(এই লেখার সব চরিত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক। কোন চরিত্রের সাথে বাস্তবে কারো মিল থাকলে তা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত ও কা্কতলীয়। বাস্তবে এইসব চরিত্রের কোনো অস্তিত্ব নাই।)
"বদরুল.................."
"বদরুল.................."
একটা গুরুগম্ভীর কণ্ঠে ভেসে এল আওয়াজটা।
"বদরুল হোসেন, পিতাঃ সৈয়দ মাহতাব হোসেন।"
আবার সেই একই কণ্ঠে ভেসে এল শব্দটা।
বদরুল সাহেব ঘামছেন। তাঁর কপাল বেয়ে টপ টপ করে পানি ঝরছে। সবকিছু কেমন আশ্চর্যভাবে তাঁর সাথেই মিলে যাচ্ছে। কিন্তু এমনতো হওয়ার কথা ছিল না। কোথাও একটা মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছে মনে হয়। তিনি কী করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। জীবনে কত সমস্যা কত কঠিন সময় তিনি হাসিমুখে পেড়িয়ে এসেছেন। তাঁর কাছে আসতে হলে ১০টি সিকিউরিটি দরজা পাড় করে নিরাপত্তা তল্লাসির পর কেউ ঢুকতে পারে। কিন্তু সেই বদরুল সাহেবকে আজকে বড়ই অসহায় দেখাচ্ছে। তিনি সাহায্যের জন্য এদিক ওদিক তাকালেন। চারিদিকে পতঙ্গপালের মত কেবল মানুষ আর মানুষ। সবাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার মধ্যে তাঁর বডি গার্ডদের, পিএস আর ব্যক্তিগত প্লেনের পাইলটকেও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কেউ তাঁর দিকে একটিবারের জন্যও তাকাচ্ছে না। সবার মুখই কেমন যেন ফ্যাঁকাসে হয়ে আছে।
"বদরুল হোসেন, পিতাঃ সৈয়দ মাহতাব হোসেন, দেশঃ বাংলাদেশ, জেলাঃ ............" আবার সেই গুরুগম্ভীর কণ্ঠে ঘোষণা এল।
কি আশ্চর্য!! বদরুল সাহেব নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। এটা কি করে সম্ভব? এই মুহূর্তে তাঁর মনে হল এই মাটিটা যদি ফাঁক হত আর তিনি ভিতরে ঢুকে যেতে পারতেন! তিনি মনে মনে তাঁর নিজ অর্থায়নে করা মসজিদের সংখ্যা গোনার চেষ্টা করলেন। তাঁর মাথার ভিতর কেমন যেন সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। এই বিপদে তিনি যাঁদের ডাকবেন বলে ঠিক করছিলেন তাঁদের সব্বাইকে তিনি তাঁর পিছনের লাইনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেলেন। হায় হায়! কি হল! তিনি ভাবলেন। আজ কোথায় তাঁর সিকিউরিটি, কোথায় তাঁর ভরসার মানুষেরা! তাঁর সামনের মাটিতে তিনি একটি তরলের ধারা লক্ষ্য করলেন। যেই কাজটি তিনি কোনদিন করেননি আজ তাই সবার সামনে করে ফেলেছেন। তিনি হন্যে হয়ে তাঁর পরম প্রিয় পরিবার সদস্য আর আত্মীয়স্বজনদের খুঁজতে লাগলেন। যদি কারো দেখা মিলে এই সময়। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না।
"বদরুল হোসেন, পিতাঃ সৈয়দ মাহতাব হোসেন, দেশঃ বাংলাদেশ, জেলাঃ ............ থানাঃ............ গ্রাম............" আবার সেই বজ্রকঠিন আওয়াজটা ভেসে এল। তিনি তাঁর ৬৫ বছরের জীবনে এত কঠিন কণ্ঠ আগে কোনদিন শুনেননি। তাঁর একবার মনে হল এখান থেকে এখনই ছুটে পালাই। কিন্তু আফসোস তাঁদের চতুর্দিকে পালানোর কোন উপায় নেই। চারিদিকে ঘিরে আছে কঠিন নিশ্ছিদ্র বলয়। তিনি মনে মনে ভাবলেন এত মানুষ এদের মধ্যে মিশে গেলে মনে হয় কেউ তাঁকে আর খুঁজে পাবে না। হায়! হায়! এটাও মনে হয় সম্ভব হল না। তাঁর নাম ঘোষণার সাথে সাথে তাঁর হাত, পা কোনটি আর কোন কাজ করছে না। কেমন যেন অসাড় হয়ে গেছে। তাঁর মনে হল তিনি প্রায় জামান সাহেবকে স্ট্রোক করেছেন বলে ব্যাঙ্গ করতেন। আজ তাঁরই সেই একই পরিণতি।
"বদরুল হোসেন, পিতাঃ সৈয়দ মাহতাব হোসেন, দেশঃ বাংলাদেশ, জেলাঃ ............ থানাঃ............ গ্রাম............মহল্লা.........বাড়ি............... এখনই সামনে দাঁড়াও........." বজ্রকন্ঠ আবার ভেসে এল।
বদরুল সাহেব কম্পিত, ভীত হৃদয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর দিকে এখন কোটি কোটি চোখ তাকিয়ে রয়েছে। চারিদিকে এক অসহ্য নীরবতা। কেউ যদি কিছু একটা বলতো! তিনি নিজ হৃদয়ের ধুকপুক শব্দ শুনতে পেলেন।
"শুরু হচ্ছে বদরুল হোসেন, পিতাঃ সৈয়দ মাহতাব হোসেন, দেশঃ বাংলাদেশ, জেলাঃ...........থানাঃ............
গ্রাম............মহল্লা.........বাড়ি...............এর জীবন ছবি"
বদরুল সাহেব নিজের চ্যানেলের আর তাঁর প্রিয় ক্যামেরাম্যানের নাম মনে করার চেষ্টা করলেন। ইস! আজ প্রয়োজনের সময় কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ এই চ্যানেলে তাঁর কত সাক্ষাৎকার, কত গান, কত বক্তৃতা, কত ছবি নিয়মিত প্রচার আর প্রসার হত! নিজের জীবন নিয়ে একটা ছবি বানানোর আর একটা বই লেখার বড়ই ইচ্ছে ছিল বদরুল সাহেবের। তিনি কখনই চাননি এভাবে তাঁর স্বপ্ন পূরণ হোক।
"স্যার স্যার........."
কে যেন ডেকেই চলেছে। বদরুল সাহেব ঘুম থেকে পড়িমরি করে উঠে পড়লেন। সারা বিছানা ঘামে ভেজা। এতক্ষণ তাহলে তিনি স্বপ্নই দেখছিলেন! যাক বাবা বড় বাঁচা বেঁচে গেছি ভাবলেন বদরুল সাহেব।
"স্যার আজকে সকাল ১০ টায় আপনার একটা টিভি শ আর ক্রীড়া টুর্নামেন্ট উদ্ভোদন করার শিডিউল আছে।" বলল বদরুল সাহেবের পিএস। "সরি স্যার কিন্তু আপনি নিজেই বলেছিলেন এটার কথা।" "ওকে ওকে আমার কালো মার্সিডিজটা রেডি কর। আমি রেডি হচ্ছি।" বললেন বদরুল সাহেব আর মনে মনে ভাবলেন এর পর থেকে কখনই আর কানে হেডফোন লাগিয়ে ঘুমাবেন না।