আমার নাম সূর্যপ্রিয়া। এমন পুরনো দিনের মতন নাম কেনো রাখা হয়েছিল তার জবাবে দারুণ মজার একটা কাহিনী বলে আব্বু। আমার জন্ম এক শুক্রবার সকালে হয়েছিল। যদিও আমার জন্ম হওয়ার কথা ছিলো শুক্রবার দিনের বেলা কোনও এক সময়, ডাক্তার-নার্সদের সম্মিলিত উপস্থিতির মধ্যে; কিন্তু এতটা অপেক্ষা করার মতন ধৈর্য আমার এখনও নেই, তখনও ছিল না। তাই, প্রত্যুষে আমার অপ্রস্তুত আম্মুকে অনেক অনেক কষ্ট দিয়ে আমার আগমন। মাত্রই সূর্য উঠছে তখন। আরামদায়ক একটা জায়গা থেকে বিরক্তিকর এক জায়গায় টেনে বের করা হয়েছে আমাকে, পরিষ্কার করে তোয়ালে পেঁচিয়ে আমাকে তুলে দেয়া হয়েছে আব্বুর কোলে, তারস্বরে চিৎকার করে কাঁদছি আমি; এমন সময় হাসপাতালের জানালা দিয়ে দিনের প্রথম সূর্যের আলো কেবিনে প্রবেশ করল। আর সবাইকে অবাক করে দিয়ে, আমি সেই আলোর দিকে হাত বাড়িয়ে কাঁদা বন্ধ করে খিলখিল করে হেসে উঠলাম। ব্যস, আমার নামটাও তখন থেকে স্থায়ী হয়ে গেল। সূর্যপ্রিয়া।
সেই আমি সূর্যের আলো দেখি না কতদিন হয়ে গেলো! আজকের কথা, ঠিক এই মুহূর্তের কথা হিসেবে ধরলে; ৪৪ বছর ৭ মাস ১১ দিন ১৩ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট।
শুধু তাই না, কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে সূর্যের কথা, উত্তর দিতে গিয়ে থমকে যাই আমি। আসলেই কি আমার মনে আছে সূর্যের আলো গায়ে মাখার অনুভূতি কেমন ছিল? কেমন কমলা-হলুদ উজ্জ্বল গোল বলের মতন দেখতে ছিল সূর্য? গ্রীষ্মকালের প্রচণ্ড গরমে ঘামতে ঘামতে সূর্যের নামে অভিসম্পাত দেয়ার কথা, শীতকালের সকালে মিষ্টি রোদের অপেক্ষা করা, সূর্যোদয়ের নব-কিরণের আলস্য কিংবা সূর্যাস্তের ক্লান্তি মুছে দেয়া আভা- এসব কি আসলেই মনে আছে নাকি মুছে গেছে সেইসব স্মৃতি আর এখন নিজের মনে মনেই বানিয়ে গল্প বলে যাই আমি? কেমন যেন গল্পের পাতা থেকে উঠে আসা বর্ণনা বলে মনে হয় কিংবা রাতের গভীরে ধেয়ে আসা স্বপ্নের মরীচিকা যেন - সূর্য। না, সূর্য হারিয়ে যায় নি, ধ্বংসও হয় নি। এখনও প্রতিদিন জেগে ওঠে পৃথিবীর বুকে আলো ছড়িয়ে দিতে, অস্তও যায়। কিন্তু, তা দেখার সৌভাগ্য আমার আর কোনোদিন হবে না। হয়তো ভবিষ্যতের কোনও এক প্রজন্ম আবার সূর্যের, সূর্যালোকের দেখা পাবে। তখন হয়তো বুঝবে এই বৃদ্ধ আমার বলা গল্পগুলোর মধ্যে কোনও অতিশায্য ছিল না।
প্রথম যখন আমরা, পৃথিবী-পৃষ্ঠ ছেড়ে ভূ-অভ্যন্তরে নেমে আসি থাকার জন্য, সবাই ভেবেছিল অল্প কয়েকদিনের ব্যাপার হবে সেটা। নিজেদের জীবন বাঁচানোর জন্য নেয়া একটা সাময়িক উদ্যোগ। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে দাবানলের মতন ছড়িয়ে পড়া জীবাণুর আক্রমণে তখন পুরো পৃথিবীই দিশেহারা হয়ে পড়েছে। আমাদের ছোট বাংলাদেশেও তার থাবা বসাতে ছাড়েনি সেই জীবাণু। অনেকে অবশ্য জীবাণু না বলে, জীবাণু-অস্ত্রর কথা বলছিল। চীন, ইরান, রাশিয়া কিংবা উত্তর কোরিয়া- কোনও এক দেশের গোপন ল্যাবরেটরিতে প্রস্তুত করা জীবাণু-অস্ত্র। কট্টরপন্থী ইসলামিক জঙ্গিদের নাম কিংবা ইহুদী-রাষ্ট্র ইসরাইলের নামও উঠে এসেছিল সন্দেহের তালিকায়। কিন্তু, সব দেশেই জীবাণুটা তার ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছিল। জাতি-ধর্ম-গোত্র-দেশ নির্বিশেষে মানবজাতি তখন তাদের লাখো বছরের ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতন বিশ্বজুড়ে সৃষ্টি হওয়া দুর্যোগের সামনে অসহায় বোধ করছিল।
আমার বয়স তখন মাত্র ষোলো বছর। নিউ টেনে পড়ি আমি, সামনেই এসএসসি পরীক্ষা। অবশ্য পড়ালেখায় কখনোই অতটা মনোযোগী ছিলাম না আমি, যতটা মনোযোগ দিতাম ছবি আঁকার পেছনে। একদিন সকাল বেলা জানতে পারলাম, আব্বু ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে একটা ছোট্ট ঘর কিনেছে আমাদের জন্য। নিশ্চয়ই আম্মুর সাথে কথা বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তবে আমাকে জানানোর কোনও প্রয়োজন বোধ করেনি। অবশ্য আমাদের দেশের আব্বু-আম্মুরা আর কবে ছেলে-মেয়েদের সাথে কথা বলে কোনও সিদ্ধান্ত নিয়েছে; তা যতই তাদের জীবনের সবচাইতে বড়ো সিদ্ধান্তই হোক না কেন! বাইরের অবস্থা তখন ভীষণ খারাপ। আব্বু বাসায় বসে অফিস করছে বছর খানেক হতে চলল। আম্মুও বাইরে বের হওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। সরকারের নিজস্ব উদ্যোগে কেন্দ্রীয় সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। অনলাইনের মাধ্যমে অর্ডার দেয়া হলে বাসায় এসে এক মাসের জন্য প্রয়োজনীয় সকল খাদ্যদ্রব্য ও নিত্য ব্যবহার্য্য জিনিস দিয়ে যায় ডেলিভারি ম্যান। সেই ডেলিভারি ম্যানকেও অবশ্য আমাদের এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের গেটের ভেতর ঢুকতে দেয়া হতো না। কমপ্লেক্সের বাইরে সকল ভাড়াটিয়ারা মিলিত খরচে একটা জীবাণু-শনাক্তকারী যন্ত্র কিনেছে। আমাদের দিয়ে যাওয়া সকল জিনিসকে সেই যন্ত্রে রাখা হয় ঘণ্টাখানেক। পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা শেষে যখন নিরাপদ বলে নিশ্চিত হয়, তখনই কেবলমাত্র সেই জিনিসগুলো আমাদের ঘরে প্রবেশের অনুমতি পায়।
---
আমার স্কুলে যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বান্ধবীরা মিলে অনলাইনে আলোচনা করি যে এরকম অবস্থা চলতে থাকলে হয়তো পরীক্ষা দেয়া ছাড়াই আমাদের এসএসসি পাশের সার্টিফিকেট দিয়ে দেয়া হবে, সেটা নিয়ে আমরা সকলেই ভীষণ উত্তেজিত। অবশ্য তারপর, কলেজে ভর্তি হওয়ার ঝামেলাটা কিভাবে সামাল দেয়া হবে সে ব্যাপারে কারো কোনও ধারণাই নেই। দুই বছর হতে চলল সারা দেশ জুড়ে জরুরী অবস্থা জারি করা হয়েছে। একসময় রাত্রিকালীন কারফিউ চললেও এখন চব্বিশ ঘণ্টার জন্যই কারফিউ বলবত রাখা হয়েছে। শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পুরোপুরি ছেড়ে দেয়া হয়েছে সেনাবাহিনীর হাতে। প্রথমে ঢাকা কেন্দ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও, ধীরে ধীরে অন্যান্য বিভাগীয় শহরে, তারপর জেলায় জেলায় এমনকি গ্রামেও নেয়া হয়েছে একই উদ্যোগ। সারা দেশই একরকম সেনা-নিয়ন্ত্রণাধীন এই মুহূর্তে। শুধু সেনাবাহিনীই নয়, র্যাব-পুলিশ-আনসার-বিজিবি সবাই এখন এই জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যস্ত। সারাক্ষণ রাস্তায় টহল দেয় জলপাই রঙের কিংবা খয়েরী আর নীল রঙের গাড়িগুলো। আব্বু আমাকে রাতে ঘুমানোর আগে এসে কপালে চুমু খাওয়ার সময় বলে যেত যাতে আমি ভয় না পাই, বাইরের ঐ সৈন্যরা আমাদেরকে নিরাপদ রাখবে জীবাণুর থেকে, খুব দ্রুতই আবার সব ঠিক হয়ে যাবে, আবারো বাইরে বের হতে পারবো আমরা, স্কুলে যাবো, পার্কে যাবো, কক্সবাজারে ঘুরতে যাবো, কুয়াকাটার বালুকাবেলায় দাঁড়িয়ে আবারও সূর্যাস্ত দেখবো। তখনো জানতাম না আমি, সব কথাই মিথ্যে বলে প্রমাণিত হবে পরে। আর কখনো বাইরে বের হয়ে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে সকালের বিশুদ্ধ বাতাস বুক ভরে টেনে নিতে নিতে সূর্যোদয় দেখা হবে না আমার। আমাদের যেই জীবন খুব গড়পড়তা, সাধারণ ছিল, যেই জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা আমরা বিরক্ত হয়ে পড়ছিলাম - একসময় সেই জীবনের কথা ভেবে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদবো।
যতটুকু বেঁচে থাকার মতন, ততটুকু বেঁচে থাকা হয়ে গেছে আমার - কিশোরী আমার মনে সেই সত্যটা ঢুকেনি। আমাদের জীবন আরও তিন বছর আগে, প্রথম যেদিন লন্ডন শহরে এক অদ্ভুত জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার খবর টিভিতে শুনেছিলাম, সেদিনই একরকম শেষ হয়ে গিয়েছিল। পৃথিবী পালটে গিয়েছে, পালটে যেতে বাধ্য হবো আমরাও - জানতাম না তখনও।
এখন যখন পিছন ফিরে তাকাই, নিজের জীবনের প্রথম চৌদ্দ বছরের কথা ভাবি, এক অন্যরকম ভালোলাগায় ভরে যায় আমার মন। আমি খুব সৌভাগ্যবান যে আমার আব্বু-আম্মু দুজনই খুব ভ্রমণপিপাসু ছিলেন। ঐ চৌদ্দ বছরের মধ্যেই দেশের পাশাপাশি বিদেশও ঘুরে ফেলা হয়েছে আমার। কুয়াকাটার কথা মনে পড়ে আমার, হালকা কুয়াশায়, ভেজা ভেজা অন্ধকারে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকা। একটু একটু করে আলো বাড়তে থাকে আর তারপর একসময় লাফ দিয়ে পানির ভেতর থেকে মাথা উঁচু করে হেসে উঠে সূর্যটা। বাতাসে সমদ্রের গন্ধ, দূরে থাকা গাছগুলোর ঘ্রাণ, লবণাক্ত স্বাদ মিলে-মিশে এক অদ্ভুত মাদকতা ভর করতো। মনে পড়ে সূর্যাস্তের কথা, লাবণী পয়েন্টে - হাজারো মানুষের ভিড়ে সূর্য আর আমি কেমন একলা হয়ে যেতাম। একদৃষ্টিতে তাকিয়েই থাকা, তাকিয়েই থাকা। এক মুহূর্তের জন্যও চোখ সরাতাম না যদি ফিরে দেখি ফাঁকি দিয়ে ডুবে গেছে সূর্য। মনে পড়ে সাজেকে ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়ানো মেঘগুলোর কথা, রাঙ্গামাটির ঝুলন্ত ব্রিজের কথা। মনে পড়ে সিলেটের রাতারগুলে ছোট্ট দোলন্ত নৌকায় বসে পানিতে ভেসে ভেসে সবুজের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া। কিংবা সুন্দরবনে দিনের বেলাও সূর্যের আলোর সাথে যখন বনের রঙ মিলেমিশে সবুজাভ-কমলা হয়ে যায় আর রাতের বেলা অনেক অনেক দূর থেকে বিলুপ্তপ্রায় মামা-র ডাক ভেসে আসে। মনে পড়ে সিমলার হাড় কাঁপানো শীতের আমেজের কথা, কলকাতায় গিয়ে পুরনো দিনের বইয়ের বর্ণনার মাঝে নিজেকে খুঁজে পাওয়া, নেপালের কাঠমণ্ডুতে বৌদ্ধ মন্দিরে কিংবা ভুটানের নিটোল প্রকৃতির মাঝে নিজেকে হারিয়ে খোঁজা।
স্মৃতিগুলো অবশ্য ইদানীং আমার সাথে লুকোচুরি খেলছে; মনে থাকে, আবার ভুলে যাই। রংগুলো সব ময়লা, পুরনো হয়ে গিয়েছে। উজ্জ্বলতা হারিয়ে এখন ধূসর-প্রায়। সময় একটু একটু করে আমার মস্তিষ্কের গোপন কুঠুরি থেকে এক এক করে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে আমার স্মৃতিগুলোকে। অবশ্য, আমিও কম চালাক নই। সেরকম সময়ে আমি আমার পুরনো ছবির খাতাটা খুলে বসি। যেই খাতাটা আমার ভ্রমণসঙ্গী ছিল। যেখানে আমি আমার তখনও অপটু হাতে আটকে রাখার চেষ্টা করছিলাম স্মৃতিগুলোকে। ঘুরে বেড়ানোর দিনগুলো হারিয়ে গিয়ে একসময় শুধুমাত্র স্কুলে যাওয়া-আসার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেলো। তারও পরে নিজের বাসার মধ্যেই আটকে গেলাম আমি। আব্বু, আম্মু আর আমি - তিনজন, জেলখানায় বন্দী যেন। আর শুধু ইন্টারনেটের মাধ্যমে বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে যতটুকু যোগাযোগ হতো, ততটুকুই। শেষ একবার বাইরে বের হয়েছিলাম, হাসপাতালে যাওয়ার জন্য। টানা এক সপ্তাহ অসুস্থ থাকায় আমাকে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছিল আব্বু-আম্মু। সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে বিশেষভাবে প্রস্তুত করা গাড়িতে করে বাইরে বের করা হয়েছিল আমাদের। সেই বুঝি শেষ সূর্য দেখা ছিল আমার, শেষ বাইরে বের হওয়া।
---
ষোলো বছর বয়সে আমার কাছ থেকে সূর্য দেখার অধিকারটুকুও কেড়ে নেয়া হলো। কিছুই বলার ছিলো না আমার, বলার মতন কিছু বাকিও ছিল না। আব্বু-আম্মুর অসহায়ত্বটুকু আমি বুঝতে পারছিলাম কিন্তু নিজের মনটাকে কিছুতেই বুঝাতে পারছিলাম না। ইঁদুরের মতন মাটির নীচে গর্ত করে বাস করতে হবে আমাদের - কেবল এই কথাটাই ঘুরেফিরে মনে হতো। আব্বু-আম্মুকে তাও কয়েকবার বলেছিলাম আমি, আরও কিছুদিন অপেক্ষা করা যায় চাইলে। এখনও এতটা খারাপ হয়ে যায়নি পরিস্থিতি যে মাটির নীচের অন্ধকার গর্তে গিয়ে লুকিয়ে থাকতে হবে আমাদের। আমি জানতাম, আব্বু-আম্মু নিজেদের চাইতেও বেশি ভয় পাচ্ছে আমাকে নিয়ে, তাই নিজের মধ্যে কেমন একটা অপরাধবোধও কাজ করছিল। এত অনুরোধ-আদেশ-নিষেধ, এত সতর্কতার পরও জীবাণুটা ছড়িয়ে পড়ছিল সর্বত্র। প্রতিদিনই খবর পাওয়া যেত- হাজারে হাজারে মানুষ আক্রান্ত হওয়ার কথা, মৃত্যুর কথা, ভেঙ্গে পড়া-ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা এক পৃথিবীর কথা, বাঁচার শেষ চেষ্টা করতে থাকা পৃথিবীর কথা। প্রতিদিনের খবরে বলা হচ্ছিল, অসুস্থ ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। কিন্তু, যে রোগের শেষ পরিণতি মৃত্যু সেখানে কি সেবার কথা বলা হচ্ছিল তা নিয়ে সবাই সন্দিহান ছিল। সবাইকে শান্ত থাকতে বলা হচ্ছিল, কেউ অসুস্থ হলে সেই পরিবারের বাকি সবাইকে নিরপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হবে, সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের আওতায় রাখা হবে - কিন্তু সবাই ততদিনে জেনে গিয়েছে; পরিবারের একজন অসুস্থ হলে বাকিদের পর্যবেক্ষণে রাখার কথা বলে যে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় সেখান থেকে আর কখনোই ফিরে আসে না তারা। রাতের বেলা নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে ঘর্ঘর শব্দ তুলে সেনাবাহিনীর বিশেষায়িত ট্রাক এসে থামে আশেপাশের কোনো বাসার সামনে, আর্তনাদ-অভিসম্পাতে ভারী হয়ে ওঠে আকাশ বাতাস, কখনো গালিগালাজ-লাঠিচার্জ এমনকি গুলির শব্দ শোনা যায়। ট্রাক চলে যায়, বালিশের নীচে মাথা ঢুকিয়ে কাঁপতে থাকা আমি তখনও ঘুমানোর চেষ্টা করতাম।
একদিন রাতের বেলা স্থানান্তর মন্ত্রণালয় থেকে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ালো আমাদের বাসার সামনে। আমরা তিনজন ততক্ষণে সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে বসে আছি। ওই একই মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের কাছে আগেই নির্দিষ্ট পোশাক, হেলমেট, জুতো আর গ্লাভস পৌঁছে দিয়ে যাওয়া হয়েছে। অনলাইনে তখন ভীষণ তর্ক-বিতর্ক চলছে যে এই পোশাক আদৌ কোনো কাজে আসে কিনা, তা নিয়ে। কিন্তু আমরাও নিরুপায় ছিলাম, মনে অবিশ্বাস নিয়েও তাই সে কাপড় পড়েই আমরা তৈরি হয়ে ছিলাম। একটু আগেই সূর্য অস্তাচলে গেছে। বারান্দার নিরাপদ প্রলেপ দিয়ে বন্ধ করা ঘোলাটে কাঁচের দরজার এপাশ থেকে আমি শেষবারের মতন সূর্য দেখে ফেলেছি। গাড়ি এসে থেমে ভারি মাইকে করে আমাদের নাম নেয়া মাত্র আমরা নীচে নেমে গেলাম। মাত্র পাঁচটা ব্যাগে নিজেদের প্রয়োজনীয় সকল জিনিস নেয়ার কথা স্পষ্টভাবে বলে দেয়া ছিল। আমরা বের হয়ে গেলে, বাসা সরকারের মন্ত্রণালয়ের লোকেরা বন্ধ করে দিয়ে যাবে, যদি কখনো আবার ফিরে আসি সেই আশায়। আশাই তখন আমাদের একমাত্র সম্বল ছিল, আর পাঁচটা ব্যাগ। গাড়িতে উঠে বসলাম আমরা, একটা ট্যাঙ্কের চাইতে কম ছিলো না গাড়িটা। আমাদের সেটা পৌঁছে দিল ধামরাইয়ের কাছাকাছি তৈরী করা ভূগর্ভস্থ আবাসস্থলের প্রবেশমুখে। বিশাল একটা বিল্ডিং যার ভেতরে প্রবেশের আগে তিনবার জীবাণুমুক্ত করা হলো গাড়িটাকে। আমরা নেমে আসার পর আমাদের ব্যাগগুলো নিয়ে প্রতিটা জিনিস বের করে একাধিকবার জীবাণুমুক্ত করা হলো। একটা প্রকাণ্ড লিফট দিয়ে নীচে নামলাম আমরা। তারপর একের পর এক দরজা পার হতে থাকা, প্রতিবার জীবাণুমুক্ত হওয়া, একাধিকবার পুরাতন কাপড় ফেলে নতুন কাপড় পড়ে নেয়া। একসময় বিরক্ত হয়ে গেলাম, তখন গিয়ে জানা গেলো শেষ দরজাটা পার হয়ে এসেছি আমরা। তারপর আব্বু-আম্মু, এমনকি আমাকেও বেশ কিছু কাগজে স্বাক্ষর করতে হলো। আমাদের ছবি তুলে নতুনভাবে প্রস্তুতকৃত পরিচয়পত্র দেয়া হলো আমাদের। এই বিশাল আবাসস্থলকে অনেকগুলো ছোট ছোট ইউনিয়নে ভাগ করা হয়েছে, তার মধ্যে গ্রাম আর গ্রামের মধ্যে পাড়ায়। প্রতি পাড়ায় মাত্র দশটা করে বাসা। পরিচয়পত্রে লেখা ছিল আমরা ১৭৩ঘ পাড়ার ০৬ নম্বর বাসার বাসিন্দা।
বাসায় ঢুকে চুপ হয়ে গেলাম আমরা তিনজনই। একটা মাত্র বেডরুম, রান্নাঘরের সাথে আরেকটা রুম, একটা মাত্র বাথরুম। কোনোরকম জানালার উপস্থিতি ছিলো না, একটা চারকোনা বাক্সে ঢুকিয়ে যেন আমাদের আটকে দেয়া হলো আমাদের। যেই দরজা দিয়ে আমরা ঢুকেছি সেই দরজা সাথে সাথে বন্ধ হয়ে একটা সেন্সরের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। অনুমতি ছাড়া এই দরজা খোলার শাস্তি হলো ভূগর্ভস্থ আবাসস্থল থেকে বহিষ্কার।
আব্বু আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, "প্রিয়ামণি, আমি জানি বাসাটা খুব ছোট হয়ে গিয়েছে, তোর মনটাও হয়তো খারাপ হয়েছে খুব। কিন্তু মন খারাপ করিস না সোনা, সময়ের সাথে আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাবো। আল্লাহ চাইলে ততটা সময় এখানে থাকাও লাগবে না আমাদের, তার আগেই দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে বাইরে। আমরা আবার আমাদের বাসায় ফিরে যাবো।"
এখন যখন লিখছি এই কথাগুলো খাতার বেঁচে থাকা কয়েকটা পাতায়, আমার তো মনে হচ্ছে আব্বু যখন আমাকে এই কথাগুলো বলছিলেন তখন তিনি জানতেন আর কখনোই সেই বাসায় ফিরে যাওয়া হবে না আমাদের। এই ইঁদুরের গর্তেই আমৃত্যু বাস করতে হবে। আব্বু জানতেন, কিন্তু আদর্শ বাবার মত কাজ করেছিলেন তিনি। আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে চাননি নিষ্ঠুর বাস্তবতার সাথে।
বাসার ভেতর বাইরে থেকে বিশেষভাবে পরিশুদ্ধ করা বাতাস প্রবেশ করানো হতো, এবং নির্দিষ্ট পরিমানে- ঠিক তিনজনের জন্য যতটুকু প্রয়োজন সেটার একটা সীমারেখা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিলো। পানি ছাড়া হতো দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য, তাও বিশুদ্ধ করা। যতটুকু পানি বের হতো সেটা দিয়ে খাওয়া ব্যতীত, বাথরুম আর গোসলের জন্য অল্প অল্প করে পানি জমিয়ে রাখতাম আমরা যাতে সপ্তাহে একবার হলেও গোসল করা যায়। প্রতিদিন সকালবেলা বাসার বাইরে, দেয়ালের সাথে লাগানো একটা ছোট বাক্সে দুইবেলার জন্য খাবার দিয়ে যাওয়া হতো। জীবাণুমুক্ত এবং শীতলীকরণ প্রক্রিয়ায় জমানো। সেই হিমায়িত খাবার তিনঘন্টা ধরে সেই বাক্সে থেকে আরও একবার জীবাণুমুক্ত হওয়া শেষে ভেতরের দিকের দরজা খুলে যেতো, আমরা সেই খাবার নিতাম। প্রথম কয়েকদিন মাত্র দুইবেলা খাবারে একটু কষ্ট হলেও, ধীরে ধীরে আব্বুর কথামতন আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠছিলাম। যদিও খাবারের স্বাদ এতটাই খারাপ ছিল যে চিবিয়ে খাওয়ার বদলে একচুমুক পানি দিয়ে একটু একটু করে গিলে খেতে হতো আমার। প্রচণ্ড মানসিক অবসাদে ভুগছিলাম আমি, নিজের বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয়তা নিয়েই সন্দেহ জন্মে যাচ্ছিল। এভাবে বেঁচে থাকতে হলে বেঁচে থাকার আদৌ দরকার আছে কি না - শুয়ে শুয়ে তাই ভাবতাম। অবশ্য দেখা গেলো, এরকম হতে পারে সে সন্দেহ আগেই করে রেখেছিল স্থানান্তর মন্ত্রণালয়। আমাদের খাবারের সাথে একসময় শান্তক্রিয়া ওষুধের সরবরাহ আসতে থাকলো সপ্তাহে একবার। তা খেয়ে মাথাটা কেমন হালকা বোধ হতো সপ্তাহজুড়েই। মনে হতো, তাও তো ভালো আছি, বেঁচে আছি - অন্তত এখন পর্যন্ত।
---
প্রথম দুই বছর বাইরে থেকে খবর আসতো। প্রতিটা বাসায় একটা করে ছোট যোগাযোগ কেন্দ্র ছিল যেখানে দিনের মধ্যে একবার, সকাল সকাল আমাদের খবর শুনাতে হাজির হয়ে যেত সুন্দরী কোন মেয়ে, বুঝাতে চাইতো সবই ঠিক আছে। কিন্তু তার বলা কথায় বুঝা যেত পৃথিবী একটা অসম যুদ্ধে ধীরে ধীরে হেরে যাচ্ছে। একে একে আশার সকল বাতিই নিভে যাচ্ছিল। পৃথিবীর সকল দেশেই পাতালে থাকার জন্য বিশাল আবাসস্থল তৈরি করা হচ্ছিল। একে একে তখন পর্যন্ত সুস্থ মানুষদের সরিয়ে নেয়া হচ্ছিল সেখানে। মহাকাশে যাওয়ার কথা ভাবলেও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা আর তুলনামূলক স্বল্প স্থানান্তর-ক্ষমতার কারণে সেই প্রচেষ্টা বাদ দেয়া হয়। এমনকি সমুদ্র ও নদীর নীচেও শহর বানানোর প্রচেষ্টা করছিল অনেক দেশ। তারপর একদিন সকালে কোনরকম পূর্ব-ঘোষণা ছাড়াই বাইরে থেকে সংবাদ আসা বন্ধ হয়ে গেলো। সেই প্রথম আম্মুকে ভেঙ্গে পড়তে দেখলাম আমি। সারাদিন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে আমার চোখের আড়ালে কাঁদার চেষ্টা করলো আম্মু। কিন্তু, এই ছোট্ট বাক্সে সেটা অসম্ভব ছিল।
এরকম চলল বেশ কিছুদিন, তারপর একদিন আম্মু হঠাৎ ক্ষেপে উঠলো। বাইরের যেকোনো একটা সংবাদ কেন্দ্র থেকে আসা খবর হলেই চলবে, বাংলা না হয়ে ইংরেজি, হিন্দি, চাইনিজ কিংবা রাশিয়ান খবর হলেও অসুবিধা নেই; এই ভেবে যোগাযোগ কেন্দ্রের পর্দায় এলোপাথাড়ি নির্দেশনা দিতে থাকলো আম্মু। সেই প্রথম আমরা জানতে পারলাম এই যোগাযোগ কেন্দ্র দিয়ে একটা নির্দিষ্ট পাড়ায় থাকা সকল ঘরের মধ্যে অভ্যন্তরীনভাবে যোগাযোগ করা সম্ভব। আসলে, এখানে আসার পর ঘরের মধ্যে 'প্রতিদিনকার নির্দেশনা' ও 'প্রয়োজনীয় ব্যবহারবিধি' লেখা দুটো মস্ত বড় বই পেয়েছিলাম আমরা। কিন্তু, দুই বছর অলস সময় কাটালেও তা উলটে দেখার মতন ভুল আমরা কেউই করিনি।
শেষ যখন এই বাসায় ঢুকেছিলাম দুই বছর আগে তখন চারিদিক তাকিয়ে আমরা দেখেছিলাম যে পাড়ায় আমরা থাকতে যাচ্ছি তা যেনও একই বাড়ির দশটা হুবহু প্রতিলিপি দিয়ে বানানো। প্রতিটা পাড়াকে যে পৃথকীকৃত বায়ুস্তর দিয়ে আবৃত করে রাখা হয়েছে সেটা তখনই আমরা প্রথম জানতে পারি। আমাদের বাসায় প্রবেশ করিয়ে জানিয়ে দেয়া হয়েছিলো যে বাসা থেকে বের হওয়া যাবে না, উপযুক্ত কারণ দর্শানো ব্যতীত। আর কারণটা যথোপযুক্ত কিনা তা প্রতি ইউনিয়নের একজন নিয়ন্ত্রক সদস্য আছেন, তিনিই নির্ধারণ করবেন। আমরা বাসা থেকে অনুমতি ছাড়া বের হলে ধরে নেয়া হবে এই ভূ-গর্ভস্থ আবাসস্থলের জন্য আমরা হুমকি-স্বরূপ, কাজেই আমাদের সরিয়ে ফেলাটাই হবে তাদের প্রথম ও প্রধান সিদ্ধান্ত। এছাড়াও আমাদের সতর্ক করে জানিয়ে দেয়া হয়েছিলো, বাসার বাইরের করিডর ও উন্মুক্ত স্থানে যেই বাতাস প্রবেশ করানো হয়েছে তার সরবরাহ পৃথক লাইন থেকে আসে। কাজেই এমনটাও হতে পারে, বাসায় সম্পূর্ণ পরিশুদ্ধ বাতাস আসলেও, বাইরের বাতাসে কোনভাবে জীবাণু সংক্রমিত হয়ে গিয়েছে। সেক্ষেত্রে আমরা বাসা থেকে বের হওয়া মাত্র জীবাণু-আক্রান্ত হয়ে যাবো এবং তার কোনরূপ দায়দায়িত্ব নেবে না স্থানান্তর মন্ত্রণালয়।
যোগাযোগ কেন্দ্রের পর্দাটা হঠাৎ সবুজ হয়ে উঠলো, একটা অজানা স্বর ভেসে আসলো সেখান থেকে, "হ্যালো, কে বলছেন?" কমবয়সী একটা ছেলের গলা।
আম্মু যখন বুঝতে পারলো কোনভাবেই বাইরের কোন সংবাদ সংস্থার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেনি, বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করতে করতে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো। আমি ততোধিক আগ্রহের সাথে আম্মুর জায়গা নিলাম। যোগাযোগ কেন্দ্রের পর্দায় আঙ্গুলের ছোঁয়ায় নতুন নতুন অপশন দেখা দিলো, সেখান থেকে খুঁজতে খুঁজতে একসময় ভিডিকন সংযোগটা খুঁজে পেলাম আমি। কোনোদিনই এসব প্রযুক্তির বিশেষজ্ঞ ছিলাম না, আর গত দুই বছর ধরে নিজের আঁকার খাতার পাতায় পাতায় একের পর এক ছবি এঁকে চলেছি আমি। বাইরের পৃথিবীতে কাটানো প্রতি মুহূর্তের স্মৃতিগুলোকে রঙের ছোঁয়ায়, খাতায় জীবন্ত করে আটকে রাখছিলাম। এছাড়া খাওয়া, ঘুমানো, একই বই আটাশি-তম বারের মতন পড়া, আর দিগ্বিদিক ভাবা - এই ছিল কাজ আমার, যোগাযোগ পর্দা নিয়ে কোনই আগ্রহ ছিলো না আমার। নতুন এই সময় কাটানোর সুযোগ দেখে আমার খুশির সীমা ছিল না। কিছুক্ষণ ঝিরঝির করে আমাকে সন্দেহের মধ্যে রেখে একসময় পর্দায় একটা ছেলের মুখ ভেসে উঠলো।
আমাকে দেখে ছেলেটা অবাক হয়েছে তার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছিল। আমি আসলে খুশীর কারণে কথাই বলতে পারছিলাম না। ছেলেটাই বলে উঠলো, "তুমিও কি এই পাড়াতেই থাকো?"
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম, "হ্যাঁ, ০৬ নম্বর বাসায়।"
"আমি ভাস্কর, থাকি ০১ নাম্বার বাসায়।" ছেলেটা হাসিমুখে বলল, যেনও আমি আমার করা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে যদিও আমি কোনও প্রশ্নই করিনি।
"ভাস্কর। বাহ, সুন্দর নাম। আমি সূর্যপ্রিয়া।" কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ করেই প্রশ্ন করলাম আমি, "তুমি কি আগেও যোগাযোগ কেন্দ্র এভাবে ব্যবহার করেছ..."
"না, আসলে আমি এখানেই বসেছিলাম আর হঠাৎ করে যোগাযোগ কেন্দ্রটা সবুজ হয়ে ওঠাতে আমি পর্দাটা ধরেছিলাম। সেখান থেকেই... আগে জানলে এতদিনে সবার সাথেই কথা বলে ফেলতাম। কি যে অসহ্য গিয়েছে দুটো বছর," ছেলেটার এক নাগারে কথা বলা দেখে হাসি আসলো আমার। আমিও তো ভেতরে কত কথা জমিয়ে রেখেছি এতদিন। যাক, শুধু আমরাই ঐ দুটো ঢাউস বই না পড়ে ফেলে রেখেছি, ব্যাপারটা সেরকম না তাহলে।
ছেলেটার চুলগুলো কেমন রুক্ষ হয়ে গিয়েছে, আমাকেও মনে হয় একই রকম দেখাচ্ছে। তেলের বালাই তো নেই, শ্যাম্পুও করা যায় না কারণ সেক্ষেত্রে পানি বেশি খরচ হয়ে যায়। কাজেই পানি দিয়েই কাজ চালাতে হয় চুলের পরিচর্যায়। মুখটা শুকিয়ে গিয়েছে, কিন্তু চোখদুটো অদ্ভুত রকমের উজ্জ্বল ছেলেটার। গায়ের রঙ ফর্সা আর মুখটা এতটাই কোমল যেরকমটা হলে ছেলেদের হাফ-লেডিস বলে খ্যাপানো হয়। আমি জানি আমার গায়ের রঙ শ্যামলা মতন, আম্মুর মতই দেখতে হয়েছি আমি, তবে চার বছর ঘরে বন্দী থাকতে থাকতে তার উপর কেমন একটা ফ্যাকাসে রকম ছাপ পড়েছে। আব্বু দুষ্টামি করে বলে আমি নাকি একটু একটু করে ফর্সা হয়ে যাচ্ছি। আমার চোখের মণি যে ছেলেটার মতন এতটা উজ্জ্বল না তাও আমি জানি। ছেলেটাকে দেখে কেন যেন মনে হল এই ছেলেটাও আমার মতন ঘরের ভেতর থেকেই অভ্যস্ত। আমি যেমন, বাইরে ঘুরতে যাওয়া ছাড়া বাকিটা সময় ঘরে বসে রং-পেন্সিল, প্যাস্টেল বা জলরং আর ক্যানভাস নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম। তখন তো আর জানতাম না, বাইরে বের হওয়ার সুযোগটা এভাবে কেড়ে নেয়া হবে আমার হাতের মুঠো থেকে। আব্বু চাইতো আমি তার মত ডাক্তার হই, আর আমার ইচ্ছা ছিল চারুকলায় ভর্তি হওয়ার। এখন অবশ্য সেসব ভাবাটা বোকামি ছাড়া আর কিছু না। ভবিষ্যৎ বলে আর কিছু অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয়না আমার।
অন্তত, আমার ভবিষ্যৎ যে একটা চারকোনা বক্সের মধ্যে শেষ নিঃশ্বাস ফেলার মাধ্যমেই অন্তিম পরিণতি পাবে তা বুঝে গিয়েছিলাম আমি।
"তাহলে দুই বছর ধরে এখানে আছো তুমি?" ছেলেটা বলার পরও একই প্রশ্ন করলাম আমি।
"হ্যাঁ, এই পাড়ার সবাই তাই। একেক দিন, একেক সময় আমাদের ঘরে ঢুকানো হয়েছে দেখে কারোর সাথে কারোর দেখা হয়নি আর কি। মাত্র জেএসসি দিয়ে শেষ করেছি, তখনই সব ওলট-পালট হয়ে গেলো," আবারও একটানা কথা বলে গেলো ছেলেটা।
আচ্ছা, তাহলে ছেলেটাকে শুধু শুধু ছোট লাগছে না। ছেলেটা আসলেও ছোট আমার চাইতে, প্রায় দেড়-দুই বছরের। অবশ্য সেটা খুব একটা ব্যাপার না। দুই বছর পর আব্বু-আম্মু ছাড়া প্রথম অন্য কারোর সাথে কথা বলছি আমি, আর সেটাই আসল ব্যাপার। নিশ্চয়ই ছেলেটাও দুই বছর ধরে একাই আছে ঐ ঘরটাতে, আমার মতই নিঃসঙ্গ সময় কাটিয়েছে। আমার মত নিশ্চয়ই কারো সাথে কথা বলার জন্য মুখিয়ে আছে সেও। কথা বলার ইচ্ছে আমারও ছিল কিন্তু তার আগেই মা এসে ডাক দিল, "প্রিয়া, এদিকে আসো। তোমার বাবা ডাকছে।"
আমি ফিরে উত্তর দিলাম, "আসছি আম্মু।"
ভাস্করের প্রশ্ন শুনতে পেলাম একই সময়ে, "পরে আবার যোগাযোগ করবে তো তুমি?"
"হ্যাঁ," পর্দার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলাম আমি। "তাড়াতাড়িই যোগাযোগ করবো। টা টা।" হাত নেড়ে পর্দাটা হাতের তালুর স্পর্শে বন্ধ করে দিলাম আমি।
দেখা গেলো, অবশেষে আব্বু আমাকে বাস্তব পরিস্থিতিটা বুঝিয়ে দেয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছে। আমাকে অনেকক্ষণ সময় লাগিয়ে বলল যে আমরা হয়তো আর কখনোই পৃথিবীর উপরিভাগে ফিরে যেতে পারবো না। এই ভূগর্ভে, ঘোলাটে কৃত্রিম আলোতে, জন্তুদের মতন বেঁচে থাকতে হবে আমাদের। কারণ, বেঁচে থাকাটাই শেষ কথা। যেহেতু, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে উপরের পৃথিবীতে, সেক্ষেত্রে অন্যান্য পরিস্থিতি যে আরও খারাপ তা আন্দাজ করতে পেরেছে আব্বু। কাজেই আমাদের মানসিকভাবে আরও শক্ত হতে হবে, নিজেদের আরও মানিয়ে নিতে হবে এই অবস্থার সাথে। দুই বছর আগে এসব বললে হয়তো আমি চিৎকার, কান্নাকাটি করে ঘর মাথায় তুলতাম। কিন্তু দুই বছর অনেক লম্বা সময়। আর এই পরিস্থিতিতে, দুই বছর যথেষ্ট সময় ছিল আমাকে বড় করে তোলার জন্য। আর এভাবে বড় হয়ে ওঠা কেউ বাস্তবতার সামনে ভেঙ্গে পড়ে না। তারা শান্তভাবে ভাগ্যকে মেনে নেয়। আমিও মেনে নিলাম।
---
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই আগস্ট, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩৫