীময় হচ্ছে, একটু পরেই হয়ত দোকানদারই তার বাবাকে পান খাওয়াবে, বা খাওয়াবে চা। আমের কথা মনে পড়তেই হানিফের মাথায় চট করে চলে চুরি করে আম খাওয়ার কথা। এই কথাগুলো বারবারই মনে পড়ে তার। তার মনে পড়ে বাবা ফজলি আম কিনে তাকে বাসায় যখন পাঠাতেন, পথে হানিফ ওখান থেকে সবচেয়ে বড় ফজলি আমটি পুরোনো ট্রেনের বগিতে লুকিয়ে রেখে যেত, তারপর বাসার আম খেয়ে দৌঁড়ে আসত ট্রেনের বগিতে এবং নিশ্চিন্তে ওই আম শেষ করতো। এমনিতেও বাসায় সেই প্রায়ই ভাগে পেত সবচেয়ে বড় আমটি, তারপরও বাড়তি একটি আমের লোভ যেটির কোনো ভাগ হবে না, বরং হবে তার নিজস্ব ভাগের উপরি, তার লোভ সামলাতে পারতো না! মানুষ বলে শিশুরা স্বার্থ নিয়ে ওতটা ভাবেনা, কথাটা ঠিক না বলে মনে হয় হানিফের! বরং সে ছোট থাকতে যতটা এরকম লুকিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করতো, বড় হয়ে তেমন সে আর করেনি! করবার কথা ভাবেওনি সে, বরং টিউশনির টাকা দিয়ে বাসার জন্য নাড়ু-সন্দেশ-বিস্কিট কিনেছে সে। হানিফ দেখতে পায় ওই লুকানো আমগুলো কীভাবে উর্দ্ধশ্বাসে সে সাবার করছে! দেড়-দুই কেজির একটি আম ওত দ্রুত শেষ হয় না; তারউপর পুরোনো বগির, যত্রতত্র প্রস্রাবের, এমন কি পুরাতন মল যেগুলো সূর্যের উত্তাপে শুকিয়ে গিয়ে ঝাঝালো গন্ধ তৈরি করেছে, তারই কাছে বসে দমবন্ধ করে আম খাওয়া সহজ নয়! হানিফ অবশ্য আমের স্মৃতি নিয়ে ভাবতে সেই ফজলি বা আশ্বীনা আম থেকে এগিয়ে পড়েছে অনেকদূর!
কিন্তু আম কি হানিফ কিনতে চেয়েছিল, বা সেগুলো যদি সত্যিসত্যিই ফজলি হত হানিফ কি সেগুলো আদৌ কিনতো--এই কথাও সে ভাবে। উত্তরও সে পায়: আমগুলো তার খেতে ইচ্ছে করেছিল, ফজলি না হলেও তার খেতে আপত্তি থাকতো না; আজ সারাদিন তার খাওয়া হয়নি বলেই হয়ত খেতে ইচ্ছে হয়েছিল, হয়ত আম দেখলেই, বা কোনো খাবার দেখলেই তার জৈবিক নিয়মে খেতে ইচ্ছে করে; কিন্তু অর্থনৈতিক সূত্রে বাধে বিপত্তি! টাকা খরচ করে আম খাওয়ার কথা মনে হতেই তার খেয়াল হলো এইগুলো বাজারে এসেছে তার মত ভোক্তার জন্য নয়! কিছুদিন আগে হলে সে অন্তত দাম করতো, বুঝবার চেষ্টা করতো আমের দাম তার ক্রয়সীমার কতটুকু বাইরে চলে গেছে! কিন্তু এখন সে না জিগ্যেস করেও জানে যে আমগুলোর দাম যদি এখন সে জিগ্যেস করে বিক্রেতা তার মুখের দিকেও তাকাবে না! হানিফ ভাবে যে কীভাবে দোকানদাররা বুঝে ফেলে সে জিনিস কিনবে না! বা তার জিনিস কেনবার সামর্থ্যই নেই! দোকানদাররা নিশ্চই দূর থেকে প্রত্যেককে লক্ষ করে, বা যারা কিনতে চায় তাদের দাম জিগ্যাসার মধ্যেই বোধহয় এমন কিছু থাকে যাতে তাদের দিকে না তাকিয়েও বোঝা যায় তারা কেমন খরিদ্দার।
আম ছাড়া এই পথে হানিফের কী চোখে পড়েছে তা সে মনে করতে পারে না; প্রত্যেকদিন যে পথ দিয়ে সে হেটে যায়, যেমনটি দেখত সে, আজও তার ভিন্ন কিছু দেখেছে বলে সে মনে করতে পারে না; শুধু পুলিশ বক্সের এখানে কিছু কিশোরের জটলা তার চোখে পড়েছিল। আজ হানিফ খুব নিবিড় মনযোগে তার স্মৃতি রোমন্থনে যেতে পারেনি, এখনো তার শৈশবের খাল নদী ফসলের মাঠ, জোয়ারের জল, গাছের ফল-ফুলের গন্ধভরা বাতাস ভুলিয়ে দেয়নি তার বর্তমান! এখনো তার কৈশোরের নাবলিকা বন্ধুরা--শাহিনা, পলি, কানন, পাখি, সালমা, রিপা, স্মৃতি জোয়ারের জলের মতন, বন্যার মত, জলোচ্ছ্বাসের মতন নিয়ন্ত্রণহীন প্রবাহে ভাসিয়ে নেয়নি তাকে; তবুও স্মৃতির সামান্য ছটা তাকে অন্ধ করে এগিয়ে নিয়েছিল সামনে; পথে হাটতে হাটতে ভুলিয়ে দিয়েছিল তার চারপাশ; সে কোথা দিয়ে হাটছে, কোথায় যাবে বা তার চারপাশে চলছে কী মহাযজ্ঞ--সব। তার চিন্তা আদ্যোপান্তে শেষ হওয়ার আগেই খণ্ড খণ্ড বিচ্যুতির বীজ দিয়েছিল ঢুকিয়ে! যেগুলো সে ভাবতে চায় না, যেগুলোর আবেগে, উচ্ছ্বাসে সে সুখ বা বিপন্ন বোধ করতে চায় না!
হানিফ লক্ষ করে দিন দিন তার বিগত দিনের কাছে সে কতটা অসহায় হয়ে পড়েছে! তারই ভেতরের কোনো এক ভিন্ন সত্তা তাকে পরিচালিত করে নিয়ে চলছে তারই ইচ্ছামত--যার সাথে তার আন্তরিক ইচ্ছার রয়েছে অনেক বিরোধ! হানিফ ভাবে সবার জীবনেও বোধহয় এমন ঘটে, সবাই বোধহয় জীবনকে নিয়ে যত সামনে এগিয়ে যায়, ততই সে শক্তি তার স্মৃতির মধ্যে ঢুকে তাকে পেছনে নিয়ে যেতে থাকে!
না, সে যে একেবারে পুলিশ বক্স খেয়াল করেনি, তা নয়। তার হয়ত ওই জটলা ভালো করে দেখবার ইচ্ছে করেনি; সন্ধ্যার অন্ধকারে ওইখানে দাঁড়িয়ে দেখবার সাহস তার হয়নি--হয়ত পুলিশের কাছে না ভিড়াটাই ভালো মনে করেছে সে। হয়ত পুলিশের পোশাক দেখে তার অস্বস্তিকর মনে হয়েছে, নোংরা মনে হয়েছে; হানিফ ঠিক জানে না ঠিক কী কারণে ওখানে দাঁড়ায়নি সে।
বাসার ঠিক কাছে মসজিদের সামনের একটি কিশোর প্রায়ই কলা বিক্রি করে, হানিফ পঞ্চাশ টাকায় ওর কাছ থেকে এক ডজন সাগর কলা কিনে। অথচ বাসায় তার কলার থেকে অনেক বেশি দরকার তরিতরকারি, মাছ-সবজির! মাছের কয়টা মাথা ফ্রিজে পড়ে রয়েছে; এছাড়া কোনো মাছ নেই; নেই একটু সবজিও। সারাদিন বাইরে না খেয়ে যে টাকাটুক সে সঞ্চয় করেছিল, বাসায় ফেরার পথে তাই খরচ করে বসলো হানিফ কলা কিনে! শুধু কলা দিয়ে ভাত তার পছন্দ হয় না; বাসায় দুধও নেই; রুটিও সে কিনে নেয়নি! রুটি কেনবার টাকা তার হয়ত ছিল, কিন্তু রুটি-কলায় খাদ্যের যে খরচটি তার হবে, সেই টাকায় তো এককেজি নলা মাছ কিনতে পারতো, দিব্যি এক সপ্তাহ চলে যেত তার! এছাড়া কলা-রুটি দিয়ে তো দুপুরে বা রাত কাটানো যাবে না!
হানিফ খাবার নিয়ে এত ভাবতে পছন্দ করে না; কলাগুলো দেখে তার খেতে ইচ্ছে হয়েছিল, আর দামও কিছুটা কম মনে হয়েছিল, অন্তত কিছুদিন আগের রোজা থেকে, তাই এগুলো তার কেনা। কলাগুলো কেবল আজকেই নয়, খেতে ইচ্ছে করেছিল রোজার আগে থেকেই, কিন্তু ৪০টাকা হালি কলা খাওয়ার কথা সে চিন্তা করতে পারে না।
কলা কিনে বাসার সিঁড়ি চড়তে চড়তে হানিফের মনে হয়, সে কি কলাগুলো আমের বিকল্প হিসেবে কিনেছে? আম কেনার সামর্থ্য নেই বলে কি কলা কিনে হানিফ সেই অপমানের শোধ নেয়ার চেষ্টা করেছে? যদি কলাগুলোও সে না কিনতো তাহলে কি নিজের সামেনেই আজ সে দরিদ্র হয়ে যেত? দরিদ্র হতে কি তার লজ্জা বোধ করে, সে কি তার সমস্ত সামর্থ্যে নিজের কাছে এটা বুঝাতে চায় সে দরিদ্র নয়? সাততলায় সম্পূর্ণ টাইল্স করা ফ্ল্যাটে থেকে কি এটা প্রমাণ করতে চায় যে সে দরিদ্র নয়, তার অভাব নেই?
দরজার সামনে এসে সে কিছুক্ষণ দাঁড়ায়--সাততলা পায়ে হেটে উঠার ক্লান্তি দূর করতে চায়; তারপর পকেটের মানিব্যাগ থেকে চাবি বের করার চেষ্টা করে। তবে মানিব্যাগটি নিয়ে তার চোখে পড়ে সেই কার্ডটি! হানিফ বুঝতে পারছে কার্ডসম্পর্কিত আগ্রহ, উদ্বেগ এবং সামান্য উত্তেজনাটি এখন অনুপস্থিত হয়ে পড়েছে; এখন আর এটি সঙ্গে রাখবার কোনো মানে নেই; কিন্তু তারপরও এটি সে ফেলেও দেয় না, এটিকে ফেলে দেবার আগ্রহও সে বোধ করে না; মানিব্যাগ থেকে, সেটিকে না ধরেই, ঘরের চাবিটা বের করে প্রবেশ করে। হানিফেরও এখন একটি ঘর আছে; অন্তত আছে থাকবার জায়গা, পথে পথে ঘুরে ঘুরে তাকে রাত কাটাতে হয় না এখন আর; ছাত্রাবাসের ছাদে, বেঞ্চিতে, বারান্দায, চেয়ারে ঘুমাতে হয়েছে অনেকদিন, কিন্তু এখন আর ঘুমুতে হয় না বলে সে সুখ বোধ করে। তবে ঘরের অবস্থা দেখে বোধহয় অসুখী হয় হানিফ। ফ্লোরে বালি কিচকিচ করছে, ঘরের যত্রতত্র গড়াগড়ি খাচ্ছে পুরোনো খবরের কাগজ, পুরোনো বাতিল সেন্ডেলগুলো পড়ে রয়েছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। হানিফ এগুলো কখনও গুছায় না, তবে এগুলো গুছানো দেখতে পছন্দ করে । তার মনে উঁকি দেয় সেই ঘরের যেখানে সবকিছুতে রয়েছে গুছগাছের নিপূণ ছাপ। একবার সে ইনডিয়ান হাইকমিশন ফার্স্ট সেক্রেটারির সাথে দেখা করতে গিয়েছিল তার ছেলেকে পড়ানোর আলাপ করতে। ভেতরে ঢুকে ছিমছাম, গুছানো পরিবেশ দেখে, আর এয়ারকন্ডিশানের পরিমিত শীতলতায় ভিজে অসাধারণ লেগেছিল তার; সিঁড়ি বেয়ে হানিফ যখন সেক্রেটারির কক্ষের দিকে যেতে থাকে তার দুপাশে চিত্র ও সূচিকর্ম আর কোনায় কোনায় পিতলের টবে রাখা ফুল গাছ তাকে মুগ্ধ করেছিল; আর দূর করেছিল পথে আসার সমস্ত ক্লান্তি! জীবনের অগণিত ক্লান্তির মাঝে এতটুকু সুখস্মৃতি হানিফকে একটি গুছানো ঘরের কথা প্রায়ই মনে করিয়ে দেয়।
হানিফ তবু আজও কিছু গুছায় না, কলাগুলো ডাইনিং টেবিলে রেখে, রেফ্রিজারেটর থেকে জল বের করে খায়, রান্নাকরা ভাত, আর ডাল বের করে। এই ভাতগুলো একবারে বরফজমা হয়ে আছে, ডালটাও গেছে বরফ হয়ে। এগুলো গরম করতে অনেক সময় লাগবে তার, চুলার জাল আস্তে আস্তে দিয়ে পনের বিশমিনিট সময় নিয়ে এগুলো গরম করতে হবে--বিশেষ করে ভাতটিকে খাওয়ার উপযোগী করতে কিছুক্ষণ পরপর ভাতগুলো নেড়ে দিতে হবে; তবে বাইরে থেকে এসে এত কষ্ট করতে তার ইচ্ছে করে না; মনে হয় কলাগুলো খেয়ে যদি রাত কাটিয়ে দেওয়া যেত! কিন্তু সে ঠিকই জানে কলা খেয়ে রাত কাটানোর ভয়াবহ পরিণাম! পরের দিনেও না খাওয়ার ভার তাকে তাহলে বইতে হবে। না, হানিফ রান্না না করার কথা ভাবতে চায় না। গ্যাসের দুটো চুলায় ভাত ও ডাল বসিয়ে, জাল কমিয়ে দিয়ে, স্নানে প্রবেশ করে। অবশ্য আজকের জলে ভিজতে তার কোনো স্মৃতি মনে পড়ে না; তার মনে পড়ে না, তার উলঙ্গ শরীরে সাবান মেখে দিচ্ছে কোনো বিবাহঅপেক্ষারত নারী; ঝামা দিয়ে ঘষে ঘষে, তার শত আপত্তি উপেক্ষা করে, তুলে ফেলছে দেহের বহুকালবব্ধ ময়লার আস্তরণ; তার ভেজা উত্থিত প্রত্যঙ্গে থেকে কেউ সাবধানে সরাচ্ছে না অপ্রয়োজনীয় ফেনা! কোলে তুলে জোড়াস্তনে মাথা চেপে ধরে অবিবাহিত-গন্ধে ভরে তুলছে না তার রাত-দুপুর! নূপুরের দিকবিদক শব্দে, যুবতী-আনন্দে গা থেকে গড়িয়ে পড়ছে না কোনো উষ্ণ জল! বরং চুলোয় বসানো ভাত আর ডালের নির্ভেজাল স্মৃতি তার স্নান সারিয়ে দেয় মুহূর্তে। না, কোনো ক্ষতি হয়নি তার সপ্তাহপুরানো খাবারের, আরো মিনিটদশ স্নানের স্নাপিকাদের সাথে কাটালেও তার বিশেষ কোনো ক্ষতি হতো না।
হানিফ আর কোনো রান্না করে না, হয়ত তার রান্নার ইচ্ছাও করে না; না করার প্রধান কারণ হযে থকতে পারে ডাল ওর খুব প্রিয়, কেবল ডাল দিয়ে একথাল ভাত সাবার করার ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা আছে তার। তার কৈশোরের সকালগুলো পান্তাভাত আর ডালের সংমিশ্রণে মুখর। বাসার সবাই যখন ঘুমিয়ে, সকালে উঠে হাতমুখ ধুয়ে রান্নাঘরে হানিফই নিজে ভাত নিয়ে খেতো। মা উঠে সকালের কোনো ভাজি করতে হয়ত বাজাতেন দশটা, কিন্তু ওতক্ষণ অনাবশ্যক অপেক্ষা করা হানিফের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এছাড়া পান্তাভাত আর ডালের অতুলনীয় বিন্যাস আর অনির্বচনীয় স্বাদের সম্মোহন তো ছিলই; হানিফ যেন প্রতিসকালে শুনতে পেতো রান্নাঘরে থাকা পান্তাভাত ও ডালের অনুক্ষেপনীয় আমন্ত্রণ। অবশ্য এই আমন্ত্রণ বহুকাল আর অনুক্ষেপনীয় মনে হয়নি হানিফের। তবে এটি যেহেতু তার স্মৃতির স্থায়ী অংশে প্রোথিত, তাই কৈশোরপর্বের বহু বছর পর হলেও, খাদ্যসঙ্কটকালে তার খাবার আগ্রহকে এখনো এটি মৃদুদোলা দিয়ে থাকে; এবং সেই দোলারই পৃষ্ঠপোষকতায় অলস রাতে কোনোকোনো দিন হানিফ কেবল ডাল আর পান্তার কাছাকাছি গরমভাতের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে, আর তৃপ্তি বোধ করে।
যখন বাহিরে ছিল বাসায় এসে কী কী করবে তার একটা পরিকল্পনা করে রেখেছিল হানিফ, কিন্তু ভাত খাওয়ার পর সমস্তদিনের ক্লান্তি যেন একজোট হয়ে তার উপর ভর করে বসলো! হানিফ এখন মনে মনে বাদ দেয় তার কম্পিউটারে বসে একরাশ কাজ করবার কথা। বরং তার একটু বিশ্রাম নিতে ইচ্ছে করে। হাত-পাসহ সম্পূর্ণ শরীর, এমনকি কি মস্তিষ্কও হানিফের নিস্তেজ হয়ে পড়ছে বলে মনে হয়; হানিফ তাই কম্পিটার না ছেড়ে টিভি ছাড়তে চায়; আর বিছানায় দু পা ছড়িয়ে হেলান দিয়ে টিভি দেখাতে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করে। বিছানাটিও তার সম্পূর্ণ অগুছালো। বিছানার যত্রতত্র পড়ে আছে বই, লেখার কাগজ, আইকা, নেইল কাটার, স্টেপলস, ভিজিটিং কার্ড, কলার ছোলা, ব্যবহৃত টিস্যু পেপার, বাসের টিকেট, মৃত তেলাপোকা, অগণিত বড়ছোট মাথার চুল; তারই ধার ঘেসে যাতায়াত করছে পিঁপড়ার সারি; তারা কোথা থেকে আসছে, কোথায় যাবে সে ঠিক জানে না। হানিফ পিপড়ার গন্তব্য খোঁজার চেষ্টা করে, এবং একসময় আবিষ্কার করে যে কম্পিউটারের পাশে যে স্পিকারটি আছে সেখানেই যাওয়া পিপড়াগুলোর লক্ষ। ওখানে কী থাকতে পারে তা হানিফ ভাববার চেষ্টা করে। স্পিকারের যে ছিদ্রটা আছে ওখানে কি তেলাপোকা বাসা বেধেছে? নাকি যে ডায়নোসরের বংশধরটি এতদিন তার থেকে বের হয়ে পিপড়া শিকার করতো, আজ তার মহাপ্রয়াণ ঘটলো! আর সেই সুযোগে আশপাশের সমস্ত পিপীলিকার দল মরিয়া হয়ে দলে দলে মিছিল করে যাচ্ছে সেইখানে স্বজাতিবধের প্রতিশোধ নিতে। যাই হোক হানিফের আর ভাবতে ইচ্ছে করে না, সে শুধু একটু উদ্বিগ্ন হয় তার বিছানার গা ঘেঁষে যেহেতু পিঁপড়ের দল অভিযান চালিয়েছে, এই অভিযানের আক্রমণ তাকেও কিছুটা পোহাতে হয় কিনা! কিন্তু ততক্ষণে টিভিতে কারিনা কাপুর তার যৌবনজ্বালায় দিশেহারা; তার গা বেয়ে বেয়ে ও ছিটকে ছিটকে পড়ছে অসহিষ্ণু যৌবনজল! হানিফ গত চোদ্দ বছর ধরে এভাবে কারিনার যৌবন ছিটকে পড়তে দেখছে বিধায় এখন আর কাম অনুভব করে না, কোন আনাড়ি নায়ক যখন কারিনার নগ্ন দেহ দেখানোর জন্য এক এক করে কারিনার গা থেকে কাপড়গুলো সরিয়ে নিচ্ছে, তখনও হানিফ লক্ষ করে তার প্রত্যঙ্গটি একেবারে নিস্তেজ! আচমকা হানিফের সেই বাসে পাওয়া কার্ডের কথা মনে পড়ে! তাহলে কি আসলে সে যৌন অক্ষমতায় ভুগছে! ক্লান্ত দেহে হটাৎ শক্তি খুঁজে পায় হানিফ, সে মানিবেগের পকেট থেকে কার্ডটি বের করে একটি নাম্বারে ফোন দেওয়ার কথা ভাবে; তার জানা দরকার এইভাবে কারিনাকে দেখে উনার নিস্তেজ থাকাটা কি কোনো অক্ষমতার মধ্যে পড়ে কি না! হানিফ শুনতে পায় ফোন বেজে চলছে, একের পর একটা লম্বাটানে অগ্রসর হচ্ছে কলারটিউন। না ফোনটি কেউ ধরে না, হানিফ কিছুটা বিস্মিত হয়, আবার ফোন দিতে থাকে; এবার একজন ঘুমকাতর নারীকণ্ঠ শুনতে পায় হানিফ! হানিফ কথা না বলে নাম্বারটি দেখবার চেষ্টা করে যে ঠিক আছে কিনা! এবং এরই মধ্যে ‘হ্যালো’ বলে উঠে। জবাব আসে ‘কী চান?’। হানিফ একটি বিব্রত বোধ করে, কিন্তু সাহস করে বলে,
‘এটা কি হিমালয় বনৌষধী হারবাল সেন্টার?’
উত্তর আসে, ‘আপনের কী দরকার?’
হানিফ বলে, ‘আমি একটা সমস্যায় সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিলাম!’
জবাব আসে, ‘এখন বাজে কয়টা?’
হানিফ ঠিক জানে না এখন কয়টা বাজে, সময়ের সাথে তার সমস্যার কী সম্পর্ক তা সে বুঝতে পারে না; সে তার সমস্যাটি বলতে যায়, কিন্তু তাকে থামিয়ে নারীকন্ঠটি বলে, ‘রাইত ১২টায় আপনের সমস্যার কথা মনে হইলো?’
হানিফ একটু বিব্রত বোধ করে, চায় ফোন রেখে দিতে, কিন্তু একটি নারীর কাছে এভাবে অপদস্থ হতে চায় না বলে সাহস করে বলে, ‘সমস্যাটি মাত্রই টের পেলাম!’
‘হুননের টাইম আমার নাই, আপনে সকালে ফোন দিয়েন’ বলে মহিলাটি ফোন রেখে দেয়!
হানিফ একটু আহত বোধ করে। বিশেষ করে সেই নারীকণ্ঠের ধরনে যেই রুক্ষতা সে টের পায় তা সে প্রত্যাশা করেনি! তার এখন অস্বস্তি লাগে এমন একটি স্থানে কিছু না ভেবেই কল দিতে গিয়েছে বলে।
ওদিকে রাত বারটা যখন অতিক্রান্ত, টিভিতে কারিনা যখন আর মগজে অনুরণের পাত্রী হবার অযোগ্য হয়ে পড়েছে, সমস্ত দিবসের ক্লান্তি, অবসাদ নিয়ে হানিফ যখন নিষ্ক্রিয়প্রায়, তারউপরে একটি ফোনের এমন ব্যর্থতা হানিফকে আর জেগে থাকতে দেয় না।হানিফ প্রায়ঘুমিয়ে পড়ে; তবে এখনও তার মগজটিকে কাজ করতে দেখা যায় তার হাতের পরিচালন দেখে: হয়ত মশাদের কামড় থেকে নিজেকে মুক্ত করার ব্যর্থ চেষ্টায় ওটি নিয়োজিত। হানিফ তারপরও টের পায় এই কামড়গুলো ঠিক মশার নয়, গুণগুণ আওয়াজ তেমন শুনা যাচ্ছে না, সে টের পাচ্ছে তার শরীর বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে পিঁপড়ার দল। হানিফ কিছুক্ষণ পরপরই ডলে মারার চেষ্টা করছে ওদের কিন্তু একের পর এক অনিয়মিত কামড়ে সে ঘুম নিয়েই বিছানায় উঠে বসে; ঘরের আলো তখনও জ্বলছে, বিছানায় তাকেয়ে হানিফ খুঁজবার চেষ্টা করে আসলে পিঁপড়া নাকি অন্য কিছু!
অন্যকিছু হলে কী-ই বা হতে পারে তা হানিফ জানে না--অতিলৌকিক কিছু ভাববার মত মানসিকতা তার নেই; তাই লৌকিক নিয়মে কী হতে পারে তা হানিফ বুঝবার চেষ্টা করে। হুম্ পিঁপড়াই; ঘুমের ঘোরে যে-কয়টা মশা মেরেছিল হানিফ, সেই শবদেহগুলোর অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া সম্পাদন করতেই তাদের আগমন। আর পুণ্যকাজে বাধা সৃষ্টিকারী হানিফকেই তাই কিছু প্রতিবাদ সহ্য করতে হয়েছে। প্রাণিজগতের অমোঘ বৈশিষ্ট্যটি হানিফের কাছে আবার ধরা পড়ে: যে যাকে পারছে, যখন পারছে, যেভাবে পারছে তখনই খাদ্য হিসেবে তাকে রূপান্তিরিত করতে তাদের বাধছে না! শুধু ভিন্নজাতি নয়, স্বজাতি হত্যা করে খাদ্যের উৎসব করাই এদের ঐতিহাসিক চিরায়ত বৈশিষ্ট্য; এতে কোনো রাখঢাক নেই, কোনো অভিযোগ নেই, নেই মিথ্যাপ্রতিশ্রুতির কোনো দণ্ড; প্রত্যেকটি প্রাণিই তা বুঝে! কিন্তু হানিফ বুঝে না মানুষই কি তা বুঝতে পারে কিনা! মানুষ নিশ্চই বুঝে ভালো করে,--একসময় তো ঠিকই বুঝতে হতো তাকে; তার জীবনযাপন যখন অন্যান্য প্রাণির সাথে প্রত্যেক দিনে ও রাতে সাংঘর্ষিক হতো, তখন কি সে বুঝতো না? একটি নবজাতক যেভাবে বুঝে, এবং সবসময় স্মরণ করিয়ে দেয় তার অস্তিত্ব কীভাবে তার দিবারাত্রির বেঁচে থাকার সাথে সাংঘর্ষিক, ঠিক তেমন করেই কিশোর, তরুণ, যুবক, বয়স্ক--সবাই বুঝতো একদিন! কিন্তু এখন সবাই বুঝে না বলে হানিফের মনে হয়! অন্ততপক্ষে যে বয়সটি সে পার করে এসেছে কয়েকবছর আগে, সে বয়সটি বুঝে না এসব--এমনই এখন মনে হয় হানিফের। এই বয়সটির আগের বয়সটিতে কি সে বুঝতো--ঘুমঘোর কেটে গেলে হানিফ তা ভাবতে শুরু করে। অবশ্য ঘুম আর জাগরণ কিছ্ইু হানিফের এই চিন্তাপ্রক্রিয়াকে থামাতে পারে না; পারেনি বহুদিন; স্বপ্নের মধ্যেও হানিফের ভাবতে পারার বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে! যখন কোনো দমবন্ধকরা পরিস্থিতি হানিফের চারপাশে ঘনিয়ে আসে, বা যখন সে দেখতে পায় সে শুধু ভাগছে আর ভাগছে, প্রাণপণে ছুটছে দিকবিদিক, কিন্তু খুব দূরে সরে যেতে পারছে না তার বিপদ থেকে--তখনও সে ভাবে; তখনও সে ভাবতে পারে যে এই বিপদগুলো বাস্তব নয়, এই অন্ধকার নয় যাবজ্জীবনের জন্য! একটু পরেই তার ঘুম ভাঙবে, এবং সে দেখতে পাবে সে যেমনটি ছিল তেমনই আছে। কোথায়ও কোনো ক্ষতি হয়নি। তার দমবন্ধ হওয়া ফুসফুস থেকে বাতাস বেরুচ্ছে, কিছুমুহূর্ত আগেও যেটিকে দেখতে পেয়েছিল সে স্থবির!
হানিফ ভাবে নবজাতকের প্রথম বেঁচে থাকার চেষ্টার পর যখন থেকে তাকে তার দাবিগুলো নিজের উপস্থাপন করতে হয় নি, অর্থাৎ তার দাবিগুলো দাবি হয়ে উঠবার আগেই তার হয়ে কেউ না কেউ পূরণ করে দিয়েছে তখন থেকেই আর অন্যান্যর মত করে এই দৈনন্দিন সংগ্রামের মানসিকতা থেকে সে বিচ্যুত হয়ে পড়েছিল; কিছু সময়ের জন্য জীবনের মর্মার্থকে এমনভাবে উপলব্ধি করা শুরু করেছিল যা আসলে মোটেই ব্যবহারিক নয়! হানিফের মনে আসে সে বয়সে তার দেখা স্বপ্নগুলো: কীভাবে তার স্বপ্নগুলো বাস্তবের চেয়েও বেশি বাস্তব ছিল তার কাছে; কীভাবে সে নিজের স্বপ্নে আলোড়িত হতে হতে অন্যদেরও স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিল তার মতো করে! জগতের সব উজ্জ্বল রঙ; জগতের সব আলো তার মধ্য দিয়ে, তার মধ্য থেকে ছিটকে পড়েছিল, উৎসারিত হয়েছিল তখন! অন্ধকারও তার কাছে মোহনীয় মনে হয়েছিল, অন্ধকারের ক্ষুদ্র কোটরের মৃদু আলোও তার পড়েছিল চোখে; সেই আলোয় পথ চলতে দিব্যি তার সমস্যাই হচ্ছিল না; হানিফ তখন টের পেয়েছিল অত্যন্ত সংবেদন বেদনাও--প্রাণিজগতে যার আলোড়ন হয় খুব সামান্য;--কেবল নিজের নয়, আর সমস্তেরও--যার প্রাণ আছে, যার প্রাণ নেই;--সে বেদনায় সে কেঁপে উঠেছিল থরথর; বুক ঘনঘন আবেগে মোচড়ে উঠেছিল তার;--উঠেছিল কেবল? এখন কি উঠে না, হানিফ ভাবে। হানিফ দেখতে পায় মোচড়ের বেগে আবেগগুলো তার ভিতরে লুটোপুটি খায়; সে দেখতে পায়, বুঝতে পারে, অনুভব করে তার প্রতিটি রোমকূপ বেয়ে সে আবেগগুলো গড়িয়ে পড়ছে। সে নীল হয়ে উঠছে তারই বেদনায়!
কিন্তু আজ যখন আবারও সেই দৈনন্দিন সংগ্রামের প্রাকৃত মানসিকতকার বাস্তবতায় তাকে উপস্থিত করা হলো, বুঝিয়ে দেওয়া হলো সেই স্বপ্নের জগতটিকে বাস্তবে কল্পনা করতে নেই; রূপকথার পরী ও মৎসকন্যারা কেবল গল্পের অবয়বে আসে আর যায়, তখন হানিফ টের পেলো সে একবারে অপ্রস্তুত এই জগতের কাছে! ছেলেবেলায় স্কুলে দৌড় প্রতিযোগিতায় জোর করে তাকে দাঁড়িয়ে দেওয়া হলে যেমনটি সে অপ্রস্তুত ছিল, প্রাণপণে দৌড়িয়ে দৌড়িয়ে সে নিজেকে আবিষ্কার করেছিল যে সে সব থেকে পেছনে, আজও ঠিক তেমনি হানিফ নিজেকে উপলব্ধি করে!
অস্তিত্বরক্ষার এই ভাবনাগুলো সম্পূর্ণ করতে হানিফের মুহূর্ত লাগে; হানিফের শুয়ে থাকা থেকে উঠে বসতে যতক্ষণ লাগে, ঠিক ততটুকু সময়! মাঝে মাঝে তার থেকেও কম সময়ে এইসমস্ত চিন্তাসহ তার জটিলতাগুলো হানিফের মস্তিষ্কে ভাসে। সে এতবার এগুলো ভাববার সুযোগ পেয়েছে, এবং শুধু ভাবনা নয়, একএকটি মুহূর্তের অগ্রসরতার সঙ্গে সঙ্গে তার এই চিন্তাগুলো পুঞ্জিভূতও হয়েছে ও প্রসারিতও হয়েছে;--এর জন্য আলাদা করে সময় তাকে ব্যয় করতে হয়নি! যখন দৈনন্দিন সময়ের ব্যস্ততা থেকে সে একটু অবসরে যায় তখনই তার সকল উপলব্ধি, অনুভূতি, জীবন সম্পর্কিত তার অনুসিদ্ধান্তগুলো, কিছু মুখ, কিছু কথা, কিছু অপমান, কিছু ভালোবাসা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরে! কবে কোন দোকানি তাকে অপমান করেছিল, কবে সে খেয়েছিল কার চর, কবে তার পাগুলোতে এলাপাতাড়ি আক্রমণে একটি একটি করে খেলার স্ট্যাম্প ভেঙে পড়েছিল কোন পাহাড়ে; কবে স্ফীত স্তনে মাথা চেপে শ্বাস বন্ধ হয়ে পড়েছিল তার; কবে কোন সন্ধ্যায়, কংক্রিট ঘেরা নীরবতায়, কে কপোলে আলতো করে চুমু দিয়ে ধরিয়েছিল কাঁপন; কার যোনিরস কবে পান করে সে পড়েছিল অসুস্থ হয়ে! কবে কোন শিক্ষককে তার মনে হয়েছিল শুয়রের বাচ্চার মতন! এগুলো হানিফের মনে আসে, বারবার আসে, সে থামাতে চাইলেও আসে, তার ভালো না লাগলেও আসে। তার মনে আসে খুব বিশৃঙ্খল, খুব অপরিণত, খুব অপূর্ণ, খুব অংসবৃত, খুব খণ্ডখণ্ডভাবে। তার কখনো মনে আসে তার অবিবাহিত মায়ের মুখ যাকে তার কখনও দেখবার কথা নয়; চোখে পড়ে তার মায়ের সুপারি বাগানে গণ্ডার পর গণ্ডা সুপারি কুঁড়িয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলে তাঁর বাড়ি ফেরার দৃশ্য; অথবা কোনো বাদলপ্রাতে তিনি আম কুঁড়াচ্ছেন; তারপর দাদুর মার থেকে বাঁচার জন্য লুকিয়ে রয়েছেন সিলিঙে। কখনো হানিফ দেখতে পায় তার আট বছরের নিজেকে তার পঁচিশ বছরের নিজের সাথে হেটে হেটে কথা কয়ে যাচ্ছে তিতাসের পারে, মেঘনার চরে। কখনো সে দেখতে পায় তার বাবাকে পান চিবুতে চিবুতে শীতলক্ষার কোনো মাছকে ডাঙায় তুলতে যুদ্ধ করতে; আর তার পাশে দাঁড়িয়ে কিশোর হানিফ সেই যে আনন্দে লাফানো শুরু করেছিল তার লাফানো থামেনি এখনো! পরক্ষণেই দেখে তার বাবার মৃত মুখ--মরার আগে তাকে জড়িয়ে ধরে ভেঙে পড়বার দৃশ্য! ফুসফুসে কীট নিয়ে যে মামা বহু বছর আগে হাড্ডিসার অবস্থায় একা অসহায়ের মত বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল হানিফের পিতার ঘাড় ধাক্কায়, চলে যেতে যেতে হানিফকে বলে গিয়েছিল, ‘মামা, আরেকবার আসলে তোমাকে একটা জামা কিনে দেব কেমন’, যে কথা শুনে হানিফ ভেঙে পড়েছিল পথে--সেগুলো হানিফের মনে পড়ে! কিছু জীবনের অনেক খণ্ডখণ্ড সুখ, বিস্তৃত অনেক ব্যথা, নিজের কথা, সঙ্গে অনেকের, বা গুল্পে পড়া কোনো পাত্র বা বিশেষ কোনো পাত্রীর মুখ তার চোখে এভাবেই ভেসে উঠে মুহূর্তের পরিসরে! প্রতিটি মানুষ হানিফের জীবনে অসংখ্য প্লট নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার অবয়ব ঘিরে! যাদের একএকটি প্লটে এক একটি অবয়বে একবার ভাসতে দেখলেই মুহূর্তেই হানিফের পুরো ঘটনা মনে পড়ে! ঘটনার ফাঁকে ফাঁকে মনে পড়ে এর আনন্দ ও বেদনা!
এরই মধ্যে হানিফ তল পেটে খুব ব্যথা অুনভব করলে বিছানা ছেড়ে টয়লেটে পা বাড়ায়। খুব মনযোগে কমোডে প্রস্রাবের রঙ ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে; না, আজ তেমন একটা জল খাওয়া হয়নি তার, প্রস্রাব হলুদ হয়ে পড়েছে বেশ; এভাবে চললে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রত্যঙ্গটিতে টনটন ব্যথা শুরু হয়ে যাবে! এখন প্রায়ই জল খাওয়া হয় না এতটা তার; জল খাওয়ার অভ্যাস এতটা তার ছিল না কখনো। যাকে সে ভালোবেসেছিল বার বছর আগে: সেই লক্ষী মেয়েটি, সেই বোকা মেয়েটি যে তাকে ভালোবাসা দিয়েছিল তার মায়ের মত করে তার জল খাওয়ার অভ্যাস করেছিল অনেক; যখন দূরে থাকত, ফোনে কেবল বলতো ‘জল খাও, জল খাও, জল খাও। জল খেয়েছো বাবু?’, ফোনে অস্থির হয়ে হানিফ বলত ‘জলই তো খাই, তোমাকে খাব, আস’। খুশি হয়ে ঝরে পড়তো সেই মেয়েটির হৃদয় থেকে পিপাসার জল, হানিফ ফোনের এই প্রান্তে বসে সেই জল খেয়ে তার তৃষ্ণা মেটাত! এখন অবশ্য হানিফকে কেউ বলে না ‘জল খাও’, এখন হানিফকে বলতে হয় না, হানিফই ঘনঘন জল খেয়ে নেয়। যখনই জল খায় তখনই সেই লক্ষী ময়েটির জল খেতে তাগাদার কথা তার মনে পড়ে; হানিফ সেই তাগাদা উপেক্ষা করে না! কিন্তু আজ বাইরে বেশ ঘাম ঝড়েছে তার, সেই পরিমাণে বাইরের জল কিনে সে খায়নি--একান্ত না পারলে বাইরে থেকে জল কিনে খাওয়ার অভ্যাস তার নেই; তাই আজ বেশি সময় যখন সে বাইরে ছিল পর্যাপ্ত জলের যোগান হানিফ দিতে পারেনি তার শরীরকে! তাই প্রস্রাব সেরেই তার মগটিতে চিনির শরবত বানিয়ে খেয়ে নেয় হানিফ। এই মগটি সেই লক্ষী মেয়েটিরই কিনে দেওয়া--প্রায়দশ বছর ধরে এই মগটি করেই হানিফ জল খেয়ে আসেছে; এর ডাণ্ডাটি ওর হাত থেকে পড়েই বেসিনে ভেঙে গিয়েছিল ছাত্রাবাসে থাকতে! সেদিন ফোনে বলেছিল মেয়েটিকে খুব দুঃখ করে; মেয়েটি তাকে আদরে আদরে ভরে তুলে আরেকটি কিনে দেবে বলেছিল! সব কিছুতই আদর করতো মেয়েটি; ব্যথা পেলে, ব্যথা না পেলে, কিছু ভেঙে গেলে, কিছু হারিয়ে গেলে, কোনো কথা মনে না আসলে, ঘুম পেলে, ঘুম না পেলে, ক্লাস করতে ইচ্ছে না করলে, টিউটোরিয়াল দিতে না চাইলে, ক্ষুধা পেলে, পছন্দের কিছু খেতে চাইলে, বই পড়লে, কবিতা লিখলে, বেশি রাত জেগে থাকলে, সকালে ঘুম থেকে উঠতে না চাইলে খুব খুব আদর করে দিত মেয়েটি। ও আদর করত কথায়, আদর করত নিঃশব্দে, ও আদর করত কেঁদে, আদর করত বকে, আদর করে দিতো সারা মুখে ক্ষুদ্রক্ষুদ্র চুমুতে, কোলে নিয়ে, বুকে জড়িয়ে, চুলে মাখিয়ে; আদর করত ঘরের বাতাসগুলোর মধ্যে ওর আদর মিশিয়ে দিয়ে, হানিফের নাসারন্ধ্রে ওর বুকের মাদকভরা সুগন্ধ ছড়িয়ে দিয়ে; ও তাকিয়ে আদর করতো; ও আদর করতো না তাকিয়ে; ও মুখে খাবার তুলে দিয়ে আদর করতো; আদর করতো নিজে খাবার খেতে চেয়ে; কখনো ও খাবার চিবিয়ে দিয়ে হানিফকে খাইয়েছে পাখিরা যেভাবে তার সন্তানদের মুখে মুখ ঢুকিয়ে খাওয়ায়! হানিফের মনে পড়ে সে যখন ঘুমিয়ে পড়তো, তার পাশে শুয়ে তার বালিশ ঠিক করে দিত মেয়েটি-- কোথাও উঁচুনিচু হয়ে হানিফের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে কিনা, কোথাও হানিফের পা রয়েছে কিনা ভাঁজ হয়ে, হাতটুকু পেঁচিয়ে রয়েছে কিনা কোথাও অসাবধানে, নিশ্বাস ছাড়তে গায়ের কাঁথা কোথাও কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে কিন!
হানিফ এই আদরগুলো থেকে দূরে পড়ে আছে আজ দু বছর; এর আগেও এই আদরগুলো হানিফ উপলব্ধি করতো; হানিফ জানতো এই আদরের কতটুকু মূল্য তার কাছে; কিন্তু মেয়েটি কি এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল আদর করতে করতে? বা কি সে নিজে? আদরেরও যে উপবাস হয়--হানিফ কি তখন তা জানত না!
হানিফ এইবার খুব অস্থির হয়ে উঠে! বিছানায় নয়, চেয়ারে নয়,অন্ধকারে নয়, আলোতে নয় কোথাও তার ভালো লাগে না; তার মাথা পেছন থেকে ধরে উঠে, হৃৎপিণ্ডের গতিবিধি হটাৎ দ্রুত হয়ে উঠে; হানিফের মনে হয় এখন যদি ছাদের রেলিং থেকে সে ঝাপ দিয়েও পড়ে তার স্বস্তি হবে না; তবুও হানিফ চেয়ারে বসবার চেষ্টা করে। তার নিজের অস্থিরতায় বিচলিত হতে সে চায় না; তার মনে হতে থাকে তার মাথা তাপে ফেটে পড়বে এখনই; হানিফ টের পায় তার জীবনের নানা স্মৃতিগুলো আরো বিশৃঙ্খল হয়ে উঠেছে, আরো সূত্রহীন পড়েছে, হয়ে পড়েছে আরো অস্পষ্ট, আরো অসংলগ্ন। সে চেষ্টা করেও তার মধ্যে ঢুকতে পাচ্ছে না, তা থেকে বেরুতে পারছে না। সে টের পাচ্ছে তার শরীরটি হয়ে পড়েছে অনুভবহীন মাংসস্তুপের সমষ্টির মত! এই অবস্থা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হানিফের খুব চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে, খুব কিছু একটা মারাত্মক--যা করার সঙ্গে সঙ্গে তার এই অস্থিরতা কিছুটা লাঘব হবে। না হানিফ এর কিছুই করতে পারে না; তার চোখ বেয়ে জল পড়ছে কেবল; তার কণ্ঠনালি থেকে, তার নাক থেকে, তার মুখ থেকে গরগর করে বেরুতে থাকে জল!
এখন আর অন্য কোনো কিছুই হানিফের মনে আসে না। তার মায়ের কিশোরী মুখ, বাবার মৃত্যুন্মুখ চেহারা, ছেলেবেলার খেলার সাথী, নদীর জল, ভেসে ওঠা চর, প্রচণ্ড অপমান, খণ্ডখণ্ড সুখ, কোনো নারীর অনাবৃত স্তন, কোনো প্রিয় বন্ধু বা মৃত জন--কিছুই না। সারাটি দিন ধরে যেগুলো হানিফকে শত মানুষের ভিড়ে ব্যস্ত করে রাখে--তার সব এখন অনুপস্থিত!

হানিফ নিস্তব্ধ রাতের মত ক্রমশঃ একলা হতে থাকে।




০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রোড জ্যাম ইন ভিয়েতনাম

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৭



আমার ধারনা ছিল জটিল জ্যাম শুধু বাংলাদেশেই লাগে । কিন্তু আমার ধারনা ভুল ছিল । ভিয়েতনামে এরকম জটিলতর জ্যাম নিত্য দিনের ঘটনা । ছবিটি খেয়াল করলে দেখবেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেভাবে শরণার্থীরা একটি দেশের মালিক হয়ে গেলো!

লিখেছেন মাঈনউদ্দিন মইনুল, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২৬



এবার একটি সেমিনারে প্রথমবারের মতো একজন জর্ডানির সাথে পরিচয় হয়। রাসেম আল-গুল। ঘনকালো মাথার চুল, বলিষ্ট দেহ, উজ্জ্বল বর্ণ, দাড়ি-গোঁফ সবই আছে। না খাটো, না লম্বা। বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। প্রতিটি সেশন... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×