✪
৬/৭ টা স্কুল পালানো ছেলেকে দেখা যাচ্ছে চট্টগ্রামের শান্তশিষ্ট এক পাড়াগাঁয়ে । তাদের পরিধেয় বস্ত্রটা আলুথালু হয়ে রয়েছে। জামার হাতার দিকটা মলিন থেকে মলিনতর হয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত বহুদিনের কপালের ঘাম মুছতে মুছতে।
এদের সবাই যে দৈনিক স্কুল পালায় তা না। কেউ কেউ বছরে এক কি দু’বার। যাহোক গ্রীষ্মের তাপদাহে নির্জন জায়গাটাকে আরো নির্জন করতেই যেনো একটা গাছের পাতাও নড়ছে না। নির্জনতা ভাঙতে মাঝে মাঝে একটা কাক কিছুক্ষন পরপর ক্ষীন গলায় কা-কা করে উঠছে। তাতে অবশ্য গাছের নীচে থাকা কুকুরটার ঝিমোতে খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না।
হিমালয় নামের ছেলেটি যথারীতি স্কুল পালানো দলটার মধ্যমনি, ঝুপড়ি দোকানে সেই আসরটা জমিয়ে রেখেছে। সুনীল আর তূর্য কি একটা নিয়ে খুব তর্কাতর্কি করছে। রুহিত ঘর্মাক্ত ও ময়লা শরীর নিয়ে বসে রয়েছে। এদিক সেদিক ক্রিকেট খেলে বেড়ায় সে, ক্রিকেটই তার ধ্যান-জ্ঞান। আজকেও পাড়ার বড় মাঠ থেকে ক্রিকেট খেলে এসেছে। পরবর্তীতে এই রুহিতই ফার্স্ট ডিভিশন খেলে চট্টগ্রামে বেশ একটা নাম ডাক করবে।
বাচ্চু একটা বেঞ্চির উপর তার সৃষ্টিশীল আঁকিবুঁকি চালিয়ে যাচ্ছে, সেগুলো এলোমেলো শব্দ বা তিন চারটা বাক্যের মত হয়ে ছোট ছোট অনুকবিতায় রুপ নিচ্ছে। থেকে থেকে সে আবার বেশ উচু গলায় বাংলা ও ইংরেজি গান গেয়ে উঠছে, এতে অবশ্য অন্যরা বেশ অভ্যস্ত। পরবর্তীতে এই বাচ্চুই হয়ে উঠবে বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের এক জীবন্ত কিংবদন্তি। তাকে ঘিরে গড়ে উঠবে বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের এক স্বর্নালী অধ্যায়। একটা দেশে ব্যান্ড সঙ্গীতকে প্রচন্ড জনপ্রিয় করে তুলবে সে। তার গীটারের সুর ছুটে চলবে জার্মানী, ইংল্যান্ড, ইটালি সহ পৃথিবীর বহু দেশের বহু স্টেজের লাখো জনতার মাঝে। সে হয়ে উঠবে “গীটার গড” আইয়ুব বাচ্চু। তবে সেটা আরো অনেকদিন পরের কথা।
✪
চট্টগ্রামের বনেদি হাজি পরিবারের কর্তা হাজি সাহেব একটা সংবাদপত্রের উপর ছোলা মুড়ির বাটি রেখে খুব আগ্রহের সাথে ছোলা-মুড়ি খাচ্ছেন। বাচ্চুকে স্কুল থেকে ফিরতে দেখে তাকে মনে করিয়ে দিলেন প্রাইভেট পড়তে যেতে হবে, সে যেনো হাতমুখ ধুয়ে, খাওয়া দাওয়া করে একটু বিশ্রাম নিয়ে পড়তে চলে যায়। তারপর তিনি আবার আগ্রহ নিয়ে ছোলা,মুড়ি খেতে লাগলেন।
প্রাইভেট পড়ার ব্যাপারে বাচ্চুর খুব আগ্রহ। তার কারন এই নয় যে পড়া লেখা সে খুব পছন্দ করে, বাড়ির কাজ ঠিকভাবে দেখানোর পর প্রাইভেট শিক্ষকের বাড়ির ছাদে মনের সুখে গিটার বাজানো যায়। এটাই আসল কারন আর এটাতেই তার সকল আগ্রহ। শিক্ষক নুরুল সাহেব বাচ্চুকে খুব পছন্দ করেন। বাচ্চুকে তিনি বাড়ির কাজ দেখিয়ে দিয়ে বলেন যাও ছাদে যাও, গিটার বাজাও। তার এই প্রশ্রয়েই এক কিংবদন্তী গিটার বাদক নিজেকে তৈরী করে নিতে থাকে।
শিক্ষক নুরুল সাহেবের বাড়ির ছাদের অদূরে লম্বা গাছের সারির মাঝ দিয়ে পশ্চিমের সূর্য ঢলে পড়ে প্রতিনিয়ত। ঘরে ফেরা পাখিদের কিচির মিচিরে জীবন্ত হয়ে উঠে সাঝের বেলা। ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে খেয়ালি বাচ্চু তার রুপালী গিটারে সুর তোলে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে। আর এর অনেকদিন পর তার মনে পড়ে যায় এই বিকেলের কথা, এই বিকেলগুলোর কথা।
✪
সময়টা ১৯৮০। “সোলস” নামের চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক একটা উঠতি রক ব্যান্ড ধীরে ধীরে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বড় বড় হোটেলগুলোর সাথে তাদের চুক্তি। হোটেলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে “সোলস” পশ্চাত্যের ইংরেজি রক গান পরিবেশন করে।
বাচ্চু “সোলস” ব্যান্ডে যোগ দেওয়া একজন সদ্য সদস্য। এর আগে কিছুদিন সে “ফিলিংস” নামে একটা ব্যান্ডের সাথে ছিলো। তখন মাহফুজ আনাম নামের অষ্টম শ্রেনীর এক ছেলে আবার বাসা থেকে ঝগড়া করে আজিজ বোর্ডিং এ এসে উঠেছে, ফিলিংস নামক সেই দলে গান বাজনা করে সে। খুব অল্প বয়সে ঘর পালানো এই ছেলেটিই পরবর্তীতে হয়ে উঠবে বাংলা ব্যান্ডের আরেক দিকপাল জেমস।
সন্ধ্যাবেলা। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ হোটেলের সামনে একটা ট্যাক্সি থেকে সোলস ব্যান্ডের কি-বোর্ড বাদক নকীব খান, ড্রামার রনি বড়ুয়া আর বাচ্চু গিটার হাতে নামলো। পিছনের আরেকটা ট্যাক্সিতে করে ব্যান্ডের মূল ভোকাল তপন চৌধুরী দলের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে আসছে। আর তাদের আগেই একটা ভ্যানে করে দুটো সাউন্ড বক্স আর একটা ড্রাম চলে এসেছে। আগ্রাবাদ হোটেলটাকে মরিচবাতি দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়াছে। লাল, নীল মরিচবাতি জ্বল জ্বল করছে।
একটু রাত করেই কনসার্ট শুরু হল। পশ্চাত্যের বিভিন্ন ব্যান্ডের জনপ্রিয় গানগুলো সোলস ব্যান্ডের মূল কন্ঠশিল্পী তপন চৌধুরি আর নকীব খান গেয়ে চলেছে। ইদানিং অবশ্য নিজেদের ব্যান্ডের তৈরি করা বাংলা গান ও গাচ্ছে এই দুজন। বাচ্চু ও গিটার বাজানোর পাশাপাশি মাঝে মাঝে গান করছে। গানগুলো তার লেখা।
গভীর রাতে গান বাজনা করে ঘরে ফিরে আসে “সোলস” আর বাচ্চু। এভাবে প্রতিনিয়ত কনসার্ট করে ঘরে ফেরার কালে তারা অনুভব করে পায়ের নিচে মাটি জমাট বাধতে শুরু করেছে- হয়তো সেদিন বেশি দূরে নয় যখন আর অন্যদের গান নয়, তাদের নিজেদের গাওয়া বাংলা গানই মানুষের মুখে মুখে ঘুরে ফিরবে।
পরের পর্ব পড়তে - রূপালী গিটার -পর্বঃ ২
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মে, ২০১৪ দুপুর ১:৩৯