‘আজকের শিশু আগামীদিনের ভবিষ্যৎ’ এই কথাটা শুনতে শুনতে বুড়া হয়ে গেলাম কিন্তু আর ভবিষ্যৎ হইতে পারলাম না। তাই বলে কি ভবিষ্যতের স্বপ্ন ছেড়ে দিবো? পৃথিবী দিনে দিনে ধ্বংসের দিকে চলে যাচ্ছে বলে কি পৃথিবীকে ধ্বংসের মুখে ছেড়ে দিবো? না, ছেড়ে দিবো না। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভবিষ্যৎ হিসেবে না, বর্তমান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। যাতে বর্তমান পৃথিবী ভবিষ্যতের জন্য একটা উদাহরন হয়ে থাকে।
আমরা প্রায় সময়ই বলে থাকি আমরা যারা ১৯৮০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছি তারাই শেষ ভাগ্যবান প্রজন্ম। কারণ আমরাই শেষ প্রজন্ম যাদের শিকড়ের সাথে সম্পর্ক ছিল, আমরা শেষ যারা প্রকৃতির অনেক কাছাকাছি ছিলাম, আমাদের সময়েই শেষ যখন জীবন সহজ- সরল ছিলো। আমাদের নানু-দাদু রূপকথার গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়াতো, ঘুম থেকে উঠে বাবার হাত ধরে ফুল কুড়াতে যেতাম আর মায়ের সাথে বসে মালা গাঁথতাম, গাছে পিড়ি দিয়ে দোলনা বানিয়ে খেলতাম, গাছে ঝুলতাম, পুকুরে সাঁতার কাটতাম, মাঠে নেমে কানামাছি- ছোঁয়াছুঁয়ি খেলেছি, হাড়ি-পাতিল, মাটির পুতুল খেলে অল্পতেই খুশি হতাম। আবার বিচি খেয়ে ফেললে পেটে গাছ হবে, চাঁদের বুড়ি চাঁদে বসে চরকা কাটছে, আমরা যেদিকে যাই চাঁদও সেদিকে যায় এরকম কতো সহজ-সরল চিন্তা ভাবনা ছিলো আমাদের। হ্যাঁ, আমাদের সাথে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের তুলনা করে লাভ নেই। এখন পৃথিবী দ্রুত হয়ে গেছে, জীবন ধারা ও জীবন মান বদলে গেছে। এখনকার মা-বাবাদের প্রায় অভিযোগ করতে দেখা যায়, আমাদের বাচ্চাদের সকাল শুরু হয় ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে, বাচ্চাকে ইউটিউবে কার্টুন না দেখালে ভাত খায় না, পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট হলে গিফট হিসেবে স্মার্ট মোবাইল চাই, খেলাধুলা বলতে গেলে নামই নেই, সামাজিকতা মানেই চ্যাট, ভার্চুয়াল জগতই ওদের আসল ঠিকানা। এরকম শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন প্রজন্মকে নিয়ে কি কোনো আশা করা যায়? হ্যাঁ, আমি আশাবাদী। কারণ এই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম থেকেই আমাদের ভবিষ্যৎ নেতা তৈরি হবে যে কিনা সাত সাগরের মাঝি হবে এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে কাজ করতে হবে এবং ওদের মনস্তত্ব ধরতে হবে। ওরা কি ভাবে কি চায় জানতে হবে এবং ওদের চিন্তা ভাবনাকে প্রাধান্য দিয়ে ওদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। ওদের জন্য একটা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে হবে যাতে ওদের সাথে মিলে আমরা একটা নতুন পৃথিবী উপহার দিতে পারি। একটু ভেবে দেখলে দেখা যাবে, ‘জেনারেশন জেড’ এর টেকনোলজির উপর বেশি নির্ভরতার পেছনে আমরা মা-বাবারাই দায়ী। ওদেরকে মাটির সাথে, শিকড়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে আমাদেরই। আমাদের আনন্দ দেয়া ছোটো ছোটো গল্প, সরলতার সাথে ওদের মেলবন্ধন তৈরি করে দিতে হবে আমাদেরই। ওদের নিজেদেরকে অন্বেষণ করার পটভূমি আমাদেরই রচনা করে দিতে হবে।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিয়ে কাজ করার এখনি সময়। কারণ এখন আমরা এমন একটা পর্যায়ে আছি যেখানে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ‘জেনারেশন জেড’, আমাদের প্রজন্ম ‘জেনারেশন ওয়াই’ বা ‘মিলেনিয়ালস’, আমাদের মা-বাবার প্রজন্ম ‘জেনারেশন এক্স’, আমাদের নানু-দাদুর প্রজন্ম ‘বেবি বুমারস’ একসাথে রয়েছে। এর মধ্যে আমাদের নানু-দাদুর প্রজন্ম লোপের পথে। এই প্রজন্মগুলোর সেতুবন্ধন কারা করতে পারে? আমরাই যারা ‘জেনারেশন ওয়াই’ তারাই করতে পারি। এই ‘জেনারেশন জেড’ ২০২০ সালের মধ্যে স্বেচ্ছাসেবায় যোগ দিবে, ওরা নিজেদের আলাদা গুণকে চিনে নিবে, তারা এই জগত নিয়ে চিন্তা করবে, বিভিন্ন গোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে দান করবে, আর মুখোমুখি কথোপকথনকে পছন্দ করবে। তাই ওরা ওদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কম সচেতন এই ভাবনা থেকে বের হয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী তৈরি করতে হবে। এই পৃথিবীর বুকে শিশুর জন্য বেহেশত গড়ে দিবো ঐক্যের ডাক দিয়ে। তাইতো কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য এর কণ্ঠে-
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি—
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গিকার।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ৮:০৬