অনিন্দিতা কলেজে বিজ্ঞান শাখায় ভত্রি হলো। এর আগে কখোনো সুন্দরী কাউকে দেখিনি মনে হলো! তাছাড়া আমার চারপাশের অবস্থা অনুযায়ী কাউকে ভালো লাগাটা আবশ্যক মনে হলো। আমি কথা কম বলতাম, মেয়েদের সাথে। নিজেকে হিরো মনে করতাম সবসময়! ছেলেদের ১২-টা বাজানো ছিলো আমার দৈনিক রুটিন। সেদিন সুচরিতার বইয়ের মধ্যে উতপল-এর একটা মিথ্যা গোপণ চিঠি রাখার কারণে নাহিদের সাথে ওর খুব একটা গোণ্ডগোল বেধে গেলো! চিঠিতে শুধু লেখা ছিলো, ‘সুচরিতা, আমি তোমাকে প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ফেলেছি। নাহিদ-ই তোমার সাথে মিথ্যা প্রেমের নাটক করছে! ইতি, তোমার উতপল!’ আমাকেই পরে মিটিয়ে দিতে হলো। পরে অবশ্য ওদের দুজনকেই আমাকে খাওয়াতে হলো।
অনিন্দিতা কেনো আমার সাথে সবসময় কথা বলতে আসে-না, এটাই আমার মনঃকষ্ট! মাঝে-মাঝে কোচিং শেষ করে আসার সময় ওর সাথে দেখা হলে সেদিন আমার ঈদের দিন মনে হতো! ও-আমার সাইকেল-এ না উঠে ওর সাথে হাটতে বল্লো, ‘এতো ইচ্ছা থাকলে আমার সাথে হেটে চল্’! কালো মেঘ না হয়ে ঝুম বৃষ্টি হওয়ায় আমার দেহ-মন জুড়িয়ে গেলো! যদিও আমি কেন যেন খুব লজ্জা পেতাম, যেটা আমার চোখ-মুখ লাল হওয়ার মাধ্যমে ধরা খেত ওর কাছে! বেশ কিছুদিন এমন ঘটলো, আর আমি মনে মনে এমন দিনের জন্যই অপেক্ষা করতাম, প্রতিদিন!
এটা নিয়ে-যে খুব একটা কান্ড হবে এটা আগেই বুঝতে পেরেছিলাম! একদিন এক বড় ভাই আমাদের ক্লাসে এসে সবাইকে জানিয়ে গেলো, আর সবাই আমার সাইকেল-এর প্রশ্ংসায় পঞ্চমুখ হয়ে গেলো। আমার মেজাজটা যার-পর নাই খারাপ হলো, যদিও মনে-মনে ব্যাপক পুলোকিতো হলাম! তবুও আমাকে নিয়ে হাসা-হাসি’র একটা বিহিত করতে হবে, না-হলে মান-সম্মান নিয়ে সবার সামনে কিভাবে থাকবো এটা নিয়ে আমার ঘুম হারাম হওয়ার উপক্রম হলো!
সেদিন নাহিদকে ফয়সালের ব্যাপারে বল্লাম, ‘দ্যাখ দোস্ত, ফয়সাল তোর ব্যাপারে অনেক খারাপ কথা বলে বেড়াচ্ছে! তুই নাকি ওর বিরুদ্ধে টিচারদের কাছে কি-সব বলছিস’? আর তোকে চ্যালেঞ্জও করছে, তুই নাকি কিছুই করতে পারবি-না ওর!” একই কথা ফয়সাল, হাবিব, জাকির, রাজীব সবাইকে জানাতেই তুলকালাম বেধে গেলো! অবস্থা বেগতিক দেখে পরে সবাইকে খবর দিলাম, ‘ক্লাস টিচার স্মরণ করেছেন’, যথারিতী সবাই যেয়ে কাউকে না পেয়ে ফিরে আসলো! আমার কপালে শনির আছর দেখে আগেই বাসায় ফিরলাম! পরদিন সবাইকে চুইংগাম খাইয়ে দফা-রফা করলাম! টাকা-টা অবশ্য সবার কাছ থেকে শেয়ারে নিয়ে বল্লাম, ‘দ্যাখ তোদের সবারই উচিত মিলে-মেশে থাকা আর একে অপরের উপর বিশ্বাস রাখা’!
প্রতিদিন একটা গোলাপের কুড়ি নিয়ে আসতাম, অনিন্দিতাকে দেব বলে! পারি-নি কখোনো এই ভয়ে, যদি আমাকে খারাপ ভাবে! অন্য কাউকে দিয়ে খুশি থাকি! একটা লেখার প্যাড আর একটা কলম নিয়েও অনেক দিন ঘুরেছিলাম, তাও দিতে পারি-নি!
কিছুদিনের মধ্যে দেখলাম, ফয়সাল আমার সাথে খুব ভাব জমাতে চাইছে! বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হলো না, অনিন্দিতার জন্যই এই আদিখ্যেতা। অনিন্দিতার সাথে নাকি ও অনেক আগে থেকেই পরিচিত। তখন থেকেই ও অনিন্দিতাকে পছন্দ করে, আসলে তার চেয়েও বেশিকিছু! তাছাড়াও ওর বিশেষ পরিচয়, ও আমাদের ম্যাথ টিচার-এর একমাত্র ছেলে! আমাদের ম্যাথ টিচার হচ্ছেন, ঐ এলাকার প্রভাবশালী ব্যাক্তি। যা-হোক, ব্যাপারটা বুঝলেও চেপে গেলাম! আর রবিন-এর সাথে আমার একটু বেশি খাতির ছিলো, ছোটো-বেলার বন্ধু বলে। রবিন-কে সাথে নিয়েই ফয়সাল-এর ব্যাপারটা উপোভোগ করি, আর প্রায়ই ওর কাছ থেকে ক্যান্টিনের বিল উদ্ধার করি! যদিও এই উপোভোগ বেশিদিন স্থায়ী হলো না! ফয়সাল আমাকে কিভাবে যেন আপন করে নিলো! আমার পাশে-পাশে থাকতে লাগলো, ওর যে-কোনো সমস্যায় আমাকেই স্মরণ করতে লাগলো, আর কেমন যেন আমার ভৃত্যের মত আচরণ করতে লাগলো! এই যেমন ক্লাস শেষে আমার আমি প্রায়ই বই-খাতা, কলম ইত্যাদি ভুলে যেতাম, এখন ওই আমাকে মনে করিয়ে দেয়! আমাকে নিয়ে কেউ মজা করলে, ওই উত্তর দেয়! একদিন শুনলাম, নাহিদকে নাকি ফয়সাল মেরে নাক ফাটিয়ে দিয়েছে কারণ, নাহিদ আমাকে বলেছিলো ‘ছ্যাচড়া আর সুযোগ-সন্ধানী’!
ও খুব একটা ভালো ছাত্র না হওয়ায় ওর কিছু সুবিধাও হলো! আমি বাড়ীর কাজ করলাম কি-না তার নিয়মিতো খবরও সে রাখতো। ডিবেট-এ আমার টিমে থাকতো সবসময়। ওর বাড়ীর কাজ, ক্লাসের পড়া আমাকে প্রায়ই বুঝিয়ে দিতে হতো। যে-কোনো পরীক্ষার সময় ওর বাবা কায়দা করে আমার পাশেই আসনের ব্যাবস্থা করে দিলেন! আমি অবশ্য সবাইকেই হেল্প করতে করতাম।
ওদের বাড়ীতে ছাত্র/ছাত্রী, বন্ধু-বান্ধব কেউ-ই আমন্ত্রীতো ছিলো-না, আর ভুল করে কেউ ঢুকে পড়লেও কাউকে বসতে বলা হতো-না! সেখানে আমি রীতিমতো নিমন্ত্রীতো অতিথি হয়ে গেলাম, ওর ফ্যামিলিও আমাকে সাদরে গ্রহণ করলো তাদের সন্তানের পড়াশুনার কথা ভেবে!
ছাত্র হিসেবে মোটামুটি ভালো আর স্যারদের সাথে অতি ভদ্র আচরণ করাতে, টিচারগণ আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। যে-কোনো অনুষ্ঠান, শিক্ষা-সফর ইত্যাদিতে আমি ছাড়া আধুরা! এ বছরের পিকনিকে প্রশান্ত যাচ্ছে-না শুনে খুবই মন খারাপ হলো, পরে খবর নিয়ে জানতে পারলাম ওর ফ্যামিলির অবস্থা। যাই-হোক, ওকে কিছু না জানিয়ে সবার কাছ থেকে চাদা তুলে ও-কে জোর করে ধার হিসেবে দিলাম। ‘দোস্ত, তুই আসলেই খুব অন্য-রকম-রে’! আমি ও-কে জড়িয়ে ধরে বল্লাম, আমরা সবাই অন্য রকম বন্ধু!
কোনো এক সাধারণ ড্রেস-এর দিনে আমার মতো অনিন্দিতাও ইউনিফর্ম পরে আসলো, কাকতালীয়ভাবে তাও আবার অন্য সবার আগে আমরা কলেজে উপস্থিত হলাম! সাহস করে বেশ কিছু কথা বল্লাম ওর সাথে। ও-কে অনেক খুশি মনে হলো, অথবা ও-যে অনেক মজা পেল সেটা নিশ্চিত ভেবে আমার সারাটা দিন ফুরফুরে কাটলো! মনে মনে শুধু এটাই চাই, ‘এমনই যেন হয় প্রতিদিন, এমনই হওয়া উচিত প্রতিদিন’! মেজাজটা অতি খারাপ হতো, যখন দেখতাম অন্য সবাই ওর কাছে ফয়সালের জন্য উকালতি করতো, হাসিও পেতো প্রচন্ড!
ফয়সাল মাজারে এসেছে, অনিন্দিতার জন্য ও দোয়া করবে! আমাকেও বল্লো ওর সাথে দোয়া করতে! ‘দোস্ত, প্লিজ আমাদের জন্য একটু প্রাণ খুলে, খাস দিলে দোয়া করিস’!দু’জনে একসাথে দাড়ালাম, কিন্তু আমি পারলাম-না! মনে মনে ও-কে নিয়ে হেসে খুন হলাম আর আমার সুপ্ত বাসনা খোদাকে জানালাম! কাজটা ঠিক হয়নি ভেবে, মাদ্রাসার এক এতীমকে ১০০ টাকা দিয়ে এলাম। কিন্তু ফয়সালকে মনে হয় আমার চেয়ে দেখতে সুন্দর, তাছাড়া ও প্রভাবশালীর ছেলে! এই-যা সমস্যা!
‘আমি সবই পারি’ বলে একদিন ধরা খেতে হলো! ঈদের ছুটির আগের দিন ফয়সালের সাথে বাজী ধরলাম, অনিন্দিতা আমার সুপারিশে রাজী হবে! সেদিন মনে মনে চেয়েছিলাম, জীবনে আর কিছুতে জয়ী হলেও এটাতে যেন হেরে যাই!
অনিন্দিতা আমার কথা রাখেনি! আমার একটা মুখের কথায় সব কল্পনা আর স্বপ্নের অবসান ঘটিয়ে ও রাজী হয়ে গেলো! আমার কাছে ফয়সালের জন্য ফুল দিয়ে আমার ছোটো মনটাকে একেবারে ক্ষুদ্র বানিয়ে ফেল্লো। আমি শুধু বলেছিলাম, ‘ফয়সালকে বিশ্বাস কর, ওর উপর আস্থা রাখ। ও তোকে কষ্ট পেতে দেবে-না। অন্য সবাইকে দ্যাখ, কেউই স্থায়ী-না! কিন্তু ও তোকে কোনো অবস্থাতেই ছাড়েনি!’
বুঝলাম, আমার কথার অনেক শক্তি যা শুধু আমার জন্যই কাজে আসে-না!
টিফিন শেষে কলেজে এসে মনে হলো, ক্লাসে একটা অনুষ্ঠান চলছে, শুধু আমাকেই কেউ জানায়নি! ফয়সালকে অকৃতজ্ঞ বুঝেও কিছু বল্তে পারলাম না। অনিন্দিতাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুই এতোদিন চুপ করে থাকলি কেন’? ও আমাকে জানালো, ‘আগে কখোনো এভাবে ভেবে দেখি-নি’!
বাকি সারাদিন, সমস্ত ক্লাস কৃত্রিম হাসি নিয়ে শেষ করে বাসায় ফিরলাম।
মনে হয়, আমার কথাই বলা উচিত ছিলো!

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




