somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

‘ইসলামী দর্শন’ বা ‘হিকমাত’ কি ?

১৪ ই মার্চ, ২০১৮ বিকাল ৫:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ঐতিহাসিক বর্ণনানুসারে প্রথম মুসলিম দার্শনিক হলেন আল কিন্দি। কিন্তু আল কিন্দির অনেক পূর্ব থেকেই তৎকালীন মুসলিম সমাজে বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাভাবনার যথেষ্ট প্রচলন ছিল। আর এই বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাভাবনার মূল উৎস ছিল আল কোরআন এবং এ কোরআন কেন্দ্রিক গড়ে ওঠা চিন্তার ভিত্তিও ছিল বুদ্ধিবৃত্তি। পবিত্র কোরআনে অসংখ্য আয়াত রয়েছে যা জ্ঞানী ও বিচক্ষণ ব্যক্তিদের সম্বোধন করে বর্ণিত হয়েছে। এরই পাশাপাশি অসংখ্য আয়াতে বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টি লাভের জন্য মানুষকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। বিশ্ব-পরিচিতি লাভের উৎসাহ দিয়েই কোরআন ক্ষান্ত হয়নি, বরং বিশ্ব-পরিচিতি ও বাস্তব পরিচিতি অর্জনের ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও উপস্থাপন করেছে। এরই সূত্র ধরে মুসলিম সমাজে চিন্তাচেতনার এক মজবুত ভিত্তি গড়ে উঠেছে যার প্রতিফলন ঘটেছে সেই যুগের মনীষীদের মধ্যে।
হেনরী কোরবিন তাঁর ‘ইসলামী দর্শনের ইতিহাস’ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে ‘ইসলামী দর্শনের উৎসসমূহ’ শিরোনামের প্রথমেই কোরআনের বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে ইসলামী দর্শনের একটি মূল উৎস হলো কোরআন। পবিত্র কোরআন থেকেই মুসলমানরা দার্শনিক চিন্তাচেতনার অনুপ্রেরণা ও খোরাক পেয়েছেন।
বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানের প্রথম সারির ব্যক্তিদের অন্যতম হলেন হযরত আলী (কাঃ)। হযরত আলী (কাঃ) এর পত্র, খুতবা ও উপদেশবাণীপূর্ণ গ্রন্থ ‘নাহজুল বালাগাহ্’ বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্মিক আলোচনায় পূর্ণ। ‘নাহজুল বালাগাহ্’ দর্শনের অসংখ্য পরিভাষা সৃষ্টি করেছে এবং অধিবিদ্যার অনেক বিষয়কে অনেক সূক্ষ¥ভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছে। ‘নাহজুল বালাগাহ্’ গ্রন্থে দার্শনিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক পন্থায় আলোচিত অনেক বিষয় রয়েছে যার মধ্য থেকে কয়েকটি আমরা এখানে উল্লেখ করছিঃ
আল্লাহর অস্তিত্ত্ব বিষয়ক (১০৮ ও ১৯৫ নম্বর খুতবা ও ৩১ নম্বর পত্র), একত্ববাদ বিষয়ক (এক নম্বর খুতবা), আল্লাহর বৈশিষ্ট্যসমূহ ও সত্ত্বার সাথে ঐ বৈশিষ্ট্যের সম্পর্ক বিষয়ক (১৬০, ১৯৮, ১৯৯, ১২৩ নম্বর খুতবা), সৃষ্টির সাথে ¯্রষ্টার সম্পর্ক (১, ৪৯, ৬৫, ৮৬, ১৩৩, ১০৮, ১০৯, ১৫২, ১৬৩, ১৮৫, ১৮৬, ১৯৫, ১১৮, ১৯৫ নম্বর খুতবা ও পত্র ৩১), বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে, না কি অনাদি- এ বিষয়ক (১, ৯১, ১৬৩, ১৮৬ নম্বর খুতবা), অস্তিত্ত্ব জগতের বিভিন্ন স্তর (১ ও ৯১ নম্বর খুতবা)... ইত্যাদি। তাই আল কিন্দির পূর্বেও মুসলিম সমাজে ব্যাপকভাবে বুদ্ধবৃত্তি চর্চা হতো তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। তবে প্রতিষ্ঠিত প্রথম দার্শনিক হিসেবে সাধারণত আল কিন্দিকে ধরে নেওয়া হয়।
অন্যদিকে ইসলামী উসূল, ফিকাহ্শাস্ত্র ও কালামশাস্ত্রীয় আলোচনার একটি বিরাট অংশ স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তির ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। মু’তাযেলী কালামশাস্ত্র বুদ্ধিবৃত্তিক চরমপন্থার (Intellecualism) ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। তাঁদের কাছে যুক্তি বা বুদ্ধিই মুখ্য, এমনকি ধর্মীয় কোন বিষয়ের ক্ষেত্রেও যদি বুদ্ধি ও শরীয়তের সিদ্ধান্ত ভিন্ন হয় তাহলে তাঁরা বুদ্ধিবৃত্তিক সিদ্ধান্তকে গ্রহণ করতেন। এ জাতীয় কালামশাস্ত্রে Islamic theologic Scholastic- এর উৎপত্তি ঘটে হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রথমার্ধে। এ মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা হলেন হাসান বসরীর (মৃত্যু ৭২৮ খ্রিঃ) শিষ্য ওয়াসেল বিন আ’তা (মৃত্যু ৭৪৮ খ্রিঃ)।
ইসলামী দর্শনের আলোচনার শুরুতেই একটি মৌলিক প্রশ্ন আমাদের সামনে আসে। যে প্রশ্নটির সূত্র ধরে তথাকথিত বুদ্ধিজীবী মহলের অনেকেই ইসলামী দর্শনের ভিত্তিকেই সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে থাকেন। তাঁদের দৃষ্টিতে ইসলামী দর্শন বলতে কোন দর্শনই নেই। তাই তাঁদের মতে ‘ইসলামী দর্শন’ এই পরিভাষা থেকে ‘ইসলাম’ কথাটি বাদ দেওয়া উচিত। কেননা, প্রথমত ‘ইসলামী দর্শন’ নামের দর্শনটি সম্পূর্ণরূপে গ্রীক দর্শনের নকল। ফ্রান্সের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আরনেস্ট রেনান (Ernest renan) বলেন, “এই দর্শন [ইসলামী দর্শন] অ্যারিস্টটলের অন্ধ অনুকরণ বৈ কিছুই নয়। এখানে কেবল গ্রীক চিন্তভাবনাকেই আরবী ভাষায় লেখা হয়েছে।” [E. Renan Aeverroeset, paris, v১১১ ed, p, ৭-৮] এ উদ্ধৃতিটি নেয়া হয়েছে আরবী গ্রন্থের ফারসী অনুবাদ ‘দার বরে-এ ফালসাফায়ে ইসলামী রাভেশ ওয়া ত্বাতবিকে অন্’ মূল লেখক- ইবরাহীম বাইউম্মী মাদকুর, অনুবাদক আব্দুর রহমান অয়াতি, প্রকাশকাল ফারসী সাল ১৩৬১, পৃষ্ঠাঃ ০৮।]
দুহিম বলেন, “ইসলামী দর্শন নব প্লেটোনিক দর্শনেরই (Neoplatonic) নকল।”[ Duhem , Le Systeme du monde, paris, ১৯১৭, T, ১v, p, ৩২১ es suive.] ২ এখন প্রথম প্রশ্নটি হলো ইসলামী দর্শন কি গ্রীক দর্শনের নকল? যদি তা-ই তবে তাকে কখনই ইসলামী দর্শন নাম করা উচিত নয়।
দ্বিতীয়ত দর্শন একটি স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান। তাই স্বাধীন জ্ঞানের সাথে ইসলাম বা খ্রিস্টধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। কেননা, স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তি কোন জাতি-গোষ্ঠী বা ধর্মের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। আরো সহজ ভাষায় বলতে গেলে বিষয়টি এমন যে, বুদ্ধির সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। তাই প্রশ্ন হলো ইসলামকে দর্শনের সাথে সংযুক্ত করা কতটা যুক্তিযুক্ত?
প্রথম প্রশ্নটি ছিল ইতিহাসগত প্রশ্ন, আর দ্বিতীয় প্রশ্নটি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রশ্ন। মোটকথা, এ দু’টি প্রশ্নকে সামনে রাখলে ইসলামী দর্শন বলতে কোন দর্শনেরই আর অস্তিত্ত্ব থাকে না।
উল্লিখিত প্রশ্ন দু’টির ওপর ভিত্তি করে আমার আলোচনাকে কয়েকটি অংশে ভাগ করে নিয়েছি। যথাঃ
১। ইসলামী জ্ঞান বলতে আমরা কী বুঝে থাকি? বা ইসলামী জ্ঞানের সংজ্ঞা ও কোনো জ্ঞান ইসলামী হওয়ার মানদন্ড কী?
২। হিকমাত ও ইসলামী দর্শন;
৩। বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান ও ইসলাম;
৪। পাশ্চাত্য দর্শনে ইসলামী দর্শনের প্রভাব।


ইসলামী জ্ঞানের অর্থ
ইসলামী জ্ঞান বলতে আমরা কী বুঝে থাকি? কোন্ কোন্ প্রকারের বিদ্যাকে আমরা ইসলামী জ্ঞানের অন্তর্ভূক্ত করতে করতে পারি? অন্যভাবে বললে ইসলামের সাথে জ্ঞানের আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে কী? তাই ‘ইসলামী জ্ঞান’ না বলে ‘মুসলিম জ্ঞান’ বলা উচিত। এমনটি ঘটেছে ইসলামী জ্ঞানের ব্যাপারে, বিশেষ করে ইসলামী দর্শনের ক্ষেত্রে। অনেকে ইসলামী দর্শনকে ধরে নিয়েছিলেন আরব দর্শনের সমার্থক শব্দ হিসাবে। তাঁদের যুক্তি ছিল ইসলামী দর্শন নামের বিশেষ দর্শনের গ্রন্থসমূহ যেহেতু আরবী ভাষায় রচিত হয়েছে সেজন্য তাকে ‘আরবীয় দর্শন’ বলা উচিত।[ইসলামী দর্শনের ইতিহাস, হেনরী কোরবিন, পৃষ্ঠাঃ ৭।] কিন্তু সামান্য গবেষণার পরেই যখন বুঝতে পারলেন ইসলামী দর্শন নামের দর্শনের মহান দার্শনিকগণ পারস্যের বা বর্তমান ইরানের অধিবাসী এবং ফারসী ভাষাতেও অসংখ্য দর্শন গ্রন্থ রচিত হয়েছে তখন তাঁরা তাঁদের পূর্ব ধারণার গন্ডিটি আরকেটু প্রসারিত করে বললেন, এ দর্শনকে ‘মুসলিম দর্শন’ বলা উচিত।[ইসলামী দর্শনের ইতিহাস, হেনরী কোরবিন, পৃষ্ঠাঃ ৭।] তাঁদের এরূপ মতামতের সপক্ষে তাঁরা কোন যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ উপস্থাপন এবং এ ক্ষেত্রে সঠিক কোন নীতি অবলম্বন করেন নি। আর এ কারনেই খেয়ালখুশী অনুযায়ী মত পেশ করে থাকেন এবং পরক্ষণে পূর্বের মত থেকে আবার সরে আসেন।
পৃথিবীতে এমন কোন সভ্যতা আছে কি যে সভ্যতা গড়ে ওঠার পথে অন্য কোন সভ্যতা থেকে উপকৃত হয়নি? এমনকি গ্রীকসভ্যতাও তার পূর্বের মিশরীয় ও ভারতীয় সভ্যতা থেকে উপকৃত হয়েছে। অর্থাৎ প্রতটি সভ্যতা গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে তার পূর্বের বা সমসাময়িক সভ্যতা থেকে তার প্রয়োজনীয় সাহায্য নিয়ে থাকে। তবে এ সাহায্য দু’ভাবে হতে পারেঃ
১। ঐ সভ্যতাকে অন্ধের মতো অনুকরণ করে;
২। জাতীয়করণ পদ্ধতির মাধ্যমে।
কোন সভ্যতাকে অন্ধের মতো অনুকরণ করে কখনও নতুন একটি স্বতন্ত্র সভ্যতা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। কেবল অনুবাদ ও অনুকরণ করে সভ্যতা গড়া যায় না। কোন সভ্যতা গড়ে ওঠার প্রথম শর্ত হলো ঐ সভ্যতা গড়ে ওঠার মতো শক্তিশালী একটি ভিত্তির উপস্থিতি। সভ্যতা গড়ে তোলার জন্য যথেষ্ট মেধার প্রয়োজন। আর অনুবাদের মাধ্যমে মেধা আমদানী করা যায় না। বরং মেধা হলো একটি জাতীয় সম্পদ। তবে আধুনিক যুগে মেধা আমদানী-রফতানী হচ্ছে, বিশেষ করে পাশ্চাত্য জগৎ তাদের বস্তুগত সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে গরীব দেশের জাতীয় সত্ত্বা বিচ্ছিন্ন মেধাবীদের ক্রয় করছে। তাই আজ আমরা বলতে পারি, বর্তমান পাশ্চাত্য সভ্যতার আর্থিক ও মানবিক (মেধাগত) ভিত্তি- দু’টিই আমদানী করা সম্পদ। তারপরও স্বীকার করতে হয় এই সভ্যতার অবকাঠামো তাদের নিজস্ব প্রকৃতি থেকে উৎপত্তি ঘটেছে। অবকাঠামোকে বহির্বিশ্ব থেকে আমদানী করা হয়নি। মোটকথা, প্রাচীন গ্রীক দর্শন অনুবাদ করে ইসলামী দর্শনের ভিত্তি বা অন্য কোন দর্শনের ভিত্তি রচনা করা সম্ভব নয়। আব্বাসী খেলাফতের যুগে যত গ্রন্থ অনুবাদ হয়ে মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছে তার চেয়ে অধিক গ্রন্থ মুসলিম সমাজ থেকে অনুবাদ হয়ে মধ্যযুগে পাশ্চাত্যে গমন করেছে। এমনকি মধ্যযুগের শেষে পাশ্চাত্যের রেঁনেসার যুগেও আরেক দফা মুসলিম মনীষীদের গ্রন্থ অনুবাদ হয়ে পাশ্চাত্যে প্রবেশ করে- যার সত্যতা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে।
কোন সভ্যতা থেকে উপকৃত হওয়াটা নেতিবাচক কিছু নয়। আমরা এ কথা বলতে মোটেও সংকোচ বোধ করি না যে, ইসলামী দর্শনের প্রথম যুগে প্রাচীন গ্রীক দর্শনের কিছু কিছু গ্রন্থ আরবী ভাষায় অনুবাদ হয়ে মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলোঃ শুধু অনুবাদ করেই একটি বিশাল দার্শনিক আদর্শ সৃষ্টি করা কি সম্ভব? মোটেও সম্ভব নয়। আর ইসলামী দর্শনে অনুবাদকৃত প্রাচীন গ্রীক দর্শনের অবিকৃত নমুনা পাওয়া আজ বেশ দুষ্কর। প্রাচীন গ্রীক দর্শন যখন মুসলিম সমাজে প্রবেশ করে তখন সেখানে দার্শনিক বিষয় ছিল দু’শত, আর বর্তমানে ইসলামী দর্শনের বিষয়াবলী হচ্ছে সাত’শর মতো। শুধু তাই নয়, উল্লিখিত প্রাচীন গ্রীক দর্শনের দু’শটি বিষয়কে আবার তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যার একটি অংশ মুসলিম দার্শনিকদের দ্বারা সংশোধিত হয়েছে বা বাদ পড়েছে, আরেকটি অংশ ইসলামী চিন্তার আলোকে ব্যাখ্যার মাধ্যমে নতুন রূপ লাভ করেছে, আর শেষের অংশটির ক্ষেত্রে আরো নতুন নতুন যুক্তি ও প্রমাণ সংযোজন করা হয়েছে।
অর্থাৎ মুসলমানরা প্রাচীন গ্রীক দর্শন হুবহু গ্রহণ করেননি; বরং তাঁরা তাঁদের বুদ্ধিবৃত্তির আলোকে বিচার-বিশ্লেষেণ করেই তা গ্রহণ করেছেন। এই বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তাঁদের ধর্মীয় চেতনা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা পালন করেছে। কেননা, মুসলমানরা তাঁদের আদর্শকে বিভিন্নমুখী জ্ঞানের আলোকে ব্যাখ্যা ও সমুন্নত করার লক্ষ্যে দর্শনের শরণাপন্ন হন।
মহান ইসলামী সভ্যতায় এমন কিছু শক্তিশালী উপাদান রয়েছে যার ফলে অন্য কোন সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে সহজেই জাতীয়করণ করা সম্ভব হয়েছে। যেমনঃ পারস্যের প্রাচীন সভ্যতা ইসলামের প্রভাবে পরিশোধিত হয়ে মুসলিম সভ্যতায় রূপান্তরিত হয়েছে। কেননা দ্বিত্ববাদী এক ধর্মের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল তাদের সংস্কৃতি ও সভ্যতা। ইসলামের সংস্পর্শে এসে সে সভ্যতার নেতিবাচক দিকগুলোর বিনাশ ঘটেছে, আর ইতিবাচক দিকগুলো স্বাভাবিক গতিতেই ইসলামের ছত্রছায়ায় ধর্মীয় রূপ লাভ করেছে।
বিশুদ্ধ জ্ঞানার্জনের জন্য ইসলাম ধর্মে পূর্ণ স্বাধীনতা ও উৎসাহ দিয়ে বলা হয়েছেঃ “জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে বক্তার প্রতি লক্ষ্য করো না, বরং লক্ষ্য করো সে কী বলছে।”[ ইমাম আলী (আঃ) বলেনঃ لا تنظر إلى من قال وانظر إلى ما قال] তাই বলা যায় শুধু তরবারীর শক্তিতে রাজ্য জয় করা হয়নি, বরং জ্ঞান এক্ষেত্রে আরো অধিক ভূমিকা রেখেছে, তাই আজও ইসলাম বিশ্বের অন্যতম শক্তি হিসেবে টিকে আছে। সুতরাং এটি ইসলাম ধর্মের এক বিশেষ কৃতিত্ব। ইসলাম ধর্মে জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে যতটা গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এমনটি বিশ্বের অন্য কোন আদর্শে করা হয়নি। প্রজ্ঞাকে (হিকমাত) হারানো মানিকের সাথে তুলনা করা হয়েছে। দোলনা থেকে মৃত্যু অবধি জ্ঞানার্জনের কথা বলা হয়েছে। জ্ঞান অর্জনের জন্য যেখানে যাওয়া প্রয়োজন সেখানেই যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
ইরানের ইসলামী বিপ্লবের চিন্তাগত ভিত্তির রচয়িতা শহীদ ওস্তাদ মুতাহ্হারী বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে চার প্রকারের ইসলামী জ্ঞানের সংজ্ঞা ও পরিচয় দিয়েছেন। যথাঃ
১। যে সকল বিদ্যার বিষয়বস্তু ও উপকরণসমূহ ইসলামের মূল (উসূল) অথবা শাখাগত (ফুরু) বিষয় থেকে নেওয়া হয়েছে অর্থাৎ এমন বিদ্যা যা কোরআন ও সুন্নাহ্ সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। যেমনঃ পঠনশাস্ত্র (কিরাআত), তাফসিরশাস্ত্র, হাদীসশাস্ত্র, কালামশাস্ত্র, ফিকাহ্শাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র ইত্যাদি।
২। যে জ্ঞানসমূহ পূর্বোক্ত বিদ্যাসমূহের প্রাথমিক উপকরণমূলক বিদ্যা। যেমনঃ আরবী ব্যাকরণ, বুদ্ধিবৃত্তিক কালামশাস্ত্র, বুদ্ধিবৃত্তিক নীতিশাস্ত্র, ¯স্রষ্টাতত্ত্ব (ঐশী দর্শন), যুক্তিবিদ্যা, উসূল-এ ফিক্হ ইত্যাদি।
৩। যে সকল জ্ঞান কোন না কোনভাবে ইসলামী জ্ঞানের সাথে সংশ্লিষ্ট। অন্যভাবে বলা যায়, ইসলামে অনিবার্যভাবে শিক্ষণীয় বিষয়। এরূপ জ্ঞান অর্জন করা মুসলমানদের উপর এমনকি ওয়াজিবে কেফায়ীস্বরূপ।
মহানবী (সাঃ)-এর অতি প্রসিদ্ধ طلبُ العلم فريضةٌ على كل مسلمٍ এই হাদীসটিতে অর্থাৎ ‘জ্ঞান অর্জন প্রতিটি মুসলমানের জন্য ফরজ’ এ জ্ঞান অর্জনের কথাই বলা হয়েছে।
আগেই বলেছি প্রতিটি মুসলমানের জন্য ধর্মের মৌলিক বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান রাখা ওয়াজিব (واجب عینی)। আর এই জ্ঞানকে বোঝার জন্য যে বিদ্যা অর্জন জরুরী তাও ওয়াজিব। একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি সহজভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। ধরুন, আপনি ওযু করবেন, ওযু করা ওয়াজিব কোন কাজ নয় বরং একটি মুস্তাহাব কাজ। কিন্তু স্বতন্ত্রভাবে ওযু করা আপনার জন্য ওয়াজিবব না হলেও ওয়াজিব নামাজ পড়ার ক্ষেত্রে ওযু করা অনিবার্যতার রূপ লাভ করেছে। একইভাবে ধর্মের মৌলিক বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান রাখা আমাদের প্রত্যেকের জন্য ফরজ। আর এই জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় বিদ্যাসমূহ অর্জন করাও ওয়াজিব।
উল্লিখিত হাদীসের আলোকে যে জ্ঞান প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ করা হয়েছে সে জ্ঞান (এক ও দুই নম্বর ধারায়) উল্লিখিত জ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং হাদীসটিতে যে জ্ঞান মুসলিম সমাজের জন্য জরুরী সে জ্ঞানের প্রতি ইশারা করা হয়েছে।
ইসলাম ধর্ম একটি সামাজিক ও সর্বব্যাপী ধর্ম। যে ধর্ম শুধু একগুচ্ছ ব্যক্তিগত উপদেশ ও বিধি-নিষেধের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং এটি ব্যক্তি ও সমাজ গঠনমূলক ধর্ম। তাই ইসলাম, একটি সমাজে যত ধরনের পেশার প্রয়োজন, পর্যাপ্ত পরিমাণ ব্যক্তির সে সংশ্লিষ্ট জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেকের ওপর ওয়াজিব (واجب کفائی) করে দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ সমাজে চিকিৎসকের প্রয়োজন, এই দৃষ্টিতে যতক্ষণ পর্যন্ত সমাজে চিকিৎসকের প্রয়োজন থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত চিকিৎসা বিদ্যা অর্জন প্রতিটি মুসলমানের ওপর ফরজ (واجب کفائی)। এরূপ প্রকৌশল, শিল্প, ব্যবসা প্রতিটি ক্ষেত্রে জ্ঞান অর্জন ফরজ। এমনকি ইসলামী সমাজকে শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য যে সব জ্ঞানার্জন প্রয়োজন সে সব বিষয়ে গভীরভাবে গবেষণা ও অধ্যয়ন করাও ইসলামের দৃষ্টিতে ইবাদত ও ফরজ কাজ।
অতএব, তৃতীয় প্রকারের জ্ঞানও (গণিত, পদার্থ বিজ্ঞান ও এরূপ অন্যান্য জ্ঞান) উপরিউক্ত ব্যাখ্যানুযায়ী ইসলামী সমাজের প্রয়োজনীয়তার ওপর ভিত্তি করে ইসলামী জ্ঞানের অন্তর্ভূক্ত হয়ে পড়ে।
৪। যে সব বিদ্যা ইসলামী সমাজে উৎপত্তি ও বিস্তার লাভ করেছে তবে সমাজে এ জাতীয় বিদ্যার প্রয়োজন ছিল কিনা বা ইসলামের দৃষ্টিতে তা বৈধ কিনা, এ সব বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়াই নিশ্চিতভাবে বলা যায়, সার্বিক অর্থে এ ধরনের জ্ঞানের অস্তিত্ত্ব সমাজে রয়েছে। যেমনঃ জ্যোতিষী বিদ্যা ইত্যাদি। [অশনায়ীই বা উলূমে ইসলামী, শহীদ ওস্তাদ মুর্তাজা মুতাহ্হারী, পৃষ্ঠাঃ ১৫-১৭।]
শহীদ মুতাহ্হারী ইসলামী দর্শনকে দ্বিতীয় প্রকারের অন্তর্ভূক্ত হিসাবে দেখিয়েছেন। অর্থাৎ ইসলামের মৌলিক পরিচিতির ক্ষেত্রে দর্শনের অপরিহার্য ভূমিকা রয়েছে। আর এ ভূমিকার প্রতি লক্ষ্য রেখেই দর্শনকে ইসলামী জ্ঞানের অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।
আরেকটি দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে যে, দর্শন ইসলামী জ্ঞানের অন্তর্ভূক্ত। এ দৃষ্টিকোণে যেহেতু মুসলমানরা একত্ববাদে বিশ্বাসী, আর এ বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে তারা মনে করেন যে, মহান স্রষ্টা সর্বজ্ঞ এবং তিনিই তাঁর প্রেরিত মহামানব নবী রাসূলদের, বিশেষত আদি মানব হযরত আদম (আঃ)-এর শিক্ষক وَعَلَّمَ آدَمَ الأَسْمَاء كُلَّهَا এবং এই শিক্ষার ধারা সকল যুগে অব্যাহত ছিল এবং নবীগণের মাধ্যমে এ জ্ঞান মানব জাতির দুয়ারে পৌঁছেছে, এ কারণেই পবিত্র কোরআন নাযিল হওয়ার শুরুতেই আল্লাহ্ মানব জাতিকে এ বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেনঃ اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ عَلَّمَ الْإِنسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ}
এ আয়াতসমূহ হতে প্রমাণিত হয় যে, সমস্ত জ্ঞানের উৎস হচ্ছেন মহান স্রষ্টা। আর স্রষ্টা পরিচিতি ও তাঁর দিক-নির্দেশনামূলক সকল জ্ঞান হলো ঐশী জ্ঞান (علم الهی)। ঐশী জ্ঞানের বিপরীতে অবস্থান করছে বস্তুবাদী জ্ঞান। এখানে ঐশী জ্ঞান বলতে কেবল কোরআন-হাদীসকেই বোঝানো হচ্ছে না, বরং সকল প্রকারের জ্ঞানকেই বোঝানো হচ্ছে। পক্ষান্তরে বস্তুবাদী জ্ঞান বলতে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানকে বোঝানো হচ্ছে না, বরং যে সব জ্ঞান মানুষকে ঐশী পথ থেকে বিচ্যুত করে সে সব জ্ঞানকেই বোঝানো হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে কোন জ্ঞানই মানুষকে সত্যপথ বা ঐশীপথ থেকে বিচ্যুত করে না। কেননা, জ্ঞান হলো আলো, আলোর কাজ হলো পথ দেখানো, আর পথিকের দ্বায়িত্ব হলো পথ বেছে নেয়া। অর্থাৎ প্রয়োগ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা জ্ঞানকে বস্তুবাদী বা পার্থিব রূপদান করে থাকি। তাই এ ব্যাখ্যানুযায়ী এমনকি কোরআন-হাদীসের জ্ঞানও বস্তুবাদী জ্ঞানে পরিণত হতে পারে। এখানে জ্ঞানের সাথে ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। মহান আল্লাহ্ সকল জ্ঞানের একমাত্র উৎস। তিনি সকল প্রকার জ্ঞানের মাধ্যমে মানব জাতির সম্মুখে সত্যের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এখন পথ নির্বাচনের দায়িত্ব আমাদেরঃ إِنَّا هَدَیْنَاهُ السَّبِیلَ إِمَّا شَاكِراً وَ إِمَّا كَفُوراً (ইনসানঃ ৩) অন্যদিকে জ্ঞানের জনক বা স্রষ্টা আমরা নই, বরং আমরা গবেষণা ও চেষ্ট-প্রচেষ্টার মাধ্যমে আবিষ্কার করি মাত্রঃ وَالَّذينَ جاهَدوا فينا لَنَهدِيَنَّهُم سُبُلَنا (সূরা আনকাবুতঃ ৬৯) বা وَ إِنْ مِنْ شَیْ ءٍ إِلاَّ عِنْدَنا خَزائِنُهُ وَ ما نُنَزِّلُهُ إِلاَّ بِقَدَرٍ مَعْلُومٍ (সূরা হিজরঃ ২১) অর্থাৎ সব পথই হলো তাঁর, আমরা কেবল প্রচেষ্টার ভিত্তিতে নিজস্ব পথ পেয়ে থাকি। অতএব, সব জ্ঞান তাঁরই। আমরা আমাদের গবেষণা ও প্রচেষ্টার তারতম্য অনুযায়ী জ্ঞান লাভ করে থাকি। এই জ্ঞান যখনই জ্ঞানের উৎস (আল্লাহ্) হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে তখনই (شَاكِراً إِمَّا বস্তুবাদী রূপ লাভ করে। আর জ্ঞানের সাথে যতক্ষণ পর্যন্ত জ্ঞানদাতার সংযোগ রক্ষিত (وَ إِمَّا كَفُوراً) হবে ততক্ষণ পর্যন্ত সেটি হবে ঐশী জ্ঞান। এই সংযোগ রক্ষার একটি নিদর্শন হলো এই জ্ঞানের আলোতে ঐশী রূপ প্রতিফলিত হওয়া।
ইসলামী দর্শন হলো (حکمت الهی) ঐশী প্রজ্ঞাশাস্ত্র, যেখানে মহান স্রষ্টার হিকমাতের প্রতিফলন ঘটেছে। তবে মুসলিম দার্শনিকরা কখনই তাঁদের জ্ঞানে প্রভূর হিকমাতের পূর্ণরূপ প্রতিফলিত হওয়ার দাবি করেন না এবং এটি সম্ভবও নয়। তবে ঐশী জ্ঞানের সারিতে স্থান পাওয়ার জন্য এটিই যথেষ্ট। ইসলামী দর্শনকে মুসলিম সমাজে সাধারণত ‘হিকমাতে ইলাহী’ (ঐশী প্রজ্ঞা) অর্থেই ব্যবহার পরিলক্ষিত হবে।

হিকমাত ও ইসলামী দর্শন
আসলে হিকমাত কি? হিকমাতের সংজ্ঞাই বা কি? হিকমাতকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছেঃ
هى العلم بحقائق الاشياء و اوصافها وخواصها و احكامها على ما هي عليه و ارتباط الاسباب بالمسببات و اسرار انضماط نظام و الموجودات و العمل بمقتضاه
অর্থাৎ হিকমাত হলো প্রতিটি বস্তুর বিশুদ্ধ রূপ, গুণাবলী, বৈশিষ্ট্য, বিধি-বিধান (যেমনটি আছে তদ্রুপ) এবং অস্তিত্ব জগতের নিয়ম-শৃঙ্খলা, বিভিন্ন কার্যকারণের রহস্য ও তাদের মধ্যকার সম্পর্ক সম্বন্ধে অবগত হওয়া এবং তদনুযায়ী আমল করা। [‘ইসতালাহাতুস সুফিয়া- আব্দুর রাজ্জাক কাশানী, [হিজরী অষ্টম শতাব্দীর অন্যতম সুফী এবং দার্শনিক তেহরান, ১৩৭৬, পৃষ্ঠাঃ ১৩৩।] হিকমাতের প্রচলিত অন্য সকল সংজ্ঞার ক্ষেত্রেও অন্যরা এই অংশটির উল্লেখ করেছেনঃ هى العلم بحقائق الاشياء , প্রতিটি বস্তুর আসল রূপ দর্শন করা হলো হিকমাত। আর যিনি এ দর্শন লাভ করেন তিনিই হলেন হাকিম।
ইসলামী চিন্তাধারায় সাধারণত ‘দর্শন’ নামটি ‘হিকমাত’ পরিভাষাতেই ব্যবহৃত হয়। আর দার্শনিককে বলা হয় ‘হাকিম’। মুসলিম সমাজে প্রচলিত দর্শন চর্চার প্রথম যুগেই দার্শনিকগণ তাঁদের এ পদ্ধতিকে ‘হিকমাত’ নামে অভিহিত করেছেন। আব্বাসীয় খলিফা মামুনের যুগে দর্শন চর্চার জন্য বিশেষ একাডেমী তৈরী করা হয়- যার নাম ছিল ‘দারুল হিকমাহ্’। আল কিন্দির রচনায় এ শব্দটির (হিকমাত) ব্যবহার হয়েছে এবং তিনি হিকমাতকে দু’ভাবে বিভক্ত করেছেনঃ ঐশী হিকমাত (حکمت الهی) ও মনুষ্য হিকমাত (حکمت انسانی)[ ‘মাওয়ারেফে ইসলামী দার জাহানে মুয়াসের’ সৈয়দ হুসাইন নাসর, তেহরান ১৩৭১, পৃষ্ঠাঃ ২২।]
মনুষ্য হিকমাত হলোঃ যুক্তি বিদ্যা, গণিত ও দর্শন; আর ঐশী হিকমাত হলোঃ ওহী যা একমাত্র নবীদের প্রতি নাযিল হয়ে থাকে।[‘ইসলামী দর্শনের ইতিহাস’, হেনরী কোরবিন, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ২১১।] অর্থাৎ কিন্দিও দর্শনকে ‘হিকমাত’ পরিভাষায় ব্যবহার করেছেন। অতএব, ইসলামী দর্শনের প্রথম যুগেও ‘হিকমাত’ শব্দটি মুসলিম দার্শনিকদের কাছে অপরিচিত ছিল না; বরং এ পরিভাষাকে তাঁরা দর্শনের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করেছেন।
তবে এ বিষয়টিও স্মরণে রাখা উচিত যে, নবীদের প্রদত্ত ঐশী হিকমাত আর মনুষ্য হিকমাতের মধ্যে গুণগত পার্থক্য রয়েছে। আমরা এ পার্থক্যকে সূর্যের কিরণের সাথে তুলনা করে ব্যাখ্যা করতে পারি। সূর্য হতে যতই দূরে যাওয়া হবে ততই সূর্যের তাপ ও জ্যোতি হ্রাস পেতে থাকবে এবং আস্তে আস্তে সূর্যের আলো মলিন হয়ে আসবে। তারপরও সেই অবশিষ্ট ক্ষীণ আলোটাও কিন্তু সূর্যেরই আলো। একইভাবে নবীদের দেয়া ঐশী হিকমাতের মান ও গুণ অবশ্যই অন্যদের হিকমাতের তুলনায় অনেক বেশি। আর এই গুণগত মান বৃদ্ধি নির্ভর করে নবীদের রহস্য বা হিকমাত ধারণ ক্ষমতার ওপর। পার্থিব জগতেও ঐ একই নিয়ম বিরাজ করছে।
ইসলামী হিকমাতে উপলব্ধিকে কয়েকটি স্তরে ভাগ করা হয়ে থাকে। যথাক্রমে বস্তুজগতের উপলব্ধি শক্তি, উদ্ভিদজগতের উপলব্ধি, পশুসমূহের উপলব্ধি এবং মানবিক উপলব্ধি যাকে বুদ্ধিবৃত্তি বা আকল বলা হয়ে থাকে। এই বুদ্ধবৃত্তি সাধনা, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে কাশ্ফ ও শুহুদের (Intution) স্তরে উত্তীর্ণ হতে পারে। বস্তু থেকে শুরু করে এই উপলব্ধি ক্রমোন্নয়ন মুখী ধারা অতিক্রম করে ইলহাম বা ওহী প্রাপ্ত হওয়ার উপযোগী হয়ে ওঠে। অতএব, আমাদের উপলব্ধি শক্তির সর্বোচ্চ পর্যায় হলো ওহী প্রাপ্ত হওয়ার স্তর।
‘আওয়ালী আল লাইয়ালী’ নামক গ্রন্থসহ অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে মহানবী (সাঃ)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে নিম্নোক্ত হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে رب ارنی الاشیاء کما هی অর্থাৎ হে আমার প্রতিপালক! “বস্তুর প্রকৃত রূপ আমাকে দেখাও।” এ প্রার্থনায় রাসূলুল্লাহ্ সূত্রগত প্রজ্ঞার প্রতিই ইঙ্গিত করেছেন।১১ তবে এখানে সামান্য পার্থক্য রয়েছে। তা এই যে, রাসূল (সাঃ) বস্তুর আসল রূপ অবলোকন করতে চান; আর দার্শনিকগণ তাকে অনুধাবন করার চেষ্টা করেন মাত্র। অন্যদিকে অন্তর-চক্ষু দিয়ে প্রত্যক্ষ করার সাথে সূত্রগত প্রজ্ঞার যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। তাই অন্তরে অর্জিত বোধের সাথে মেধাগত বোধের কোন তুলনাই চলে না। তদুপরি রাসূলের অন্তরে নিগূঢ় রহস্য প্রত্যক্ষকরণের ক্ষমতা অনেক বেশি, সে ক্ষমতা থেকে তার অনুসারী ও পন্ডিতগণ স্বাভাবিকভাবেই বঞ্চিত। এ ছাড়াও জ্ঞানের মান ও পরিমাণগত দিক থেকেও নবী-রাসূলদের সাথে অন্যান্য মানুষের তুলনাই চলে না।
হযরত ইবরাহীমও একই প্রার্থনা করে বলেনঃ رَبِّ هَبْ لي حُکْماً “হে আমার প্রভু! আমাকে হিকমাত (বস্তুর আসলরূপ দর্শন-শক্তি) দান কর (সূরা শুয়ারাঃ ৮৩)। অর্থাৎ এখানে জ্ঞানের দ্বারা বস্তুর সত্য রূপটি প্রত্যক্ষকরণের কথা বলা হচ্ছে। আর এই প্রার্থনার উত্তর অন্যখানে মহান প্রভু এভাবে দিয়েছেনঃ
وَ کَذلِکَ نُري إِبْراهيمَ مَلَکُوتَ السَّماواتِ وَ الْأَرْضِ “এভাবেই আমরা ইবরাহীমকে আকাশমন্ডল ও পৃথিবীর মালাকুত দেখালাম (যেন তাঁর জ্ঞান পূর্ণ হয়)” (সূরা আনআমঃ ৭৫)। কোন বস্তুর অন্তরসত্তা আসল রূপকেই ‘মালাকুত’ বলা হয়ে থাকে। আর হিকমাতের অর্থ হলো বস্তুর আসল বা বাস্তব রূপ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা।
মানবসত্ত্বা সূত্রগত প্রজ্ঞায় অর্জিত পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে ব্যবহারিক প্রজ্ঞার লক্ষ্যে উপনীত হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে প্রজ্ঞার স্বাধীন ও স্বকীয় ভূমিকার ফলে একে ‘কল্যাণ’ নামকরণ করা হয়েছে।
তবে এই সম্পর্কটিকে এমনই হতে হবে যে, সত্ত্বার বুদ্ধিবৃত্তিক দিকটি দৈহিক ক্রিয়াশক্তির ওপর সার্বিক আধিপত্য লাভ করবে এবং এভাবে দৈহিক তাড়না ও প্রবৃত্তি বুদ্ধিবৃত্তি এবং পরম সত্ত্বার অনুগত হয়ে যাবে।
আর এ বর্ণনা থেকে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, দেহ তার নিজস্ব (সত্ত্বাগত) গন্ডিতে মানবাত্মা বা বুদ্ধিবৃত্তির শর্ত নয়। তা না হলে এমতাবস্থায় দৈহিক তাড়নার পতন বা বিলুপ্তি ব্যতীত বিজয়ের কোন পথই থাকত না।
ব্যবহারিক প্রজ্ঞার উদ্দেশ্য হলো দেহের ওপর আত্মার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং দেহকে আত্মার অনুগামী ও অনুসারী করে তোলা। শ্রেষ্ঠ জিহাদে (জিহাদে আকবর) বুদ্ধিবৃত্তি ও আত্মার শক্তি যদি নাফ্সের শক্তিকে অতিক্রম করতে পারে তাহলে তখন আত্মা হয় নাফসের অধিকর্তা। প্রকৃতপক্ষে আত্মা ও দেহের মধ্যে কোন যুদ্ধ নেই। দেহ হলো হাতিয়ার বা মাধ্যম; আর মাধ্যম কখনও নিজেই যোদ্ধা হতে পারে না। পক্ষান্তরে নাফ্স যদি আত্মার ওপর প্রাধান্য লাভ করে তখন দেহকে তড়নাগত অনুভূতি, পরিতৃপ্তি ও সম্ভোগের পথে পরিচালনা করে থাকে। আর নাফ্সের ওপর আত্মার বিজয় ঘটলে সে দেহকে নাফ্সের পরিপূর্ণতা সাধনের লক্ষ্যে পরিচালিত করে। তাদের যে কেউ বিজয়ী হলে অপরকে হাতিয়ার হিসাবে স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থে ব্যবহার করে থাকে।
অতএব, ব্যবহারিক প্রজ্ঞার ফলেই নাফ্সের ওপর বুদ্ধিবৃত্তির নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। আর ব্যবহারিক প্রজ্ঞার লক্ষ্য হলো নিজ শক্তি ও ক্ষমতানুযায়ী প্রবৃত্তির শক্তির ভারসাম্য রক্ষা ও তাকে নিয়ন্ত্রণ করা। মহানবী (সাঃ) ব্যবহারিক প্রজ্ঞার লক্ষ্যের প্রতি এভাবে ইঙ্গিত করেছেনঃ تخلقوا بأخلاق الله “আল্লাহর চরিত্র-বৈশিষ্ট্যেমন্ডিত হও।”
হযরত ইবরাহীম (আঃ) ব্যবহারিক প্রজ্ঞার লক্ষ্যে উপনীত হতে প্রভুর কাছে প্রার্থনা করেনঃ وَأَلْحِقْنِي بِالصَّالِحِينَ “এবং আমাকে সৎ লোকদের অন্তর্ভূক্ত করুন”- (সূরা শুয়ারাঃ ৮৩)। ইবরাহীম (আঃ) সূত্রগত প্রজ্ঞায় বিভিন্ন স্তরের মধ্যকার পার্থক্য সম্পর্কে অবগত ছিলেন তা ওই প্রার্থনা থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়। এজন্যই তিনি প্রার্থনা করেন যাতে পরিশুদ্ধ মানবদের অন্তর্ভূক্ত হতে পারেন। মহান প্রভু তাঁর ঐ প্রার্থনা গ্রহণ করে বলেনঃ
وَلَقَدِ اصْطَفَيْنَاهُ فِي الدُّنْيَا وَإِنَّهُ فِي الْآخِرَةِ لَمِنَ الصَّالِحِينَ “ এবং আমরা নিশ্চয় তাঁকে এ জগতে মনোনীত করেছিলাম এবং পরকালে, সে অবশ্যই পরিশুদ্ধদের অন্তভূক্ত হবে”- (সূরা বাকারাহ্ঃ ১৩০)। তবে সমস্ত পরিশুদ্ধ ব্যক্তি একই স্তরের নন। কেউ কেউ পৃথিবীতেই পরিশুদ্ধতার গুণে ভূষিত হন, আবার কেউ পরকালে।
পবিত্র কোরআন ব্যবহারিক ও সূত্রগত প্রজ্ঞার প্রতি ইশারা করেছে সূরা ত্বীনের এ আয়াতগুলোতেঃ
لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ فِي أَحْسَنِ تَقْوِيمٍ ثُمَّ رَدَدْنَاهُ أَسْفَلَسَافِلِينَ إِلَّا الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ
“নিশ্চয় আমরা মানুষকে সর্বোৎকৃষ্ট উপাদানে বা আকৃতিতে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর আমরা তাকে হীন থেকে হীনতম স্তরে নামিয়ে দেই, সেই সকল লোক ব্যতীত যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে।”
উল্লিখিত আয়াতের প্রথমে মানুষের অভ্যন্তরীণ আকৃতি উপাদান ও আত্মিক অবস্থার প্রতি ঈঙ্গিত করা হয়েছে যা ঐশী ভূবন বা বস্তুহীন জগতের পরিচায়ক। আর এর পরেই তার (পাশবিক ইচ্ছাশক্তির অধীন) বস্তুগত দিকের প্রতি দৃষ্টিপাত করা হয়েছে। অবশেষে ব্যবহারিক প্রজ্ঞার গুরুত্ব বর্ণনা করে বলা হয়েছে যে, প্রজ্ঞাবিধানই তার সংশোধন ও পরিশুদ্ধতার একমাত্র পথ। তৃতীয় আয়াতের প্রথমাংশে (الَّذِينَ آَمَنُوا) সূত্রগত প্রজ্ঞার প্রতি নির্দেশ করা হয়েছে যা বিশ্বের আদি-অন্ত, কেয়ামাত এবং এর মাঝখানে অবস্থিত বিষয়সমূহ, যেমন আসমানী গ্রন্থ, ফেরেশ্তা, নবুওয়্যাত সম্পর্কিত বিষয়বস্তুর পরিচিতি। আর শেষাংশে (وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ) ব্যবহারিক প্রজ্ঞার চূড়ান্ত লক্ষ্যের প্রতি ঈঙ্গিত করা হয়েছে। আর তা হলো পরিশুদ্ধতা অর্জন।
ইসলামী দার্শনিক বা প্রাজ্ঞগণ ঐশী মানবদের ভাষ্যের প্রতি লক্ষ্য রেখেই দর্শনের সংজ্ঞায় সূত্রগত ও ব্যবহারিক প্রজ্ঞার লক্ষ্যের প্রতি এভাবে নির্দেশ করেছেনঃ لفلسفة هي التشبّه بالإله অর্থাৎ দর্শন হলো খোদার সাদৃশ্য অর্জন। যেহেতু পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে لَيْسَ كمِثْلِهِ شَيْءٌ “তাঁর সঙ্গে কোন কিছুরই সাদৃশ্য নেই”। তাই এখানে দার্শনিকদের কথিত সাদৃশ্যের অর্থ হলো খোদায়ী নৈতিকতায় নীতিবান বা খোদায়ী বৈশিষ্ট্যে গুণান্বিত হওয়া। যে গুণ অর্জনের নির্দেশ স্বয়ং রাসূলুল্লাহ দিয়েছেন এ বাণীতে تخلقوا بأخلاق الله
অতএব, ইসলামী দর্শন বা হিকমাত একই বিষয়ের দু’টি নাম মাত্র। পবিত্র কোরআন থেকে হিকমাত সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে যে আলোচনা করা হলো, তা’ই ইসলামী দর্শনের আলোচ্য বিষয়। আর ইসলামী দর্শনই যে হিকমাত এবং এটি কোরআনে উল্লিখিত হিকমাতেরই একটি রূপ এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে এদের মধ্যকার দু’টি পার্থক্য আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছিঃ
১। বস্তুর সত্য রূপটি আধ্যাত্মিক মানবরা অন্তর্চক্ষু দ্বারা অবলোকন করতে চান আর দার্শনিকগণ বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে অনুধাবন করতে চান না;
২। আধ্যাত্মিক মানবদের অন্তরের ধারণক্ষমতার সাথে দার্শনিকদের আত্মিক ধারণ ক্ষমতার পার্থক্য রয়েছে। সুতরাং উল্লিখিত বর্ণনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, ইসলামী দর্শনের পথ, পন্থা ও লক্ষ্য পাশ্চাত্য দর্শন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
এখানে উল্লেখ্য যে, হিকমাত ও জ্ঞানের ( حکمت و علم) মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছেঃ آتَيْنَا حُكْمًا وَعِلْمًا ۚ “আমি তাকে প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দান করলাম”- (সূরা আম্বিয়া : ৭৯ ; آتَيْناهُ حُكْماً وَ عِلْماً “তখন আমি তাকে প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দান করলাম”; (সূরা কাসাস : ১৪ حُكْمًا وَعِلْمًا ۚ তখন আমি তাকে প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দান করলাম ; [সুরা ইউসুফ : ২২ ]
এ আয়াতগুলোতে হিকমাত ও জ্ঞানকে পৃথকভাবে আনা হয়েছে। যদি জ্ঞান ও হিকমাত একই বস্তু হতো তাহলে পৃথকভাবে আসত না।
পবিত্র কোরআনের সূরা রূমের ৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ
يَعْلَمُونَ ظَاهِرًا مِّنَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ عَنِ الْآخِرَةِ هُمْ غَافِلُونَ
“তারা পার্থিব জীবনের বাহ্যিক দিক সম্পর্কে জ্ঞান রাখে, অথচ পরকালের খবর রাখে না। অতএব, এখানে ‘জ্ঞান’ শব্দটি বস্তুর বাহ্যিক দিক সম্পর্কে অবগত হওয়া অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।”
যুগে যুগে যত নবী রাসূল এসেছেন তাঁদেরকে বিভিন্ন জ্ঞান প্রদানের পাশাপাশি হিকমাত প্রদান করা হয়েছেঃ
وَيُعَلِّمُهُ ٱلْكِتَٰبَ وَٱلْحِكْمَةَ وَٱلتَّوْرَىٰةَ وَٱلْإِنجِيلَ
“তাঁদেরকে তাওরাত ও ইন্জিল শিক্ষা দেয়ার পাশাপাশি কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।”- (সূরা আলে ইমরানঃ ৪৮)
وَإِذْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ النَّبِيِّينَ لَمَا آتَيْتُكُمْ مِنْ كِتَابٍ وَحِكْمَةٍ
“আল্লাহ সকল নবীকে হিকমাত ও কিতাব দেওয়ার সময় (তা শিক্ষাদানের) অঙ্গীকার নিয়েছিলেন।”- (সূরা আলে ইমরানঃ ৮১)।
فَقَدْ آتَيْنَا آلَ إِبْرَاهِيمَ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَآتَيْنَاهُمْ مُلْكًا عَظِيمًا
“অবশ্যই আমি ইবরাহীমের বংশধরদেরকে কিতাব ও হিকমাত দান করেছিলাম। আর তাঁদের দান করেছিলাম বিশাল রাজ্য।”- (সূরা আন নিসাঃ ৫৪)
وَلَقَدْ آتَيْنَا لُقْمَانَ الْحِكْمَةَ أَنِ اشْكُرْ لِلَّهِ ۚ وَمَن يَشْكُرْ فَإِنَّمَا يَشْكُرُ لِنَفْسِهِ ۖ وَمَن كَفَرَ فَإِنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ حَمِيدٌ
“নিশ্চয় আমি লোকমানকে হিকমাত দান করেছিলাম।” (সূরা লোকমানঃ ১২)
وَلَمَّا جَاءَ عِيسَىٰ بِالْبَيِّنَاتِ قَالَ قَدْ جِئْتُكُم بِالْحِكْمَةِ
“ঈসা যখন সুস্পষ্ট প্রমাণ ও দলিল নিয়ে আসলেন এবং বললেনঃ নিশ্চয় আমি তোমাদের কাছে হিকমাত নিয়ে এসেছি।”- (সূরা যুখরুফঃ ৬৩)।
খোদাপ্রদত্ত হিকমাতের ধারা নবীদের মাধ্যমে মানব সমাজে বিস্তার লাভ করেছে। অন্যদিকে মুসলমান হওয়ার একটি মূল শর্ত হচ্ছে এ আয়াতটিঃ
آمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ كُلٌّ آمَنَ بِاللَّهِ وَمَلائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ وَقَالُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ }
“রাসূল (সাঃ) এবং মুমিনরাও বিশ্বাস করেন ঐ সমস্ত বিষয় সম্পর্কে যা তাঁর পালনকর্তার পক্ষ থেকে তাঁর কাছে অবতীর্ণ হয়েছে। তাঁরা সবাই বিশ্বাস রাখেন আল্লার প্রতি, তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি এবং তাঁর রাসূলদের প্রতি, তাঁর গ্রন্থসমূহের প্রতি। তাঁরা বলেন, আমরা তাঁর রাসূলদের মধ্যে কোন তারতম্য করি না।”- (সূরা বাকারাহ্ঃ ২৮৫)
উপরিউক্ত আয়াতসমূহের মাধ্যমে কয়েকটি বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে যায়। আর তা হলো হিকমাতমূলক জ্ঞান যা মহান ¯্রষ্টার পক্ষ হতে তাঁরই প্রেরিত মহামানবদের মাধ্যমে সর্বপ্রথম মানব সমাজে বিস্তার লাভ করেছে। আর শেষের আয়াতটির দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, অতীতের সকল প্রেরিত পুরুষদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন মুসলমান হওয়ার একটি শর্ত। এই বিশেষ নীতির ওপর ভিত্তি করে মুসলমান বিশ্বাস করেন যে, বর্তমান মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম (আঃ)- এর আদর্শের ধারাবাহিকতায় চরম বা পরিপূর্ণ রূপ হলো ইসলাম ধর্ম। তাই যেমন সকল প্রেরিত পুরুষদেও মধ্যে কোন রকম পার্থক্য না করেই বিশ্বাস স্থাপন করতে হয় ঠিক তেমনিভাবে সকল ঐশী গ্রন্থের প্রতিও ঈমান আনার পর ইসলামী ঈমান পূর্ণতা লাভ করে। অর্থাৎ ইসলাম ধর্ম সকল ঐশী আদর্শের ক্রমবিকাশের চূড়ান্ত রূপ। এ মতের ভিত্তিতে কেবল শেষ নবীর উম্মতই প্রকৃত অর্থে মুসলমান নয়, বরং সকল নবীর অনুসারীরাই মুসলমান। তবে পরিভাষাগত অর্থে শেষ নবীর উম্মতই ‘মুসলমান’ উপাধিতে পরিচিত।
মোটকথা, হিকমাত যেহেতু নবীদের ঐশী সম্পদ তাই হিকমাত একত্ববাদী মুসলমানদের হারানো রত্ন। এই চিন্তার ওপর ভিত্তি করে অন্যতম মুসলিম দার্শনিক শেইখ ইশরাক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে একটি তালিকা উপস্থাপন করেছেন।[হিকমাতুল ইশরাক, সোহরাওয়ার্দী, হেনরী কোরবিন সম্পাদিত, তেহরান থেকে মুদ্রিত, ১৩৩১ সালে, শারহে জুরীর ভূমিকা, পৃঃ ৫০২-৫০৩।] যেখানে হিকমাতমূলক জ্ঞানের মূল শিক্ষক হিসাবে হেরমেস নবী বা ইদ্রিস নবীকে ধরা হয়েছে। হেরমেসীয় দর্শনের প্রভাব আজও পাশ্চাত্য দর্শনে বিদ্যমান। দার্শনিক আদর্শেও প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে প্রথমবার তাঁর নাম উল্লিখিত হয় খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ সালে দ্বিতীয় টলেমীকে লেখা ম্যানিথোর (Manetho) চিঠিতে। [Hermes Trismegistos, Mead, Vol, 1, London ১৯৪৯, page-১০৫]



ইসলামী দর্শনের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক মোল্লা সাদরাও এই একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে থাকেন[মোল্লা সাদরার রচনাসমগ্র, “রিসালাতু ফিল হুদুস”, তেহরান, ১৩০২, পৃষ্ঠাঃ ৬৭।] ঃ
«اعلم ان الحکمة نشأت اولا من آدم صفی الله و عن ذریته شیث و هرمس اعنی ادریس و عن نوح لان العالم ماخلا قط عن شخص یقوم به علم التوحید و المعاد و ان هرمس الاعظم هوالذی نشرها فی الاقالیم و البلاد و اظهرها و افاضها علی العباد و هو ابو الحکماء و علامة العلماء اشرکنا الله فی صالح دعائه»
অর্থাৎ জেনে রাখ! হিকমাতের উৎপত্তি ঘটেছে হযরত আদম (আঃ) এর মাধ্যমে এবং তাঁর বংশধরদের মধ্যে হতে শীষ ও হেরমেস যিনি ইদ্রিস নামে প্রসিদ্ধ এবং নূহের মাধ্যমে। কেননা ভূ-পৃষ্ঠ কখনই তাওহীদ ও কিয়ামতের (সূত্রগত প্রজ্ঞা) জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিশূন্য হতে পারে না। আর যারা মানব জাতির মধ্যে হিকমাত প্রচার ও প্রসারে অধিক ভূমিকা রেখেছেন তাদের মধ্যে হেরমেস হলেন শ্রেষ্ঠ। তাই তাঁকে হিকমাতের জনক বলা হয়। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর দোয়ার অন্তর্ভূক্ত করুন।]
তবে এ ব্যাখ্যাটি গ্রহণযোগ্য হওয়ার উপযুক্ত হতে হলে আরও দু’টি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া জরুরী। প্রশ্ন দু’টি হলোঃ হেরমেস যে ইদ্রিস নবী তার প্রমাণ কি? আর দ্বিতীয় প্রশ্নটি হলো পবিত্র কোরআনে উল্লিখিত হিকমাত (বিশেষ প্রকারের জ্ঞান) যে প্রচলিত ইসলামী দর্শন তার প্রমাণ কি?
প্রথম প্রশ্নটির ক্ষেত্রে আমাদের হাতে অসংখ্য ঐতিহাসিক বর্ণনা রয়েছে। তবে যেহেতু এটি অনেক পূর্বের ইতিহাসের বিষয় তাই বর্ণিত তথ্যের নিশ্চয়তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে যায়। তারপরও আমাদের কাছে স্পষ্ট যে, অতীতকাল থেকেই মুসলিম ইতিহাসে হেরমেস নামক ব্যক্তির নাম উল্লেখ এবং তাঁকে ইদ্রিস নবী হিসেবে ধারনা করা হয়েছে। আর পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াত অনুযায়ী (যা আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি) মহান প্রভু নবীদের মাধ্যমেই মানব সমাজে হিকমাতমূলক জ্ঞানের বিস্তার ঘটিয়েছেন। অর্থাৎ মানব সমাজে হিকমাতের প্রধান শিক্ষক হলেন আল্লাহর নবী ও রাসূলগণ।
মুসলিম সমাজে হযরত লোকমান (আঃ) একজন হাকিম হিসাবে প্রসিদ্ধ। বিশেষ করে তাঁর বিভিন্ন উপদেশ বাণী যা হিকমাতমূলক জ্ঞানের উৎস থেকেই উৎসারিত হয়েছে তাতে সূত্রগত ও ব্যবহারিক হিকমাতেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
وَلَقَدْ آتَيْنَا لُقْمَانَ الْحِكْمَةَ أَنِ اشْكُرْ لِلَّهِ وَمَنْ يَشْكُرْ فَإِنَّمَا يَشْكُرُ لِنَفْسِهِ وَمَنْ كَفَرَ فَإِنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ حَمِيدٌ
“আমি লোকমানকে প্রজ্ঞা দান করেছি এই মর্মে যে, সে যেন আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হয়। যে কৃতজ্ঞ হয় সে তো নিজের কল্যাণের জন্যই কৃতজ্ঞ হয়। আর যে অকৃতজ্ঞ হয়, আল্লাহ্ অভাবমুক্ত, প্রশংসিত।”- (সূরা লোকমানঃ ১২)
قَالَ لُقْمَانُ لِابْنِهِ وَهُوَ يَعِظُهُ يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ
“যখন লোকমান (উপদেশের উদ্দেশ্যে) তাঁর পুত্রকে বললেনঃ হে বৎস! আল্লাহর সাথে শরীক করো না, নিশ্চয় আল্লাহর সাথে শরীক করা মহা অন্যায়।”- (সূরা লোকমানঃ ১৩)
এখানে সূত্রগত হিকমাতের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। কেননা, তাওহীদ বা একত্ববাদ সংক্রান্ত আলোচনা সূত্রগত হিকমাতের অন্তর্ভূক্ত।
يَا بُنَيَّ إِنَّهَا إِنْ تَكُ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِنْ خَرْدَلٍ فَتَكُنْ فِي صَخْرَةٍ أَوْ فِي السَّمَاوَاتِ أَوْ فِي الْأَرْضِ يَأْتِ بِهَا اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ لَطِيفٌ خَبِيرٌ
“হে বৎস! কোন বস্তু যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় এবং তা যদি প্রস্তর গর্ভে অথবা আকাশে অথবা ভূ-গর্ভেও থাকে, তবে আল্লাহ্ তা-ও উপস্থিত করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ্ গোপন ভেদ জানেন, সবকিছুর খবর রাখেন।” (সূরা লোকমানঃ ১৭)
يَا بُنَيَّ أَقِمِ الصَّلَاةَ وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَاصْبِرْ عَلَى مَا أَصَابَكَ إِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ
“হে বৎস! নামায কায়েম কর, সৎ কাজের আদেশ দাও, মন্দ কাজে নিষেধ কর এবং বিপদাপদে ধৈর্য্য অবলম্বন কর। নিশ্চয় এটি সাহসিতার কাজ।” এখানে ব্যবহারিক হিকমাতের প্রতি নির্দেশ করা হয়েছে।”- (সূরা লোকমানঃ ১৭)
وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ
“অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণা করো না। নিশ্পয় আল্লাহ্ দাম্ভিক-অহংকারীকে পছন্দ করেন না।”- (সূরা লোকমানঃ ১৮)
وَاقْصِدْ فِي مَشْيِكَ وَاغْضُضْ مِنْ صَوْتِكَ إِنَّ أَنْكَرَ الْأَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِيرِ
“চলার ক্ষেত্রে মধ্যবর্তিতা অবলম্বন কর এবং কণ্ঠস্বর নিচু কর। নিঃসন্দেহে গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা কর্কষ।”- (সূরা লোকমানঃ ১৯)
উল্লিখিত বিষয়গুলো সবই সূত্রগত ও ব্যবহারিক কিমাতের অংশ বিশেষ। শেইখ ইশরাকের সোহরাওয়ার্দী) দৃষ্টিতে যারা নৈতিক ও আত্মিকভাবে এখনও পরিশুদ্ধ হয়নি, ইশরাকী হিকমাত অধ্যয়নের অনুমতি তাদের নেই। তাঁর দৃষ্টিতে আত্মশুদ্ধি ব্যতীত কেবল যুক্তি দিয়ে সত্য উপলব্ধি সম্ভব নয়। অবশ্য পবিত্র কোরআনেও আত্মশুদ্ধির পর হিকমাত শিক্ষার স্তরের কথা উল্লেখ করা হয়েছে (সূরা জুমুআহ্ঃ ২ নং আয়াত, আলে ইমরানঃ ১৬৪ নং আয়াত), যেমনঃ “তিনিই নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তাঁর আয়াতসমূহ, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমাত।”- (সূরা জুমুআহ্ঃ ২)
পবিত্র কোরআনের দৃষ্টিতে, পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ অথবা পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই অতি তুচ্ছ ও নগণ্য মাত্র قُلْ مَتَاعُ الدُّنْيَا قَلِيلٌ (সূরা নিসাঃ ৭৭)। কিন্তু এরই পাশাপাশি যদি এ আয়াতটিকে রাখা হয়ঃ
يُؤْتِي الْحِكْمَةَ مَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُؤْتَ الْحِكْمَةَ فَقَدْ أُوتِيَ خَيْرًا كَثِيرًا
“তিনি যাকে ইচ্ছা হিকমাত দান করেন এবং যাকে হিকমাত দান করা হয় সে প্রভূত কল্যাণকর বস্তু প্রাপ্ত হয়। উপদেশ তারাই গ্রহণ করে যারা জ্ঞানবান।” (সূরা বাকারাহ্ঃ ২৬৯) আবার যদি এ আয়াতটির পাশে এ আয়াতটি রাখা হয় وَمَا أُوتِيتُمْ مِنَ الْعِلْمِ إِلَّا قَلِيلًا ‘তোমাদেরকে অতি সামান্যই জ্ঞান দান করা হয়েছে’- (সূরা ইসরাঃ ৮৫)। হিকমাত যদিও সমগ্র পৃথিবীর তুলনায় অনেক কিন্তু এই হিকমাতই আবার প্রভুর জ্ঞানের তুলনায় কিছুই নয়।
হিকমাত শিক্ষাদানকে নবী-রাসূল আগমনের একটি বিশেষ লক্ষ্য হিসাবে পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে (সূরা জুমুআহ্ঃ ২ নং আয়াত, বাকারাহ্ঃ ১৫১ নং আয়াত, আলে ইমরানঃ ১৬৪ নং আয়াত)। আর এ কারনেই মহান আল্লাহ্ সকলের উদ্দেশ্যে বলেন (প্রাথমিকভাবে নবীকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে)ঃ
ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ
“আপনার পালনকর্তার পথের প্রতি আহ্বান করুন হিকমাতের মাধ্যমে, উত্তম উপদেশের দ্বারা এবং তাদের সাথে বিতর্ক করুন সর্বোত্তম পন্থায়।”- (সূরা নাহলঃ ১২৫)
উপরিউক্ত আয়াত থেকে আমরা বেশ কয়েকটি বিষয় অনুধাবন করতে পারি। প্রথমত ধর্ম প্রচারের সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম হলো হিকমাত অর্থাৎ ধর্মের সাথে হিকমাতের একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। দ্বিতীয়ত হিকমাত ধর্মীয় বিষয়াবলী উপস্থাপনের একটি উৎকৃষ্ট মাধ্যম। অন্যদিকে সূরা জুমুআর আয়াত থেকে বোঝা যায় নবীদের আগমন ঘটেছে হিকমাত শিক্ষা দেওয়ার জন্য, আর পূর্বোক্ত আয়াতে হিকমাত শিক্ষা লাভের পর মহান আল্লাহ্ তাঁর ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে সে হিকমাত প্রয়োগের নির্দেশ দিচ্ছেন।
মোটকথা, মহান আল্লাহ্ ও তাঁর প্রেরিত মহাপুরুষদের মাধ্যমে সমাজে যে জ্ঞানের বিস্তার ঘটেছে সে জ্ঞান হলো ঐশী জ্ঞান। আর আমরা সকল ঐশী জ্ঞানকে ইসলামী জ্ঞান বলে বিশ্বাস করি। যে জ্ঞান প্রভুর অস্তিত্ব প্রমাণ এবং বিশুদ্ধভাবে তাঁর বৈশিষ্ট্যসমূহের ব্যাখ্যা করে সে জ্ঞান হলো ইসলামী জ্ঞান। আর এ জ্ঞানের বিপরীতে অবস্থান করছে বস্তুবাদী জ্ঞান। নতুবা জ্ঞানের সাথে খ্রিস্টধর্ম, হিন্দুধর্ম বা ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। তাই হিকমাতমূলক জ্ঞান মহান আল্লাহ্ তাঁর প্রেরিত মহাপুরুষদের মাধ্যমে মানব জাতিকে শিক্ষা দিয়েছেন।
এই পরিভাষা গুলো সম্পূর্ণরূপে পবিত্র কোরআনেরই পরিভাষা। কেননা, পবিত্র কোরআনে অসংখ্যবার হাকিম ও হিকমাত শব্দের ব্যবহার ঘটেছে। তাই বলতে পারি ইসলামী দর্শনের জন্ম হলো পবিত্র কোরআনের গর্ভে। যে কারনে দর্শনশাস্ত্র ইসলামে একটি পবিত্র রূপ ধারন করেছে। ইসলামী দর্শনই যে ঐ হিকমাত এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে চাইলে মোল্লা সাদ্রা (রহঃ)- এর ‘আসফার’ ও ওস্তাদ জাওয়াদী আমুলী (রহঃ) রচিত ‘রাহীকে মাখতূম’ গ্রন্থদ্বয় দেখুন।
আর দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তর হলো পাত্রহীন জ্ঞান পূর্ণ স্বাধীন, সকল প্রকার বন্ধনমুক্ত ও নিরপেক্ষ। কিন্তু যখন সে কোন পাত্রে অবস্থান করে তখন তার পূর্বের মতো আর স্বকীয়তা থাকে না। কেননা, সে যে পাত্রে অবস্থান করে সে পাত্রটিই বিভিন্ন ধরনের বিশ্বাসের আসক্তিতে আবদ্ধ। তাই সে বিশ্বাস যুক্তিযুক্ত হোক বা না হোক, তার (পাত্রের) অবস্থার ওপর নির্ভর করে বিশেষ রূপ লাভ করে। ইসলাম ধর্মে জ্ঞান হলো আলোর তুল্য আর আকল বা বুদ্ধিবৃত্তি হলো তার নিয়ন্ত্রক। তাই জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তি একে অপরের পরিপূরক, কেউই এককভাবে সম্পূর্ণ নয়।
মোটকথা, বুদ্ধিবৃত্তি যে মানব সভ্যতায় অবস্থান করে, সে মানব সত্তার ( نفس ) প্রতি সে কোন না কোনভাবে আসক্ত। আর এ আসক্তি তার সৃষ্টিগত স্বভাব। আর সত্তাগত স্বভাব থেকেই সে তার নিজের কল্যান ও অকল্যানের সংকেত পেয়ে থাকে। فَأَلْهَمَهَا فُجُورَهَا وَتَقْوَاهَا ‘অতঃপর তাকে তার অসৎ কর্ম ও সৎ কর্মের জ্ঞান দেয়া হয়েছে’ (সূরা শাম্সঃ ৮)। শুধু তাই নয়, বরং তার সত্তা (যে সত্তায় বুদ্ধিবৃত্তি অবস্থান করছে) সে সত্তাও ঐশী রূপের প্রতিচ্ছবি।
فِطْرَةَ اللَّهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا “তিনি আল্লাহর প্রকৃতির ওপর মানবকে সৃষ্টি করেছেন” (সূরা রূমঃ ৩০)। অর্থাৎ মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি স্বাধীনভাবে কাজ করলেও সে সত্তাগতভাবে বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, যে বৈশিষ্ট্য তাকে দিক-নির্দেশনা দিয়ে থাকে। আর এই কল্যানকামী সংকেতের অনুগামী বুদ্ধিবৃত্তিকেই ইসলাম গ্রহণ করেছে। তাই বুদ্ধিবৃত্তি কার্যক্ষেত্রে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ; আর সে সত্তাগতভাবে আল্লাহ্র সাথে সংশ্লিষ্ট। এরূপ বুদ্ধিবৃত্তিকে বলা হয় (عقل قدسی) পবিত্র বুদ্ধিবৃত্তি (Sacred intellect)। ইসলামী দার্শনিকদের দৃষ্টিতে বিশুদ্ধ বাস্তবতা অবলোকনের জন্য পবিত্র বুদ্ধিবৃত্তির একান্ত প্রয়োজন। প্রাচীন গ্রীক দর্শনে প্লেটো এই পবিত্র বুদ্ধিবৃত্তিকে ‘মুসুল অবলোকন’ বলে বর্ণনা করেছেন। কেননা, মুসুল অবলোকন হলো বিশুদ্ধ বাস্তবতা অবলোকন। সক্রেটিস এ ক্ষেত্রে ‘দশম বুদ্ধিবৃত্তি’ (عاشر عقل) বা (عقل فعال ) ‘ক্রিয়াশীল বুদ্ধিবৃত্তি’ পরিভাষাটি ব্যবহার করেছেন। আর মাশ্শাই দর্শনে বলা হয় (عقل مستفاد)। কিন্তু পাশ্চাত্য জগতে আধুনিকতাবাদের (Modernism) নামে প্রকৃতির ওপর বিজয়ের লক্ষ্যের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে বুদ্ধিবৃত্তি। অর্থাৎ এর ফলে সেখানে রেঁনেসা পরবর্তীতে বুদ্ধিবৃত্তি Instrumental reason - এর রূপ লাভ করেছে। তাই এই চিন্তার ওপর ভিত্তি করে ফ্রান্সিস বেকন (Francis Bacon, ১৫৬১-১৬২৬) তার Novum Organum গ্রন্থে বলেন, ‘জ্ঞানই শক্তি। সেটাই জ্ঞান যা মানুষের বস্তুগত কল্যানে ফল দান করে।’
অতএব, বর্তমান পাশ্চাত্য জগতে প্রচলিত বুদ্ধিবৃত্তি পরিভাষা আর ইসলামী দর্শনে প্রচলিত বুদ্ধিবৃত্তির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ইসলামী দর্শনে পবিত্র বুদ্ধিমত্তা হলো ঐশী বার্তাবাহক। তাই ইসলামী দর্শনে ব্যবহৃত বুদ্ধিবৃত্তি পরিভাষাটিকে ঐশী আলোকচ্ছটা বিচ্ছিন্ন ভাবা অসম্ভব।
ইসলামী ইতিহাসে হিজরী প্রথম শতাব্দীর শেষাংশ ও দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রথম ভাগের পর থেকে ধর্মীয় চিন্তা পদ্ধতি বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। যেমনঃ কালামশাস্ত্র, ফেকাহ্শাস্ত্র, অধ্যাত্মবাদ (সুফীবাদ), দর্শনশাস্ত্র ইত্যাদি। ইসলামের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ও ক্ষেত্রে এই চিন্তাগত বিভক্তির মূল কারন ছিল সে সময়ে সমাজে নতুন করে ‘আল্লাহর কিতাবই যথেষ্ট’ এ চিন্তা পদ্ধতির প্রতিফলন ঘটেছিল। কেননা, রাসূল (সাঃ) মানব জাতির হেদায়েতের জন্যে মানব সমাজের মাঝে অতি মূল্যবান যে দু’টি জিনিস রেখে গিয়েছিলেন, তার একটি হলো মানব জাতির পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান (পবিত্র কোরআন) আর অপরটি হলো ঐ পবিত্র কোরআনের প্রকৃত ব্যাখ্যাকারী রাসূল (সাঃ) এর পবিত্র আহলে বাইত। কিন্তু ‘আল্লাহর কিতাবই যথেষ্ট’ বলে পবিত্র আহলে বাইতকে কোরআন থেকে বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে স্বেচ্ছাচারী ব্যাখ্যার নতুন একটি পথ উন্মুক্ত করা মুসলিম সমাজে। যার সূত্র ধরে পরবর্তী যুগে নতুন নতুন মাঝহাব ও চিন্তা পদ্ধতির সূত্রপাত ঘটে। এ কথার সত্যতা যাচাইয়ের জন্যে ইসলামের ইতিহাস পাঠই যথেষ্ঠ।
কিন্তু শীয়াদের মাঝে ধর্মীয় স্বকীয়তা অনেক খানি বজায় ছিল। কেননা, শীয়ারা ছিলেন পবিত্র আহলে বাইতের অনুসারী। আর অন্যদিকে পবিত্র আহলে বাইত ছিলেন পবিত্র কোরআনের একমাত্র ব্যাখ্যাকারী হিসেবে স্বীকৃত। ফলে শীয়াদের মাঝে ঐ বিভক্ত নীতির তেমন প্রতিফলন ঘটেনি। আর (ইমামদের অনুপস্থিতিতে) সাময়িকভাবে এরুপ ঘটলেও পরবর্তী কালে তা একক রূপ ধারন করেছে। যেমনঃ সাময়িক ভাবে দর্শন শাস্ত্র তার যাত্রা পথে শরীয়ত ও তরীকত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল।
ইসলামী দর্শনের ইতহাসে ইবনে সীনার একটি মৌলিক ভূমিকা হলো শরীয়ত ও হিকমাতকে একটি অভিন্ন ধারায় প্রবাহিত করা। অন্যদিকে শেইখ সোহারাওয়ার্দীর মৌলিক অবদান হলো তিনি হিকমাত ও তরীকতকে পরস্পর অবিচ্ছিন্ন একটি ধারায় নিয়ে আসেন। আধ্যাত্মবাদের অন্যতম প্রবক্তা মুহিউদ্দিন ইবনে আরাবীও শরীয়ত ও তরীকতকে একটি অভিন্ন রূপ প্রদান করেন। সবশেষে মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক মোল্লা সাদরা (রহঃ) শরীয়ত, হিকমাত ও তরীকতকে একত্রিত করলেন। আর এ পর্যায়ে এসে ইসলামী দর্শন তার স্বর্ণ যুগে প্রবেশ করে।
ইরানের ইসলামী বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেইনী (রহঃ) মোল্লা সাদরার ঐ আদর্শ নীতির সাথে রাজনীতিকেও সংযুক্ত করে ইসলামের প্রকৃত রূপকে সমাজে বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করেছেন।
রেঁনেসার ( Renaissance) যুগ থেকেই বুদ্ধিজীবি মহলের একটি প্রতিষ্ঠিত ধারণা হলো জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রগতির জনক হলো সেকুলার জ্ঞান (ধর্মবিচ্ছিন্ন জ্ঞান) ও শাসন ব্যবস্থা। তাই প্রগতি ও প্রযুক্তির আলো দেখতে হলে আমাদেও সেকুলার হওয়া অনিবার্য। কিন্তু এই ধারণাকে আজ ইসলামী শাসন-ব্যবস্থা একটি চাপিয়ে দেওয়া ভুল সূত্র হিসাবে প্রমাণ করেছে। কেননা, আজ ধর্মীয় শাসন-ব্যবস্থা ও চিন্তা-চেতনার মধ্য দিয়ে ইরান অভূতপূর্ব প্রযুক্তি ও জ্ঞান বিজ্ঞানের পথে এগিয়ে চলেছে। আর এ জন্যই আজ পাশ্চাত্য ইসলামের ছায়ায় বিকশিত প্রযুক্তি বাস্তবায়নের পথে (মিথ্যে অজুহাতের ধুয়ো তুলে) প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার চেষ্টা চালাচ্ছে।


সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মার্চ, ২০১৮ রাত ১১:০৫
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×