ছেলে কখনো বাবার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারেনি।
যেখানে "অপদার্থ ছেলে" নামক এক শিরোনামে বাবার প্রতিটা কথা শুরু হয়,সেখানে ছেলে হয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলার জন্য সত্যি সাহসিকতার প্রয়োজন। সেই ছেলে যদি অনেক ক্ষুদ্র কিছু করতে পারে তখন তার ইচ্ছে হয় একটু বুক ফুলিয়ে বাবার সামনে দাঁড়াতে। কিন্তু তা আর হয়ে উঠেনা। কিছু বলার জন্য দরজার সামনে হাটা হাটি করতে থাকা এক জোড়া পা ব্যস্ত ভঙ্গিতে চলতে থাকে। হঠাৎ পর্দার আরাল থেকে কখনো যদি বাবার চোখে বিষটি ধরা পরে যায় তখন ধমকের সুরে শুনতে হয় "কিরে গাধা,ওখানে ডায়বেটিক্স রোগির মত বারবার হাটছিস কেনো? কিছু বলবি?" ছেলে মিনমিন করে বলে কেটে পরে "কিছুনা বাবা,এমনি!"
নিজের রুমে বসে ছোট্ট এক নিশ্বাস ফেলে ভাবে - "আজকেও বলতে পারলাম না"। বলবে কি করে,অভ্যাসটা তো নেই।
এমন অনেক অনুভূতি আছে যা বেশি দিন লুকিয়ে রাখা যায়না,তাই বাবার সামনে থেকে ছেলের মুখটাই লুকিয়ে রাখতে হয়।কারন ছেলের কাছে এটাই সব থেকে সহজ কাজ। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেরা এক ধরনের দায়ের বোঝা অনুভব করতে শুরু করে। আপনি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান না হলে লিখে এই অনুভূতি বোঝানো সম্ভব না।
কিছু বিষয় ভাষা জগতের বাইরে থাকে। কাউকে যেমন বোঝানো যায়না ঠিক তেমন করে সহ্যও করা যায়না। এক পর্যায়ে হাসিখুসি থাকার মানে হারিয়ে ফেলা। অযথাই নিজের চুপচাপ থাকার জগত তৈরি করে ফেলা। এমন এক জগত যেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ।ভাল লাগার বিষয় গুলো ভাল না লাগার বিষয়ে কবে পরিবর্তন হয়ে যায় সে নিজেও জানেনা।
বন্ধুরা মিলে যখন চাইনিজ রেস্টুরেন্টে বসে বিভিন্ন খাবার খাওয়ায় ব্যস্ত থাকে, তখন টি স্টলে বসে এক কাপ চা আর একটা সস্তা সিগারেটে যেনো ভালবাসা আর জীবনের মানে খুঁজে চলা। ছোট ছোট ধোয়াটে নিশ্বাসে যেনো দিনকে দিন সে শিখে-এখানে ভালবাসা বড়ই ধূসর প্রকৃতির।
ব্যস্ততার দিন শেষে ঘরে ঢুকতেই যখন ছোট বোনটি রুমে এসে বলে, "ভাইয়া, আমার কানের দুলটা এনেছো?ঐ দিন যে বললাম মামুন ভাইয়ের দোকানে নতুন এসেছে... "
ভাই হয়ে ছোট বোনটির সাথে ইনিয়ে বিনিয়ে মিথ্যা বলতে হয়, "আরে যাহ্,ভূলেগেছি! কাল এনে দিবো"
ছোট বোনের কিছু বোঝার বাকি থাকেনা।বোনটা যে তার এই উঠোনেই বড় হয়েছে। ভাইয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বোনটিও বলে "ভাল করেছো ভূলে গিয়েছ,আমার তো কানের দুল খুব একটা ভাল লাগেনা, তাছাড়া পরাও হয়না। আনতে হবেনা ভাইয়া"
বোনের রুক্ষপ্রকৃতির মুখটা সেদিন কোনো ভাই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখার শক্তি যেনো হারিয়ে ফেলে।
সেই ছেলেই হয়তো একদিন সাহস করে বাবাকে একটা ফোন করেই ফেলে। সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার থেকে বাবার কাছে ফোন কল করাটা যেনো একটু সহজ!
বৃদ্ধ বাবার কমদামি ফোনটি বেজে উঠে।
ছেলে ফোন করেছে...
ফোনের ঐ পাশ থেকে ছেলের ভাঙা কন্ঠে সংক্ষেপে বলা "বাবা,চাকরিটা হয়েগেছে"।
অশ্রুসিক্ত চোখ বাবার অসাধারণ ব্যক্তিত্বের সাথে মিশে থাকা চশমাটা কে কেমন ঘোলাটে করে দিয়েছে,সেটা ছেলে আর দেখতে পেলোনা। চশমা খুলতে খুলতে আবেগ প্রবন বাবা আজকেও বলে উঠলো-"শুনছো, তোমার অপদার্থ ছেলে চাকরি পেয়েছে।"
মা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে,অজানা সুখের দু'ফোঁটা চোখের জল তার মলিন আঁচলে মুছতে ব্যস্ত হয়ে যায়।
বাবা-মা কখনই জানতে পারেনা,তাদের ছেলে কে বলা "অপদার্থ" শব্দটাকে ঘিরে কত ভালবাসা লেপ্টে আছে।
আর ছেলে জানতে পারেনা,এই "অপদার্থ" শব্দটা তাকে কবে পদার্থে রূপান্তরিত করেছে।
উৎসর্গঃ সকল মধ্যবিত্ত অপদার্থদের কে!
#অপদার্থ
#সুপ্ত_জীবন_চক্র
#আরিয়ান_রাইটিং
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই আগস্ট, ২০১৭ বিকাল ৪:২৭