somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিরহযাপন থেকে উঠে আসা কুসুমের কথামালা

০৬ ই মার্চ, ২০১৪ বিকাল ৫:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কবি শতাব্দী কাদের- এর কাব্যগ্রন্থ বিরহযাপন প্রকাশিত হয়েছিলো ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে, ঐতিহ্য প্রকাশনী থেকে, প্রচ্ছদ করেছিলেন ধ্রুব এষ। গ্রন্থে মোট কবিতা ছিলো আটটি। মূল্যের কথায় যাবো না। কবিতা অমূল্য। পয়সা দিয়ে কেনা যায় না।

কবি শতাব্দী কাদের নব্বই দশকের একজন কবি। ময়মনসিংহে নব্বই দশকের শুরুর দিকে তাদের যুথবদ্ধ উদ্দাম কবিতাচর্চা আরম্ভ হয়। আমরা তখনো ইমেচিওয়র। কবিতাও লিখতে আসিনি। যখন এলাম, ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা থেকে চলে এলাম ময়মনসিংহে, তখনই তাদের কথা শোনা হলো। কার কাছে? ওই ভাবে ঠিক কারো কাছে নয়। এর তার কাছে। কবিতাসংশ্লিষ্ট এবং চর্চায় জড়িত সবার কাছে। সবাই বলতো নব্বইয়ের শুরুর দিকে যে ফ্লো ময়মনসিংহের কাব্যাঙ্গনে এসেছিলো সেটা আর আসবে না। এমন মন্তব্য শোনার পর খারাপ লাগার কথা। আমারও লাগতো। কেন ভাই, আমাদের মাঝে কম কী আছে? আমরা কি কবিতা লিখতে আসিনি? আমরা কি সাহিত্য কারো চেয়ে কম পড়ি? আমাদের কি গ্রুপ নেই? ইত্যাদি নানা কথা মাথায় আসতো। এরও কারণ আছে। সেই সময়টা আসলে আমাদেরও শুরুর সময় ছিলো। কেবল কবিতার গন্ধ পেয়েছি। গন্ধ শুঁকে শুঁকে এগুচ্ছি। প্রকৃতঅর্থে পরিপক্কতা আসেনি। কিন্তু সেই সময়টায় আমাদের এমন মনে হতো না। মনে হতো, সাহিত্যে পড়ি, সাহিত্য করি- কার চেয়ে কম জানি আমরা! বয়স, সময় মানুষকে কীভাবে বদলে দেয়, কতটা বিবর্তিত করে দেয় তা আমাদের জানা ছিলো না। এখন জানি। সময় সবচেয়ে বড় শর্ত। সময়ের প্রবাহে কত গভীর সম্পর্কই ভেঙে যায়। গজিয়ে ওঠে নতুন সম্পর্ক। এ প্রসঙ্গে উৎপল কুমার বসু’র কয়েকটা কথা স্মরণযোগ্য। উৎপলকুমার বসু’র কবিতা সংগ্রহের ভূমিকায় লেখা ছিলো। “কমবেশি চল্লিশ বছর গত হতে চললোÑ সেই প্রথম কবিতা ছাপা হওয়ার পর। ততদিনে কত-না বন্ধুত্ব হারিয়ে ফেলেছি। কত প্রেম পর্যুদস্ত হল। হাসি-তামাশায় ভোর হয়ে গেল। কত রাত্রি। এখন শুধু শব্দের সম্মোহন। এর উল্টোটাও তো হতে পারত।”

হ্যাঁ, তা তো পারতোই। শূন্য দশকে আমরা যারা ময়মনসিংহ থেকে কবিতা লিখতে শুরু করেছিলাম, তাদেরও কিছু কিছু কথা এখনকার নতুন কবিদের মাঝে শোনা যায়। তবে এটা ততটা প্রকট নয়। যতটা প্রকট ছিলো নব্বই দশকের বেলায়। আমি অনেককেই বলতে শুনেছি, নব্বইয়ের কবিতার মূল ফ্লো এসেছিলো ময়মনসিংহ থেকে। একটা নির্দিষ্ট নদীর পাড় থেকে যে জলপ্রবাহের এতো আওয়াজ হয় তা আমরা বুঝেছি বহু পরে।

কবি শতাব্দী কাদের সেই উদ্দাম তরুণদের একজন। তার কোন কাব্যগ্রন্থ আমার হাতে ছিলো না। সম্প্রতি কবির নিজের বদান্যতায় গ্রন্থটি হাতে পেলাম। পাঠ করলাম। এই পাঠের অনুভূতি শেয়ার করার জন্যই এই লেখা। এটা কোন ট্র্যাডিশনাল আলোচনা হয়, কবিতা বিশ্লেষণ নয়। এই লেখায় কোন লেখক নয়, পাঠক উঠে আসুক- এমনটাই আমার প্রত্যাশা।

০১.

অসহায় বাংলাদেশ অনাবাদি একচিলতে উর্বর জমিন।
(উলঙ্গ পোস্টকার্ড/ বিরহযাপন)
মোদ্দা কথা, এখন আমি বীর্যবান এক অচল পুরুষ
(ঐ)
ইতিমধ্যে আমরা পলিথিন-ঘুড়ি উড়াতে শিখেছি...
(ঐ)
আকাশে দেখছি মেঘ
গাধার মতো প্রশ্ন করো না রোদ চাচ্ছি কি না!
(ঐ)
রোদের কবলে পড়ে অন্ধকার আমাদের প্রিয় হয়ে ওঠে...
(ঐ)

একজন কবির মনোজগত তো আর পরিপার্শ্বরহিত কিছু নয়। কবি তার লেখার সমস্ত উপকরণই আশপাশের জগত থেকে সংগ্রহ করে নেন; এই পরিবেশ কেবল ইন্দ্রিয়জাত, অনুভূতিলব্ধ জগত নয়। এখানে অভিজ্ঞতা, পাঠ, পর্যবেক্ষণ সমস্তই এক হয়ে যায়। একটি দিনের সাথে দ্বন্দ্বে নেমে পড়ে আরেকটি দিন। অতীতের সাথে বর্তমান। বা বর্তমানের সাথে অতীত। এ সমস্তই আমরা জানি। তাই কবিকে যখন বলতে শুনি, ইতিমধ্যে আমরা পলিথিন-ঘুড়ি উড়াতে শিখেছি, তখন আমাদের মনেও প্রশ্ন জাগে শেষ কবে আমরা কাগজের ঘুড়ি উড়িয়েছিলাম, কবে প্রথমবার উড়িয়েছিলাম পলিথিনের ঘুড়ি। আসলে পলিথিনের ঘুড়ির ছদ্মবেশ নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয় অতীত, এবং সেই অতীতকে সরিয়ে দিতে অথবা সুকৌশলে সড়িয়ে দিতে উড়ে আসা বর্তমান। কাগজের ঘুড়ি যতটা সহজলভ্য এবং টেকসই, পলিথিনের ঘুড়ি তারচেয়ে অনেক বেশি। তবে কাগজ এবং পলিথিন এক কথা নয়। কাগজের সাথে আমরা সহজেই মেলাতে পারি অতীতের সহজাত, প্রাকৃতিক পরিম-লকে; যেমন পলিথিনের সাথে, পলিমার কার্বনের সাথে সহজেই মেলানো যায় ক্রমশ জটিল হয়ে আমাদের মনোজগতের চারপাশে বিষাক্ত ধোঁয়ার মতো নৃত্য করতে থাকা কৃত্রিমতাকে। তাহলে আমরা বেশ বুঝতে পারি, পলিথিনের ঘুড়ি আসলে কোন পলিথিনের ঘুড়ি নয়। এখানে এটা যেন একটা চলমান, উড়ন্ত প্রতীক যার বিস্তৃত ছায়ায় বর্তমানের উপযোগবাদী, কৃত্রিম, যান্ত্রিক সবকিছু এক হয়ে মিশে যেতে পারে। এবং কাগজের ঘুড়ি (যদিও কাগজের ঘুড়ির কথা স্পষ্ট বলা নেই) নিয়ে আসে ঐতিহ্যের প্রেক্ষাপট। আমরা কি কিছুটা বিমূঢ় হয়ে যাই না! এখানেই আমরা ধরতে পারি একটি মাত্র প্রতীকের ব্যবহারের মাধ্যমেও দুই বা ততোধিক প্রতীক উঠে আসতে পারে। অন্তত একটি সংযুক্ত প্রতীক। যদিও এমনটা সচরাচর দেখা যায় না। উলঙ্গ পোস্টকার্ড কবিতায় আমরা এমন কিছু টেকনিক পাই। এই টেকনিকগুলোকে সম্পূর্ণ নতুন বলে হয়তো দাবি করা যাবে না। তবে প্রচলিতও বলা যাবে না। যেমন এই কবিতাতেই আমরা কবিকে বলতে শুনি, রোদের কবলে পড়ে অন্ধকার আমাদের প্রিয় হয়ে ওঠে। কে পড়ে থাকে রোদের কবলে, কারা? উত্তর তো সহজ। কবি নিজে। তিনি হয়তো সেখানেই ডুবে আছেন, রৌদ্র কবলিত মাঠে। অথবা রোদের জলসায়। এবং এইভাবে থাকতে থাকতে একদিন তিনি হয়তো রোদকে আর ভালোবাসতে পারেন না। তার মন হয়তো বিপরীত কোন কিছুর দিকে ধাবিত হতে চায়। রোদের বিপরীতে কেবল অন্ধকার থাকতে পারে। তাই তার মন খুঁজে নিতে চায় অন্ধকার। আমি আগেই বলে নিয়েছি, কবি সমাজ বিচ্যুত, বিচ্ছিন্ন কোন জীব নন। তিনি তার মনোজগতের যে প্রকাশনা কবিতায় রচনা করেন তা তার ব্যক্তিক নয়। এই মনোজগতের সীমানা বহুদূর প্রসারিত। বাসিন্দাও অনেক। বাকিরা হয়তো কবি নন। তাই নিজের কথাগুলো এভাবে বলে বোঝাতে পারেন না। বেছে নিতে পারেন না বিরল টেকনিক।

কিছুক্ষণ আগেই আমরা শুনেছিলাম, পলিথিনের ঘুড়ির কথা, এবার আমরা শুনলাম অন্ধকারের প্রিয় হয়ে উঠবার কাহিনি। পলিথিনের ঘুড়ির আগে ছিলো কাগজের ঘুড়ি, আর অন্ধকার আমাদের প্রিয় হয়ে উঠবার আগে আমরা ছিলাম রৌদ্রের কবলে। আমরা কি কাগজের ঘুড়ির সাথে রোদ; এবং পলিথিনের ঘুড়ির সাথে অন্ধকারের প্রিয় হয়ে উঠবার কাহিনিকে মেলাতে পারি না। যদি এমনটাই হয় তাহলে তো এই যোগসূত্র থেকে বোঝা যায় এভাবেই আমাদের ভেতরের সারল্য সরে যাচ্ছে জটিলতার দিকে। কেন? কেননা আমরা সারল্যের ভেতরে থাকতে থাকতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম। আর আমাদের এই অতিষ্ঠ হয়ে উঠবার সুযোগে কেউ যেন ঠেলে দিলো পলিথিনের ঘুড়ি, কেউ যেন ঠেলে দিলো নতুন অন্ধকার।

এখানে একেকজন একেক মতে, একেক পথে ভাবতে শুরু করবেন। কেউ দোষ দেবেন পুঁজিবাদকে, সা¤্রাজ্যবাদকে; কেউ দেবেন মানবিকতাকে প্রতিস্থাপিত করে দেয়া পণ্যবাদকে। যে যেভাবেই দেখুক, কবি তার চোখে যা দেখেছেন তা কোন উজ্জ্বল সম্ভাবনা নয়। এখানে বলে রাখা ভালো উদ্ধৃত পংক্তিগুলো একই কবিতার এবং ক্রমান্বয়িক। কেউ যদি কবিতাটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করতে থাকেন তাহলে তিনি ক্রমান্বয়ে প্রথম থেকে শেষ উদ্ধৃত পংক্তির সন্ধান পাবেন। অন্যান্য কবিতায় আমরা যেমন দেখে থাকি, কবিতার মেইন ট্রেন্ডটা কারণ থেকে কার্যের দিকে যায়। কিন্তু এই কবিতায় কবি কার্য থেকে কারণের দিকে গেছেন এবং প্রথম দুটো উদ্ধৃত পংক্তির মধ্যে আসলে কার্যোত্তীর্ণ অবস্থার কথা বলা আছে। হ্যাঁ, এই সব উদ্ধৃত পংক্তির মাঝে আরো অনেক পংক্তি আছে। অনেক কথা আছে। তবে মেইন আইডিয়াটি ক্যাঙ্গারুর মতো লাফে লাফে এগিয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। যারা বলে থাকেন কবিতায় কোন ইউনিটি থাকে না, বেসিক ট্রেন্ড থাকে না; তাদের বলতে চাই ইউনিটি বা বেসিক ট্রেন্ডকে ধারণ করার মতো সামর্থ্য না থাকলে এগুলো না থাকতেই পারে। তবে সামর্থ্য থাকলে ইউনিটি বা বেসিক ট্রেন্ডকে ধারণ করা সম্ভব। প্রকৃতপক্ষে এভাবেই কবির আইডিয়ার সাথে সংযুক্ত হয় টেকনিক এবং এই দুয়ের সমন্বয়ে রচিত হয় কবিতা।

০২.
তুমি ছিলে শুধু ধূধূ মরুভূমি
আমি তো বুঝেছি নদী.....
(বিরহযাপন)

যে হাতে তোমাকে ছুঁই সে হাতে ঈশ্বরও সেবী না
যে হাত তোমাকে ছোঁয় সে হাত কখনও দেবী না।
(ঐ)
চাঁদ, তুমি ভাওয়ালের চিত্রল হরিণ...
(ঐ)
যাপিত জীবন থেকে ঝরে যাবে সুবর্ণ অতীত
(ঐ)
অনুভবের সুতায় তখন কালো বরফের মতো জমে ওঠে রাত।
(ঐ)
ভোরবেলা তুমি এসে ভাঙছো না শিশিরের ঘুম
সারারাত মদ গিলে গিলে
সারারাত জল ঢেলে ঢেলে
সকল শুশ্রƒষা দিয়ে ফুটিয়েছি কবিতাকুসুম।
(ঐ)
নাম কবিতাটির কয়েকটি পংক্তির সাহায্য নিলাম। এটা বলা যাবে না, কবিতার একপাক্ষিক কোন ব্যাখ্যা হতে পারে। চূড়ান্ত কোন ব্যাখ্যা হতে পারে। আমার এক শিক্ষক বলতেন, বাচ্চাদের যে ব্যাখ্যা পড়ানো হয় বাংলা গ্রন্থে, তা কেন জানিস? আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি, বাঘের ছবি দেখলে লাফিয়ে উঠি, বাঘের লাল ঠোঁটে লেগে থাকা হরিণের রক্তের দাগের মধ্যে খুঁজে পেতে চেষ্টা করি অদম্য পৌরুষের ছাপ; আমার তখনো শেখা হয়নি, সেই রক্তের দাগেই আসলে রচিত হয়ে গেছে একটি প্রাকৃতিক হত্যাকা- ও হত্যার ইতিবৃত্ত। আমি জানতাম না। শিক্ষক বলেছিলেন, ব্যাখ্যা লেখতে লেখতে, করতে করতে বাচ্চাদের ভেতরে বেড়ে ওঠে যৌক্তিক শেকল তৈরি করার ক্ষমতা, পৃথিবীর সমস্তই যে আসলে রূপক- তা ব্যাখ্যা না পড়লে, ব্যাখ্যা না করলে জানা যায় না। আমি অবশ্য সেই পাঠ্যক্রমভুক কোন ব্যাখ্যেয় অংশের আলোচনা করতে যাচ্ছি না। চাইছিও না।

বিরহযাপন কবিতাটি নামের মধ্যে দিয়েই নিজেকে স্পষ্ট করে তোলে। বিরহযাপন মানে বিরহকে যাপন। কিন্তু ক্রমান্বয়ে উপর্যুক্ত উদ্ধৃতিগুলো পড়তে পড়তে যদি শেষ পংক্তির কাছে আসা যায় তাহলে মনে হতেই পারে, এই বিরহ আসলে প্রথাগত অর্থে বিরহ নয়। স্থুল অর্থে প্রেমের বেদনা উদ্যাপন নয়। এটা আসলে একটা প্রক্রিয়া যার মধ্যে দিয়ে ফুটে ওঠে কবিতাকুসুম।

ধূ ধূ মরুভূমির প্রেক্ষাপট থেকে তাকে আমরা উপনীত হতে দেখি এই সত্যের দিকে যে সত্য তাকে শেখায় অথবা ভাবায়, এমনকি নদীর তলেও, জলের তলায় ওৎ পেতে থাকে মরুভূমি। অথচ তার নিষ্ঠার কোন অভাব ছিলো না। অলৌকিকতার ছোঁয়া ছিলো না। এভাবে রচিত হয় টানাপোড়েন। টানাপোড়েনের মধ্য থেকেই কি দার্শনিকতার ভিত্তিভূমি উঁকি দ্যায় তার মনে? তবে দার্শনিকতার আগে কল্পবাস্তবের নান্দনিকতাও চোখে পড়ে সুনিশ্চিত। হয়তো একারণেই প্রথম অবস্থায় চাঁদকে মনে হয় ভাওয়ালের চিত্রল হরিণ, তারপর তাকে বলতে শুনি, যাপিত জীবন থেকে ঝরে যাবে সুবর্ণ অতীত। ঝরে যাবার বেদনায় আক্রান্ত হন তিনি। কল্পবাস্তবতার ঘোর থেকে খানিকটা নেমে চলে আসেন বাস্তব-সচেতনতার কাছাকাছি আর টের পেতে থাকেন, অনুভবের সুতায় কালো বরফের মতো জমে ওঠে রাত। এখানে উল্লেখ্য যে, অনুভব শব্দটা একটা চাবি-শব্দ। উপলব্ধি নয়, অনুভব। প্রেম, নেশা - এইসব ধরে শেষাবধি তাকে বলতে শুনি, সকল শুশ্রƒষা দিয়ে ফুটিয়েছি কবিতাকুসুম। পূর্ণাঙ্গ ফুল নয়। কুসুম। কেন? হয়তো এই কুসুমের সৃষ্টিই কেবল তার মধ্যে। পরিচর্যার ভার তার নয়। একবার প্রস্ফুটিত হলে এই কুসুমের যতœআত্তির ভার অন্য কারো। কার? হতে পারে পাঠকের। হতে পারে পরিপার্শ্বের। যাই হোক না কেন, কুসুমের সম্ভাবনা তখন নির্ভর করে অন্যের উপর। কবির উপর নয়।

এখানে মনে পড়ে, বোদলেয়ারের করেসপন্ডেন্স কবিতাটির কথা। বোদলেয়ার বলেছিলেন, প্রকৃতি এক বিশাল রূপকের সংগ্রহশালা। তবে শতাব্দী কাদেরের কবিতার প্রেক্ষাপটে বোদলেয়ারের সংগ্রহশালার রেঞ্জ আরো বেড়ে যায়। কেবল প্রকৃতি নয়, সমগ্রতার কেন্দ্রভূমি জুড়ে উড়তে আরম্ভ করে রূপকের প্রজাপতিগণ।

০৩.
শতাব্দী কাদেরের কবিতায় বাস্তবতা যেমন আছে ঠিক তেমনই আছে পরাবাস্তবতা। কে যেন বলেছিলেন, পরাবাস্তবতার রেশ ছাড়া কবিতার ঘোর রচিত হয় না। আর ঘোর না থাকলেও কবিতার চার্ম অনেকটাই লঘু হয়ে যায়। তবে এটা তো অস্বীকার করা যাবে না যে, পরাবাস্তবতার পটভূমি তো আসলে বাস্তবতারই উস্কানি। বাস্তবতা থেকে কুড়িয়ে নেয়া প্রতীকের আন্তঃক্রিয়াশীলতা থেকেই রচিত হয় পরাবাস্তবতার ঘোর। এক্ষেত্রে শতাব্দী কাদেরের কবিতায় বাস্তবতা বেশ স্পষ্ট। যেমন

নদীর স্বীকৃতি দিতে বর্ষা আঁকি অন্তত বছরে একবার...
আপাতত এই সমাধান
(বসন্তবদল/বিরহযাপন/শতাব্দী কাদের)

আক্ষরিক অর্থেই তার কথার সত্যতা পাওয়া যায় যখন আমরা দেখি বাংলাদেশের অধিকাংশ নদীই কেবল বর্ষার সময় ছাড়া শুকেèা, বালিশুকেèা, নির্জলা পড়ে থাকে। একবার ছেয়ে যায় বন্যায়। অথচ নদীমাতার সন্তান এই ভূখ-ের ঐতিহ্য তো অন্য কথা বলে। তার মানে, আমরা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছি আমাদের ঐতিহ্য থেকে। বছরে একবার শুধু উপলক্ষ্য হিসাবে যেমন আমরা উৎসব পালন করে থাকি ঠিক সেভাবেই নদীমাতৃক কুলাচারের কথা নদীর মধ্য দিয়ে স্মরণ করি বছরে একবার। জলের প্রবাহের মধ্য দিয়ে খুঁজে নিতে চাই আরেকটি উৎসবের উপলক্ষ্য।

ঠিক এভাবেই তার কবিতায় যেন মুখ্য হয়ে থাকে প্রতীক। রূপক। প্রতীক ও রূপকের বহুমাত্রিকতা।

০৪.
কবিতার ঐতিহ্যিক ধারা থেকে বলা যায়, শতাব্দী কাদের চিত্র-সচেতন। শব্দের ভেতরে যে ইমেজ লুকানো থাকে তার ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত। আমরা নিচের কবিতাংশটির দিকে তাকাতে পারি

নদীর সিথানে বসে ঝিমায় শালিক
চোখে জল, জলের ভেতরে কাঁপে অনন্ত আকাশ
কুমারী ঢেউয়ের স্তনে সারি সারি রূপালি ঝালর
নদীতে তখন ¯œান সারছে পূর্ণি-ধৌত রাত...
(দৃশ্যাবলির ডানা/বিরহযাপন/শতাব্দী কাদের)

ঠিক এভাবেই তার কবিতায় শব্দের পটভূমি থেকে উঠে আসে অসংখ্য চিত্র। শব্দে ও শব্দে রচিত হয় চিত্রসঙ্গতি। কেবল উপলব্ধি নয়, অনুভূতির রাস্তা ধরে উঠে আসে পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের দুয়ারে।

০৫.
প্রথাগত আলোচনার ফর্মে এই লেখাটিও চলে যাক, তা আমি চাই না। কবি শতাব্দী কাদের-কে যতটুকু জানি বা চিনি তার থেকে মনে হয়, তিনি কবিতা থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। আমি জানি না, কেন? হয়তো অভিমান, অথবা তুমুল জীবনগ্রস্ততার কারণে তিনি আর সেই কুসুমের কাছে যেতে পারছেন না যাকে একরাতে, সারারাত মদ গিলে গিলে, সারারাত জল ঢেলে ঢেলে, তিনি নিজেই সবার অলক্ষ্যে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। হয়তো কুসুমের পরিচর্যার ভার যাদের নেয়ার কথা ছিলো তারা কেউ নেয় নি বলে কবি মনে করছেন। আমি অবশ্য মনে করি, বিষয়টা আদতে এমন নয়। কুসুমের ভার যাদের নেবার কথা ছিলো তারা ঠিকই নিয়েছে। তারা তাদের কথায় এটা তো বলেই থাকে। আর জীবনগ্রস্ত তো আমরা সবাই। জীবন যেন একটা বিরাট মাকড়সার মতো ধীর স্বচ্ছ তন্তুর জালে আমাদের ক্রমশ আটকে দিচ্ছে। হ্যাঁ, আমরা তো চলেই যাবো। তবে বিরহযাপন নিশ্চয়ই হারাবে না। বিরহ-যাপনের স্বার্থেই তার আবার ফিরে আসা উচিৎ। আমাদের স্বার্থেও।



০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×