আপনি কি ডঃ পিনাকী ভট্টাচার্যের লেখা স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ বইটির কথা শুনেছেন বা বইটি কিনবেন কিনা এই নিয়ে দোটানায় আছেন?
এই প্রথম কোন বই পড়ার পর আমি তার বুক রিভিউ লেখার সাহস পেলাম। কারণ স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ লিখতে গিয়ে ডাঃ পিনাকী ভট্টাচার্য্য যে বইগুলো থেকে রেফারেন্স দিয়েছেন, তার বেশিরভাগই গত দুইবছরে আমি একাধিক বার পড়েছি।
আপনি যদি জানতে চান স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ বইটির মুল বিষয়বস্তু কি এবং ইতিহাসের দলিল হিসেবে এটি কতটুকু নির্ভরযোগ্য তাহলে পুরো লেখাটি পড়ুন, অথবা ইউটিউবে সাবটাইটেল অন করে ভিডিও দেখুন
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ বইটির বিষয়বস্তু
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ বইটির সময়কাল ১৯৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বর থেকে শুরু করে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট পর্যন্ত। তার মানে হচ্ছে এটি বাংলাদেশে শেখ মুজিবের শাসনামল এর ইতিহাসনামা।
যারা ফেসবুকে ডাঃ পিনাকী ভট্টাচার্যকে ফলো করেন তারা নিশ্চয়ই তার অসাধারণ বিশ্লেষণ ক্ষমতা সম্পর্কে জানেন। শেখ মুজিব সরকারের আমলে কি ঘটেছে তা তুলে ধরার পাশাপাশি কেন ঘটেছে তা সম্পর্কে পিনাকী ভট্টাচার্যের বিশ্লেষণ হচ্ছে এই বই এর মূল আকর্ষণ।
৪৫৯ পৃষ্ঠার এই বইটি ২২ টি অধ্যায়ে ভাগ করা। প্রতিটি অধ্যায়েই ঘটনার সাথে রিলেটেড পিকচার যোগ করায় এই বই আপনাকে ইতিহাসের সাথে ভিজুয়ালি কানেক্ট করতে হেল্প করবে।
শেখ মুজিব সরকারের প্রশাসনিক ব্যর্থতা নিয়েই বেশি অভিযোগ শোনা যায় তাই হয়ত আপনি সরাসরি সপ্তম অধ্যায়ে চলে যেতে চাইবেন, তবে আমি বলব তার আগেরগুলোও পড়ুন। তাহলে জানতে পারবেন যুদ্ধের ঠিক পরে আমাদের অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, এবং সামাজিক মুল্যবোধ কেমন ছিল। শেখ মুজিব প্রশাসক হিসেবে কতটুকু সফল বা ব্যর্থ তা যাচাইয়ের আগে আপনাকে সেই সময়ের প্রেক্ষাপট অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে।
ফারাক্কা বাঁধ ও শান্তিবাহিনীর সুত্রপাত
স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও আমাদের দুটি প্রধান সমস্যার একটি হচ্ছে ভারতের ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে পানিশুন্যতা ও লবণাক্ততার বৃদ্ধি, যার ফলে প্রায় চার কোটি মানুষের জীবন ও জীবকার পথে বাধা সৃষ্টি হয়েছে। আর আরেকটি প্রধান সমস্যা হচ্ছে পার্বত্য চট্রগ্রামে পাহাড়ি বাংগালি বিরোধ।
ডাঃ পিনাকী ভট্টাচার্য প্রমাণ সহ লিখেছেন কীভাবে এ দুটি সমস্যার সুত্রপাত ঘটেছিল শেখ মুজিব সরকারের আমলেই। আর কোনও বইতে এই বিষয়ে এত বিস্তারিত লেখা পাইনি।
বাকশাল
বাকশাল নিয়ে অনেক চেঁচামেচি শুনলেও সেই সময় নিয়ে গোছানো লেখা পাওয়া মুশকিল। ডাঃ পিনাকী ভট্টাচার্য সেই অভাবও পুরণ করেছেন।
তিনি লিখেছেন কোন পরিস্থিতিতে আর কি উদ্দেশ্যে শেখ মুজিব বাকশাল কায়েম করেন, কিভাবে গণতন্ত্র ছুড়ে ফেলে একদলীয় শাসন কায়েম করেন, আর কীভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে সবাইকে তা মেনে নিতে বা চুপ থাকতে বাধ্য করেন।
এই বই পড়ার পর বাকশাল নিয়ে কেউ আপনার সাথে তর্কে পেরে উঠবে না। এটা আমার পারসোনাল গ্যারান্টি।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ এর শেষ অংশে জানতে পারবেন কেন আর কীভাবে সেনাবাহিনীতে অসন্তোষ সৃষ্টি হয় এবং সেনা বিদ্রোহে শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হন।
এই পর্যায়ে আপনার মনে হতে পারে সেনাবিদ্রোহই শেখ মুজিবর রহমান পতনের মূল কারণ। কিন্তু আমি এই ন্যারেটিভে একমত নই।
ইতিহাসের অন্যান্য বইতে দেখা যায় ঐ সময়ে জাসদ সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে সরকার পতনের প্ল্যান করছিল। আওয়ামীলীগের মধ্যেও কথা চলছিল অনাস্থা ভোট বা এরকম কোন সাংবিধানিক উপায়ে শেখ মুজিবকে ইমপিচ করা যায় কিনা। অর্থাৎ ঐ সময়ে তার নিজের দল, বিরোধী দল, এবং সেনাবাহিনী, সবাই শেখ মুজিবের পতন চাচ্ছিলেন। এই কারণে শুধু সেনা অসন্তোষের বিষয়টা জোর দিয়ে বলা মনে হয় ঠিক না।
এইবার আসি বইটি সম্পর্কে রেটিং এ
আমার মতে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার ক্ষেত্রে ডাঃ পিনাকী ভট্টাচার্যের লেখা স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের রেটিং দশ এর মধ্যে আট।
দশ এ দশ দিতে পারছিনা কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে জাসদের উপর অত্যাচার, এবং সেনা অসন্তোষ গড়ে ওঠার পেছনের ঘটনাগুলো তিনি কিছুটা কাটছাঁট করে লিখেছেন। সেনা বিদ্রোহ ছাড়াও আরো অনেক উপায়ে যে শেখ মুজিবকে ক্ষমতা থেকে সরানোর চেষ্টা চলছিল সেগুলোও হাইলাইট হয়নি।
নিরপেক্ষতার ক্ষেত্রে বইটি সম্পর্কে আমার রেটিং ১০/১০
আমার ধারণা তিনি পক্ষপাতযুক্ত নন এটা প্রমাণের জন্যই পিনাকী ভট্টাচার্য ঐ সময়ের দুঃশাসনের কথা কিছুটা কমিয়ে লিখেছেন। শেখ কামাল সম্পর্কে ঐ সময়ে অনেক গুজব ছিল। কিন্তু ডাঃ পিনাকী সেসব গুজবের পালে হাওয়া দেননি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এবং বিশেষ করে বুদ্ধিজীবি হত্যায় জামায়াত সরাসরি যুক্ত থাকার কথা কথা পরিষ্কার করে লিখেছেন। এছাড়া পুরো বইতে জিয়াউর রহমানের প্রশংসা করে একটা লাইনও লেখেন নি।
স্টোরিটেলিং এর ক্ষেত্রে বইটি সম্পর্কে আমার রেটিং ১০/১০
শুরুতেই বলেছি অসাধারণ বিশ্লেষণ আর রিলেটেড পিকচার যোগ করায় এই বই খুব সহজে পাঠকের সাথে কানেকশন তৈরী করে ফেলে। তাই এখানেও দশ এ দশ দিচ্ছি।
আমার মতে এই বইয়ের ওভারল রেটি দশ এ নয়
এবার আসি এই বইটি কাদের পড়া উচিত।
আপনি যদি বর্তমান সময়ের একজন পলিটিকাল কিংবা হিউমান রাইটস একটিভিস্ট হন, জার্নালিস্ট হন, অথবা একজন সচেতন নাগরিক হন এবং আপনি শেখ মুজিব এর শাসনআমল সম্পর্কে কংক্রিট নলেজ অর্জন করতে চান, তাহলে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ বইটি আপনার জন্যই লেখা।
এবার চলে আসি বইটা কোথায় পাবেন।
আমি এমাজন ইউকে থেকে Twenty Pounds দিয়ে কিনেছি। বাংলাদেশে এই বইয়ের পাবলিশার হরপ্পার ফেসবুক পেজ থেকে কিনতে পারবেন এক হাজার টাকায়।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ বই এর প্রকাশক হরপ্পা এর ফেসবুক পেইজ লিঙ্ক
স্টুডেন্ট এবং এন্ট্রি লেভেল জব এ যারা আছেন তাদের পক্ষে এই করোনা মহামারীর সময়ে এক হাজার টাকা খরচ করার মত অবস্থা নাও থাকতে পারে।
সেক্ষেত্রে আমি সাজেস্ট করব কয়েকজন বন্ধু মিলে শেয়ার করে বইটা কিনুন। পাঁচজন মিলে কিনলে একেকজনের মাত্র ২০০ টাকা খরচ হবে।
ভিডিও ডেস্ক্রিপশন এ আমি আমাজন এবং হরপ্পা এর লিঙ্ক দিয়ে দিচ্ছি। সেখান বইটি কিনুন, পড়ুন, এবং পড়া শেষ হলে আপনার ফ্রেন্ডসার্কেলে যারা কিনতে পারেনি তাদের কে পড়তে দিন।
আজকের মত বিদায় নিচ্ছি আমি অ্যাডাম নট্রিয়েল, মুখ খুলতেই মুখোশ পড়েছি। খোদা হাফিজ।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুন, ২০২১ দুপুর ১২:২৫