somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ধারাবাহিক: শ্যামলা রংয়ের মেয়েটি

৩১ শে অক্টোবর, ২০২৩ দুপুর ১:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

‘‘কলকাতা গিয়েছিলুম দুমাসের একটা মেরীন শর্টকোর্স করার জন্যে।
প্রথম দিনেই চোখ মেরে দিয়েছি একজনকে। প্রেম হয়ে গেছে, প্রেএএম।! উত্তরাধিকারসূত্রে পেলুম প্রেমিকা।
কি, হিংসে হয়? *হিইইইংসে হয়? আমার মত হতে চাও?’’

বাংলাদেশ থেকে বাসে চেপে আমরা তিন বন্ধু মিলে বৃষ্টিভেজা দুপুরে কলকাতার সেন্ট্রালের একটা হোটেলে উঠে নাওয়া খাওয়া সেরে পরদিন ভোরে ট্যাক্সি ক্যাব চেপে সোজা গড়িয়ায়। উরিব্বাপশ্ এত্তোদুর! রাস্তা ফাঁকা থাকলে চল্লিশ মিনিটের বেশী লাগেনা কিন্তু রাশ আওয়ারে এক থেকে দেড় ঘন্টা লেগে যায়। গড়িয়ার এই বিশেষ কলেজে পৌঁছে প্রয়োজনীয় ফরমালিটি শেষ করতে করতে প্রায় দুপুর। যদিও এখানে সমুদ্রগামী জাহাজের অফিসারদের স্যাটেলাইট কমিউনিকেশনের উপর ট্রেনিং দেওয়া এবং পরীক্ষা নেওয়া হয়, তবে পুরো বিল্ডিং বাকি দশটা অফিসের মতো। দোতলা। নীচতলায় রিসিপশান, ক্লাশরুম ইত্যাদি। উপর তলায়ও ক্লাশরুম, প্র্যাক্টিক্যাল ইকুইপমেন্ট রুম, ডায়নিং রুম। লাঞ্চ আর সারাদিন চা বিস্কুট মুফতে, অর্থাৎ ফ্রী। আমার ক্লাসে টোটাল স্ট্যূডেন্টস্ এগার জন। এরমধ্যে বাংলাদেশের আরেকজন ছাত্র পেলাম, সব মিলে এখন কলেজে আমরা চারজন বাংলাদেশী। কতৃপক্ষ একজন পদস্থ কর্মকর্তার মাধ্যমে আমাদের জন্য ট্যাক্সী ডাকালেন এবং তাঁকে আমাদের থাকার যায়গায় পৌঁছে সব বুঝিয়ে দিয়ে আসতে বললেন। তিনি আমাদের যেভাবে সব বুঝিয়ে দিলেন তাতে বুঝলাম আমরা মোটামুটি ভিআইপি। দোতলার পুরোটাই আমাদের।

সাউথ ক্যালকাটার পশ্ এলাকা গড়িয়ার বাঘাযতীন শ্রী-কলনীতে ছোট্ট তিনতলা একটা বাড়ী। কর্নার হাউস। ডিটাচড্। দোতলার পুরোটাই আমাদের জন্য বরাদ্দ। আমার রুম রাস্তার দিকের টা। সবদিকে জানালা, খোলামেলা। পর্দা সরালে হুহু বাতাস আর আলো খেলা করে। সামনে লম্বা একটা বারান্দাও আছে। খুব পছন্দ হয়ে গেলো। বাড়ী ভাড়ার সাথে প্রতিদিন একজন ক্লিনার এবং একজন রান্নার ঠাকুর ফ্রী। ক্লিনার প্রতিদিন সকালে সবার বিছানা চাদর আর, বালিশের কভার ইত্যাদি পাল্টে নতুন লাগিয়ে সারা ঘর, রান্নাঘর, বারান্দা আর বাথরুম পরিষ্কার করে এয়ার ফ্রেশনার দিয়ে যায়। রান্নার ঠাকুরকে টাকা দিয়ে দিই সে বাজার করে আমরা যেভাবে চাই সেভাবে সব রেঁধে দেয়। খেতেও বেশ। শুধু গোমাংসের কথা বলা যাবেনা। ঠাকুর ওসব ছোঁয়ও না।

ক্লিনারকে খুব একটা দেখা যায় না কারন তাকে ভোরে আসতে বারণ করেছি। ব্যাচেলরদের প্রাইভেসি নষ্ট। আমরা কলেজে যাবার পর এসে সে তার কাজ করে দিয়ে চলে যায়। কিছু চুরি যাবেনা, এই গ্যারান্টি কলেজের। রান্নার ঠাকুরকে সারাদিন পাওয়া যায়, সন্ধ্যার পর চলে যায়। ওর নাম দুঃশাসন, আমরা ওকে ওই নামে ডাকিনা। ‘ঠাকুর’ বলে ডাকি। আমি যখন খুব রাজসিক ঢংয়ে ডাকি, ‘ঠাকুউউউউর!’ এক দৌড়ে এসেই দাঁত বের করে হেসে বলে, “আজ্ঞে, বলো!” উপরের পাটিতে চারটে, আর নীচের পাটিতে চারটে দাঁত নেই। হাসলে জিভ, পাশের দাঁত আর কালচে-ধুসর মাড়ি দেখা যায়। দেখতে এতো মায়া লাগে! মনেই হয় না বয়স পঞ্চান্ন। বেঁটে খাটো, অনেকগুলো কাঁচাপাকা চুল। গোঁফ আছে ঝাঁকড়া, কাঁচাপাকা। প্রতি বিষ্যূদবার সন্ধ্যার পর ঠাকুর দারু খায়, সেদিন তাকে আগে ছেড়ে দিতে হয়। আমাদের সমস্যা হয় না।

আমাদের বাড়িটার ঠিক নিচেই রাস্তার একপাশে একটা চাপাকল, কংক্রীট ঢালাই করে সুন্দর ঘাটের মত করে রাখা। এটা এই এলাকার খাবার জলের জন্য। সব বাড়িতে সাপ্লাই পানি থাকলেও খাবার জল আর পূজোর জন্য বিশুদ্ধ জল বলতে ওই চাপাকল। প্রতিদিন সকালবেলায় সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে একে একে জল নিয়ে যায়। দুঃশাসন ঠাকুরকে বললাম এই বিষয়ে চিন্তা না করতে। আমরা পাঁচ লিটার বা দশ লিটার ওজনের অনেকগুলো খাবার জলের ডিব্বা নিয়ে আসবো। দুঃশাসন খুশী হয়, আবার দুশ্চিন্তায়ও পড়ে। বাংলাদেশের মানুষ এত্তো অপচয় করতে পারে? নাকের ডাগায় ফিরিতে (ফ্রী তে) জল, আর এরা কিনা পেলাস্টিকের ডিব্বা ভর্তি জল কিনবে?

আমরা আসার আগে যে গ্রুপ এখানে থাকতো তারা চলে গেছে, রয়ে গেছে নর্থ ইন্ডিয়ান একটা ছেলে। ট্রেনের রিজার্ভেশন পায় নি তাই যাবে আজ রাতে। আমার প্রথম নাম ‘আফলাতুন’ শুনে অনেক হাসলো কারন ও জেনে এসেছে আফলাতুন মানে পাজি। তারপর আমাদের মধ্যে দ্রুত বন্ধুত্ব হয়ে গেল। ও মারাঠি, হিন্দী এবং উর্দুতে ফ্লুয়েন্ট সে। আমার কাছে হিন্দি, উর্দু সব এক ভাষা। তারচেয়েও বড় কথা আমি ফেণীর ছেলে, আমার মাতৃভাষার সাথে ‘হায়’ লাগিয়ে দিলেই হিন্দী বা উর্দু ভাষা হয়ে যায়, তাই ওর সাথে কথা বলতে কোন সমস্যা হচ্ছিলোনা। ছেলেটার নাম আলতাফ, যদিও সে হিন্দু। আড্ডা ভালোই জমে উঠেছে, আমার গার্লফ্রেন্ড নেই বা কখনো প্রেম-ভালোবাসা করিনি শুনে আমার দিকে এমন ভাবে তাকালো যেন ফকির-মিসকিন দেখছে। নাটক-সিনেমায় অনেক পয়সাওয়ালারা যেরকম পকেট থেকে টাকার তোড়া বের করে গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে দেয় অনেকটা সেই ভঙ্গিতে আলতাফ আমাকে বললো,
“ইয়ার আফলাতুউউউন, তু মেরা আচ্ছা দোস্ত হ্যায়, তু মেরা গার্লফ্রেন্ড কো লে লে।” (বঙ্গানুবাদ:- তুমি আমার ভালো বন্ধু, আমার গার্লফ্রেন্ডকে তুমি নিয়ে নাও)

আমি ভাবছিলাম পোলার মাথায় ছিট আছে কিনা। হতভম্ব ভাব কাটিয়ে ওঠার আগেই সে আমাকে যুক্তি দিয়ে বোঝালো যেহেতু সে উত্তরে ফিরে যাচ্ছে এবং আর কখনো বাংলায় আসবেনা সেহেতু ওই মেয়ে আমার গার্লফ্রেন্ড হতেই পারে। আমাকে বোঝায়,
“আমি যেহেতু চলে যাচ্ছি ওই মেয়ে এরকম আরেকটা শর্ট কোর্স করতে আসা ছেলের সাথে প্রেম করবে। সেটা নাহয় তুমি হলে আফলাতুন! তুমিও যাবার আগে আবার কারো কাছে হাওলা করে দেবে?” একটু দম নিয়ে আবার বলে, “তাছাড়া, আমিও ওকে এভাবেই পেয়েছি?”
“মানে?” আরেকবার আকাশ থেকে পড়লাম।
“আগের স্টুডেন্ট কোর্স শেষ করে চলে যাবার আগে আমাকে হাওলা করে দিয়ে গেছে।” এবার আমার মাথা ঘুরছে। আলতাফ হঠাৎ তাড়াহুড়ো শুরু করে দিলো।
“লিসেন আফলাতুন, মা’ লা’ ওই জানালার সামনে আসবে, আমি সরে দাঁড়াবো। দোস্ত, তু উসকো আঁখ মার-দেনা। ওকে?” মেয়েটার নাম মালা, বুঝলাম।

দোতলার জানালার পর্দা সরিয়ে অদ্ভুতভাবে শীষ দিয়ে এক ধাক্কায় আমাকে বারান্দায় ঠেলে দিলো তারপর চট করে আড়ালে চলে গেলো। আমি বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে আছি। কিংকর্তব্যবিমুঢ়। একটু পর মেয়েটা এলো। শ্যামলা রংয়ের মেয়ে। মুখোমুখি বিল্ডং, বেশী দুরে নয়। আমার দিকে না তাকিয়ে জানালার দিকে উৎসুক চোখে দেখছে, বোঝা যায় আলতাফকে খুজছে। ব্যাটা আলতাফ রুমের ভেতর সবগুলো জানালার পর্দা টেনে ভেতরে লুকিয়ে আছে মেয়েটা যাতে তাকে দেখতে না পায়। হাল্কা, মাঝারি স্বাস্থ্যের মেয়েটার গোলগাল মুখখানা বড় মিষ্টি। গাঢ় খয়েরী রংয়ের একটা ফ্রকের মত ড্রেস, প্রায় হাঁটু পর্যন্ত। গভীর কালো চুলের সামনের অংশ গলা পর্যন্ত, বাকী অংশ একদম কোমরে গিয়ে ঠেকেছে। হারামী নর্থ ইন্ডিয়ান আড়াল থেকে নীচু গলায় আমাকে বলেই যাচ্ছে,
“আফলাতুউউউন আঁখ মার! আঁখ মার চূতিয়া! আঁখ মার!! আবে ও? আঁখ মার না স্‌-স্সালা!!!” এ ও কি সম্ভব? কাঁধ ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে একটা ভঙ্গি করলাম যার মানে হচ্ছে,
“আঁখ মারবো? আমি?? আর ইউ ম্যাড??” এবার ও দুহাত জোড় করে হাঁটুর উপর বসে পড়লো,
চিপিয়ে চিপিয়ে, প্রায় ফিশফিশিয়ে মিনতি করে বললো, “এক বার আঁখ মার দে মেরা বাপ!”

আমি ঝট্‌ করে ঘুরে মেয়েটার দিকে তাকালাম, বোধ হয় সেকারনে মেয়েটিও আমার দিকে তাকালো।
চোখাচুখি দুজনে . . .

(চলবে)

*হিইইইংসে হয়? আমার মত হতে চাও?’’ (*কপিরাইট © শেফুদা)
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৩ দুপুর ২:১০
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিনেতা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৫



বলতে, আমি নাকি পাক্কা অভিনেতা ,
অভিনয়ে সেরা,খুব ভালো করবো অভিনয় করলে।
আমিও বলতাম, যেদিন হবো সেদিন তুমি দেখবে তো ?
এক গাল হেসে দিয়ে বলতে, সে সময় হলে দেখা যাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×