somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ধরণৗখলা

১৭ ই মে, ২০১৩ দুপুর ২:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মহিলার এক চোখ খোলা ছিলো। সোজা আকাশের দিকে। যেন গত রাতে যে সব তারা আকাশে অদৃশ্য ছিলো আজ সকালের মেঘলা প্রেক্ষাপটে সেগুলোর অস্তিত্ব সম্পর্কে তাকে কেউ নিশ্চিত করেছে। এখন শুধু দেখা বাকি। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে হবে। পলক ফেলা যাবে না। ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটানো যাবে না। ধৈর্য্যহারা হলেই লা পাত্তা হয়ে যাবে গতরাতেও লা পাত্তা থাকা ওইসব তারা। আবেদ আলী আরেকটু ঘনিষ্ট হলো মহিলার। মহিলার সাথে তার এখনো খানিকটা দূরত্ব আছে। গজখানেক হতে পারে। একটু হেরফেরও হতে পারে। হেরফের হলেও খুব বেশি হেরফের হবে না। দুই এক আঙুল বা এরকম কিছু। আবেদ আলীর দৃষ্টি মহিলার খোলা চোখের দিকে। বারকয়েক বন্ধ চোখটার দিকেও গেছে। তবে দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। বন্ধ চোখ দেখতে কার ভালো লাগে? সিনেমার নায়কের ভালো লাগতে পারে। রাজকন্যা নায়িকা ঘুমিয়ে আছে সোনার পালঙ্কে; পাশে আধশোয়া হয়ে নায়ক অপলকে দেখে যাচ্ছে ঘুমন্ত নায়িকার মুখ। তবে নায়িকার দিকে তাকিয়ে থাকা নায়কের চোখে যে মুগ্ধতা বা বিবশতা লেগে থাকে তার কোন রেশ নিজের ভেতর উপলব্ধি করতে পারে না আবেদ আলী, তারপরও সে তাকিয়ে থাকে মহিলার খোলা চোখটার দিকে, মাঝে মাঝে বন্ধ চোখটার দিকেও। সে আরেকটু এগিয়ে যায় এবং মহিলার পাশে বসে। এবার মহিলার সাথে তার দূরত্ব এক হাতেরও কম হবে। এবার সে আর দূরত্ব নিয়ে ভাবে না। অন্যসব মানুষের চেয়ে অনেক এগিয়ে সে যে মহিলার প্রায় দেহলগ্ন হয়ে বসে আছে এটা তার খেয়ালে থাকে না। হঠাৎ সে খেয়াল করে গত রাতের বৃষ্টিতে বেশ ভিজেছে মহিলা। সারারাতের বৃষ্টি মহিলার শরীরের উপর দিয়ে গেছে। আবেদ আলী চোখ বন্ধ করে। টের পেতে চেষ্টা করে বৃষ্টির ফোঁটা মুখে, বুকে, গোপনাঙ্গে এবং সারাশরীরে অবিরাম পড়তে থাকলে কীরকম লাগতে পারে। অনেকক্ষণ ধরে যদি পড়তে থাকে? সারারাত, না, আরেকটু কম হবে, ছয় সাত ঘণ্টা ধরে যদি একটানা পড়তেই থাকে, তাহলে কীরকম লাগতে পারে। ব্যথা কতটা তীব্র হতে পারে।

বেডিরে কেউ চিনছ নাহি? বাজখাই গলার স্বরটা আবেদ আলীর মনোযোগ খানিকটা নষ্ট করে দেয়। সে টের পায় তার ঠিক পেছনেই এসে দাঁড়িয়েছে মোতলেব মেম্বার। সে ঘাড় না ঘুরিয়েই বলে দিতে পারে, মোতলেব মেম্বার শাদা লুঙ্গির উপরে শাদা পাঞ্জাবী চাপিয়েছে। সকালে যেহেতু বৃষ্টি পরবর্তী হিমেল বাতাসের দাপট এখনো রয়ে গেছে তাই তার গায়ে একটা শালও থাকতে পারে। কালো সু জুতা। কালো মোজা। সাতসকালেও মুখে পান আছে। স্বপনের দোকানের পান। গত রাতে কিনে নেয়া ছিলো। একবার আবেদ আলীর ইচ্ছা হয় ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিতে অনুমান ঠিক আছে কি-না। আরেকবার ভাবে, থাকলেই কি, না থাকলেই বা কি। তারচেয়ে মহিলার দিকে তাকিয়ে থাকা ভালো। মহিলা চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। কেউ হয়তো দয়া বশত পুরোনো একটা কাপড় দিয়ে শরীর ঢেকে দিয়েছে। তবে মুখ খোলা। ভেজা চুল। বেশির ভাগই মাথার নিচে চাপা পড়েছে। পাতলা কয়েক গোছা কপালে লেগে আছে। বোঝা যায় গত রাতে বেশ ভিজেছে। এখন আর ভেজা নেই। কিন্তু কপালের সাথে, কপাল বেয়ে একটা গালের সাথে লেগে আছে। মনে হতে পারে আঠা দিয়ে কেউ চুলগুলো আটকে দিয়েছে। নড়াচড়ায় যাতে সরে না পড়ে। আবেদ আলী ভাবে আরেকটু কাছে যাবে নাকি? আরেকটু ভালো করে দেখার জন্য। কথা কছ না ক্যান? চিনছ নাহি বেডিরে কেউ? বেডি ত আছমান থাইক্যা পড়ছে না, কুনু জাগা থাইক্যা আইছে, কুনু জাগাত যাইতাছিল, কেউর বাড়িত্। তাইলে চিনছ না কেরে? মোতলেব মেম্বার কাউকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলে না। কারো চোখের দিকে তাকিয়েও কিছু বলে না। মহিলার লাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আপন মনেই যেন কথা বলতে থাকে। তার ডান হাতে পানের ডাঁটা। বাম হাত চলে গেছে গোঁফে। তা দিচ্ছে। আবেদ আলী ঘাড় ঘুরিয়ে দ্যাখে। আবেইদ্যা, বেডির অত কাছে গেছছ কেরে, চিনছছ নাহি? এবার সরাসরি আবেদ আলীর দিকে তাকিয়েই সে প্রশ্নটা করে। হ্যাঁ, সে আবেদ আলীকেই প্রশ্নটা করেছে। একটা উত্তরও নিশ্চয়ই প্রত্যাশা করছে। মোতলেব মেম্বার কথা বেশি বলে। তার গদির সামনে দিয়ে গেলেই ডাক দিয়ে অযথা কথা বলতে থাকে। কি যে বলে নিজেই জানে না। প্রশ্ন মাঝে মাঝে করে। উত্তরের জন্য তেমন অপেক্ষা করে না কারণ বিশেষ কাউকে লক্ষ্য করে সে প্রশ্ন করে না। কখনো যদি করে তাহলে দ্রুত উত্তর দেয়াই ভালো। যদি ক্ষেপে যায়, বিরক্ত হয়, রাগ হয় তাহলে ঘটনা খারাপের দিকে মোড় নেবে। গলা থেকে বেরুতে থাকবে অশ্রাব্য গালাগাল। যা নয় তা-ই অবলীলায় বলা হয়ে যাবে। আবেদ আলী টের পায় তার বুক ধ্বস ধ্বস করছে। অজানা ভয়ে বুকের ভেতরে, পেটের ভেতরে সবকিছু কেমন যেন কুঁকড়ে আসছে। সমবেত জনসাধারণের দিকে সে তাকায়। খুঁজতে চেষ্টা করে তার দিকে তাকিয়ে থাকা গোটা পঞ্চাশেক লোকের কারো চোখে সন্দেহ আছে কি-না। সবার দিকে তাকিয়ে সে বলে, না মিয়াছাব, চিনতারি না।

আবেদ আলী কম কথার লোক। সবাই জানে। আবেদ আলীর দোকানে যারা যায়, তাকে নিয়ে যারা গল্প করে, তার আকাক্সক্ষাহীনতা সম্পর্কে যারা জানে তারা নিশ্চিত ভাবেই বলতে পারে, আবেদ আলী কম কথার লোক। দুইটা প্রশ্ন করলে একটার উত্তর দ্যায়। তাও মাঝে মাঝে দ্যায় না। কেউ কেউ ভাবে, কানে কম শোনে আবেদ আলী। কেউ বলে ভাবুক মানুষ, ভাবের জগতে থাকে। রহস্য একটা আছে আবেদ আলীর। সবার ধারণা এমনটাই। তবে কেউ বলতে পারে না, কি সেই রহস্য। তার চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, আবেদ আলী নেই। নেই মানে সে যে মারা গেছে, এমনটা না। বাস্তবতায় সবসময় সে থাকে না। অন্য কিছু ভাবতে থাকে। তাই বলে কাজে কর্মে তার ভুল হয় না। কেউ যদি তার কাছে এক কেজি চাল চায় সে এক কেজি চালই দেবে। বেশি দেবে না। কমও দেবে না। একারণেই তার দোকানে খদ্দেরের সংখ্যা বেশি। তারা জানে আবেদের দোকানে পচা জিনিস নাই। গান্ধা জিনিস নাই। এক কেজির জায়গায় নয়শ পঞ্চাশ গ্রাম পাওয়ার সম্ভাবনা নাই। মোতালেব মেম্বারের যাবতীয় শুকনা খাবার আবেদের দোকান থেকেই কেনা হয়। মাসে এক বা দুই দিন বাড়ির কামলারা আসে। চাহিদা অনুসারে মালপত্র নিয়ে যায়। কামলাদের সাথে মোতালেব মেম্বার নিজেও থাকে। মালপত্র বুঝে পাওয়া শেষ হলে টাকা গুনে দ্যায় নিজের হাতে। এইসব কারণে আবেদের দোকানে মানুষ আসে বেশি। ভরসা রাখে বেশি। তার দোকানের একেবারে সমস্যাও যে নাই এটা বলা যায় না। সমস্যা একটা আছে। সে কাউকে বাকিতে দেয় না। যত কাছের লোকই হোক, যেই হোক, বাকি আবেদ আলী দেবে না। সবার আগে তার দোকানের ঝাঁপ খোলে, সবার পরে বন্ধ হয়। বাজারের আশপাশের সুস্থ মানুষ সাধারণত যতক্ষণ সজাগ থাকে আবেদ আলীর দোকানও প্রায় ততক্ষণ খোলা থাকে। ফলে যে কোন দরকারে তার দোকানে আসা যায়। যখন তখন। অসময়ে অবশ্য খুব বেশি খদ্দের আসে না। সময়েই আসে। মাঝে মাঝে দুই একজন বিপদে পড়ে আসে। নেহাৎ জরুরী জিনিস। আগে নিতে মনে নাই। এখন তো নিতেই হবে। যেমন রেইনকোট(!)। আরেকটা বিষয় হলো আবেদ আলীর দোকানে কখনো আড্ডা বা মজমা বসে না। গঞ্জের বাজারে যেরকম দেখা যায়, লোকজন অহেতু বিভিন্ন দোকানে বসে অলস সময় পার করে। আড্ডা দ্যায়। ফালতু কথা বলে। আবেদ আলী কাউকে সেরকম প্রশ্রয় না দেয়ায় তার দোকানে অকারণে কেউ আসে না। কাজের সময় কাজ, না হলে ভাবন ক্রিয়া। সম্ভবত এটাই হলো আবেদ আলীর নীতি। হয়তো এসব জানার কারণেই লোকজন আবেদ আলীর দিকে খুব বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকে না। পরবর্তী কর্ম নির্ধারণের বিষয়ে পরষ্পর কথা বলতে শুরু করে। ভীড়ের জটলায় এমনটা হয়। তার উপর ভীড়টা যদি হয় কোন অজ্ঞাত মহিলার লাশ দেখতে গঞ্জের মানুষের। প্রত্যেকের ভেতর থেকেই একটা করে গোয়ান্দা উঁকি দিতে থাকে। খুনের প্রেক্ষাপট রচনা করতে থাকে। একের পর এক ক্লু সাজাতে থাকে। খুঁজে পেতে চেষ্টা করে খুনীকে অথবা খুনীদেরকে। আর এখানে তো কেবল খুন নয়। মহিলার লাশ দেখেই বোঝা যায় তাকে যথেষ্ট নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। জটলার মাঝে অনেকেই মৃত মহিলার দিকে সমব্যথার চোখে তাকায়। সবচেয়ে বেশি সমব্যথা বোধহয় আক্রান্ত করে আবেদ আলীকেই।

না মিয়াছাব, চিনতারি না বলে আবেদ আলী আবার মহিলার দিকে মনোযোগ দিতে প্রয়াসী হয়। সে বোধ করে যতটা মনোযোগী সে কিছুক্ষণ আগেও ছিল এখন আর ততটা মনোযোগ দিতে পারছে না। বিভিন্ন আবেগ কাবু করে ফেলছে। ভয়, গ্লানি। দায়। একটা দীর্ঘশ্বাস মুখ দিয়ে বেড়িয়ে আসে। যেন দীর্ঘ বাতাসের দলার মধ্যে নিজের ভেতরে লুকিয়ে থাকা যাবতীয় দায়, গ্লানি, ভয় আর অস্থিরতাকে বিসর্জন দিতে চেষ্টা করে। আরেকবার সে জটলার দিকে মুখ ঘুরিয়ে আনে। এখন লোকের সংখ্যা আরো বেড়ে গেছে। সমানে লোক আসতে শুরু করেছে। আবেদ আলীর ভয় হয় সে একটা মৌচাকের ঠিক মাঝখানে বসে আছে নাকি? আশেপাশে যারা ভীড় রচনা করে চলেছে তারা কি আসলেই মানুষ, নাকি মানুষের ছদ্মবেশ ধরে আসা মৌমাছি? রাণী মৌমাছির লাশ দেখতে, শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসেছে। মৌচাক থেকে যেমন একটা গুনগুন আওয়াজ হয়, অনেকটা সেরকম আওয়াজই যেন হচ্ছে চারপাশে। গুন গুন। সবাই কথা বলছে। আবেদ আলী স্পষ্ট বুঝতে পারে। কারো কথাই তেমন শোনা যাচ্ছে না। সবার কথা শোনা যাচ্ছে। ফলে কে কী বলছে তা বুঝতে হলে ঠিক বক্তার মুখের কাছে কান নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় আছে বলে বোধ হচ্ছে না আবেদ আলীর। তারপরও সে কান খাড়া করে দ্যায়। শুনতে চেষ্টা করে লোকজন বিচ্ছিন্নভাবে কী বলাবলি করছে। কারো মুখ থেকে নিজের নাম উচ্চারিত হচ্ছে কি না শুনতে চেষ্টা করে আবেদ আলী। আসলে ততটা মনোযোগ দিয়ে চেষ্টাও করে না। তার বোধ হতে থাকে পেটের ভেতর বেশ ভারি কী একটা বস্তু ক্রমশ দানাদার হয়ে উঠছে। এক বেলার খাবার যদি হজম না হয় তাহলে তার মাঝে মাঝে এমন হয়। খাবার অনেক সময় নিয়ে হজম হয়। হজম হওয়ার আগে যতক্ষণ সময় লাগে ততক্ষণ পেটে এই অস্বত্বির ভাবটা মোচড়াতে থাকে। কিন্তু সেটাতো বদহজম হলে। খাবার হজম না হলে। সকালে সে কিছু খায়নি। দৈবকের দোকান খোলেনি। তাহলে পেটের ভেতরে যে আবর্জনা দানা বাঁধছে বলে তার বোধ হচ্ছে তা আসলে কি? ভয়? মরা বেডির গাত আত দিছছ কেরে? বেডি দেকছছ না আগে কুনু দিন? সর শয়তানের বাইচ্চা। সর। কেউ পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠল। আবেদ আলীর খেয়াল হলো তার বাম হাতটা মৃত মহিলার বাম হাতে লেগে আছে। সে নিজেই কি অজান্তে মৃত মহিলাটির বাম হাতটা ধরে রেখেছে? কোন গভীর আত্মীয়তা বশত? অবশ্য ঠিক ধরে থাকা বলা যায় না এটাকে। লেগে থাকা বলা যেতে পারে। আবেদ আলীর খেয়াল হলো মরা বেডির গাত তার নিজের হাতটাই লেগে আছে। এটাই হয়তো খেয়াল করেছে সমবেত দর্শকম-লীর কেউ। তার হাতের উপরে আরোপ করেছে পৌরুষ, আর মৃত মহিলার হাতে নারীত্ব। হয়তো সম্পর্কটাকে আরো গাঢ় হতে দিতে চায় না সে। তাই চিৎকার করে সবাইকে জানিয়ে দিল সে কি দেখেছে এবং কাকে দেখেছে। আবেদ আলী তার হাতটা ধীরে ধীরে সরিয়ে নিল। খানিকক্ষণ সময় আরো তাকিয়ে থাকলো মহিলার দিকে। তারপর উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে গেল দর্শকসারির দিকে। এখন কেবল জনসাধারণ নয়। পুলিশও এসেছে। দারোগার জিপ থেকে মোটামত এক ভদ্রলোক নেমে এলো। ডান হাতে লাঠি। বাম হাতে মাথায় ব্যবহারের টুপি। একবার সবার দিকে তাকিয়ে সোজা চলে গেল মৃত মহিলার দিকে। মহিলার বাম হাতটা সাদা কাপড়ের বাইরে ছিলো। হাতটার দিকে খুব মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে থাকলো দারোগা। হয়তো সেও কোন ক্লুর সন্ধান করছে। কিংবা কে বলতে পারে পেয়েই গেছে কিনা। আবেদ আলীর বাম হাতটা তো অনেকক্ষণ মহিলার বাম হাতে লেগে ছিলো। যদিও সচেতনভাবে না তবু সে কি কোন ক্লু পেতে পারতো না? দারোগা নেমেই হয়তো যে ক্লুটা পেয়ে গেলো সেই ক্লুটা কি পেতে পারতো না এতক্ষণ ঘনিষ্টভাবে বসে থেকেও? দারোগা আশেপাশে আরেকবার তাকালো। অভিজ্ঞ চোখে আরেকবার দেখে নিলো চারপাশের মানুষগুলোর চেহারা। কার চোখে কি খেলা করছে। কাকে কী জিজ্ঞেস করা যায়? লম্বামতো একটা লোক দারোগার কাছাকাছি ছিলো। হালকা পাতলা গড়ন। তাকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলো দারোগা। পুলিশের উপস্থিতির বিষয়টা ততক্ষণে সমবেত সকলের মাঝেই কমবেশি সংক্রমিত হয়ে গেছে। যারা অবলীলায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা বলছিলো তারা এখন কিছুটা সামলে নিয়েছে। কথা বলছে না বললেই চলে। বললেও মেপে। যেভাবে আবেদ আলী চাল মাপে। খুব হুঁশিয়ার। কে জানে মুখ থেকে কখন কোন কথাটা ফসকে যায়। দারোগার কানে গিয়ে লাগে। লম্বা লোকটা একটু ঘাবড়ে গেলো। এমনটার জন্য সে প্রস্তুত ছিলো না। আরো অনেক লোক তো আছে। শ দুই এক হতেই পারে। এতগুলো লোকের মাঝে তাকেই কেন চোখে পড়লো দারোগার তা সে সহসাই বুঝে উঠতে পারে না। আবেদ আলী স্পষ্ট দেখলো লোকটার কালো মুখের চামড়া ইষৎ সাদা হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ সে কিছুই করলো না। গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকলো। যেন ভেবে পাচ্ছে না কী করবে। দারোগার দিকে এগিয়ে যাবে? নাকি ভীড় ঠেলে পেছনের জটলার মধ্য দিয়ে কোনভাবে পথ করে নিয়ে দৌড় দেবে। আবেদ আলী লোকটাকে চেনে। যদিও খুব ভালো চেনে একথা বলা যাবে না। নামটা ঠিক মনে পড়ছে না। দুলাল বা নন্দ কি যেন। অবশেষে সে এগিয়ে এলো দারোগার ডাকে। খুব ভদ্র বিনয়ী একটা ভাব করে গুটিসুটি মেরে দারোগার সাথে নিরাপদ দূরত্ব রেখে দাঁড়ালো।

কী নাম? দারোগা জিজ্ঞেস করলো। প্রশ্নটা করার সময় পর্যন্ত দারোগার চোখ ছিলো লোকটার চোখের দিকে। তবে প্রশ্নটা করেই সে চোখ সরিয়ে নিলো।

জ্বী, দুলাল। আমার নাম দুলাল। আবেদ আলীর ধারণা ঠিক প্রমাণিত হলো। লোকটার নাম দুলালই হবে। বাজারের পাশে যে বড় পুকুরটা আছে সেটার পেছনে উড়িয়া পট্টিতে থাকে। উড়িয়াই হবে। বাজারে কুলির কাজ করে। এটুকুই আবেদ আলী জানে। এর চেয়ে বেশি কিছু জানলেও এই মুহূর্তে তার মনে পড়ে না লোকটা সম্পর্কে সে আর কী জানে। এমন কোন কারণ কি আছে যে কারণে লোকটাকে সন্দেহ করা যায়?

রাতে কোথায় ছিলি? এই প্রশ্নটা যদি আবেদ আলীকেই করা হতো তাহলে সে কী করতো? কী উত্তর দিতো? আবেদ আলী অনুমান করতে চেষ্টা করে। তার মাথা যেন হঠাতই কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। এই প্রশ্নের জবাব সে কীভাবে দিতো তা অনুমান করতে পারছে না। যে কোন কথাই তার মুখ থেকে বের হয়ে যেতে পারতো। এমনকি বেফাঁস কথাও। সে হঠাৎ ভাবতে আরম্ভ করে সত্যি কথাটাই বলে দেয়া উচিৎ হতো?

জ্বী, বাড়িত আছলাম ছার। ঘুমাইতাছলাম। আসলেই সে কি বাড়িতে ছিলো কিনা সেটা একটু জেরা করলেই দারোগা বুঝে ফেলতে পারে। জেরারও প্রয়োজন নাই। জোরে একটা হাট মারলেই চলবে। মনতোষ মেথরের বাড়িতে দাওয়ায় বসে অর্ধেক রাত পর্যন্ত সে হয়তো বাংলা মদ পেটে চালান করেছে। পকেটে টাকা থাকলে হয়তো দুই তিন দান জুয়ায়ও হাত লাগিয়েছে। আবেদ আলী ভাবে, দুলাল খারাপ কাজেই ব্যস্ত ছিলো। কিন্তু তার সেই খারাপ কাজের সাথে একটা একলা নিঃসহায় মহিলাকে ধর্ষণের পর হত্যা করার কোন যোগ নেই। এখন যেহেতু মনতোষের পাগলা পানি অথবা জুয়ার আসর ভাঙতে এই সাত সকালের মৌজের ঘুম ছেড়ে দারোগা উঠে আসেনি, তাই সে আর লম্বা লোকটা অর্থাৎ দুলালকে আর ঘাঁটায় না। কাবাবের মধ্যে হাড্ডি ডেকে এনে লাভ নেই। তাতে মূল কাজে বাগড়া পড়বে। এখন এমন একটা বাগড়া সে আশা করে না। যদি দরকার হয় পরে দেখা যাবে।

যা বাড়িতে চলে যা। এখানে কি সিনেমা দেখানো হচ্ছে? এতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভাগ।

অকস্মাৎ যেন দুলালের সাধনায় সিদ্ধিলাভ হয়ে গেল। তার মুখে রক্ত আবার ফিরে এলো। কৃতজ্ঞতায় তার সারাটা শরীর দারোগার দিকে খানিকটা ঝুঁকে এলো। তারপর ত্বরিত গতিতে সোজা হয়ে ভীড়ের ভেতর দিয়ে পথ করে নিয়ে একরকম ছুটে বেরিয়ে গেল। আবেদ আলী অনুমান করতে পারে দুলাল এখনই বাড়িতে যাবে না। খানিকটা সময় বিশ্রাম নেবে। কোন গাছের নিচে নিতে পারে। কোন গুদামের বারান্দায় নিতে পারে। তবে যেখানেই সে বিশ্রাম নিক আশেপাশে আর থাকবে না। দূরে চলে যাবে। অন্তত যতটা দূরে গেলে দারোগার কঠিন মুখ, দৃঢ় চোয়াল আর অন্তর্ভেদী চোখ তাকে তাড়া করে বেড়াবে না। আবেদ আলী দেখলো দুলাল চলে গেল। তার চলে যাওয়া সমবেত জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিলো একটা নীরব আতঙ্ক। আস্তে আস্তে সরে পড়ায় ধান্ধায় পড়ে গেল অনেকেই। আবেদ আলী একবার মোতালেব মেম্বারের দিকে তাকালো। আরেকবার সমবেত জনসাধারণের দিকে। লোকজনের চোখ এখন অনেকটা উদাসী। খানিক আগেও তারা যতটা সম্পৃক্ত ছিলো মৃত মহিলার সাথে, এখন আর ততটা নেই। একটা ভয় তাদের বিবশ করে দিয়েছে। প্রায় সকলকেই। এমনকি মোতালেব মেম্বারকেও। ঘটনাস্থলে পুলিশ আসা মাত্রই সে তার সিনা সামান্য টান করার চেষ্টা করেছিলো। হাজার হলেও সে মেম্বার। পুলিশ দেখে তার ভয় পাওয়ার কি আছে? পুলিশ তো আর ভিন্ন গ্রহের কোন প্রাণি না। ভূত না প্রেতাত্মা না। তাহলে সে কুঁকড়ে থাকবে কেন? সে টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। সিনা টান রাখবে যেন কয়েকজন চেষ্টা করলেও তার মেরুদ- বাঁকা না করতে পারে। আবেদ আলী দেখলো মহিলার লাশ থেকে মেম্বার সাহেব আস্তে আস্তে অনেকটাই পিছিয়ে গেছে এবং ভীড়ের সাথেই মিশে গেছে। এতক্ষণ ধরে সে নিজেকে নির্ভীক, টান টান প্রমাণ করার চেষ্টা করলেও নিজের অজান্তেই যেন সেই প্রমাণ করার খেলায় হেরে গেছে। হেরে গেছে আবেদ আলী নিজেও। মহিলার লাশ ওঠানোর দৃশ্য দেখার মতো মনের জোর সে হারিয়ে ফেললো। ধীরে ধীরে পিছিয়ে যেতে লাগলো।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×