somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পকেট ভর্তি বাজার

২৩ শে নভেম্বর, ২০২০ রাত ৯:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আমার ওয়াইফ একটা রিসার্চ ফার্মে চাকুরি করে। করোনার মধ্যে বেশ কিছুদিন তাকে বাড়িতে বসে কাজ করতে হয়েছে। কোরবানীর ঈদের পরে সম্ভতঃ অক্সফামের সাথে ওদের কোন একটা প্রজেক্ট চলছিল, আলট্রা পুওর গ্রুপের মানুষদের নিয়ে। তখন মোবাইলে ওর কিছু কনভার্সেশন মাঝে মধ্যেই আমার কানে আসত। যাদেরকে ও ইন্টারভিউ করত সেসব প্রান্তিক মানুষদের অধিকাংশেরই সারা বছর মাছ মাংসের সাথে কখনও সাক্ষাৎ ঘটেনা! বেশিরভাগ উত্তরদাতাই জানিয়েছেন, শুধুমাত্র বর্ষার মৌসুমে তারা হাত জাল দিয়ে ধরে কিছু চুনো মাছ খেতে পারেন। বাচ্চাদের ফলমূল খাওয়াতে পারে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে একজনতো বলেই বসল, 'ফল কই পামু আপা। গাছে একটা কাঁঠাল ধরছিল, ঐডাই সবে মিল্যা খাইছি'। শুনে প্রচন্ড মন খারাপ হল। আমি নিজেও বেড়ে উঠেছি নিম্ন মধ্যবিত্ত সারাউন্ডিংসে। কিন্তু সারাবছর কেউ মাছ কিনতে পারেনা কিংবা গ্রামের মানুষেরাও ফলমূল খেতে পায়না, এটা আমার দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ধারণাতেও ছিলোনা।

কর্মের সুবাদে আমাকে দেশের প্রায় প্রতিটি স্তরের মানুষের সাথেই মিশতে হয়। ভেবে দেখলাম, এই আমিই যদি এদের সম্বন্ধে না জানি, তবে এদের ভাগ্য নিয়ন্তা যারা অর্থাৎ সমাজের নীতি নির্ধারকেরা এদের কথা কীভাবে জানবেন? যে কোনদিন জ্যামে বসে থাকেনি সে কীভাবে লোকাল বাসে ঝুলের থাকার কষ্ট নিয়ে মাথা ঘামাবে? যাদের কাছে কাঁচা মরিচের কেজি ৩০০ কিংবা ৩০০০-এ কিছু এসে যায়না, তারাই বা কীভাবে নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্তের যন্ত্রণা বুঝবে?

কিন্তু কেন এদেশে দ্রব্যমূল্যের এত লাগামছাড়া দাম? সরকারতো বলছে দেশে পর্যাপ্ত খাদ্যের মজুদ রয়েছে, তবে? বোদ্ধাদের জিজ্ঞেস করলে তারা মূলতঃ ২টা কারণ বলবেন ঃ
১ম কারণ, সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেট জিনিসটা যে কী ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, তা সম্মানিত ব্লগাররা আমার চেয়ে ভালো জানেন। ডিমান্ড-সাপ্লাইয়ের কচকচানি অন্তত বাংলাদেশে টেকেনা!
২য় কারণ, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ব। ঢাকায় বসে আমরা যে দামে পণ্য কিনি, তার অর্ধেকও যদি উৎপাদক শ্রেণীর কাছে যেত দেশে এত আয় বৈষম্য থাকতোনা। অবশ্য অর্থনীতিবিদরা বলবেন, মানি সার্কুলেশন বাড়ছে; জিডিপির উন্নয়ন হচ্ছে!

কিন্তু এর বাহিরেও কিছু কারণ সবার অলক্ষ্যে সমাজ-সংস্কৃতিতে, মানুষের মননে পরিবর্তন আনছে। এই বিষয়গুলো নিয়েও সময় এসেছে কথা বলবার। তাই নিজের মত করে আরও ৩টা পয়েন্ট আমি দাঁড় করালাম ঃ

৩য় কারণ, মুনাফার লক্ষ্যমাত্রা। পুঁজিবাদের নিয়মই হল, মানুষ যত ব্যয় করবে তার আয়ের আকাংখাও তত বাড়তে থাকবে। আগে একজন রিকশাওয়ালা হয়ত দিনশেষে পেট ভরে খাওয়ার মত চাল ডাল কেনার পরেও বাচ্চাদের জন্য চুকলেট কেনার পয়সা হাতে থাকলে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতেন, কিন্তু এখন তারও ঘরে কালার টিভি, ফ্রিজ আর হাতে মোবাইল না থাকলে চলেনা। একই ভাবে একজন ব্যবসায়ী ১০০ টাকার পণ্য বেচে কেউ ৫০-৬০, এমনকি কেউ ১০০-১৫০ টাকাও লাভ করতে চান। অথচ ২০ বছর আগেও ব্যবসায়ীরা ২০-২৫% লাভেই সন্তুষ্ট থাকতেন (নিউ মার্কেট, এলিফ্যান্ট রোডের ব্যবসায়ীরা ছাড়া)। এতে করে হচ্ছে কি, সমাজের প্রতি স্তরেই ব্যয় বাড়ছে। সেই বাড়তি ব্যয় কেউ মেটাচ্ছেন 'উপরি' বাড়িয়ে, আবার কেউ মেটাচ্ছেন ব্যবসার পণ্যের দাম আরও বাড়িয়ে। আর মাঝখান দিয়ে যার কিছুই বেঁচার নেই, সে যাচ্ছেন হেরে।

৪র্থ কারণ, লোক দেখানোর ঝোঁক। যাদের হাতে প্রচুর কাঁচা পয়সা, তারা সাধারণতঃ কোনকিছুর দরদাম করার তোয়াক্কা করেন না। এটা তাদের জন্য গাত্রদাহের কোন কারণ না হলেও দিনশেষে সমাজের জন্য তা বিষফোঁড়ার শামিল হয়ে দাঁড়ায়। ধরা যাক, আপনি রিকশা থেকে নেমে ২০ টাকা ভাড়া দিলেন, যেখানে প্রচলিত ভাড়া হয়ত ১৫ টাকা। আপনার এই কর্মের কর্মফল ভোগ করবে আপনার পরের প্যাসেঞ্জার। রিকশাওয়ালা তাকে বলবে,'সবাইতো ২০ টাকাই দেয়'! অর্থাৎ, আপনি একটা সিস্টেম লসের জন্ম দিলেন। (রিকশাওয়ালার প্রসংগ স্রেফ উদাহরণ।) একই ভাবে মাছের বাজার বা বাজারের অন্যান্য স্তরেও অল্প কিছু মানুষের ঔদ্ধত্বের জন্য চাহিবা মূল্য বেড়ে তা অন্যদের ভোগায়।

৫ম কারণ, তথাকথিত অর্গ্যানিক কালচার! এ পর্যন্ত পড়েও যারা আমার পাশে ছিলেন, তারা এবার নিশ্চয়ই ভুরু কোঁচকাচ্ছেন, কীসের মধ্যে কী! আসলে বাঙ্গালীর মধ্যে একটা বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে, দামি জিনিস মানেই ভালো জিনিস। তাই যখনই কেউ হালের ফ্যাশন 'অর্গ্যানিক' শাক-সব্জি, মাছ-মাংসের ঝুঁড়ি নিয়ে অনলাইনে বসেন, তাকে মাথায় রাখতে হয়, দাম যেন বাজার থেকে বেশি থাকে! এমনকি সুপারশপ থেকেও তাদের দাম বেশি রাখাটা প্রায় বাধ্যতামূলক। এদিকে সুপারশপ ওয়ালারা সবসময়ই কাঁচা বাজার থেকে দাম কেজিতে ১০-১৫ টাকা বেশি রাখেই। তারা যখন দেখে এর চেয়েও বেশি দামে পাবলিক অনায়াসেই অনলাইন থেকে কিনছে, তারাও দেয় নিজের পণ্যের দাম বাড়িয়ে। ওদিকে তাদের দেখাদেখি দাম বাড়ান কাঁচা বাজার ওয়ালারাও। আর অনলাইন এবং সুপারশপের দাম যখন কাছাকাছি হয়ে যায়, অর্গ্যানিক ওয়ালারাও তাদের 'এক্সক্লুসিভিটি' ধরে রাখতে আরও দাম বাড়িয়ে দেন এবং আবারও একই সাইকেলে বাজারের সবাই দাম বাড়ান! কী একটা উদ্ভট মেকানিজমে বাজার কাজ করছে, বুঝতে পারেন কি?

আমার মনে হয় উদীয়মান অর্থনীতিগুলো সবসময়ই একটা পর্যায়ে এধরণের প্যারাডক্সের মধ্যে দিয়ে যায়। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মানুষের মন মানসিকতাও উন্নত; আর ঠিক এখানটাতেই আমরা পিছিয়ে! অর্থনীতির ভাষায়, সরকার কখনই বাজার ব্যবস্থাকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করবেনা। তাই আজ যে দ্রব্যমূল্যের ভারসাম্যহীনতা, তার পেছনে দায়ী আসলে আমরা নিজেরাই- 'জনগণ'।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০২০ রাত ১০:৩৯
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×