somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

ঐশিকা বসু
নমস্কার পাঠক, সামহোয়্যারের এই ব্লগে ঐশিকা আপনাকে স্বাগত জানায়। জীবনের নানা হাসি-কান্না, দুঃখ-বেদনার ইতিহাসে লেগে থাকে কতই না কাহিনী। সেসব কিছু নিয়েই আমার এই ব্লগ। সত্য-কল্পনার মিশেলে কিছু গল্পের ব্লগ। যদি পাঠকের ভাল লাগে। নিজেকে সার্থক বলে মনে করব।

প্রতিস্পর্ধী (প্রথম পর্ব)

০৭ ই জানুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ১:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আকাশটা তখনো গনগনে লাল। সন্ধ্যের পড়ন্ত বেলায় জায়গাটা নিস্তেজ হয়ে আসে। দু-একটা গাড়ির হুস হুস শব্দে সচকিত হয়ে ওঠে নিশ্ছিদ্র নিস্তব্ধতা। সাঁই সাঁই বেগে চলে গাড়িগুলো। তবু মেটে পথ ছেড়ে হাইরোডের রাস্তাটাই রোজ ধরে দৃপ্ত। এতে নাকি শর্টকাট হয়। হেঁটে হেঁটে রোজ এভাবে বাড়ি ফেরে সে। রাস্তার একধার দিয়ে সতর্ক হয়ে হাঁটতে থাকে। তবে আজ যেন সে কিছুটা অন্যমনস্ক। অন্য কোন ভাবনায় সে তন্ময় হয়ে ধীরে ধীরে পা ফেলছে। পিছন থেকে একটা ট্রাক আসছে। হয় সে সেটা বুঝতে পারেনি, নয়ত বুঝে সরে এসেছিল। একটা জোর ধাক্কা লাগল পিছন থেকে। নিমেষে ছিটকে পড়ল তার দেহটা দুহাত দূরে।
ট্রাকটা কিছুটা এগিয়ে থামল। তারপর ড্রাইভার তার খালাসীকে বলল, ‘খতম?’ খালাসীটা গাড়ি থেকে নেমে দৃপ্তর নাকের কাছে হাত নিয়ে গেল। তারপর ফিরে এসে জানাতেই, ড্রাইভার কাকে যেন মোবাইলে ফোন করে বলে দিল, ‘চিন্তা নেই বস। কাম পুরা হো গয়া’।
* * *
বিজনুর সেন্ট্রাল লাইব্রেরি। বাড়ির থেকে মাধবকে এখানেই পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই ওরা আগে এখানেই এসেছিল। মাধব তখন বই পড়ছিল – ‘কেন আমি ধর্মবিরোধী?’ বার্ট্রাণ্ড রাসেলের ‘হোয়াই আই অ্যাম নট অ্যা ক্রিশ্চিয়ান?’ বইটার বাংলা অনুবাদ। লাইব্রেরির নিস্তব্ধ একলা রিডিং রুমে ওদের পায়ের আওয়াজে সজাগ হয়ে ওঠে মাধব। পিছন ফিরে দেখে জনা তিনেক লোক। ওদের তিনজনের পকেটেই লাল রঙের গোলাপফুল গোঁজা। আর প্রত্যেকের মুখই বেশ ভয়ার্ত।
মাধব ওদের তিনজনকেই চেনে। প্রথম দুজন শ্যামলকাকু আর নিশুদা। ওর বাবার পাড়াতুতো বন্ধু। আর অন্যজন সিধুবাবু। তিনি শুধু বাবার নন, সবাইকার বন্ধু। যথেষ্ট ভাল ও উপকারী মানুষ বলেই সবাই তাকে চেনে জানে। অঞ্চলের সবার সাথেই তার সদ্ভাব। সকলের বাড়িতেই তার আনাগোনা।
শুরুটা করল শ্যামলকাকু। একটু কেশে নিয়ে, তারপর ঢোঁক গিলে, সে বলে, ‘মাধব, তোকে ... মানে তোর বাবার একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। তোকে এখনই হাসপাতালে যেতে হবে’।
প্রথমটা শুনেই মাধব একটা শক খেল। তারপর বিস্ফারিত চোখে সে সিধুবাবুর দিকে তাকাল। সিধুবাবু বয়স্য ও ভরসাযোগ্য। তিনি কিছুটা আশ্বাস দিলেন, ‘বিশেষ কিছু চিন্তার নেই। তুমি এসো আমাদের সাথে। আমরা রয়েছি তো’।
মাধব প্রথমটায় ভেঙে পড়ছিল। ওর ডান বাহু ধরে তুলে সিধুবাবু একটা ভাড়া করা ট্যাক্সি গাড়িতে চেপে বসলেন। সঙ্গে শ্যামলকাকু আর নিশুদা। আশ্চর্যের কথা, ট্যাক্সিটা কোন হাসপাতালের সামনে নয়, থামল বিজনুর পুলিশ স্টেশনের সামনে।
মাধব সন্দিগ্ধ স্বরে বলে, ‘এখানে এলাম কেন?’ সিধুবাবু সেসবে উত্তর না করে ওকে নিয়ে প্রথমে পুলিশ স্টেশনের অফিস ও সেখান থেকে এক অফিসার আর দুই কনস্টেবল সহ মর্গে গেলেন। মাধব দেখল সাদা কাপড়ের চাদরে ঢাকা শায়িত মানবদেহ। শবের মুখ থেকে কাপড়টা সরানো হল। ডানগালটা তুবড়ে ভেঙে গেছে। ডানচোখ নিশ্চিহ্ন আর মাথার ডানপাশটা থেঁতলে গেছে। তবু মাধবের চিনতে অসুবিধা হল না এটাই তার বাবার দেহ। কিন্তু এবার আর মাধব আগের মত ভেঙে পড়ল না।
‘সেন্ট্রাল হাইওয়ের ধারে পড়েছিল বডিটা। সম্ভবত ট্রাক বা ম্যাটাডর জাতীয় কোন গাড়ি এসে পেছন থেকে ধাক্কা মেরেছে। স্থানীয় লোকেদের কাছে খবর পেয়ে আমি নিজে স্পটে গেছিলাম। এখন আপনাদের কাছে কিছু প্রশ্ন আছে। অত্যন্ত জরুরী সেগুলো’। পেশাদারী ভঙ্গীতে একটানা কথাগুলো বলে থামলেন ওসি। খাকি রঙের ইউনিফর্মের পকেটে তার গোলাপী গোলাপটা শোভা পাচ্ছে।
টেবিলের ওধারে বসে তিনি। আর এপারে মাধব, সিধুবাবু, শ্যামলকাকু আর নিশুদা। সিধুবাবু মাধবের গার্জেন হয়ে নিজেই যেচে উত্তরটা দিলেন, ‘নিশ্চয়ই, আপনি প্রশ্ন করুন প্লিজ’।
- যদিও আমরা জানি না, এটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট না অন্য কিছু, তাও বলছি, আপনারা কি দৃপ্তবাবুর এই মৃত্যুর ব্যাপারে কাউকে সন্দেহ করেন? ওনার কোন শত্রু থাকতে পারে বলে মনে হয়?
সিধুবাবু মুখ বেঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে হেসে বললেন, ‘কার শত্রুর কথা বলছেন আপনি? দৃপ্তর? হাঃ হাঃ। শুনলেও হাসি পায়। সত্যি কথা বলতে কি জানেন, ওর মত এত প্রাণখোলা মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। আর এমন ভাল লোকের যে কোন শত্রু থাকতে পারে, এটা ভাবতে গেলেও উর্বর মস্তিষ্কের প্রয়োজন হয়’।
শ্যামলকাকুও তাতে সায় দেয়, ‘দেখুন স্যার, বন্ধু হিসেবে আমি ওকে যতটা চিনেছি তাতে ওর শত্রু থাকা প্রায় অসম্ভব। আমার তো মনে হয় এটা নিছকই একটা অ্যাক্সিডেন্ট’। তারপর সে মাধবের দিকে ফিরে বলে, ‘তোর কি মনে হয় মাধু?’
মাধব ধীরে ধীরে বলতে শুরু করে, ‘আমার মনে হয় বাবাকে খুন করা হয়েছে। আসলে বাবা অনেক কিছুই পছন্দ করত না। অনেক কিছু মেনে নিতেও পারত না সে বিনা প্রশ্নে। অ্যাক্সিডেন্ট নয়, বাবাকে মার্ডারই করা হয়েছে।
সেদিন মাধব যখন বাড়ি ফিরল, রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। সকালে রান্না করা ভাত ছিল, তরকারী ছিল। সে সেসব কিছুই খেল না। শোবার ঘরে বিছানায় সে খানিকক্ষণ বসে রইল। ভাবতে পারছে না সে কিচ্ছু। সিধুবাবু বলেছিল রাতটা ওনার বাড়িতে কাটাতে। কিন্তু সে তা চায়নি। বাবার মৃত্যুটা তাকে বড্ড ভাবিয়ে তুলছে। কি হয়েছে বাবার? অ্যাক্সিডেন্ট? নাকি খুন? পুলিশকে ‘মার্ডার’ বললেও সে ব্যাপারটা নিয়ে নিজেও যথেষ্ট ধন্দে। রাতটা বড্ড একা লাগে তার। গতকালও যাকে সে জলজ্যান্ত অবস্থায় দেখেছে, সেই মানুষটাই আজ আর নেই – একথা ভাবতেও মন চাইছে না। অনেকক্ষণ কাটল একথা সেকথা ভেবে। খানিকবাদে সে বাবার পড়ার ঘরে এল। বেশ বড় ঘরখানা। ঘরের মাঝখানে একটা ছোট গোল টেবিল। বাবা সেখানে লিখত। আর দেওয়াল ঘেঁষে রয়েছে গোটা চার-পাঁচ ছোটবড় আলমারি। বইয়ে ঠাসা সেসব। আর একটাতে বাবার লেখালিখির সরঞ্জাম। সেখানে প্রচুর খাতা, বই। বিভিন্ন রঙের কলম। মাধব এক-একটা খাতা খুলে খুলে দেখতে লাগল। প্রচুর লেখালিখি রয়েছে তাতে। ছোট ছোট হাতের লেখার অক্ষরগুলো যেন কালো পিঁপড়ের মত কিলবিল করে বেড়াচ্ছে হলুদ হয়ে যাওয়া পাতার ওপরে। খুব যত্ন নিয়ে লেখা সেগুলো। যদিও অপ্রকাশিত। মাধব সেসব লেখা উদ্দেশ্যহীনভাবে কতক পড়ল, কতক পড়ল না। পরে পড়বে বলে তাকে তুলে রাখল। হঠাৎ তার নজরে এল ঐ আলমারিরই অন্য একটা তাক। সেখানে কিছু চিরকুট। কিছু ছোট ছোট কাগজ আর তাতে বেঁকা বেঁকা লেখায় কিছু শব্দ – যা মুখে আনা যায় না। এগুলো জোরে পড়া যায় না। এসব লেখা মানে মৃত্যুকে ডাকা নয় তো কি? মাধবের আর সন্দেহ রইল না, বাবাকে মার্ডারই করা হয়েছিল।
* * *
জায়গাটার নাম বিজনুর। এখানকার মানুষগুলো সবাই, কিংবা সবাই না হলেও প্রায় সকলেই গোলাপ ভালবাসে। গোলাপ – তা সে লাল, নীল, গোলাপী, সাদা যে রঙেরই হোক না কেন। গোলাপ মাত্রেই বিজনুরের পরিচয়। এই পরিচয়ের ইতিহাস কোন বইতে লেখা নেই। কেউ বলতেও পারে না ভাল ভাবে। তবু কেউ কেউ বলে এ স্থানে কোন এক অজানিত কালে এক মহামারীর প্রকোপ ঘটেছিল। সমস্ত অঞ্চলের মানুষ সেই মহামারীতে উজাড় হয়ে যেতে বসে। ঠিক এমন সময়ে এক বিদেশী সেখানে এসে একটা গোলাপের চারা পোঁতে। মানুষের ধারণা, সেইদিন থেকেই মহামারী লুপ্ত হয়ে যেতে থাকে। যারা মৃত্যুশয্যায়, তারা তো বেঁচে গেলই আর যারা তখনও সুস্থ তাদের আর নতুন করে রোগে ধরল না। তবে সেই মহামারী, সেই বিদেশী, সেই গোলাপ – সবই আজ সত্যে মিথ্যে মিথে মিশ্রিত হয়ে মানুষের বিশ্বাসে এসে ঠেকেছে। পৌরাণিক গাথার মতই তা আজ ইতিহাস অথচ বিশ্বাস।
যাই হোক, বিজনুরের মানুষ তাই গোলাপ ভালবাসে। হয়ত সেই পৌরাণিক কাল থেকেই বাসে, কিংবা মন্দ বাসে না, কিংবা তাদের তা ভালবাসতে হয়। সিধুবাবু যখন প্রতিবেশী শ্যামলের বাড়িতে যান – তার হাতে থাকে লাল গোলাপ। শ্যামলের কাছেও গোলাপ। দুজনেই গোলাপ দিয়ে আগে দুজনকে সম্বোধন করেন। তারপর শুরু হয় বাক্যালাপ। বাড়িতে পোস্টম্যান চিঠি বিলি করতে এলে তার হাতেও গোলাপ, বাড়িতে ঝি কাজ করতে এলে তার ব্লাউজে গোঁজা থাকে গোলাপ, নিশুদা অফিসে গেলে তার হাতে থাকে গোলাপ, অফিসের টেবিলে ফুলদানি – হলুদ গোলাপ তাতে, বসের আবার পছন্দ সাদা গোলাপ – সে তার অফিসঘরে সাজিয়ে রাখে, বাসে কণ্ডাক্টার ভাড়া চাইতে এলে দেখবে তার পকেটেও মুখ উঁচিয়ে রয়েছে কমলা গোলাপ।
বিজনুরে গোলাপের চাষ হয়। হেক্টরের পর হেক্টর জমি শুধু গোলাপের চাষ হয়। সে জমিকে পাহারা দেওয়ার জন্য দিনরাত নিযুক্ত অতন্দ্র অগণিত প্রহরী। এদিকে গোলাপবাজারে থরে বিথরে লক্ষ লক্ষ টাকার গোলাপ বিকোয় প্রতিদিন। ভোর হতেই ফেরিওয়ালার অবিশ্রান্ত হাঁকে ঘুম ভাঙে সকলের। একটা গোলাপ চার টাকা। বাড়ির প্রতি সদস্য পিছু একটা করে গোলাপ। বাজারে গেলে তুমি তিন টাকায় পাবে। যাদের বাড়ি বাজারের কাছে কিংবা অবস্থা যাদের ততটা ভালো নয় – তারা বাজার থেকেই কেনে গোলাপ। বাকীরা কিছুটা আলস্যে কিছুটা অনাগ্রহে ফেরিওয়ালার ভরসাকেই করে সম্বল।
দৃপ্ত গিয়েছিল শ্যামলের বাড়ি। অফিস থেকে ফিরে তার খোশগল্প করতে যাওয়ার অন্যতম স্থান। সেদিন সে গিয়ে দেখে শ্যামলের মুখ উদ্বিগ্ন। ঘটনাটা হল, পাশের গলিতে থাকে দীপঙ্কর। বছর চল্লিশেক বয়স। গতকাল বাজার করতে গিয়ে সে অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। মোটরসাইকেল অ্যাক্সিডেন্ট।
- কিভাবে যে চালায় না এই বাইকগুলো। যেভাবে পারল, যা পারল ভুস ভুস করে চালিয়ে দিল। লোকজন দেখার দরকার নেই। নিধুদা মন্তব্য করে।
দৃপ্ত প্রশ্ন করে, ‘জনার্দন রোডে মারা গেল? সেখানে তো বিশেষ একটা মোটরসাইকেল চলে না?’
শ্যামল বলে ওঠে, ‘চলে না, কিন্তু গতকাল চলেছিল’।
- কেসটা দেখছি ধাঁধাঁলো! জানিস তো, দীপঙ্করও কিন্তু গোলাপ পছন্দ করত না’। দৃপ্ত বলে বসে।
- আর কি, তোমারই মত একটা গাধা। যখন যেখানে যেত, একটাবারও গোলাপ দেখতাম না পকেটে। ঐ ফুল ছাড়া কি আর বিজনুরের লোকেদের মানায়? শ্যামল বলে।
- তাহলে তুইও বলছিস গোলাপ পছন্দ করত না বলেই ওকে প্রাণ দিতে হল?
শ্যামল আমতা আমতা করে, ‘দেখো আমি আর তার কি জানি? পুলিশ তো অ্যারেস্ট করেছে একজনকে। দেখাই যাক না কি হয়?’
এমন সময় নিধুদা বলে, ‘কি দরকার বাপু পছন্দ না করে। শুধু শুধু নিজের বিপদ নিজে বাড়ানো। এমন ঘটনা তো আর এখানে প্রথম নয়। আগে থেকে তাই সাবধান হয়ে চলাই ভাল।
দীপ্ত আশ্চর্য হয়ে বলে, ‘তার মানে আমি একটা জিনিস পছন্দ করি না, আমি একটা কাজে সায় দিই না, আর আমার সেটা বলবার কোন হক নেই?
শ্যামল সেই আগের সুরেই বলে, ‘কে বলেছে নেই? তুমি কমলা না ভালবাসো, নীল গোলাপ তো বাসবে। লাল গোলাপ তোমার পছন্দ না হতেই পারে, কিন্তু হলুদ গোলাপও পছন্দ নয়?
- কি মুশকিল! আরে বাবা, চয়েস তো এর বাইরেও থাকতে পারে। কোথায় লেখা আছে, দেখা তো দেখি, যে ভাল না লাগলেও বলতে হবে গোলাপ ভাল লাগে? পারবি দেখাতে?
- সবই কি আর লেখা থাকে গো? ওগুলো বুঝে নিতে হয়। বুঝে, মেনে নিয়ে চুপ করে থাকতে হয়। নইলেই বিপদ।
- কিন্তু কেন? .................
মাঝে মাঝে বিতর্ক চলতে চলতে রাত এগারোটা সাড়ে এগারোটা বেজে যেত। মায়ের কেবলই ভয় লাগত, বাবার কিছু হল বুঝি। সে চিন্তায় চিন্তায় বহু রাত কাটিয়েছে বিনিদ্র।
মাধবের মা যতদিন ছিল তবু চলেছিল একরকম। ক্যান্সারে মারা গেল মা। বাবার প্রকাশ্যে এ কথা বলতে আর কোন বাধা রইল না যে সে গোলাপ ভালবাসে না। আগে মা শুনলেই মুখে আঙুল চাপা দিয়ে বলে উঠত, ‘চুপ কর, চুপ কর। কে কখন শুনে ফেলবে তার নেই ঠিক’।
তবু বাবা তার নিজের মতমাফিক বলে চলত, ‘আরে এত ভয় নিয়ে বাঁচা যায় নাকি? কিভাবে যে থাকো তোমরা, ভেবে পাই না’।
বাবা না চাইলেও সে বাড়ি থেকে বেরোবার সময় তার পকেটে মা ঠিকই ঢুকিয়ে দিত লাল কিংবা নীল গোলাপ। তবু বাবা যে সেসব পছন্দ করত না তা অনেকেই বুঝে ফেলেছিল। বিশেষত বাবার ঐ বেপরোয়া স্বভাবের জন্য বাবার বন্ধুসংখ্যাও ছিল নিতান্ত অল্প।

মায়ের ভাগ্যটা ছিল ভাল। তাই বাবার মৃত্যুটা তাকে দেখে যেতে হয়নি। মারা যাওয়ার ঠিক একদিন আগে মাধবকে একবার ডেকেছিল সে। মাধব তখন রান্নাঘরে ভাতের ফ্যান গালছে। বাবার অস্পষ্ট স্বর শুনেই সন্দেহ দানা বেঁধেছিল, ঘরে গিয়ে দেখল বাবা বিছানায় শুয়ে আছে। ঘরে জ্বলছে একটা টিমটিমে নাইটলাইট। কি ব্যাপার? এখন সবে রাত ন’টা, এই অবেলায় শুয়ে পড়ার লোক তো বাবা নয়। লেখালিখির কাজ না থাকলেও নিদেনপক্ষে সে পড়াশুনোটা চালিয়েই যায়। রাত এগারোটার আগে তো শোয়ার কোন প্রশ্নই নেই। তবে আজ কি তার কোন অসুখ করেছে?
‘না রে, অসুখ নয়। তবে ভাল লাগছে না। তোর মায়ের কথা মনে পড়ছে। সে থাকলে তাও দুটো কথা বলতে পারতাম। তুই ছেলেমানুষ, তোকে আর কি বলব। তবে এটুকু বলে রাখি, কিছু লোকের থেকে দূরে দূরে থাকাই ভাল। সবাই কিন্তু আমাদের ভাল চায় না। এটা জেনে রাখিস।
- তুমি এইসব কথা বলছ কেন? কি হয়েছে তোমার বল তো?
- না রে, আজ নয়, পরে একদিন বুঝিয়ে বলব।
মাধব সেদিন ভেবেছিল বাবার হয়ত মায়ের কথা মনে পড়ছে আর তাই তার অমন স্মৃতিমেদুর ভাব। কিন্তু সে ভুল যখন তার ভাঙল, তখন আর কিছুই করার নেই।
* * *

বিজনুরের মানুষ তাই গোলাপ ভালবাসে। এই ভালবাসা দিয়েই তারা বাঁচতে শিখেছে। তাদের জীবনে হাসি-কান্না আছে, আনন্দ-দুঃখ আছে। ক্ষুধা-তৃষ্ণা-নিদ্রা আছে। নিদ্রা ভাঙিয়ে সকাল আছে। তাছাড়া অফিস করা, সংসার করা, বাজার করা কিংবা টিভি দেখা – সবই আছে। শর্ত শুধু একটাই। ভালবাসতে হবে গোলাপফুল। এটাই হল তোমার পরিচয়। আর যারা তা ভালবাসে না, তারা হঠাৎ হারিয়ে যায় বিজনুর থেকে। কেউ তাদের কোন খোঁজ পায় না। কিংবা তাদের দেহে বাসা বাঁধে কোন দূরারোগ্য ব্যাধি – বিজনুরের কোন ডাক্তার যা সারাতে পারে না। তাও যদি না হয়, তবে দীপঙ্কর বা দৃপ্তর মত একটা গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট। আর তাতেই সব শেষ। ঘাতক গাড়িটাকে ধরবার জন্য পুলিশ হন্যে হয়ে চেষ্টা করে। হয়ত দু-একটা চুনোপুঁটি জালে ওঠেও। কিন্তু ব্যস, তারপরই সব চাপা পড়ে যায়। কিছুদিন পর জানা যায় – কেস ক্লোজড।
তবে এইসব ব্যতিক্রমী ঘটনা নিয়ে বিজনুরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তত চিন্তিত নয়। সাধারণভাবে, স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে পারলেই তাদের হল। আর শুধু তো গোলাপের প্রতি একটু ভালবাসা দেখানো। গোলাপ তো কত সুন্দর ফুল, তাকে আবার না ভালবেসে পারা যায় নাকি! আর যারা তাও ভালবাসে না, তাদের গোলাপ-পিরীতির একটু ভান করলেই তো হল। ল্যাঠা চুকে যায়। এ আর এমন কি কঠিন কাজ?
কিন্তু মুশকিলটা হল তাদের নিয়ে যাদের সংসার থেকে হারিয়ে যায় ছেলে কিংবা ভাই কিংবা বোন কিংবা কারুর বাবা বা স্বামী – তারাই কেবল বোঝে প্রিয়জনকে হারাবার কষ্টটা। তারা প্রতিবাদ করে, প্রতিরোধও গড়ে তোলবার চেষ্টা করে অল্পবিস্তর। কিন্তু তাদের সে প্রতিবাদ সমুদ্রে জলবিন্দুবৎ - কেউই তা শোনে না। আর শুনলেও সেসব ঝামেলা সবাই এড়িয়েই যেতে চায়।
তবে এদিক থেকে মাধবের ব্যাপারটা কিছুটা আলাদা। সে মাকে হারিয়েছে আগেই। সম্বল বলতে তার ছিল কেবল বাবাই। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব – কারুর সাথেই মাধবের বড় একটা খাতির নেই। হয়ত তা অনেকাংশে তার মতাদর্শের জন্যই। সে চিরকালই নিজের পথে নিজের মতে চলতেই ভালবাসে। লাইব্রেরীটাকে ভালবাসে, ভালবাসে পুরনো বইয়ের গন্ধ। গোলাপ তারও ভাল লাগে না কোনদিনই। তবু কোনদিন সে এ ব্যাপারে সক্রিয় হয়ে ওঠার কথাও ভাবেনি। কিন্তু আজ যে তার শেষ সম্বলটাও হারিয়ে গেল। সে কাউকে আজ আর ‘বাবা’ বলে ডাকতে পারবে না। প্রিয়জন আর কেউ নেই তার। তার হারাবার কিছুই রইল না। যাদের সঙ্গী-সাথী আছে, তাদের হারাবার ভয় আছে। কিন্তু মাধবকে ভয় পাওয়ানোর মত ক্ষমতাও আজ কারুর নেই।

(প্রথম পর্ব সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জানুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ১:১৫
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পিরিতের সংস্কৃতিওয়ালা তুমি মুলা’র দিনে আইলা না

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৬


---- আমাদের দেশে ভাষা, সংস্কৃতি এবং সামাজিক সমুন্নয়ন তলানিতে। তেমন কোন সংস্কৃতিবান নেই, শিরদাঁড়া সোজা তেমন মানুষ নেই। সংস্কৃতির বড় দান হলো ভয়শূন্য ও বিশুদ্ধ আত্মা। যিনি মানবের স্খলনে, যেকোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসরায়েল

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৪৮

ইসরায়েল
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

এ মাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ বাবাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
নিরীহ শিশুদের হত্যা করেছে ইসরায়েল
এই বৃ্দ্ধ-বৃদ্ধাদের হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ ভাইক হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ বোনকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
তারা মানুষ, এরাও মানুষ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

গ্রামের রঙিন চাঁদ

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১২


গ্রামের ছায়া মায়া আদর সোহাগ
এক কুয়া জল বির্সজন দিয়ে আবার
ফিরলাম ইট পাথর শহরে কিন্তু দূরত্বের
চাঁদটা সঙ্গেই রইল- যত স্মৃতি অমলিন;
সোনালি সূর্যের সাথে শুধু কথাকোপন
গ্রাম আর শহরের ধূলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১৭



পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষঃ
পালবংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপালদেব অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে এই বিহার তৈরি করছিলেন।১৮৭৯ সালে স্যার কানিংহাম এই বিশাল কীর্তি আবিষ্কার করেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরবাসী ঈদ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:২৩

আমার বাচ্চারা সকাল থেকেই আনন্দে আত্মহারা। আজ "ঈদ!" ঈদের আনন্দের চাইতে বড় আনন্দ হচ্ছে ওদেরকে স্কুলে যেতে হচ্ছে না। সপ্তাহের মাঝে ঈদ হলে এই একটা সুবিধা ওরা পায়, বাড়তি ছুটি!... ...বাকিটুকু পড়ুন

×