তখন তিন তলার এক ফ্ল্যাটে মেস করে থাকতাম। আমার সাথে এক ছোট ভাই ছিল।হুটকরে একদিন আমাকে সে বলল-
-অর্ক ভাই,আমার এক বড় ভাই এখানে এসে কিছুদিন থাকতে চায়।আপনার কোনো সমস্যা হবে নাতো?
-সমস্যা হবে কেনো,সমস্যা নেই।
সমস্যা নেই বললেও আসলে একটা সমস্যা ছিল,তা হচ্ছে শোয়ার সমস্যা।তবে মেসে যারা থাকে তারা কখনই এটাকে সমস্যার চোখে দেখেনা।এ এক অদ্ভূত সাইকোলজিকাল বিহেভিয়ার।এর কোনো ব্যাখ্যা নেই! তবে এটা নিয়ে তাকে আমি কখনই মাথা ঘামাতে দেখিনি। সে ফ্লোরে ধপাস্ করে শুয়ে ঘুমিয়ে পরতো। স্বভাব গত কারনে আমি তার সাথে তেমন একটা কথা বলতাম না।একই রুমে থাকতাম,খেতাম, ঘুমাতাম অথচ, তার সাথে কথা দুই মাসে দু তিনবারের বেশি হয়নি।
বেশির ভাগ সময় তাকে লিখতে দেখতাম। খাতা ভর্তি করে তার লেখা।সব সময় লিখতো বলে একদিন কৌতূহল হল তার লেখা দেখার,আসলে সে কি লেখে এত? একদিন দুপুরবেলা তাকে ঘুমাতে দেখে তার লেখার খাতাটা হাতে নিলাম। দেখলাম খাতায় সে ছোট গল্প আর প্রবন্ধ লিখেছে।আমি পড়া শুরু করলাম।যতই পড়ছি ততই অবাক হচ্ছি। এক পর্যায়ে নিজের মাথায় হাত দিয়ে চুল টানতে টানতে অজান্তেই বললাম - এত সুন্দর করে সে লেখে কিভাবে।মায়ার এক অদ্ভূত জাল লেখার প্রতিটা লাইনে লাইনে মাকড়শারজাল হয়ে আটকে আছে।
দু'মাস থাকার পর সে যখন চলে যাবে আমি তখন মুখ ফসকে বলেই ফেল্লাম-
-আপনার লেখার হাতটা অসাধারন!
তিনি একটু মুচকি হেসে ধন্যবাদ দিলেন।আমি তখন প্রশ্ন করে বসলাম-
-আচ্ছা, কোথায় লেখেন আপনি? কোনো পত্রিকা বা ত্রৈমাসিক পত্রিকায় কি লেখেন?
তিনি বিষণ্ন মনে বললেন-
-না,চেষ্টায় আছি।আগে বিভিন্ন ব্লগে লিখতাম,ফেইসবুকে বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যেও লিখতাম।এখন আর আগের মত লেখা হয়না।আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি।
-কেনো বলুন তো?
-আমি এই ধরনের যায়গায় লেখালেখি করে অনেক দেখেছি।বেশির ভাগ সময় যে বিষয়টি লক্ষ্য করেছি তা হচ্ছে পরিচিতি।পরিচিত মানুষকে প্রাধান্য দেয়া হয় বেশি,অদ্ভূত ভাবে নতুন কে কি লিখছে তা কেউ দেখে না। লেখার লেভেল কে মূল্যায়ন করা হয় অন্যরকম করে, ব্লগের ক্ষেত্রে ভিউ দেখে আর ফেইসবুকে দেখা হয় লাইক দেখে। তাছাড়া যারা মূল্যায়ন করে তাদের মধ্যে অনেকেই লেখালেখির মানেই বুঝেনা! অনেক গুরুত্ব পূর্ণ কোনো বিষয় নিয়ে কেউ হয়তো লিখেছে।অথচ, দেখেছি তার সেই লেখা পরেই রয়েছে।তাকিয়ে দেখার কেউ নেই!...
অনেক রাগ আর অভিমান নিয়ে সে এক নিশ্বাসে বলে গেল।আমি চুপ করে শুনলাম।তার পর বললাম-
-আপনার সব লেখার মধ্যে এমন কিছু লেখা তো অবশ্যই আছে, যা সবথেকে ভাল লেখা ছিল।
-হ্যাঁ, তাতো আছে। তবে অনেক আগের।
-আপনিতো সেইগুলোর কয়েকটা ভাল সম্পাদকের কাছে পাঠাতে পারেন।দেখতে পারেন তাদের ফিডব্যাক টা কেমন আসে।
-কিন্তু পুরোনো লেখা...
-রবীন্দ্রনাথের লেখাও তো পুরোনো, তার মানেতো এই না যে তার লেখা কেউ পড়বেনা! লেখার কখনো বয়স হয়না।
এটাই ছিল তার সাথে আমার শেষ কথা আর শেষ দেখা।এর পর তার সাথে কখনই দেখা হয়নি।তার চলে যাওয়ার এক মাস পর আমিও মেস থেকে চলে আসি। অনেক গুলো বছর পারকরে ফেলেছি।আমি আর এখন মেসে থাকিনা।ছোট একটা চাকরি করি। বাসাথেকে প্রচুর বিয়ের চাপ সামলাতে না পেরে বিয়েটা বাধ্য হয়ে এক পর্যায়ে করেই ফেলি।ঢাকা শহরের চিপাচাপা এক ফ্ল্যাটে দুই জন মানুষ এখন সংসারটা কোনোরকম গুছিয়ে রাখায় ব্যস্ত।
এমনি এক ব্যস্ত সকালে চা খেতে খেতে পত্রিকায় চোখ রাখলাম। একটা লেখায় চোখ আটকে গেল। কেমন একটা পরিচিত লেখার ছন্দ,একটা মায়ার জাল আমি অনুভব করতে লাগলাম।মাথার ভিতরে পুরোনো স্মৃতি গুলোর মধ্যে একটা গুগোল সার্চ হতে লাগলো।কোথায় যেনো পড়েছি?
লেখাটার একদম শেষে এসে যখন নামটা দেখবো।তার ঠিক উপরে একটা ছোট্ট লাইনে এসে আটকে গেলাম!
--কেউ বলেছিল- "লেখার কখনো বয়স হয়না।"
আমার চোখ এই লাইনটি দেখে মুগ্ধতার ছোট ছোট শিশির বিন্দু একটু একটু করে জড়ো করছে।আমার স্ত্রী আমাকে অদ্ভূত ভাবে পত্রিকার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞাস করলো-
-তোমার কি কিছু হয়েছে? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
আমি পত্রিকা থেকে চোখ না সরিয়েই বললাম-
-তোমার লিকার চা টা অসাধারন হয়েছে!!
-কিন্তু ঐটা তো লিকার চা না!...
#আরিয়ান_রাইটিং
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই এপ্রিল, ২০১৭ রাত ১২:৩৩