যতটুকু জানি সেই ছোটকাল থেকে বাড়ীর মা-বাবা থেকে শুরু করে স্কুলের গুরুজন সহ মইমরুব্বিদের কাছে শিখেছি যে ভাষা হচ্ছে বিধাতার দান সেটা যেই ভাষা হউক না কেন। কিন্তু পাকিস্তানে খেলতে যাওয়া মহিলা টাইগার বাহিনীর অধিনায়ক সালমা পাকিস্তানের এক সংবাদ সম্মেলনে উর্দুতে কথা বলে বিপাকে পড়েছেন।
এনিয়ে আমাদের কিছু আজবমার্কা দেশপ্রেমিক ইয়া বড় বড় স্টাটাস বমি করছে যে
"ভাষা আন্দোলন কি এই জন্য করেছিলাম”
“উর্দু হচ্ছে জঙ্গিদের ভাষা”
“নব্য রাজাকার সালমাকে দেশে এনে কঠিন শাস্তি দেওয়া হউক”
ইত্যাদি ইত্যাদি
*
প্রকৃত দেশপ্রেমিকের পায়ের জুতারো সমান না এইসব হিংসুটে খামাখা দেশপ্রেমিককে কিছু প্রশ্ন করছি-
“আজ বাংলার সংস্কৃতির কবর রচনা করে আপনার বাড়ীতে যখন হিন্দি টিভি চ্যানেল এর জয় জয়কার তখন কোথায় চলে যায় আপনার দেশে প্রেম? আপনার মা, আপনার বোন, আপনার বউ যখন সারাদিন হিন্দি সিরিয়ালে ঢুকে হাবুডুবু খাচ্ছে, বাংলার আদলে বলছে “কিয়া খাবার হে তেরা” তখন বুঝি দেশ প্রেম বেড়ে যাচ্ছে..?
*
আচ্ছা বাংলাদেশে বিশ্ব ইজতেমাতে যখন দেশি মুল্লা বিদেশী মুল্লার সাথে বসে কথিত উর্দু ভাষায় ইয়া বড় মোনাজাত পরিচালনা করে, যখন লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালী সেই উর্দু ভাষাতে মোনাজাতে আমিন আমিন বলে রব তোলে, সেই আমিন আমিন ধ্বনীতে আমাদের মাননীয় প্রধান মন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী সহ অন্যান্য কর্তারা যখন সুর মেলান তখন কোথায় থাকেন আমাদের সেই দেশপ্রেমিকরা যারা আজ সালমার উপর আঙ্গুল তুলছেন?
*
যখন যেখানকার মানুষ যেভাষাতে কথা বলতে বুঝতে পারে সেই ভাষা বললে দোষ কোথায়? সেখানে যদি সালমা সেখানকার সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর বাংলায় দিতেন তাহলে তাদের বুঝতে একটু দেরি হতো সেখানে উর্দুতে বলায় বোধগম্য হয়েছে সবার সেখানে জীবন বাজি রেখে এমন দেশে খেলতে যাওয়া আমাদের ক্যাপটানকে সাহসি না বলে রাষ্ট্রদোহী বলতে একটুই গলা আটকালো এইসব কথিত দেশপ্রেমিকদের??
*
আজ আমরাই যখন বিদেশীদের এনে বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপনে পার্শ্ববর্তী দেশের নায়িকাদের ইয়া বড় বড় বিলবোর্ড ঢাকা,চট্টগ্রাম সহ দেশের কানায় কানায় লাগাচ্ছি তখন দেশপ্রেম যায় না, না? দেশি গুনবতি অভিনেতা অভিনেত্রী থাকার পরেও যখন আমরা শাহরুখ খান কিংবা ভারতীয় গায়কদের এক বড় দলকে ঢাকায় এনে সারা রাত হিন্দু গান “মেরা ভারাত মাহান” ইত্যাদি শুনি তখন দেশপ্রেম যায় না?
*
আজ হিন্দি সংস্কৃতির প্রভাবে রাস্তা ঘাটে, স্কুল কলেজে, অলি গলিতে বাড়ী বাড়ীতে যখন কমবেশি সবাই হিন্দিতে কথা বলছি, আমরা যখন “কোথায় যাচ্ছো” এর আদলে আজ “কাহা যা রাহেহো” বলছি, আমরা যখন বলি “পরে কথা বলবো আভি টিভি দেখ রাহি হু” তখন আমাদের মস্ত বড় দেশপ্রেমিক কোথায় চলে যান কিছুই বুঝি না। তখন বাংলা ভাষার কি অপমান হয় না?
*
কিছুদিন আগে বাংলাদেশে এসেছিলেনভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, তিনি বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে সমস্ত মিডিয়ার সামনেই পরিষ্কার বাংলায় উপস্থিত সবার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, "আপনারা ভালো আছেন?" অথচ মোদি যখন পরিষ্কার বাংলায় কথা বলেছিলেন তখন তার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা কোন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল জানেন? সালমা খাতুনের ব্যাপারটাও ঠিক এইভাবে চিন্তা করুন না কেন? নাকি পাকিস্তানিদের কাছ থেকে শ্রদ্ধা পাওয়াটাও দেশপ্রেমহীনতা???
কই কোন ভারতীয়রাকতো মোদির দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলে নি। আর যদি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই যদি ভারতের কোন এক সফরে গিয়ে হিন্দিতে কথা বলতেন যাতে তাদের বুঝতে সুবিধা হয় তাহলে কি তিনি রাষ্ট্রদোহী হয়ে যাবেন? এরুপ যাদের যুক্তি হয় তাহলে বলবো মাথার ভিতরে যে ছোট মগজ আছে তার চিকিতসা করান আপনারা। অবশ্য চিকিতসার ফলাফল হবে শুন্য (0), কারন ভবিষ্যতে হয়তো এইডস রোগের ঔষধ বের হতে পারে কিন্তু যাদের মনে হিংসা তাদের কোন চিকিতসা নেই।
*
কথা বলতে গেলে এই সব আজব মার্কা দেশপ্রেমিকদের কালো চেহরা উত্থাপন করতে হয়তো কয়েক খন্ডে পুস্তক রচনাও কম হবে। শুধু এই টুকু বলবো যারা আমাদের সাথে অতিতে অন্যায় করেছে আজ যদি তাদের সাথে সেইরুপ ব্যবহার আমরা করি তাহলে পাকিস্তান আর আমাদের মধ্যে পার্থক্য কোথায় রইলো? একজন যদি বহু ভাষায় কথা বলতে পারে তাহলে তার যোগ্যতানুসারে তাকে সম্মান না করে তাকে অপমান করে, দেশদ্রোহী রাজাকার বলে কোন দেশ প্রেমের সংজ্ঞা দিচ্ছেন আপনারা? ভাষাগত গোড়ামী হিংসুটে মানুষের প্রধান বৈশিষ্ট তাহলে কি আমরা হিংসুটে প্রানীতে পরিনত হচ্ছি? সালমা আমাদের ক্ষমা করো আমরা তোমার অবদানকে ভুলে গিয়েছি কারন আস্তে আস্তে আমরা মানুষ থেকে হিংসুটে প্রানীতে রুপান্তরিত হচ্ছি।
বিসিবি’র দেশপ্রেমিকরা আজ যারা সালমার উপর চটেছেন অনুরোধ রইলো নিজেকে যদি এতই দেশপ্রেমিক মনে করে থাকেন তাহলে উপরে উত্থাপিত প্রশ্নগুলির সঠিক উত্তর দিবেন বাঙালীকে নাহলে আমাদের সরকার কর্তৃক ঢাকাতে লাগানো বিলবোর্ডে একটু নজর দেওয়ার আহবান রাইলো যেখানে বড় বড় করে লেখা আছে “'সব দেশের সাথেই সুসম্পর্ক, কোন বৈরিতা নয়”.......