আমাদের সব ভালোবাসা, সব বেদনা, সব অশ্রু উৎসারিত হোক ওদের জন্য। আমাদের সব শুভকামনা ওদের জন্য। হৃদয় খুঁড়ে বেদনা না জাগানোর কথা বলেছেন জীবনানন্দ দাশ। তবে এমন কিছু গুরুভার বেদনা মর্মমূলে বিদ্ধ হয়ে থাকে যা অবিনাশী, হৃদয় খুঁড়ে জাগাতে হয় না, তা সদাজাগ্রত। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি সতীর্থদের ভয়ঙ্কর জিঘাংসার শিকার সেনা কর্মকর্তাদের স্বজনরাই নন, সমগ্র জাতি অশ্রুজলে স্মরণ করছে। এ স্মরণ শুধু বৎসরান্ত কিংবা বিশেষ দিনের নয়। স্মরণের বালুকাবেলায় তারা চিরউজ্জ্বল, অনির্বাণ।
যতদূর মনে পড়ে, ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ছিল মেঘমুক্ত, সূর্যস্নাত। উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করছিল সমগ্র রাজধানী। হঠাৎ মনে হলো সব আলো নিভে গেছে। অন্ধকারে ছেয়ে গেছে বিশ্ব চরাচর। এ সকাল যে রাতের চেয়েও অন্ধকার! সেই ভয়ঙ্কর দিন দুটি নিয়ে গতকাল সমকালের বিশেষ আয়োজনে শীর্ষ প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল 'দেশ কাঁপানো দু'দিন'। শুধু কি দেশ কাঁপানো? সেই দু'দিনের ভয়ঙ্কর ট্র্যাজেডি বিশ্বের গণমাধ্যমকেও আলোড়িত করেছিল। সেনা কর্মকর্তাদের মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ডের সংবাদ উন্মোচিত হওয়ার শোকাবহ মুহূর্তে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের শঙ্কায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা উৎকণ্ঠিত ছিল সমগ্র দেশ।
সকলের চোখ ছিল ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দিকে। কী জানি কী হয়! জনগণের নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেট নিয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই মহাজোট সরকারের সামনে অবিশ্বাস্য এক অগি্নপরীক্ষা। দুই বাহিনী পরস্পর মুখোমুখি। আতঙ্কিত সাধারণ মানুষ। বিডিআর বিদ্রোহ প্রশমন ও পিলখানায় বিভ্রান্ত বিদ্রোহী বিডিআর জওয়ানদের নিরস্ত্র করার কুশলী ও দূরদর্শী পদক্ষেপ গ্রহণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়চিত্ততা ও অসম সাহসিকতার কথা এখন মনে করে এই ভেবে বিস্মিত হই; জীবন বাজি রেখে দেশকে ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষায় কীভাবে শেখ হাসিনা প্রচণ্ড চাপের মধ্যে থেকেও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন?
প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতায় দেশ বেঁচেছে, রক্তক্ষয় এড়ানো গেছে। আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছি। কিন্তু যে পিতা তার আদরের পুত্র হারিয়েছেন, যে প্রেমময়ী স্ত্রী তার স্বামী হারিয়েছেন, যে সন্তান তার স্নেহময় পিতাকে হারিয়েছে, কোনো সান্ত্বনা কি তাদের বেদনার গুরুভার লাঘব করতে পারে? সন্তান মর্যাদার উচ্চশিখরে আরোহন করবে_ প্রত্যাশা ছিল পিতার মনে। স্বামী পুরো পরিবারের জন্য একখণ্ড সুখস্বর্গ তৈরি করবে_ মায়াবী স্বপ্ন ছিল স্ত্রীর দু'চোখে। আজীবন পিতার স্নেহছায়ায় নিরাপদ থাকবে_ সন্তানের কাছে এই নির্ভরতা যেন নিশ্চিত ছিল। দু'দিনের পৈশাচিকতায় সেই স্বপ্নের মিনার চুরমার হয়ে গেল। নৃশংস ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন। আজ বনানী সেনা করবস্থানে শহীদদের কবরের পাশে অশ্রুভেজা চোখে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকবেন তাদের স্বজনরা। সেখানে একের পর এক সাজানো কবরে সেনাবাহিনীর শ্রেষ্ঠ সন্তানরা ঘুমিয়ে আছেন।
বিডিআর বিদ্রোহের বিচার শুরু হয়েছে। সম্ভবত হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হতে খুব বেশি বিলম্ব হবে না। বিডিআর পুনর্গঠনের রূপরেখার কথা আমরা জেনেছি। অবিশ্বাস্য গোয়েন্দা ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ঢেলে সাজানোর কথা আমরা শুনেছি। ভবিষ্যতে এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়াতে কঠোর আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়ার কথাও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। বিডিআরের নাম-পোশাক বদলে যাচ্ছে। নাম ও পোশাক বদলই যথেষ্ট নয়। এই শৃঙ্খলা বাহিনীকে যথার্থ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে, সে কাজটি নিশ্চয়ই কঠিন নয়। মনে রাখতে হবে এই বিডিআরই আমাদের সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী। বিডিআর হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য কুশীলব আছে কি নেই_ এ নিয়ে ইতিমধ্যেই ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে। বিডিআরের মহাপরিচালক মনে করেন 'ডাল-ভাত কর্মসূচি' নিয়ে জওয়ানদের অসন্তোষ শেষ পর্যন্ত নারকীয় হত্যাযজ্ঞে পর্যবসিত হয়। সিআইডি তাদের তদন্তকালে বাইরের কারও কোনো ভূমিকার তথ্য পায়নি।
সরকার গঠিত উচ্চ পর্যায়ের কমিটির চেয়ারম্যান সাবেক সচিব আনিসুজ্জামান 'মদদদাতাদের' খুঁজে বের করতে অধিকতর তদন্তের পরামর্শ দিলেও গত এক বছরে কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। এ কারণে তিনি হতাশ। প্রধানমন্ত্রী গতকালও বলেছেন, বিডিআর বিদ্রোহে যারা উস্কানি দিয়েছেন তাদেরও খুঁজে বের করা হবে। বিএনপিও একটি বিদেশি রাষ্ট্রের দিকে ইঙ্গিত করে নেপথ্যের কুশীলবদের খুঁজে বের করার দাবি জানাচ্ছে। এই ধূম্রজাল ছিন্ন করার জন্য উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত অনতিবিলম্বে শুরু করা প্রয়োজন।
বিশাল সীমান্তরেখা জুড়ে প্রতিনিয়ত সদাজাগ্রত থেকে বিডিআর জওয়ানদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। তাই তাদের মর্যাদা সমুন্নত রেখেই জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণ বাঞ্ছনীয়। বিডিআরের ভেতরের ক্ষোভ ও বঞ্চনার কথাও আমাদের মনে রাখতে হবে। ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআরের অনেক দাবি-দাওয়ার কথা আমরা শুনেছি_ পরিবর্তিত বাস্তবতায় ন্যায্য দাবিগুলো অগ্রাহ্য না করাই শ্রেয়। ক্ষোভ ও বঞ্চনার জায়গাগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ভুল করা হলে ভবিষ্যতে আবার বিপদ ঘটতে পারে। গত এক বছরে গ্রেফতারকৃত অনেক বিডিআর জওয়ানের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। সুশীল সমাজ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর উৎকণ্ঠা আমলে নিতে হবে। দোষীদের শাস্তি পেতেই হবে, তবে নির্দোষ কেউ যাতে রোষের শিকার না হয়, তাও লক্ষ্য রাখা জরুরি