বাবা-মা ও একটি পরিবারের জন্য গর্ভধারণ ও শিশুর জন্ম সচরাচর আনন্দের সময়। কিন্তু অনেক দেশ এরং জনগোষ্ঠীর জন্য মারাত্নক ঝুঁকির সময়ও বটে। বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন প্রায় দেড় হাজার নারী মারা যাচ্ছে গর্ভ ও প্রসবকালীন জটিলতায়। ১৯৯০ সালের পর থেকে বিশ্বজুড়ে হিসাবকৃত মাতৃমৃত্যুর বার্ষিক সংখ্যা ৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে-এর ফলে গত ১৯ বছরে মাতৃমৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ কোটি।
শিল্পোন্নত দেশ এবং উন্নয়নশীল অঞ্চলগুলোর মধ্যে,বিশেষ করে স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে অন্য যেকোন রোগজনিত মৃত্যুহারের সাথে মাতৃমৃত্যুর হারের ব্যবধান সম্ভবত সবচেয়ে বেশি। আর এই দাবিটি করা হচ্ছে সংখ্যাগত দিক থেকেই। ২০০৫ সালের উপাত্তের ভিত্তিতে দেখা গেছে,স্বল্পোন্নত একটি দেশে একজন নারীর গর্ভ বা প্রসবকালীন জটিলতার কারণে মৃত্যুর মতো আজীবন ঝুঁকি শিল্পোন্নত দেশে বসবাসকারী একজন নারীর চেয়ে ৩০০ গুণ বেশি। অন্য কোন কারণে মৃত্যুর হার এতটা অসমান নয়। আরও বিশদ ভাবে বলতে গেলে, গর্ভকালীন আঘাত,সংক্রমণ,রোগ এবং পঙ্গুত্বের পরিণতি লাখ লাখ নারী যারা সন্তান জন্ম দিয়ে বেঁচেও যায়,তাদের জীবনভর বয়ে বেড়াতে হয়।
জীবনের একেবারে শুরুর দিনগুলো একটি শিশুর জন্য খুবই নাজুক থাকে। সামপ্রতিক বছরগুলোর হিসাবে দেখা গেছে,অনূর্ধ্ব-৫ বছর বয়সী শিশু মৃত্যুর শতকরা প্রায় ৪০ ভাগই ঘটে থাকে জন্মের ২৮ দিনের মধ্যে। ২০০৪ সালে পাওয়া সর্বশেষ হিসাবে এই সংখ্যা ছিল ৩৭ লাখ। এর এক তৃতীয়াংশই আবার ঘটে জন্মের সাতদিনের মধ্যে,একেবারে নবজাতক পর্যায়ে। মৃত্যুর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি থাকে জন্মের প্রথম দিনটিতে, শতকরা ২৫ থেকে ৪৫ ভাগ নবজাতকের মৃত্যু ঘটে এই সময়েই। নবজাতক মৃত্যুর ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবার মানগত ব্যবধানের বিষয়টিও সুস্পষ্ট। স্বল্পোন্নত দেশে জন্মানো একটি শিশুর তুলনায় ১৪ গুণ বেশি।
আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশে শিশু মৃত্যুর পাশাপাশি মা ও নবজাতকের মৃত্যুর আনুপাতিক হারও অত্যন- বেশি। এ দুটি মহাদেশে পৃথিবীর শতকরা ৯৫ ভাগ মা এবং প্রায় ৯০ ভাগ নবজাতকের মৃত্যু হয়। দেশগুলোর অভ্যন-রে সামাজিক অসমতাও অনেক বেশি, বিশেষ করে দারিদ্র্যের ক্ষেত্রে। ১৯৯৫ থেকে ২০০২ সালের মধ্যে পরিচালিত জনসংখ্যা ও স্বাস'্য জরিপে দেখা গেছে, এসব অঞ্চলে শতকরা ২০ ভাগ দরিদ্রতম পরিবারে নবজাতক মৃত্যুর হার সবচেয়ে ধনী পরিবারগুলোর তুলনায় শতকরা ২০ থেকে ৫০ বেশি। মাতৃমৃত্যুর ক্ষেত্রেও একই ধরণের অসমতা বিদ্যমান।
মা ও নবজাতক মৃত্যুর কারণগুলো আজ সুবিদিত। প্রসবকালীন জটিলতা-যেমন,প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণ, সংক্রমণ,খিঁচুনি এবং বিলম্বিত বা বাঁধাপ্রাপ্ত প্রসব এবং গর্ভপাতের জটিলতাই অধিকাংশ মাতৃমৃত্যুর অন্যতম কারণ।
ম্যালেরিয়া,এইচআইভি এবং অন্যান্য অবস্থা রক্তশূণ্যতার কারণ ঘটায় এবং অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেয়। বিভিন্ন ধরণের সংক্রমণ(যেমন-পচন/নিউমোনিয়া,ধনুষ্টংকার ও ডায়রিয়া), শ্বাসকষ্ট ও নির্ধারিত সময়ের আগেই জন্ম হচ্ছে নবজাতকদের জন্য সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য ঝুঁকি। এই তিনটি প্রধান কারণেই শতকরা ৮৬ ভাগ নবজাতকের মৃত্যু ঘটে থাকে।
তবে মানসম্মত প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা,প্রসবপূর্ব সেবা,প্রসবকালে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সহায়তা, জরুরি ধাত্রীসেবা এবং প্রয়োজন নবজাতকের প্রসব-পরবর্তী সেবা,পর্যাপ্ত পুষ্টি,মা ও নবজাতকের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত সেবাগুলো সম্পর্কে শিক্ষা--এ ধরণের অত্যাবশ্যকীয় পদক্ষেপগুলো গ্রহণের মাধ্যমে উপরিল্লিখিত অবস্থাগুলো প্রতিরোধ অথবা নিরাময় সম্ভব। গবেষণায় দেখা গেছে,আবশ্যিক মাতৃস্বাস্থ্যসেবা এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নারীর কাছে পৌঁছে দিতে পারলে মাতৃমৃত্যুর হার শতকরা ৮০ ভাগ কমিয়ে আনা সম্ভব। মাতৃকালীন উন্নত পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং টীকা গ্রহণ,পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন প্রসব এবং নাড়ি কাটা ও সঠিক যত্ন নিশ্চিত করতে পারলে শতকরা ৩৬ ভাগ নবজাতক মৃত্যুর কারণ হিসেবে বিবেচিত সংক্রমণনমূহ কমিয়ে আনা সম্ভব।
মা ও নবজাতকের মৃত্যু এবং রোগগ্রস্ততার প্রত্যক্ষ কারণসমূহের সঙ্গে পারিবারিক,লোকালয় ও জেলা পর্যায়ে আরও অসংখ্য অন-র্নিহিত কারণ আছে,যেগুলোর কারণে মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্য ও বেঁচে থাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এ সকল কারণের মধ্যে রয়েছে, কিশোরী ও অল্প বয়সী নারীর শিক্ষা ও জ্ঞানের অভাব, ছেলেদের তুলনায় এরা এখনও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাইরে রযেছে,পুষ্টিকর খাবার এবং অত্যাবশ্যকীয় ক্ষুদ্র পুষ্টিসম্বলিত খাদ্যউপাদান এখনও এদের নাগালের বাইরে। এই নারীদের স্বাস্থ্য সেবা অপর্যাপ্ত ও সীমিত। এছাড়া দারিদ্র্য, সামাজিক বিধিনিষেধ,নারী-পুরুষে বৈষম্য এবং রাজনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার মতো আরও কিছু মৌলিক প্রভাবক মা ও শিশুর মৃত্যু ও রোগগ্রস্ততার অন-র্নিহিত ও প্রত্যক্ষ কারণসমূহকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে।
উন্নয়নশীল বিশ্ব জুড়ে যেসব কারণ মা ও নবজাতকের বেঁচে থাকা এবং স্বাস্থ্যকে বিপন্ন করে তুলছে সেগুলো সেবার ধারাবাহিকতার প্রয়োজনকে আরো বেশি করে প্রতিষ্ঠিত করে। যা কিনা মা ও শিশু জীবনের জটিল মুহূর্তগুলো (বয়ঃসন্ধি, প্রাকগর্ভাবস্থ, গর্ভাবস্থা, প্রসব, সদ্য-প্রসূতকাল, প্রসব-পরবর্তী, নবজাতক, প্রাক-শৈশব ও শৈশবকাল)সময়মতো এবং মা ও শিশুর সহজগম্য জায়গাগুলোতে অত্যাবশ্যকীয় সেবা প্রদানে গুরুত্ব আরোপ করে।
ধারাবাহিক সেবা জোরারোপ করে যে, একজন নারী গর্ভাবস্থায় এবং সন্তান প্রসবকালে নিজ স্বাস্থ্য ও জীবন, সেইসঙ্গে তার শিশুকে ধারণ করার কতটা ক্ষমতা রাখে তা নির্ভর করে বয়ঃসন্ধিকালের শুরু থেকে সে কতটা সেবা,দক্ষতা ও সুরক্ষা পেয়েছে। সুস্বাস্থ্যের অধিকারিণী যেসব নারী গর্ভাবস্থায়,তার আগে ও পরে পর্যাপ্ত পুষ্টি,মানসম্মত প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা এবং মাতৃকালীন সেবা ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পেয়েছে--তারাই সাধারণত সুস', সবল শিশুর জন্ম দিয়ে থাকে। একইভাবে বিশেষবাবে প্রতিপালিত স্বাস্থ্যবান শিশুরা প্রাক-শৈশব,শৈশবকাল এবং তারপরেও বেঁচে থাকে।
মা ও নবজাতকের স্বাস্থর উন্নয়ন এককভাবে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় নিহিত নয়। সত্যিকার অর্থে কার্যকরি ও সি'তিশীল হতে হলে অত্যাবশ্যকীয় কর্মপন'ার আনুপাতিক বৃদ্ধি ঘটাতে হবে একটি পরিকাঠামোর মধ্যে, যা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অভ্যন-রের কর্মসূচিগুলোকে শক্তিশালী ও সমন্বিত করতে কঠোরভাবে চেষ্টা করে এবং নারীর অধিকার সমর্থন করার মতো একটি পরিবেশ তৈরি করে। নারী ও মেয়েদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া বৈষম্য এবং অসমতাগুলো চিহ্নিত করে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নের উদ্যোগ নিলেও তা যথেষ্ট কার্যকর, স্থিতিশীল, এমনকি সম্ভব নাও হতে পারে।