গল্পের প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
৪
দেবরাজ মুখোপাধ্যায়ের ডায়রি থেকে –
১১ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮
আজ যেটা সবথেকে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হলো তা হলো ধীমানের স্বপ্ন। অদ্ভুত একটা স্বপ্ন। আর বাস্তবের সাথে আশ্চর্য তার সমাপতন। ধীমান স্বপ্নের মধ্যে দেখতে পায়, অজস্র নাম লেখা একটা বিরাট বড়ো ছক। এতো ছোট ছোট নাম যে তার একটাও পড়া যায় না। ধীরে ধীরে সেই ছকটা কাছে আসতে শুরু করে। তারপর অসংখ্য নামের মধ্যে থেকে ঠিক একটা নাম পড়া যায়। নামটা চেনা, একজন পরিচিত প্রতিবেশীর নাম। ধীমানের কাছ থেকে জিগ্যেস করে ওর স্বপ্ন সম্বন্ধে এইটুকুই জানতে পেরেছি। আর ওর এই স্বপ্ন দেখার তিনদিন পর অর্থাৎ ঠিক চতুর্থ দিন রাত্রে সেই প্রতিবেশীর খুন হয় যার নাম সে স্বপ্নে দেখেছিলো। অত্যন্ত নৃশংসভাবে করা খুন। পুরো ব্যাপারটা মোট ছ’বার ঘটেছে। ছ’খানা খুন করা হয়েছে এভাবে। কিন্তু কিভাবে এটা সম্ভব?
এরপর জয়দীপ যা বললো, তাতে ভয় হবারই কথা। ওর কথাতেই লিখি-
‘ওর মায়ের যেহেতু এই ক’দিন সারারাত ঘুম হয়নি। তাই গতকাল রাতে আমিই ধীমানের পাশে শুয়েছিলাম। সারারাত জেগে থাকবার পরে প্রায় চারটে – সাড়ে চারটে নাগাদ যখন আমার চোখটা ঘুমে জড়িয়ে এসেছে, ঠিক সেই সময়ে টের পেলাম খাটটা ধরে যেন কেউ নাড়াচ্ছে। অত্যন্ত ভয়ানকভাবে নাড়াচ্ছে। আলোটা যেহেতু রাতে জ্বালিয়েই রেখেছিলাম, তাই দেখতে আমার সমস্যা হয়নি। কিন্তু যা দেখলাম তাতে আমার রাতের সমস্ত ঘুম ছুটে গেলো। দেখলাম, ধীমানের শরীরটাকে কেউ যেন অসম্ভব রকমের জোরে নাড়াচ্ছে। বাইরে থেকে কেউ এতো জোরে না নাড়ালে একটা মানুষের দেহ ঘুমের মধ্যে এভাবে নড়তে পারে না। আর তার সাথে একটা বিশ্রীরকমের গোঙানি। অমন ভয়ঙ্কর অবস্থা দেখে আমি জোরে চিৎকার করতে যাবো এমন সময় হঠাৎ ওর মুখে একটা নাম শুনলাম। আর নামটা শুনেই আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেলো।’
আমি জিগ্যেস করলাম, ‘নামটা কি?’
জয়দীপ বলে, ‘ধীমান স্যান্যাল।’ নামটা উচ্চারণ করতেই তার মুখটাও কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেলো।
ছেলে যে তার নিজের নাম বলেছে এটা জয়দীপ কাউকে জানায়নি। সুজাতা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়বে ভেবে সে ওকেও কিছু জানায়নি। কিন্তু সে নিজেই এতো আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে যে প্রায় নিরুপায় হয়েই গতকাল আমাকে ফোন করেছে।
তবে এখন এই স্বপ্নের রহস্যটাকে ভেদ করতে হবে। এর জন্য অনেক পড়াশুনো দরকার, অনেক ভাবনাচিন্তাও করতে হবে। কিন্তু হাতে আছে কালকের দিনটা আর পরশু। পরশু রাত্তিরবেলার মধ্যেই যা করবার তা করে ফেলতে হবে। জয়দীপ যদি গতকাল সকালে আমাকে সব জানাতো, তাহলে আরেকটু সময় পেতাম। তবে ধীমানের সাথে কথা বলে একটা ব্যাপার আমি বুঝতে পেরেছি –ছেলেটা কিন্তু অসম্ভব রকমের বুদ্ধিমান।
আজ বিকেলে ওদের ওখানে একবার যেতে হবে। তার আগে কিছু পড়াশুনো করে নিই।
১৩ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮
হিসেবমতো আজ আমার পরীক্ষার দিন। আর আমার এই পরীক্ষার সাফল্য বা ব্যর্থতার সাথে আমার বন্ধুর ছেলের জীবন জড়িত রয়েছে। তাই এটা আমার কাছে রীতিমতো চ্যালেঞ্জিং। অথচ এই ধরনের ঘটনা সম্বন্ধে আমার কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা তো নেই-ই, এমনকি এমন কোনো অপার্থিব ঘটনা যে ঘটতে পারে সে সম্বন্ধে আমি কোনদিন আন্দাজও করতে পারিনি।
তবে এই দুদিন আমি অনেক পড়াশুনা করেছি। সারারাত জেগে পড়েছি এবং নোট নিয়েছি। আর সকালে এবং বিকেলে একবার করে জয়দীপের বাড়ি গিয়ে এই তিনদিন ধরে ধীমানকে একটা মানসিক ব্যায়াম শিখিয়েছি। এই ব্যায়ামে ইচ্ছাশক্তি বাড়ে। এর নাম – আত্ম-সম্মোহন। জানি না, এইভাবে কতদূর আমি সফল হবো। তবে সমস্তটা বিশ্লেষণ করে আমি যতদূর বুঝেছি, তা যদি সঠিক হয় তবে আমি সাফল্য অর্জন করতে পারবো বলেই আমার বিশ্বাস। তবে একথাও ঠিক, এখানে একটা সামান্য ভুলও হয়ে উঠতে পারে আমার অথবা আমার কোনো প্রিয়জনের মৃত্যুর কারণ।
আর কিছুক্ষণ পরেই বেরোতে হবে। দেখা যাক, কি হয়।
৫
দেবরাজ যখন জয়দীপের বাড়ি গিয়ে পৌঁছোলো তখন ওদের সকলের ডিনার হয়ে গেছে। জয়দীপ আর সুজাতা তারই আসবার প্রতীক্ষায় বাইরের গেটে দাঁড়িয়েছিলো। দেবরাজ এসেই বললো, ‘আজ রাতে আমি ধীমানের সাথে থাকবো। অন্য কেউ থাকবে না।’ সুজাতা এর উত্তরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু জয়দীপ ওকে থামিয়ে বলে উঠলো, ‘ঠিক আছে, তাই হবে। কিন্তু ভাই, দেখিস, সবকিছু কিন্তু তোর ওপর নির্ভর করছে।’ বলতে বলতে জয়দীপের গলাটা ঈষৎ ধরে এলো। দেবরাজ ওর কাঁধে হাত রেখে বললো, ‘তুই চিন্তা করিস না জয়। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করবো। তবে একটা রিকোয়েস্ট। রাত্তিরে তোরা কেউ যেন এই ঘরে ঢুকবি না। তাতে বিপদ বাড়তে পারে।’ এই বলে আর ওদের সাথে কথা বাড়াতে চাইলো না দেবরাজ। ধীমানকে তার নিজের ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবার সুজাতা আর জয়দীপ সেখানে গিয়ে ধীমানকে বুঝিয়ে দিলো, ‘আজ রাতে দেবুকাকু তোমার সাথে থাকবে। তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।’ দেবরাজ সেই ঘরে যেতেই ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
আত্ম-সম্মোহনের মাধ্যমে ধীমানকে প্রথমে ঘুম পাড়ালো দেবরাজ। তারপর মোবাইলে রাত সাড়ে তিনটের সময় অ্যালার্ম দিয়ে সে নিজেও ঘুমিয়ে পড়লো। রাতে ভালো ঘুম হলো না। এক ঘণ্টা, দেড় ঘণ্টা অন্তর তার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিলো। পাশের ঘরে জয়দীপ আর সুজাতা রয়েছে। কথাবার্তার আওয়াজে বুঝতে পারলো, ওরাও রাতে ঘুমোতে পারছে না। সাড়ে তিনটের সময় অ্যালার্মের আওয়াজে ঘুম ভাঙলো তার। ঘুম থেকে উঠে আগে আলোটা জ্বাললো সে। তারপর ধীমানকে ধাক্কা দিয়ে জাগালো। ধীমানের ঘুম অত্যন্ত গাঢ়। তাই তাকে ঠিকমতো জাগাতে বিশেষ বেগ পেতে হলো তাকে। ধীমানের ঘুম যখন কিছুটা ভাঙলো ঘড়িতে তখন পৌনে চারটে বেজে গেছে। আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা যাবে না। চোখে জলের ঝাপটা দিয়ে ধীমানের ঘুমজড়িত ভাবটা কাটিয়ে তাকে শুয়ে চোখ বন্ধ করতে বললো দেবরাজ। ও চোখ বন্ধ করলে ওর কানের কাছে খুব আস্তে আস্তে দেবরাজ বলতে লাগলো, ‘তোমার সামনে দেখো একটা বিরাট বড়ো ছক। তার মধ্যে অজস্র নাম লেখা। তুমি একটা নামও পড়তে পারছো না। ভালো করে ছকটাকে দেখো…ছকটাকে দেখো….এইভাবে কিছুক্ষণ বলতে বলতে দেবরাজ থামলো। তারপর আবার বলতে লাগলো, ‘তোমার সামনে যে ছকটা আছে সেটা তুমি মুছে ফেলো ধীমান। ছকটাকে মুছে ফেলো ধীমান। মুছে ফেলো।’ এইভাবে বলতে বলতে দেবরাজ টের পেলো ধীমান আবার ঘুমিয়ে পড়ছে।
ঠিক এই সময়েই ঘরের মধ্যে একটা বিশ্রী গন্ধ নাকে এলো। আর তার সাথে সাথে বাতাস যেন খুব ভারী হয়ে আসতে লাগলো। দম আটকে আসছে দেবরাজের। হঠাৎ ঘরের আলোটা নিভে গেলো। দেবরাজ ভাবলো লোডশেডিং। কিন্তু রাস্তার স্ট্রীটলাইটগুলো সব জ্বলছিলো। সে দ্রুত উঠে একটা টর্চ জ্বাললো। কিন্তু একমুহূর্তের জন্য টর্চটা জ্বলেই নিভে গেলো। ঘরে একেবারে ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। আর ঠিক সেই সময় দেবরাজের চোখে পড়লো একটা অদ্ভুত জিনিস। যা দেখে তার সারা গায়ে শিহরণ দিয়ে উঠলো। সে দেখতে পেলো ঘরের এক প্রান্তে দুটো আলোর বিন্দু। হলুদাভ লাল সেই বিন্দু দুটো দেখলে মনে হয় যেন কোনো হিংস্র শ্বাপদের দুটো চোখ জ্বলজ্বল করছে। সেই বিন্দুদুটো ঘরের ঐ প্রান্ত থেকে ধীরে ধীরে ওদের দিকে আসতে লাগলো। আর সেটা যত কাছে আসছে, বিশ্রী গন্ধটা ততই আরো প্রকট হতে লাগলো। দেবরাজ বুঝতে পারলো, এই হলো সেই আততায়ী। এখানে যত নৃশংস খুন হচ্ছে, তার জন্য দায়ী এই শয়তান। এবার সে ধীমানকে লক্ষ্য করেছে। একে থামাতেই হবে। সামনের দিকে কিছুক্ষণ হাতড়াতেই সে একটা পেপারওয়েট পেলো। সজোরে সেই পেপারওয়েটটাকেই সে ছুঁড়ে মারলো ঐ চোখদুটোকে লক্ষ্য করে। পেপারওয়েটটা মেঝেতে পড়বার আওয়াজ হলো জোরে, কিন্তু আলোর বিন্দুদুটো যেমন এগিয়ে আসছিলো, তেমনই আসতে লাগলো। সামান্য পেপারওয়েটের আঘাত তার কিছুমাত্র ক্ষতি করতে পারলো না।
এবার? এবার ধীমানকে এই অশরীরীর হাত থেকে বাঁচাবে কি করে সে? হঠাৎ দেবরাজের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেলো। সে ধীমানের কানের কাছে এসে আবার বলতে লাগলো, ‘ধীমান, তোমার সামনে যে ছকটা দেখছো সেটাকে মুছে ফেলো। খুব তাড়াতাড়ি মুছে ফেলো ধীমান। আর সময় নেই। খুব তাড়াতাড়ি মুছে ফেলো। এই নাও ইরেজার।’ এই বলে সে তার হাতের টর্চটাকেই ধীমানের হাতে ধরিয়ে দিলো। আর তখনই এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটলো। ধীমান ঘুমের মধ্যেই টর্চটাকে নিয়ে খুব জোরে নাড়াতে লাগলো। আর সাথে সাথে তার সামনের ঐ রক্তিমাভ আলোকবিন্দু দুটো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। তারপর শুরু হলো একটা চাপা গোঙানির আওয়াজ। যেন কেউ একটা চাপা আক্রোশে ফুঁসছে। এইভাবে কতক্ষণ চললো বলতে পারি না। হঠাৎ একসময় টিউবলাইটটা জ্বলে উঠলো। দেবরাজ দেখলো, ধীমান অচৈতন্য অবস্থায় ঘুমিয়ে আছে। টর্চটা তখনও তার হাতে ধরা। কিন্তু ঘরে কোথাও কোন প্রাণী তো দূরস্থ একটা টিকটিকিও খুঁজে পাওয়া গেলো না।
দেবরাজ খুব বিমর্ষ হয়ে পড়লো। বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলো ভোর হয়ে গেছে। সকাল ছ’টার সময় সে জয়দীপ আর সুজাতাকে এ ঘরে ডাকলো। ওরা এসে দেখলো ধীমান ঘুমিয়ে রয়েছে, সম্পূর্ণ সুস্থ। আজকের রাতে দেবরাজেরই জয় হয়েছে। তাই দেখে ওদের আনন্দ আর ধরে না। ছেলেকে আদর করে, চুমু খেয়ে তারা ওর ঘুমটাই ভাঙিয়ে দিলো। তারপর জয়দীপ দেবরাজের কাছে এসে ওর হাত দুটো ধরে বলে ওঠে, ‘ভাই, ধন্যবাদ দিয়ে তোকে আর ছোটো করবো না। তুই আমার যা উপকার করলি, কোন বন্ধু এমনটা করতে পারে? তোকে যে কি বলবো…’ আর কিছু কথা না খুঁজে পেয়ে সে আনন্দে দেবরাজকে জড়িয়ে ধরলো। সুজাতাও এসে তাকে অনেকবার ধন্যবাদ জানালো। তাকে আজকের দিনটা খেয়ে যেতেও বললো ওরা। কিন্তু দেবরাজকে খুব অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিলো। সে ওদের কোনো উৎসাহেই যোগ দিতে পারছিলো না।
জয়দীপ ওকে এমন দেখে জিগ্যেস করলো, ‘কি হয়েছে ভাই? কোনো সমস্যা?’
দেবরাজ বললো, ‘অ্যাঁ, না। সমস্যা নয়। তবে আমার অসতর্কতার জন্যে আজ একটা বড়ো ভুল হয়ে গেলো রে।’
সুজাতা বলে, ‘কি ভুল দেবরাজদা?’
জয়দীপ বললো, ‘ওসব ছাড়। তার আগে বল, তুই এই অসম্ভব কাজটাকে সম্ভব করলি কি করে?’
দেবরাজ একটু গুছিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করলো, ‘দেখ, মূল ঘটনাটা আমি যা বুঝেছি সেটা বলছি। আমার ধারণা, অন্য কোনো বিজাতীয় শক্তি এসে ধীমানকে ব্যবহার করছিলো। সেই শক্তিটা আধিভৌতিক অথবা আধিদৈবিক হতে পারে। তবে তার পছন্দের জিনিস হলো মানুষের মাথার ঘিলু আর যকৃত। যে কারণেই হোক, সে এই দুটো জিনিসকে পেতে চায়। কিন্তু এখানকার আটঘাট সে বিশেষ বোঝে না। কোনো একটা সূত্র ধরে তাকে সমস্তটা বুঝতে হয়। সে তাই ধীমানের স্মৃতিটাকে ব্যবহার করে। ধীমান যে ছকটা দেখছিলো সেটা তার স্মৃতিতে থাকা লোকের নাম। আততায়ী সেইসব লোকের নাম আর তাদের সমস্ত বিবরণ ধীমানের স্মৃতি থেকে সংগ্রহ করে ছকটা প্রস্তুত করেছিলো। তারপর যাকে সুবিধাজনক মনে হচ্ছিলো, তাকে সে খুন করে তার উদ্দেশ্য সাধন করছিলো। ঐ ছকটাই ছিলো ওর মূল হাতিয়ার।’
জয়দীপ বলে, ‘কিন্তু তাহলে ধীমানকেই ও মেরে ফেলবার চেষ্টা করবে কেন?’
প্রশ্নটা শুনে সুজাতা হঠাৎ চমকে উঠে জয়দীপের দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকালো। কিন্তু দেবরাজের সামনে সে বিশেষ কিছু প্রকাশ করলো না। দেবরাজ বলে, ‘তার কারণ, আমার ধারণা, ধীমানের স্মৃতি থেকে তার আর কিছু পাওয়ার ছিলো না। তাই সে তাকে হত্যা করে সে তার যাবতীয় প্রমাণ লোপাট করতে চাইছিলো।’
জয়দীপ বলে, ‘যাই হোক, সে তো আর তা পারেনি। আমার ছেলে বেঁচে গেছে।’
দেবরাজ বলে, ‘তোর ছেলে তো বেঁচে গেলো। কারণ ওর ইচ্ছাশক্তি বাড়িয়ে স্বপ্নের মধ্যে কিভাবে ছকটা মুছে ফেলতে হয় সেটা আমি ওকে শিখিয়ে দিয়েছি। ঐ ছকটাকে মুছে ফেলে আততায়ীর প্রধান অবলম্বনটাকেই সে ধ্বংস করে দিয়েছে। তোর ছেলের আর বিপদ নেই।’
জয়দীপ বলে, ‘তাহলে তো আর চিন্তাই নেই।’
দেবরাজ অধৈর্যের ভঙ্গীতে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলে, ‘না রে, না। চিন্তা আছে। রাত্তিরবেলায় যার হিংস্র চোখদুটো আমি দেখেছিলাম সে পালিয়ে গেছে।
জয়দীপ অবাক হয়ে যায়, ‘হিংস্র চোখ?’
দেবরাজ রাত্তিরবেলায় যা দেখেছিলো সেটা বর্ণনা করে। তারপর বলে, ‘ঐ চোখদুটোই হচ্ছে সর্বনাশ। তুই বলতিস না, যে খুন হবে, সে নিজেই রাত্তিরবেলায় ঘর থেকে বেরিয়ে যেতো? তারপর তাকে আর কোথাও পাওয়া যেতো না। এই চোখদুটোই তার কারণ। ঘুমন্ত ব্যক্তিকে ঘুমের মধ্যে সে প্রলুব্ধ করে তাকে বাইরে টেনে নিয়ে যেতো। তারপর জনবিরল এলাকায় নিয়ে গিয়ে সে তার কাজ সারতো।
সুজাতা বলে ওঠে, ‘ওঃ কি সাঙ্ঘাতিক!!’
দেবরাজ ম্রিয়মাণভাবে বলে, ‘সেই কারণেই তো আমি কিছুতেই শান্তি পাচ্ছি না। পালিয়ে তো গেলো, এবার সে কিভাবে কাকে আক্রমণ করবে আমরা এখনও তার বিন্দুবিসর্গও জানি না।’
দেবরাজের কথা শুনে জয়দীপ আর সুজাতা দুজনেরই মুখ শুকিয়ে এলো। তাদের আনন্দে সেই আগের উচ্ছ্বাস আর রইলো না।
৬
সেইদিন আর তার পরেরদিন দেবরাজ খুব ভালো করে বিশ্রাম নিলো। আগের দিনগুলোর ধকল সহ্য করে তার আর কোনো কাজেই মন বসছিলো না, বাড়ির লোকের সাথেও বেশি একটা সময় দিতে পারলো না। দুদিন ধরে বিশ্রাম করে একটু চাঙ্গা হলো সে। তারপর একদিন বিকেলে রত্না তাকে ধরলো, ‘বাবা, জয়দীপকাকুদের বাড়িতে কি হয়েছিলো বলো না।’ দেবরাজ বললো, ‘এখন নয়, সন্ধেবেলা চা খাওয়ার সময় বলবো। কেমন?’
সন্ধেবেলার ছাদগল্পে আজকে জয়দীপদের বাড়ির ঘটনাটাই পুঙ্খনাপুঙ্খরূপে বর্ণনা করতে লাগলো দেবরাজ। ধীমানের স্বপ্নের ব্যাপারটা যখন সে বলছে, তখন দেবরাজকে থামিয়ে রত্না হঠাৎ বলে ওঠে, ‘বাবা, জানো, এই স্বপ্নটাই কাল আমি দেখেছি। একটা ছক, আর তার মধ্যে অজস্র নাম লেখা।’
বিস্ময়ে চিৎকার করে ওঠে দেবরাজ, ‘বলিস কি?’
এবার মৌমিতা বলতে শুরু করে, ‘হ্যাঁ গো। তোমার শরীরটা ক্লান্ত ছিলো না বলে কিছু জানাইনি। মেয়ে কাল রাতে স্বপ্ন দেখে খুব ভয় পেয়ে গেছিলো। সে কি ছটফটানি আর গোঙানি! আমি ওকে যত থামাতে চাই ততই ও গোঙাতে থাকে। কিন্তু পরে বুঝলাম ঐ গোঙানির মধ্যে ও একটা নাম বলছিলো।’
দেবরাজ উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে, ‘কি নাম?’
মৌমিতা বলে, ‘তোমার নাম, দেবরাজ মুখোপাধ্যায়।’
::সমাপ্ত::

সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই আগস্ট, ২০২০ দুপুর ১২:৪৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




