আব্বার শোবার ঘরে একটি ফ্যান ছিল। তিন পাখার নীল রঙের ফ্যানটি কিনেছিলেন ঝিনাইদহ শহর থেকে। সে সময় ফ্যান খুব একটা বিক্রি হতো না জেলা শহরগুলোতে। আব্বা গরম সহ্য করতে পারেন না, আর নিরাপত্তার কারনে বাহিরে ঘুমাতেও পারেন না। বাধ্য হয়েই একটি ফ্যান কিনে নিয়ে আসে বাড়িতে। যথারীতি সেটা লাগানো হয় আব্বার ঘরে।
তখন আমার জন্ম হয়নি। আমার মায়েরও বিয়ে হয়নি। আমার নানা বেড়াতে এসে ফ্যানের বাতাস খেয়ে গিয়ে নানীকে বলেছিলেন ছেলে দেখে এলাম। যেমন সুন্দর তেমনি অবস্থা। তোমার মেয়েকে ওই বাড়ি বিয়ে দিলে গায়ে ঘামাচি হবে না। সারা রাত জেগে জেগে স্বামীর জন্য হাত পাখা দিয়ে বাতাসও করতে হবে না। এমনিই পাখা ঘুরবে। বাতাস হবে। তোমার মেয়ে শান্তিতে ঘুমাবে। নানার কথায় নানী সেদিন রাজি হয়েছিল।
নানি রাজি না হলেও যায় আসে না। বিয়ে হতো। নানা, বাড়িতে যেটা বলতো সেটাই হতো। তার কথার ওপরে অন্য কারো কথার তেমন মূল্য ছিল না। নানা মেয়ে বিয়ে দিয়েছিল। মা ফ্যানের বাতাশ খেতেন আর নায়েরে গিয়ে সখিদের সে গল্প শোনাতেন। সখিরা বলতো কতো সুখ, কত সুখ।
আমাদের কয়েক ভাই বোনের জন্ম হয়। বাড়তে থাকে ফ্যানের বয়স। হারাতে থাকে সৌন্দর্য। ফিকে হয়ে আসে গায়ের রং। খসে পড়ে রংয়ের চল্টা, নড়বরে হয়ে পড়ে পাখা। বাড়তে থাকে ফ্যানের শব্দ। শুধু কমে না বাতাশ। এত বয়সি ফ্যান হলেও মনে হয় বাতাশ আরও বেড়েছে। কয়েক মাস পর পর পরিস্কার করা হয় পাখা। ঝেড়ে ফেলা হয় ধুলোবালি। ভেজা কাপড়ে তুলে ফেলা হয় গায়ের ময়লা।
ধীরে ধীরে বাড়ির মানুষের অবস্থা ভাল হতে থাকে। বাড়তে থাকে ঘরের সংখ্যা। কেনা হয় আরও কয়েকটি ফ্যান। পুরাতন ফ্যান বদলে আব্বার ঘরে লাগানো হয় নতুন একটি। আর পুরাতনটির আশ্রয় হয় খাটের নিচে। বেশ কিছু দিন পরে বাড়ি রং করতে আসা মিস্ত্রি ফিরিয়ে দেয় ফ্যানের আয়ুস্কাল। মা’কে বুঝিয়ে বলে রং করে সেটি। কাজের বিনিময়ে কয়েকটি টাকা পেয়ে খুশি হয় মিস্ত্রি। আর ঝক ঝকে নতুন রংয়ে ফ্যানটি দেখে আরও খুশি হয় মা। পুরাতন ফ্যানের নতুন রূপ দেখে, মা আমাকে বলে ’আমার রান্না ঘরে ফ্যানটি লাগিয়ে দে’।
আবারও সেটি মায়ের কাছে কাছে থাকে। মা দিনে সবচেয়ে বেশি সময় ব্যায় করে এই রান্না ঘরে। মায়ের কথায় আরও তাকে আরও একটু আয়েশে রাখার আশায় প্রতিস্থাপন হয় রান্না ঘরে।
গ্রামের অন্যসব বাড়ির রান্না ঘরের মত না, আমাদের রান্না ঘর। আধুনিক সব সুযোগ সুবিধা সমৃদ্ধ রান্না ঘরে আজও ঝুলছে ফ্যানটি। প্রায় ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ঘুরছে আজও। সুইচ চাপলে কোন ধরনের শব্দ না করেই চালু হয়। বাতাশ বাড়লে বাড়ে একটু শব্দ। মাথার ওপর আপন মনে ঘুরতে থাকে। বাড়িতে গিয়ে মা’কে বলেছিলাম ফ্যানটি বদলে ভাল একটি ফ্যান লাগিয়ে নিতে। কখন মাথার ওপর খুলে পড়ে যায়। কে জানে। মা বলেছিল, ‘না থাক, লাগবি নানে’।
মাঝে মাঝে বাড়ির কাজের লোকজন ওটাকে মুছে ঝেড়ে রাখে। সুইচ চাপলে আজও চলে। মা ওই ফ্যানের নিচে দাঁড়িয়ে আমাদের জন্য রান্না করেন। মাদুর পেড়ে খেতে দেন। সেদিন দেখলাম ফ্যানের একটি পাখার কোনা থেকে কিছু অংশ বের হয়ে এসেছে। মাকে বললাম। ওটা নাকি আরও পাঁচ বছর আগে থেকই ওই রকম, মা’য়ের জবাব।
ঢাকা মেডিকেলে গিয়েছিলাম পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে। একজন বৃদ্ধকে দেখলাম ভয়ানক ভাবে আঘাত পেয়েছেন মাথায়। কেটে গেছে মুখের অনেক অংশ। সেলাই দেয়া হয়েছে প্রায় ৩০টি। ভয়াবহ সেই দৃশ্য দেখে আৎকে উঠি। জানতে চাই কিভাবে হলো এমন?। প্রশ্নের জবাবে বৃদ্ধের স্ত্রী বললেন ’পুরাতন একটা ফ্যান ছিল বাড়িতে, রাতে ফ্যানের পাখা ভেঙ্গে পড়েছে ঘুমন্ত লোকটার ওপর’। সাথে সাথে মনে পড়ে যায়। বাড়ির কথা। মায়ের কথা। রান্না ঘরের ফ্যানের কথা।
বাসায় ফিরে টেলিফোনে মা’কে সেদিন কথাগুলো বললাম। তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলেন। কিন্তু তার রান্না ঘর থেকে পুরাতন ফ্যানটি সরানো দরকার সেটা মাথায় নেননি।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




