ইমোশনাল মানুষ হবার অনেকগুলো ডিসঅ্যাডভান্টেজ আছে । মাঝরাত্তিরে যখন ভোঁস ভোঁস করে নাক ডেকে ঘুমানো খুব দরকার, তখন উদ্ভট সব স্বপ্নেরা দল বেঁধে হানা দেয় । ভেড়া গুনবার চেষ্টা করলে সেগুলো সব স্বপ্নের খামারবাড়ীতে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করতে করতে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় । আমার কল্পনার ভেড়াগুলো পর্যন্ত আমার মত জেদী । শুধু তাই নয়, আমার স্বপ্নগুলোও এমন , যেগুলো স্রেফ মনে মনে ভাবার অপরাধেই জেলে পুরে রাখা যায় ।
ঢাকা শহরে থাকব না । লাল ইটের গুড়োয় ঢাকা রাস্তা আছে, এমন একটা মফস্বল শহর চাই । সেই রাস্তার দুপাশে থাকবে বড় বড় ছায়া-অলা গাছ । ছোট্ট সেই শহরটার খুব কাছেই বন-জঙ্গল জাতীয় এলাকা থাকতে হবে । মাঝে মাঝে হাইকিং-এ বেরোব তো !
ওই দ্যাখো ! ঢাকা শহর থেকে কিছু মানুষ কমিয়ে দিতে চাইছি , এতে জেলে পুরবার কি আছে ? এ তো ঢাকাবাসীর জন্য সুখের খবর । ঢাকাবাসীরা পারলে চাঁদা তুলে মানুষজন দূরে পাঠায় !
আগে পুরোটা শোনই না !
খামারবাড়ি মত একটা ছোট্ট দোতলা বাড়ি থাকবে । তার চারপাশে থাকবে কাঠের তক্তায় তৈরী বেড়া । ওই ইংরেজী ছবিতে যেমন দেখায় । তেমন আর কি ! তবে এত বড় বাড়ি কি আর খালি থাকলে মানায় ? ছেলে-মেয়ে থাকবে কমপক্ষে আধ-ডজন । এখন এইটা হলো জেলে পুরে রাখার মতন কথা । দেশের মানুষ খেতে পাচ্ছেনা। রাস্তায় বেড়ুলেই মানুষের গায়ে গায়ে ধাক্কা লাগে ঠুস ঠুস । মানুষের ভারে কোনদিন ছোট্ট ব-দ্বীপটা ডুবে যায় তার নাই ঠিক । এদিকে তোমার ছয়টা ছেলেমেয়ে চাই । জানো না , দুটির বেশী ভালো নয় , একটি হলে ভালো হয় ?
এই গরীব দেশে এমনটা চিন্তা করাও অপরাধ । তার পরে এতগুলো ছেলে-মেয়ে পেলে পুষে বড় করা ! আমাকেই কে পালে তার নাই ঠিক ! নিজেকে নিজে পালতে গিয়ে হয়রান হয়ে যাচ্ছি ।
শোনই না ! এ জন্যই তো এ শহরে থাকব না । এ শহরে জীবন মানে অদ্ভূত এক প্রতিযোগীতা । জন্মের আগেই মানুষ প্রতিযোগীতায় নামে । ভ্রূনটা বাঁচবে না মরবে তাও ঠিক হয় তার উপযোগীতা আর সময়ানুবর্তীতার ওপর । চাকরী-বাকরী করে এত বাচ্চা পালার সময় নাই । মেরে ফেলো । গরীব মানুষ, বাচ্চাকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াতে পারবোনা । মেরে ফেলো । বড় অসময়ে জন্ম নেবে । কিংবা এখনও সেটল হইনাই । মেরে ফেলো । সবকিছুর পরও সে বেচারা যদি বা দুনিয়ার আলো দেখলো , কথা বলা শেখবার আগেই ভর্তি হতে হবে কিন্ডারগার্টেনে । ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি না হলে , কি ডাক্তার ইন্জিনিয়ার না হলে বাপ-মায়ের প্রেস্টিজ পাংচার । লোকে ছি ছি করবে । কাজেই ৩টা কোচিং , ৪টা মাস্টার । গত ১৫ বছরে যে হতভাগ্য শিশুগুলি এমনি করে পড়ে বের হলো , এরা কি হাতী-ঘোড়া হয়েছে জানিনা । মানুষ যে হতে পারেনি সেটা পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ।
এটুকুই শেষ নয় , এর পরে আরো হ্যাঁপা আছে । একস্ট্রা কারিকুলার এ্যাকটিভিটিজ আছে না ? ক্ষুদে গানরাজ হও, কি মেরিডিয়ান চ্যাম্পিয়ন । লোকে তোমাকে দেখে হিংসায় বুক শুকিয়ে না মরলে বেঁচে থাকার কোন মানে নাই ।
বীভৎস এই জীবন আমি আমার ছেলে মেয়েদের দিতে চাইনা । এইভাবে দৌড়াতে দৌড়াতে ফুস করে কখন জীবনটা শেষ হয়ে যাবে ! এত্ত ছোট্ট একটা জীবন এভাবে খরচ করে ফেলার বিলাসিতা আমি করতে পারিনা ।
আমার হলো হেলেদুলে ধীরে সুস্থে জীবনটাকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করার মৎলব । মৌলিক প্রয়োজনগুলি পূরন করার মত টাকা থাকলেই হবে । বিলাসদ্রব্য চাইনা । গাড়ি-টাড়ি লাগবেনা । ছোট্ট শহরে থাকব । হেঁটে এপার ওপার করা যাবে । এনজিও কি ইশকুলে ছোট একটা চাকরী । কিংবা চাষ-বাস । স্ট্রবেরী ফলাবো । আর গোলাপ ফুল । ছেলেমেয়েরা সরকারি ইশকুলে পড়বে । যেমন রেজাল্টই করুক ব্যপার না । বিদ্যার জাহাজ আমার দরকার নাই । জীবনটাকে উপভোগ করতে শেখাবো । ধীরগতির একটা জীবনে আমি বাড়িতে কত সময় পাব । সেই সময়টায় নিজেই বাড়ীতে ওদের পড়াবো । আদর্শলিপি । বিখ্যাত মানুষদের জীবনী । আর ক্ল্যাসিক বইগুলো । যেগুলো পড়ে আমি বড় হয়েছি । ও আচ্ছা , বলা হয়নি , আমার বাড়িতে লাইব্রেরীটা হবে অনেক বড় । এছাড়া বাড়ীর সামনে খেলার জায়গা থাকবে ।
একস্ট্রা কারিকুলার এ্যাকটিভিটিজও থাকবে । শুক্রবার সকালে হারমোনিয়াম তবলা নিয়ে বসে যাব । সবাই যে যার মত গলা ফাটিয়ে চিল্লাবে । স্বরচিত লেখা পাঠ হবে ।
বাচ্চাদের আমার খামারে কাজও করতে হবে । এর বিনিময়ে ওদেরকে হাতখরচের টাকা দিব । এতে ওরা পরিশ্রমের মূল্য শিখবে । নিজের পরিশ্রমের আয়ের আনন্দ বুঝতে শিখবে । ফালতু খরচ বা বিলাসিতার বদঅভ্যাস হবেনা ।
আমার আম্মারা ছয় ভাই বোন । আব্বারও তাই । এখনকার শহরের ছেলেমেয়েরা তো একা একা বড় হয় । ফলে অসামাজিক হয় । বড় ভাই বোনের গাইডেন্স পায় না । ছোট ভাই বোনের দেখাশোনার দায়িত্ব নিতে হয়না । ফলে দায়িত্ববোধও জন্মায় না। শুধু নিজের স্বার্থটা বুঝে । এছাড়া শেয়ার করার মত কেউ না থাকায় অজায়গায় কুজায়গায় বন্ধু খুঁজে । একটা কিছু বিপদ আপদে পড়লে একেবারে একা হয়ে যায় ।
আমার ছয় ছেলেমেয়ে কখনো একাকীত্বে ভুগবেনা । একজনের বিপদ হলে পাঁচজন সাপোর্ট করবে । আমি বুড়ো হয়ে গেলেও একা হবনা । ছয় ছেলেমেয়ের ঘরে অন্তত বারোজন নাতি নাতনী তো থাকবে ? ছুটির দিনগুলোয় সব হল্লা করে একসাথে বেড়াতে আসবে । কেমন উৎসবের মতন দেখাবে ?
ছোট্ট এই জীবনটায় সুখী হতে কি লাগে আর , বলো তো ? কি করবো আমি ফ্ল্যাট-গাড়ী-অঢেল টাকা দিয়ে , যদি আমাকে কেউ ভালোই না বাসে ? যদি মরতে হয় একা একা ! আমার আধ ডজন ছেলেমেয়ে আর আমার স্বপ্নের খামারবাড়ী , অলীক স্বপ্নের মত মুঠো খুললেই হারিয়ে যায়...................আমি ভালো মনের মানুষ হতে পারিনি ।