অনেক কষ্টে রফিক ভাইকে ধরে ফুল বিক্রির কাজটা ম্যানেজ করেছে শিমুল। বাবা-মা অনেক আদর করে ফুলের নামে নাম রেখেছে। তবে ফুল হয়ে ফুটলেও সৌরভ ছড়ানো আর হয় না তার। তার আগেই বৃহৎ দায়িত্ব কাঁধে এসে পড়ে। দায়িত্বটা যে তার বেশি, এত অল্প বয়সেও সেটা বুঝতে শিখেছে সে।
বাবার হাত ধরে এসেছিল ঢাকায়। বাবা লোহা-লক্করের ব্যবসা করতেন। বছর দুয়েক হল সড়ক দুর্ঘটনায় নিভে গেছে তাঁর প্রাণপ্রদীপ। বাবার মৃত্যুর সাথে সাথে ইতি ঘটে সুখের জীবনের। সুখগুলোকে ছাড়পত্র দিয়ে এখন ছোট্ট একটি ছাপড়া বাড়িতে আলোআঁধারির দোলাচালে দোদুল্যমান জীবন।
আঁধারের বুক চিরে ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে ঘুম থেকে উঠে মা-ছেলে ঘরের যাবতীয় কাজকর্ম শেষ করে। এরপর ছোট বোনটিকে ঘুম থেকে তুলে দেয়। তিনজনে বাসি ভাত কয়টা মুখে দিয়ে যে যার কাজে বের হয়। ২টা বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে শিমুলের মা। স্বামী থাকা অবস্থায় ঝিয়ের কাজ করাটাকে নিতান্তই খারাপ চোখে দেখত সে।
বাসা বাড়িতে কাজ করলে ইজ্জত থাকে না। কিন্তু কি আর করা! বেঁচে তো থাকতে হবে। ছেলে-মেয়ে দুটোর আবদার মেটাতে পারে না বলে বুক চিরে বোবা কান্না ভেসে আসে তার। হতাশার কাব্যে ভাসা খোঁজে মন। দু চোখের স্বপ্ন গুলো আজ বেদনাহত, যন্ত্রণা কাতর। স্মৃতিগুলো মাঝে মাঝে পিছুটান দেয়। চোখের সামনে ভেসে ওঠা অতীত বিভ্রান্ত করে। কেন যেন স্বামীর মুখটা বারে বারে মনে পড়ে যায়। জীবিকার তাগিদে পিছুটানের সীমারেখা অতিক্রম করে পথের দিকে পা বাড়ায় শিমুলের মা। মনের অজান্তে বেরিয়ে আসা দীর্ঘনিঃশ্বাসটা লুকোনো সম্ভব হয় না।
শিমুলের বোনের নাম বকুল। মায়া কাড়া চেহারা। ঘুম-ঘুম চোখে ভাই এর সাথে ছোট ছোট পা ফেলে ফুলের দোকানের দিকে রওনা দেয়। ফুল কুড়িয়ে মালা গেঁথে কিংবা দোকান থেকে ফুল সংগ্রহ করে শহরের ব্যস্ত জায়গাগুলোতে দু’ভাইবোন ছুট দেয় সকাল সকাল। গ্রীষ্মকালে আইস্ক্রিম আর শীতকালে চকলেট বোনের হাতে গুঁজে দিয়ে ফুল নিয়ে ছুটোছুটি করতে থাকে শিমুল। গরমে ঘাম ছুটে যায় তার। সহজে কেউ ফুল কিনতে চায় না, অনেক অনুনয় করতে হয়। কেউ ফুল কিনলে অকৃত্রিম হাসি দিয়ে টাকাটা হাতে নিয়ে চলে যায়। অনেকেরই মন কেড়ে নেয় ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা সেই শেষ হাসি।
তবে ইন্সটিটুইশনগুলো বন্ধ থাকলে কিংবা হরতাল হলে দুরাশার কালো মেঘ এসে আশাগুলো ঢেকে দিয়ে যায়। এসব দিনে বিক্রি তেমন হয় না। ভয়ে গরমেও হাত পা জমে আসতে থাকে তার। খাওয়ার পয়সা জোটানোই কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। মাঝেমধ্যে উচ্ছিষ্ট খেয়ে ক্ষুধা মেটাতে হয়। তার নিজের জন্য তেমন একটা কষ্ট হয় না, তবে ছোট বোনটার জন্য কষ্টে বুকটা ফেটে যায়। চোখ দুটো বাঁধা মানে না। হঠাৎ অনুভব করে শার্টের বুকের কাছটা ভেজা। বোনকে আড়াল করে মুছে ফেলে চোখের পানি।
শত কষ্টের মাঝে তার জীবনে আনন্দের পরশ বুলিয়ে দিয়ে যায় ক্রিকেট। দেশের খেলা হলেই বোনকে নিয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে বড় পর্দায় খেলা দেখে শিমুল। বকুল ক্রিকেট বোঝে না। লোকজনের ভিড়ে ছোট্ট শরীর নিয়ে টিভি ঠিকমত দেখতেও পায় না সে। তবে এতে তার কোন ভাবান্তর নেই। পর্দার চাইতে, পর্দার বাইরে ভাই এর লাফালাফিতেই তার আনন্দ। ছোট বাচ্চার খুশি হওয়ার জন্য তেমন কোন উপলক্ষ লাগে না। ভাই আনন্দে লাফা-লাফি করলে, সেও কচি হাতে তালি দিতে থাকে। শিমুলের প্রিয় ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল। তামিম আউট হয়ে গেলে মাথায় হাত চলে যায় শিমুলের। কিছু না বুঝে বকুলও কপালে হাত দেয়। তবে ভাই দেখছে কি না এটা আড়চোখে দেখে নিতে ভুল করে না। ভাই দেখে ফেললে লজ্জা পায় বকুল, জামার মধ্যে মুখ লুকায়। শিমুল দেখেও না দেখার ভান করে। ভাই-বোনের মাঝে লুকোচুরি খেলা চলতে থাকে। অনাদরে বেড়ে ওঠা বোনের চুল-গুলো হাত দিয়ে এলোমেলো করে দেয়। বকুল পরিতৃপ্ত নয়নে ভাইয়ের দিকে তাকায়।
কোন এক পহেলা বৈশাখে বড় লোকেরা যা খায় তাই খাওয়ার জন্য আবদার করে বসে বকুল। অনেক চিন্তা ভাবনার পর যে বাড়িতে কাজ করে সে বাড়ির ভাবীর কাছ থেকে চেয়ে মেয়েটার জন্য পান্তা আর ছোট্ট এক টুকরা ইলিশ মাছ নিয়ে আসে। কিন্তু এসে দেখে ছেলে মেয়ে দুটো এখনো ফেরে নি। সকাল বেলার রান্না করা তাই টকটক একটা ভাব এসে গেছে। তাড়াতাড়ি চুলা জ্বালিয়ে সন্তান দুটোর চোখের অলক্ষ্যে পান্তা গরম করে, হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতে থাকে। কোন মতেই মেয়ের চোখে ধরা পড়া যাবে না। জেদি মেয়েটা বুঝতেই চাইবে না কিছু। তার চোখে মুখে চোরের মত ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়, হৃদস্পন্দনের গতি অহেতুক বৃদ্ধি পেতে থাকে।
কিছুক্ষণ পরেই ছেলে মেয়ে দুটি ফিরে আসে। এসেই মায়ের গলা ধরে ঝুলতে থাকে বকুল।
বকুলঃ মা আনছ?
মাঃ হু, আনছিরে মা। তুই হাতমুখ ধুয়ে আয়।
বকুলঃ হাত ধোয়া, ময়লা নাই (মাকে হাত উল্টেপাল্টে দেখায়)
মা মৃদু হেসে বকুলকে কল পাড়ে নিয়ে গিয়ে হাত ধুইয়ে নিয়ে আসে। তারপর শানকিতে করে পান্তা খেতে দেয় (বকুলের ভাষ্যমতে বড় লোকদের মত)
খুশি মনে একবার মুখে দিয়েই মুখ বিকৃত করে ফেলে বকুল, দলা করে মুখ থেকে সব বের করে দেয়।
বকুলঃ এইগুলা কি আনছ, পান্তা! খামু না, তোমাকে কি পান্তা আনতে বলছি?
বোনের কথা শুনে হঠাত উচ্চস্বরে হেসে উঠে শিমুল। পরিস্থিতি বুঝে উঠতে পারে না বকুল। অপমানে, রাগে ফুঁসতে থাকে ছোট্ট মেয়েটি।
মেয়েকে কাছে ডাকে মা। যতই কাছে ডাকে মেয়ে অভিমানে ততই দূরে চলে যেতে থাকে। জোর করে বুকের কাছে টেনে নেয় মা। আদর করে কোলে বসায়।
মাঃ বড় লোকেরা পহেলা বৈশাখে এইগুলাই খায় মা। তোমার জন্য ইলিশ মাছ আনছি দেখ। আমি মাইখা দেই, মজা পাইবা।
আদর পেয়ে কিছুটা শান্ত হয়। ইলিশ মাছ এর কথা শুনে চোখ চকচক করতে থাকে বকুলের।
বকুলঃ মা বড় লোকেরা এইগুলা খায় ক্যান? এইগুলানতো আমগো খাবার।
মেয়ের এই অবান্তর প্রশ্নের উত্তর মা দিতে পারে না। অদূরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে নির্বাক তাকিয়ে থাকে। তাঁর চোখের জল তখন পান্তায় লবণ জলের অভাব মেটাতে ব্যস্ত। কাছাকাছি বয়সের না হলেও সদ্য কৈশোর পেরোনো শিমুলের কোন আবদার নেই। মুগ্ধ নয়নে বোনের খাওয়া দেখতে থাকে। এইটুকুন বয়সেই মায়ের কষ্ট সে বোঝে। বাবার করুণ মৃত্যু এক ধাক্কায় তাকে অনেক বড় করে দেয়।
*************
টাইটেল কার্টেসিঃ িসয়াদ বস
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুন, ২০১৩ রাত ৮:৫৩