মর্গে নিথর একটা দেহ পড়ে আছে। আমাদের ভাষায় যার পরিচয় কেবলমাত্র "লাশ"। অথচ কিছুক্ষণ আগেও তার নাম ছিল, পরিচয় ছিল, ছিল ধর্মের জাত-পাত। এখন তার পরিচয় একটাই, লাশ!
লাশটার মুখের চারপাশে মাছি ভনভন করছে। কোন সাড়া নেই, কোন শব্দ নেই। একমনে আধোখোলা চোখ দিয়ে কি যেন দেখছে আর হয়তো ভাবছে অনেককিছু, কত মায়া জড়ানো ছবিগুলো হয়তো ভেসে তার দু’চোখ জুড়ে। মা-বাবার পবিত্র মুখগুলো, প্রেয়সীর মিষ্টিমুখ, সন্তানের সদাহাস্যজ্জ্বল মুখ।
সমস্ত কর্মব্যস্ততা উজাড় করে তারও তো আজ ঘরে ফেরার কথা ছিল। কথা ছিল প্রেয়সীর জন্য তার প্রিয় বকুল নিয়ে হাজির হবার। সন্তানের প্রিয় লাল সাইকেল কিনে আনার। মায়ের জন্যে কেনা অফ-হোয়াইট শালটা নিয়ে, ঘরে ফেরার। দিন শেষে সবাই ঘরে ফিরবে কিন্তু আর কোনদিন ফেরা হবে না তার। কেউ তো আর কোনদিন রাতের পর রাত অপেক্ষার প্রহর গুণবে না। ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমানের পারদ জমিয়ে রাখবে না আর কেউ। কতশত বায়না নিয়ে নানা ছলনায় কেউ আর কোনদিন ঝগড়ার আসর বসাবে না।
লাশটার পকেটে ছিল একটা নর রুমাল। যে রুমালের প্রতি ভাজে ভাজে জড়িয়ে আছে পরম মমতা। প্রতিটি শেলাইয়ের পরতে রয়েছে তার প্রিয়ার মমতার ছোঁয়া। শেলাইয়ের বুনোটগুলো যাকে আলোড়িত করতো কর্মক্লান্ত দিনে নতুন স্বপ্নের খোঁজে, নিকষ কালো মেঘে ঢাকা পড়েছে তার সমস্ত আলোকছটা। নীরব, গুমোট অন্ধকার ঘরে ঢাকা পড়েছে তার সমস্ত স্বপ্ন। সলীল সমাধী হয়েছে তার যাত্রাপথ। আধখোলা চোখ জোড়া বুঝি তার অন্তিম ঘুমের ভারে নিমজ্জিত হতে চাইছে ক্রমশ। হারিয়ে যাচ্ছে কালের মহাপ্রলয়ের অতল গভীরে।
ঢাকা মেডিকেলের মর্গে পরে থাকা একটা লাশ দেখে, অনুভুতির প্রকাশমাত্র, যে লাশ হয়তো তার প্রিয়জনের কাছে পৌঁছবে, হয়তো পৌঁছবে না, হয়তো রয়ে যাবে তার ঠিকানা, পরিচয় অজ্ঞাতই! কিংবা এই লাশ নিয়েও ব্যবসা হবে। মর্গ থেকে কিনে নিবে কোনো প্রতিষ্টান, সে কিনে নেওয়ার মাঝেও আছে অনেক ছলচাতুরী! লাশ হয়েও আরাম নেই; লাশ হয়তো মর্গে পঁচানো হবে, হয়তো সারারাত পানিতে ভিজিয়ে পরদিন হাড্ডি থেকে মাংস আলাদা করে ফেলা হবে! হয়তো সেই লাশের হাড়গুলো ভালো দামে বিক্রির ব্যবস্থা করবে একটি দুষ্ট চক্র; কিংবা মর্গের রিসিটে লাশ অজ্ঞাত পরিচয় দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হবে কোনো কবরস্থানে, যেখানটায় ওদের মতো অনেকেই আছে; ভুল বললাম, লাশ হিসেবে নয়- সাদা কাফনের কাপড়ে হাড়গুড় বিহীন শুধু লাশের আকৃতি পৌঁছাবে কবরে! কিংবা ভুলেও যদি কোনো আত্মীয়স্বজন লাশের সন্ধানে আসে; তাহলে মোটা মোটা টালি খাতা বের করে দেখিয়ে দেয়া হবে- এই নামে কোনো লাশ এখানে আসেনি! মর্গ! বড়ই বিচিত্র জায়গা। এখানে লাশ নিয়েও চলে ব্যবসা; সে লাশ যেটা হয়তো তার আদরের প্রিয় মেয়েটির সাথে রাতে গল্পচ্ছলে ঘুম পাড়ানোর গান করে। নিষ্টুর বাস্তবতা হয়ত তাকে সে পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেনা।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে নভেম্বর, ২০১৯ রাত ৮:৩৩