নাজনিনকে প্রথম দর্শনে আপাদমস্তক স্মার্ট আর আধুনিকই মনে হয়েছে । সদা হাস্যেজ্জল মেয়েটি চমৎকার ইংরেজীর সাথে স্পষ্ট উচ্চারণে বাংলাটাও খুব সুন্দর করে বলে । বেসরকারী সংস্থায় মোটামুটি উচ্চ বেতনেই চাকুরি করে । লম্বা একহারা গঠন । বেশ সুন্দরীই বলা চলে । চাল চলনে এক ধরণের আত্নবিশ্বাস ফুটে উঠে সমস্ত অবয়বে । দৃশ্যত রক্ষণশীল মেয়েটি পুরুষ সহকর্মীদের সাথে কথোপকথনে সুযোগ পেলেই স্বামীর প্রসঙ্গ নিয়ে আসে এবং এটা বলতেও ভুলে না যে, স্বামীকে সে প্রচণ্ড ভালোবাসে । তার ধারণা এ রকম করে না বললে হয়তো কোন সহকর্মী আকস্মিক তাকে প্রেম নিবেদন করে বসতে পারে । তাকে দেখে মনে হয় পুরুষ মানুষ সম্পর্কে ব্যাখ্যাতীত সন্দেহ অবিশ্বাসের দোলাচলে সে ঘুরপাক খাচ্ছে । অথচ কয়েক মাস আগেও সে এমনটি ছিল না । চাকুরিতে যোগদানের পর থেকে বেশ হাসি খুশি আর প্রাণোচ্ছল ছিল সে । মাঝে মাঝে মনে হতো সে যেন দুরন্ত প্রজাপতি কিংবা মুক্ত বিহঙ্গের মতো আকাশে উড়ে বেড়াতো । হঠাৎ কি এমন ঘটলো কেউ বুঝতে পারেনি । কিন্তু ধীরে ধীরে তার মধ্যে দৃশ্যমান পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছিল । কেন জানি মনে হচ্ছিল রক্ষণশীলতার বাতাবরণে মেয়েটি যেন নিজেকেই আড়াল করার চেষ্টা করছে ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়ে নিজের পছন্দের একটি চাকুরি পাওয়াটা নাজনিনের জন্য অত্যন্ত সুখকর এবং আনন্দের্ ছিল বলা যায় ।তার কাজের ধরণটাও বেশ মজার । একটি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে নিয়ে মূলত: তার কাজ । পারিবারিক সহিংসতায় বিপন্ন নারীর জীবনে শান্তি, স্বস্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া তার প্রাত্যহিক নেশায় পরিণত হয়েছে । অন্য নারীর জীবন নিরাপদ করার কাজে সদা অবিচল নাজনিন কখনো কখনো নিজেকে নিয়ে বিপন্ন বোধ করে । নাজনিনের মতো এটা প্রতিটি নারীর চিরায়ত অসহায়ত্ব আর বিপন্নতার গল্পও । প্রায় প্রতিটি নারীই প্রতিনিয়ত কর্মক্ষেত্রে সহকর্মী পুরুষের লোলুপ দৃষ্টির তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়ে থাকেন । নাজনিনের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি । তাকেও কর্মস্থলে অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় । সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকানো নাজনিন স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি অচেনা পরিবে্শে ক্ষমতাধর বস একজন নারী সহকর্মীর ভীতির কারণ হয়ে উঠতে পারেন । অনভিজ্ঞ নাজনিন জীবনবোধ সম্পর্কে অভিজ্ঞতার অভাবে হয়তো প্রথম প্রথম বুঝতেও পারেনি তার জন্য কি অপেক্ষো করছে । শুরুর দিকে তাকে উদ্দেশ্য করে বসের ধরাজ গলায় দুর্বোধ্য কবিতা আবৃত্তি শুনে কিছুটা হতচকিত নাজনিন নিজেকে সামলে নিয়েছিল এই ভেবে যে, লোকটা হয়তো সাহিত্যপ্রেমী টাইপের কিছু একটা হবে । “তুমি চাঁদের মতো সুন্দর কিংবা তুমি অপূর্ব অতুলনীয়” প্রকৃতির দুয়েকটা লাইন ইঙ্গিতপূর্ণ হলেও নাজনিনের মনে কোন সংশয় জাগেনি ।
কিন্তু অযাচিত আপ্যায়নের আড়ালে অফিসের বড় কর্তা তাকে যে প্রবলভাবে শয্যাসঙ্গী হিসেবে কামনা করতো এটা বুঝতে নাজনিনের খুব বেশি সময় লাগেনি । কখনো ডিনার, কখনো লাঞ্চ কিংবা কখনো ব্রেকফাস্টের অব্যাহত অনুরোধে বিভ্রান্ত নাজনিন দুয়েকবার গিয়েও ছিল । বসের অদ্ভুত চাহনি, রহস্যঘেরা বাক্যালাপে বিমোহিত করার কৌশল যখন বুঝতে পারলো তখন নিজেকে গুটিয়ে নেয়া ছাড়া নাজনিনের আর কোন উপায় ছিল না । আর কিইবা করতে পারতো সে । আশীর্বাদের ছলে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়াকে আপাত দৃষ্টিতে নির্দোষ শুভকামনা মনে হলেও এসবের আড়ালে যে যৌনতার সুপ্ত বাসনা লুকিয়ে ছিল অন্য অনেকের মত নাজনিনও তা টের পেত । কিন্তু এসব ঠেকানোর কৌশল তার জানা ছিল না ।
শুরুর দিকে বাবার বয়সী বসের ভারী কণ্ঠের গুরুগম্ভীর বচনে বরং তাকে শ্রদ্ধাই করত সে । সময় যত গড়িয়েছে গম্ভীর বচন ততটাই হালকা চটুল রসিকায় রুপান্তরিত হয়েছে । চটুল রসিকতার সাথে পাল্লা দিয়ে বসের প্রতি নাজনিনের শ্রদ্ধাবোধও খুব দ্রুত আলগা হয়ে আসছিল । ক্ষমতাধর বসের বাক্যবিলাসে কামনার স্পষ্ট ইঙ্গিত সে অনুভব করতে পারলেও চাকুরি হারানোর ভয়ে মুখের উপর প্রতিবাদ করার সাহস তার ছিল না । নাজনিনের মৌনতাকে বস যখন সম্মতি ভেবে আরেকটু অগ্রসর হলেন তখনি বিপত্তিটা দেখা দেয় । নাজনিন কিছুটা নড়েচড়ে বসে । জানার চেষ্টা করে শুধু কি তার সাথে বস্ এ রকম আচরণ করছে ? নাকি অন্য নারী সহকর্মীদের প্রতিও বসের দৃষ্টিভঙ্গি একই রকম । সহকর্মীদের সাথে কথা বলে নাজনিন জানতে পারে অনেকেরই এধরণের অভিজ্ঞতা রয়েছে । কেউ কেউ নাজনিনকে সাবধানও করেছে । ক্ষমতা, অর্থ, প্রতিপত্তি খাটিয়ে তিনি অনেককে প্রভাবিত করে তার বাসনা চরিতার্থও করেছেন । দুয়েকজন চাকুরি ছেড়ে বসের লোলুপ দৃষ্টি থেকে বাঁচতে পারলেও অনেক সময় কারো কারো সম্পর্কের টানাপোড়েনের সুযোগ নিয়ে দুর্বল মূহুর্তে তাদের শিকারে পরিণত করতে ছাড়েননি সুযোগ সন্ধানী মানুষটি । অর্গানাইজেশনের অন্দর মহলের অন্ধকার দিকটি ধীরে ধীরে নাজনিনের কাছে স্পষ্ট হতে লাগলো । কেউ কেউ হয়তো বাধ্য হয়েছিল । তবে স্বেচ্ছায় কারো কারো বসের ঘনিষ্ঠ হওয়ার ঘটনাও রয়েছে । নাজনিন বিশ্বাস করে করে টেলেন্ট এবং কোয়ালিটি থাকলে সহজে টিকে থাকা যায় । নাজনিন অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করে বসের যৌন হয়রানীর শিকার কয়েকজন কত সহজে এডজাস্ট করে চলছে । এসব ঘটনা নাজনিনকে ভাবিয়ে তুলেছিল, কিছুটা ক্ষুব্ধও । সে সিদ্ধান্ত নিল চাকুরি ছেড়ে দেয়া কিংবা পালিয়ে বাঁচা কোন সমাধান নয় । বসের মুখোমুখি হওয়ার জন্য নিজেকে সে বরং তৈরি করছিল ।
অবশেষে একদিন নাজনিন সুযোগ পেয়ে গেল । বসের কেবিনে তার ডাক পড়লো । কথোপকথনের এক পর্যায়ে বস বললেন “আমি আমার অর্গানাইজেশনের ফিমেল কলিগদের সব সময় ফেভার করি এবং বিপদে আপদে খুব সহায়তা করি” । নাজনিন তখন বলল “স্যার আমি বিশ্বাস করি আমার বিপদে আপদেও আপনি আমাকে সহযোগিতা করবেন । আমি জানি আপনি আমার বাবার মত” । নাজনিনের মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই বিনা মেঘে বজ্রপাত । বস রেগে বললেন, “ আমি বাবার মত কি করে হলাম ?(বাবা হলেইতো যত সমস্যা) তোমার মধ্যে প্রোফেশনালিজমের অভাব রয়েছে” । নাজনিন দৃঢ় অথচ শান্তভাবে বলল, “স্যার এইযে আপনি নারীদের সহযোগিতা করেন এর একটা নেগেটিভ দিকও রয়েছে । আমি নাম বলতে পারবোনা, তবে অনেকে বলাবলি করছিল আপনি নাকি সহযোগিতার আড়ালে অনেককে বিভিন্নভাবে Exploit করেছেন । তারা আমাকেও আপনার বিষয়ে সতর্ক করেছে । আমি তাদের বলেছি, ধ্যুৎ স্যার আমার সাথে এ রকম করতেই পারেন না । স্যার আপনিই বলুন, আমার সাথে কখনো এরকম হতে পারে? আমি তাদের বলেছি, স্যার যদিওবা কখনো এ রকম আচরণ করেন তাহলে আমিও ছেড়ে কথা বলবোনা । আপনিই বলুন স্যার আমি ঠিক বলেছি না” ? বস তখন প্রচণ্ড ঘামছিলেন, তাকে খুব বিমর্ষ এবং উত্তেজিত দেখাচ্ছিল । এক পর্যায়ে তিনি বলে বসলেন, “তুমি জান তোমার অনেক ফিমেল কলিগ স্বেচ্ছায় আমার কাছে এসেছিল” । মুখ ফসকে গোপন অভিলাষ বেরিয়ে পড়লেও তাকে একবারের জন্য লজ্জ্বিত মনে হয়নি । নাজনিনের নিকট তখন হালকা বোধ হচ্ছিল, এক ধরণের আনন্দও । সে মনে মনে ভাবছিল যাক বেটাকে আচ্ছা জব্দ করা গেছে । ধীরে ধীরে নাজনিন রুম থেকে বেরিয়ে আসলো । নাজনিন এখনো ঐ অর্গানাইজেশনে নির্বিঘ্নে কাজ করছে এবং সেই বসের অধীনেই ।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:৪৯