
উনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালি জাতির দুই মহানায়ক - রাজা রামমোহন রায় & ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাদের সমাজ সংস্কারকে অনেকে বেঙ্গল রেনেসা নামে অভিহিত করে। কিন্তু ইউরোপের রেনেসার সাথে তুলনা করলে বাংলার আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন ঠিক রেনেসা হয়ে উঠতে পারেনি।
ইউরোপের রেনেসায় ব্যবসায়ী বুর্জেয়া শ্রেণী কৃষকদের সাথে মিলে সামন্তপ্রথার বিলোপ ঘটিয়েছিল। ভূমিকেন্দ্রিক অর্থনীতি বানিজ্য কেন্দ্রিক অর্থনীতি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের নিজেদের দলে রাখার জন্য নতুন নতুন দর্শন আবিস্কার করেছিল বুর্জেয়া শ্রেণী। যেমন - জাতীয়তাবাদ। অর্থাৎ যদিও তুমি অন্য রাজার রাজত্বে আছ। তবু আমরা একই দেশের, একই জাতির। যেমন আমরা বলি - আমরা সবাই বাঙালি । ভারতীয়রা বলে - "তুমি হও পাঞ্জাবী বা রাজপুত বা তামিল, আমরা সবাই ভারতীয়।" ... এরকম আরকি। এক অখন্ড জাতীতাবাদের concept তৈরি করে ভূমিদাসদের সাথে নিয়ে বিভিন্ন area এর ভূমিপ্রভুদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল বুর্জেয়া শ্রেণী। তারা ব্যবসায়ী লোক, ভূমির উপর নির্ভরশীল না। যাইহোক, সমাজে যখন অর্থনীতির পরিবর্তন ঘটে তখন আপনাাআপনিই পুরোনো ধ্যান ধারণা, রীতিনীতি, ধর্মের উপর আঘাত চলে আসে।
মাঝেমধ্যে অতীত প্রগতিশীল ( এরিস্টটলের যুগ ), বর্তমান ব্যাকডেটৈড (মধ্যযুগ, অন্ধকার যুগ) । সেক্ষেত্রে অতীতের চেতনা জাগ্রত করে বর্তমানকে আধুনিক বানাতে হয়। রেনেসার সময় ধর্মনিরপেক্ষতা , মানবতাবাদ এসব নতুন নতুন concept তৈরি হয়। নতুন বৈজ্ঞানিক আবিস্কার, সাহিত্য-চিত্রকলা, পুরোনো গ্রীক দর্শনের জাগরণ, নতুন দর্শন তৈরি সবকিছু যেন চার্চের ভিত্তি নাড়িয়ে দেয়। রাষ্ট্র খ্রিষ্টধর্মের প্রভাব থেকে বের হয়ে ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে উঠে।
কিন্তু তথাকথিত বাঙালি রেনেসার সময় অর্থনীতির উল্টা পরিবর্তন ঘটেছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে সামন্তপ্রথা ( জমিদারপ্রথা ) জেকে বসেছিল। ব্রিটিশরা ভারতের business industry ধ্বংস করে দেয়ায় বাঙালি ব্যবসায়ীরা bankrupt হয়ে গেছিল। তারা অবশিষ্ট জামানো টাকা দিয়ে জমি কিনতে শুরু করেছিল। এটাই উপার্জনের একমাত্র পথ। অর্থনীতির পরিবর্তন উল্টা পথে যাওয়ায় , কৃষকদের সংগঠিত করার মত বুর্জেয়া শ্রেণী তৈরিই হয়নি। কাজেই ইউরোপের মত ভারতে ধর্মের উপর সেরকম আঘাত আসেনি ( খুবই দুঃখজনক )।
ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর পাশ্চাত্য শিক্ষার সংস্পর্শে আসার সাথে সাথে টের পেয়েছিল হিন্দু দর্শনের অসারতা। তারপরেও সমাজের চাপে বাধ্য হয়ে সংস্কৃত কলেজে বেদ বেদান্ত পড়াতেই হত। তখন বিদ্যাসাগর ভাবলেন, দেশীয় phiosophy পড়ানোর পাশাপাশি পাশ্চাত্য দর্শনও পড়ানো হোক ( ভাববাদী বা আধ্যাত্মবাদী দর্শন নয়, বস্তুবাদী দর্শন )। পশ্চিমা বস্তুবাদ ভারতের আধ্যাত্মবাদের বিরুদ্ধে ( রোগের বিরুদ্ধে ) প্রতিষেধক বা টিকার মত কাজ করবে।
ব্যক্তিগত মতামতঃ বাংলাদেশেও এরকম করা দরকার। ধর্মান্ধ সমাজের চাপে স্কুলে ধর্মীয় শিক্ষা যেহেতু পড়াতেই হবে। কেননা প্রত্যেক ধর্মের জন্য আলাদা আলাদা বই না বানিয়ে একটাই বই হোক "ধর্ম ও দর্শন" নামে। ঐ বইতৈ সব ধর্ম আলোচনা করা হবে। পাশাপাশি নাস্তিকীয় দর্শনও থাকুক। হিন্দু ছাত্র বা ছাত্রী কেন শুধুমাত্র হিন্দুধর্ম সমন্ধেই জানবে, কেন ইসলাম বা খ্রিষ্ট ধর্ম সমন্ধে জানবে না। আর মুসলিম কেন শুধুমাত্র ইসলাম সমন্ধেই জানবে, কেন হিন্দুধর্ম সমন্ধে জানবে না। ক্লাসে যখন মুসলিম ছাত্রটা তার হিন্দু সহপাঠীকে বলবে - দোস্ত, তোদের রামায়ন পড়ে অনেক মজা পেয়েছি। ভারত থেকে শ্রীলঙ্কা গিয়ে রাক্ষসের সাথে ফাইট। Cool.
হিন্দু ছাত্রটা মুসলিম সহপাঠীকে বলবে, "দোস্ত, তোদের নূহঃ নবীর কাহিনীটাও জোশ। বন্যায় দুনিয়া ভেসে গেছিল। নূহঃ নবী সব জীবের এক জোড়া নৌকায় উঠিয়ে ভাসান দিছে। what an adventure ! "
এভাবে একে অন্যের ধর্ম নিয়ে আলোচনা করলে সহনশীলতা বাড়বে। দূর্গাপূজায় মূর্তিভাঙা বন্ধ হবে। আর নাস্তিক্যবাদী দর্শন পড়ার ফলে নাস্তিকদের প্রতি ঘৃণা কমবে। শিশু ভাববে, "পৃথিবীতে এমন লোকও আছে যাদের কাছে এই দুই adventure কাহিনীই ভুয়া, রূপকথা এবং its fine. নাস্তিক আার ধর্মকে ভুয়া বললেও আমার ধর্মানুভূতি আহত হয় না।"
................ ............... ................ ................. .................. ................
এই হল আমার ব্যক্তিগত মতামত। আবার বিদ্যাসাগরে ফেরত আসা যাক। বিদ্যাসাগর দেখতে পাচ্ছিল কৃষকদের উপর জমিদার ও বৃটিশদের নির্যাতন। কৃষকের দুঃখে তিনি ছুটে গিয়েছেন। নিজের অর্থ দিয়ে help করেছেন যাতে খাজনা দিতে পারে। এমনি এমনি তিনি দয়ার সাগর, করুণাসাগর উপাধি পান নাই। জীবনে অজস্র মানুষকে টাকা দিয়ে সাহায্য করেছেন। এর মধ্যে মাইকেল মধুসূন দত্তও আছেন। কিন্তু বিধবা বিবাহ প্রচলনের জন্য যেরকম রণক্ষেত্রে নেমেছিলেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাতিলের জন্য তেমন কিছু করেননি।
তখনকার দিনে বিদ্যাসাগরই মিডিয়া। বেশ কিছু সংবাদপত্রের মালিক, বইয়ের ব্যবসা আছে। তবু চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে কিছুই লেখেননি। কারণ, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিরোধীতা বৃটিশ শাসনের বিরোধীতার সামিল। তিনি চাচ্ছিলেন বৃটিশরা থাকুক। বৃটিশদের শিক্ষা ছাড়া দেশে ধর্মীয় কুসংস্কারের যে পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে সেই পাহাড় ভাঙা সম্ভব না। মেয়েদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা, গ্রামে গ্রামে মডেল স্কুল প্রতিষ্ঠা, বিধবাদের বিয়ে দেয়া সব ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি বৃটিশ চলে যায়।
দেশীয় শাসক ক্ষমতায় আসলে যে কৃষকদের নির্যাতন বন্ধ হয়ে যাবে, এমন কোন গ্যারিন্টি আছে ? নাই। তবে ঈংরেজরা চলে গেলে নারীরা আবার গৃহবন্দী হয়ে যাবে । পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞান দর্শন ছাড়া দেশের পশ্চাৎপদ সমাজের মানসিক উন্নতি হবে না। এরা বেদ বেদান্ত থেকে বের হয়ে আসতে পারবে না। এজন্য ভারতের অর্থনৈতিক অবনতি, কৃষকদের উপর অত্যাচার এগুলো মুখ বুজে মেনে নিয়েছেন মহামহিম বিদ্যাসাগর।
ব্যক্তিগত মতামতঃ দেশের স্বাধীনতার চেয়ে দেশের মানুষের মানসিক উন্নতি বড়। আফগানিস্তান স্বাধীন হয়ে সর্বনাশ হয়েছে। ওখানে মার্কিন শাসন থাকলেই ভাল হত। তালেবানি শাসনে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে ফেসবুক পোষ্ট দেখি - তালেবানরা গাড়ি বানিয়েছে, আফগানি মুদ্রার value ডলারকে ছাড়িয়ে গেছে, আফগানিস্তান ঘুরে দাড়াচ্ছে। এসব গুজব রাটানোর উদ্দেশ্য -
বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে শরীয়াপ্রীতি জাগানো। ইসলামী শাসন থেকে ভাল কিছু আসতে পারে, এটা দেখানো। নাস্তিকদের বুঝিয়ে দেয়া যে, তালেবানরা সন্ত্রাসী না বরং জিনিয়াস। হাঃ হাঃ
যাইহোক, উনবিংশ শতাব্দীতে হিন্দুরা ঈংরেজী শিক্ষা গ্রহণ করায় সরকারী চাকরি পেতে শুরু করলেও বৃটিশদের কাছে বৈষম্যের শিকার হতে হত বেতন, পদমর্যাদার দিক দিয়ে। যখন হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছিল। তখন বৈষম্য, discrimination গায়ে মাখেনি। পরে যখন মধ্যবিত্ত শ্রেণী মোটামুটি দাড়িয়ে গেছে তখন ঈংরেজদের থেকে মুক্তি পাবার চিন্তা মাথায় এসেছে। কিন্তু চাকুরিজীবী শ্রেণী বৃটিশ সরকারের উপর নির্ভরশীল। জলে থেকে কুমিরের সাথে যুদ্ধ করা যায় না। উপায় ? সর্বস্তরের জনগণকে দিয়ে আন্দোলন করানো। এদের মধ্যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ জাগ্রত করতে হবে। ঠিক যেরকম ইউরোপে বুর্জেয়া শ্রেণী সেখানকার কৃষকদের মধ্যে করেছিল। ইউরোপে ব্যবসায়ীরা ছিল স্বাধীন। ভারতীয় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী ছিল সরকারী কামলা, সরকারের অধীন। তাই ফারাসী বিপ্লবের মত বড়সড় বিপ্লব আনতে পারেনি। বরং ধীরে ধীরে ঈংরেজ সরকারের সাথে আপোস করে একটা রাজনৈতিক দল বানিয়ে ফেলছে কংগ্রেস। এটা ধর্মনিরপেক্ষ দল। তারপরের কাহিনী আপনারা জানেন।
By the way, লক্ষ্য করার মত বিষয়- বাংলাদেশের মানুষ ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদ চায় না ( ধর্মনিরপেক্ষতা চায় )। কিন্তু বাংলাদেশে শরীয়া তথা উগ্র ইসলাম চায় (ধর্মনিরপেক্ষতা চায় না )। মানে মৌলবাদ/উগ্রতা যদি ইসলাম থেকে আসে, no problem. কিন্তু উগ্রতা অন্য ধর্ম থেকে আসে তাহলে সমস্যা। wow ! বাঙালি মুসলমানদের হিপোক্রেসি।
Whatever, এই হল "ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ" বইয়ের সংক্ষিপ্ত আলোচনা। যার লেখক বর্তমান বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর। যেমন মুসলমানরা নজরুলকে রবীন্দ্রনাথের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করায়। তেমনি আমরা নাস্তিকরাও বদরুদ্দীন উমরকে সলিমুল্লাহ খানের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে রবীন্দ্রবিদ্বেষী সলিমুল্লাহকে এক হাত দেখে নিতে পারি। চিল্লাইয়া কন - ঠিক কিনা ? ( ওয়াজ মাহফিলের ভাষায় বললাম। হাঃ হাঃ )

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


