দক্ষিণ এশিয়াতে বাংলাদেশ নামে একটি দেশ আছে। দেশটির ইতিহাস পৃথিবীর অন্য সব দেশের থেকে একটু আলাদা। এই দেশটি পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেটি ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে ৫২ সালে। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে আসাদের রক্ত দিয়ে দিয়ে শুরু করে দেশটি ৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে ৩০ লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে। স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় দেশটি বড় দুইটি অংশে বিভক্ত ছিল। একদল ছিল স্বাধীনতার পক্ষে আর একদল ছিল স্বাধীনতার বিপক্ষে আর অখণ্ড পাকিস্থান এর পক্ষে।
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলিম তাই ইসলাম ধর্মকে ব্যাবহার করা হয়েছিল সুকৌশলে। বলা হয়েছিল অখণ্ড পাকিস্থানের বিরধিতা করা মানে ইসলামের বিরধিতা করা। এমনকি পাকিস্থানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য এবং স্বাধীনতার জন্য যারা লড়াই করছিল তাদেরকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য দেশের ভেতরে যে দলগুলো তৈরি করা হয়েছিল তাদের নামগুলোও দেয়া হয়েছিল আরবি নাম “আল-বদর” “আল-শামস” ইত্যাদি যাতে করে সাধারন মানুষের আবেগকে ইসলাম ধর্মের নামে ব্যাবহার করা যায়।
যুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীন সময়ে বাংলাদেশের সমস্ত নির্বাচিত অনির্বাচিত সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহায়তায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলার মাটিতে করা সম্ভব হয়নি। কখনো ক্ষমার আশ্রয়ে (মুজিব সরকার), কখনো প্রশ্রয়ে (জিয়া সরকার), কখনো আস্কারায় (বিনপি সরকার) আর কখনো লোভে এবং হজম করতে না পারার অক্ষমতায় (আওয়ামিলীগ সরকার)ওরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে এবং ইসলামের আশ্রয় নিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে গেছে। ৯২ তে যখন গণআদালত বসিয়েছিল এক অসম সাহসী শহীদ মুক্তিযোদ্ধার (রুমি) অসম সাহসী মা (জাহানারা ইমাম) তখনও তৎকালীন সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য জাহানারা ইমামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দিয়েছিল এবং তিনি ওই মামলা মাথায় নিয়েই মৃত্যু বরন করেছিলেন।
২০১৩ সালে সরকার যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করল তখন কাদের মোল্লা নামের একজন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর গণহত্যার অপরাধ প্রমান হওয়া সত্তেও যখন তার ফাঁসির আদেশ হল না তখন যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগ আন্দোলন গড়ে উঠল, তাদের দাবী ছিল একটাই ৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং সর্বোচ্চ শাস্তি। কিন্তু এইখানেও ইসলামকে ব্যাবহার করা হল সুকৌশলে। যুদ্ধাপরাধীদেরা ইসলামের কাছের লোক, ওরা ইসলামের কথা বলে, ওদের অলৌকিক মহিমায় ওদেরকে চাঁদে দেখা যায়। বিভিন্নরকম ফেক/এডিটেড ছবি প্রকাশ করা হতে লাগল যেখানে দেখা গেলো ওদের জন্য বিভিন্ন দেশের বড় বড় ইসলামী ব্যক্তিত্বরা বিভিন্ন বড় বড় ইসলামী সমাবেশে তাদের মুক্তির দাবী জানাচ্ছে। এমনকি পবিত্র কাবা শরিফের ছবিও বিকৃত করা হল। যেই ব্লগাররা শাহবাগের এই আন্দোলনকে সঙ্ঘটিত করেছিল তাদের জীবনের উপর বিভিন্ন রকমভাবে হামলা করা হতে লাগল এবং দুই একজনকে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের লোকজন মেরেও ফেলল। ওরা শুধু তাতেই ক্ষান্ত হল না দুই একজন ব্লগারের লেখার সুত্র ধরে পুরো শাহবাগ আন্দোলনটাকেই নাস্তিকদের আন্দোলন বলে প্রচার এবং প্রমান করার চেষ্টা করা হতে লাগল। বাংলাদেশের সাধারন লোকজনের আবেগকে ইসলাম ধর্মের নামে ব্যাবহার করা খুব সহজ। ধর্মের অবমাননার কথা শুনিয়েই তাদেরকে উত্তেজিত করে ফেলা যায় কেউই সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে যায় না। কাজেই ৭১ সালের মতই এই অস্ত্রটিই আবার প্রয়োগ করা হল সুনিপুনভাবে।
এক্ষেত্রে সরকারও যথেষ্ট ভাল ভূমিকা রাখল। প্রথমে তারা চেষ্টা করল আন্দোলনটিকে ব্যবহার করে তাদের শাসনামলের সমস্ত ব্যর্থতা ঢাকতে। তাই আন্দোলনের প্রথম দিকে সরকার সিধান্ত নিল আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধন করার। যখন ব্লগারদের উপর হামলা হচ্ছিল এবং দুই একজনকে মেরে ফেলা হল সরকার চেষ্টা করল তাদেরকে নিরপত্তা দিতে। কয়েকজন ব্লগারকে পুলিশি নিরাপত্তাও দেয়া হল। কিন্তু পরবর্তীতে সরকার যখন দেখল সামনে নির্বাচন কাজেই দুই কুলই রক্ষা করতে হবে তখন তারা বিভিন্ন ব্লগ বন্ধ করে দিল। গ্রেপ্তার করা শুরু করল বিভিন্ন ব্লগারদেরকে এবং সিধান্ত নিল শাহবাগ আন্দোলনের পুরোধা গনজাগরন মঞ্চ বন্ধ করে দেয়ার। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশে যখন যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের লোকজন মসজিদে আগুন দিল তখন ইসলামের অবমাননা হল না। যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের লোকজন মিথ্যা ব্লগ তৈরি করল এবং ওরা নিজেরাই বিভিন্ন ব্লগারদের নামে ইসলামের অবমাননাকারি লেখা লিখতে লাগল এবং খোদ পবিত্র কাবা শরিফের ছবি বিকৃত করল তখনও ইসলামের অবমাননা হল না এবং সেইসব ব্লগ বন্ধও করা হল না। যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের লোকজন শাহীদ মিনার ভাঙল তখন রাষ্ট্রদ্রোহিতা হল না। যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের লোকজন যখন জাতীয় পতাকা ছিঁড়ল তখনও রাষ্ট্রদ্রোহিতা হল না। হারতালের নামে জ্বালাও, পোড়াও আর পিটিয়ে পুলিশকে মেরে ফেলা হল তখনও তাদের কিছু হল না। উলটো সরকার যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবীতে গড়ে উঠা আন্দোলনকে বন্ধ করে দেয়ার সিধান্ত নিল এবং ব্লগারদেরকে গ্রেফতারের সিধান্ত নিল।
এইভাবে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সমস্ত নির্বাচিত অনির্বাচিত সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহায়তা যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের শক্তি সব সময়ই পেয়ে এসেছে এবং মনে হচ্ছে সামনেও পাবে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




