কিটস বা শেলীর কবিতা যদি আপনি পাঠ করেন, দেখবেন, বিশ্বসাহিত্য ইতোমধ্যে দেখেছে এবং স্বীকারও করেছে যে, তাদের কবিতায় আবেগটাই প্রধান। শুধু কিটস বা শেলী নয় রোমান্টিক কবিগণের সবাই আবেগে আক্রান্ত ছিলেন। যদিও আক্রান্ত শব্দটিকে নেগেটিভ অর্থে বিবেচনা করার সুযোগ রয়েছে, তবু আমি বলবো আজকের প্রেক্ষাপট আর প্রায় দুইশো বছর আগের প্রেক্ষাপট এক নয়, হতে পারে না, তাই এই শব্দটিকে নেগেটিভ অর্থে বিবেচনা না করাই ভালো। আজকের কবিতার প্রেক্ষাপট থেকে বলা যায় আবেগের বাহুল্য কবিতার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে না। বরং অনেকের মতে কবিতাকে প্যাঁচপ্যাঁচে করে তোলে। তাহলে কি বলা যায় আজকের কবিতা আবেগরহিত? না। মোটেও না। কবিতায় আবেগ দুইশো বছর আগেও ছিলো। বর্তমানেও আছে। আমি আশা করি দুইশো বছর পরেও থাকবে। যদিও যারা ক্লাসিসিস্ট, বিশেষত এলিয়টের মতাদর্শে বিশ্বাসী এবং যারা এলিয়টের মতো বিশ্বাস করেন পোয়েট্রি ইজ নট এ টার্নিং লুজ অব ইমোশন, তাদের ক্ষেত্রে বিষয়টা ভিন্ন। ভিন্নতার মাত্রায়ও অনেক স্তর রয়েছে। কট্টরপন্থীরা ভাবেন আবেগের কোন স্থান নেই কবিতায়। বিশেষত আজকের যুগে যখন মানুষের ভেতর থেকে আবেগ সরে গেছে এবং বলতে কি মানবিকতাও বিলুপ্তপ্রায়, এমন একটা সময়ে কবিতায় আবেগের উপস্থিতি আসলে বর্তমানতার ধারা থেকে কবিকে এবং পাঠকে দূরেই সরিয়ে দ্যায়। কট্টরপন্থীরা এমনটাই ভাবেন। ক্লাসিসিস্টদের মাঝে কিছুটা উদার লোকও আছে। তারা এতটা কট্টর নন। কিছুটা নমনীয়। কবিতায় একটা মাত্রার আবেগ তারা বরদাস্ত করেন। খুব বেশি হলে চোখ পাকিয়ে ওঠেন। বলেন, না, না, এটা হলো না; এতটা আবেগ কবিতায় প্রত্যাশিত নয়; আরে ভাই এটা তো রোমান্টিক যুগ না; এই যুগে প্রেমের আগেই চলে আসে সেক্স, তারমানে মনের আগেই দেহ; এখানে এই সময়ে এতটা আবেগ কবিতাকে আনস্মার্ট করে তোলে। তারা বলেন। অথবা না বললেও এমন ধারাই ভাবেন।
এবার আসা যাক কবিতায় বুদ্ধির উপস্থিতির বিষয়ে। বুদ্ধি আসলে কী? বিজ্ঞানীগণ বুদ্ধির যে সংজ্ঞা দেন, কবিতায় কি আমরা বুদ্ধিকে সেইভাবেই চাই? বুদ্ধি মানে কি (কবিতায়) জটিলতার সৃষ্টি করা? না, আমি মনে করি কবিতার বুদ্ধি আর বিজ্ঞানের বুদ্ধি এক নয়। কবিতায় আমি একে বুদ্ধি বলতেই চাই না। আমি বলতে চাই মেধা। দেখার ক্ষমতা। শোনার ক্ষমতা। বোঝার ক্ষমতা। কীরকম? একটু ব্যাখ্যা করা যাক, রণজিৎ দাশ- এর একটা কবিতা উদ্ধৃত করা যাক:
ভাতকাপড়ের দুশ্চিন্তা করেই
সমস্ত জীবনটা কাটলো আপনার।
কোনো শিল্প, কোনো সম্ভোগ, কোনো উদাসীনতা
আপনাকে স্পর্শ করলো না।
আপনার কথা লেখা আমার পক্ষে অসম্ভব।
আপনি আমার লেখার জগৎ থেকে একটু দূরে রয়েছেন,
যেমন শহর থেকে একটু দূরে থাকে পাওয়ার স্টেশন।
(বাবাকে/ রণজিৎ দাশ)
শেষ পংক্তি বাদ দিলে কবিতায় বাবার যে অবস্থান, বাবাকে দেখার যে দৃষ্টি কবিতায় উঠে আসে, তার ঠিক উল্টো এবং বলা যায় অপ্রত্যাশিত ভাব উঠে আসে শেষ পংক্তির মধ্য দিয়ে। একটা পংক্তি দিয়ে কেবল, পাওয়ার স্টেশনের অবস্থান দিয়ে, শহর থেকে একটু দূরত্বে সরিয়ে পিতাকে তার বর্তমান সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে তিনি গেঁথে দিলেন। এই অকস্মাৎ এবং কাব্যিক মোচড় তিনি কোনোভাবেই এই কবিতায় দিতে পারতেন না যদি তার দেখার চোখ না থাকতো। শহর থেকে পাওয়ার স্টেশনের দূরত্ব সম্পর্কে তিনি যদি সম্যক অবহিত না হতেন তাহলে তাহলে তার পক্ষে এই মানের কবিতা লেখা সম্ভব হতো না। এ তো গেল দেখার চোখের কথা, এই চোখ আরো বেশি মাত্রায় উপস্থিত হয় বিনয় মজুমদারের কবিতায়। বলা যায় বিনয় মজুমদারের কবিতার মূল কেন্দ্রে থাকে এই চোখ, কান, নাক তথা পঞ্চেন্দ্রিয়র অবস্থান। তবু কি আমরা এমন একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, মেধার অস্তিত্ব ছাড়া ভালো কবিতা, বিশেষত আজকের প্রেক্ষাপটে, হতে পারে না? না, আমরা এমন কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারি না। সিকদার আমিনুল হক- এর নিচের কবিতাটির দিকে তাকানো যাক।
সুলতা জানে, সুলতা জানে ভালো,
আকাশে মেঘÑদীঘিতে কেন হাঁস,
সুলতা জানে, সুলতা জানে ভালো
কবিরা কেন নারীর ক্রীতদাস!
সুলতা জানে, সুলতা জানে ভালো,
প্রেমিক কেন থাকে না চিরকাল
সুলতা জানে, সুলতা জানে ভালো
দহনে শ্রুতি নির্মম বহুকাল
(সুলতার নিজস্ব আয়না/ সিকদার আমিনুল হক)
এবার আসা যাক অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গে। অভিজ্ঞতাই হয়তো আবেগ বা মেধার চেয়ে বেশি অনিবার্য আজকের কবিতায়। শুধু আজকের নয়। চিরকালীন কবিতায়। এই অভিজ্ঞতা থেকেই কবিতার প্রাণ জন্ম নেয়। অবশ্য মেধাবী কবি যারা তারা অভিজ্ঞতার সাথে এক সূত্রে মেধাকে গেঁথে ফেলতে পারেন। ফলে তাদের কবিতায় অভিজ্ঞতার মতো প্রকট মনে হয় না। মেধার আবরণে ঢাকা থাকে বিধায় আমাদের মনোযোগ টেনে নিতে পারে। ধরে রাখতে পারে। আমরা নিশ্চয়ই স্মরণ করতে পারি, ওয়ার্ডসওয়ার্থের সলিটেরী রীপার কবিতাটির কথা, বিশেষত শেষের অংশটা, ঞযব সঁংরপ রহ সু যবধৎঃ ও নড়ৎব, খড়হম ধভঃবৎ রঃ ধিং যবধৎফ হড় সড়ৎব. নেহায়েৎ অভিজ্ঞতার সাংগীতিক প্রকাশের মধ্য দিয়েই কবিতাটি আমাদের আন্দোলিত করে তোলে। মনে গেঁথে যায়। আমূল গেঁথে যায়। এতটাই নাড়িয়ে তোলে পাঠককে যে বহুকাল পরেও সে ভুলতে পারে না সেই কবিতাটির কথা। এখানে মেধার চেয়ে সংগীত হয়ে উঠেছে প্রধান। তবু কি কবিতাটি আমাদের নাড়িয়ে দিতে পারে না? পারে। আর পারে বলেই হয়তো বলা যায় অভিজ্ঞতা থেকেই সৃষ্টি হয় কবির মনোজগতের। সেই মনোজগত যে কেবল প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় নির্মিত তা নয়। অপ্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাও সেখানে সমান গুরুত্বপূর্ণ। তবে কবির অভিজ্ঞতা অন্যদের অভিজ্ঞতার মতো নয়। অত্যন্ত শিল্প-উপযোগিতার দৃষ্টিকোণ থেকে। একজন সাংবাদিক যেভাবে অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করেন বা একজন রহস্য উপন্যাসের লেখক, কবি সেইভাবে অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করেন না। সমস্ত অভিজ্ঞতা তার সত্তার অংশ হয়ে যায়। এবং কবিতার ভেতর দিয়ে তিনি যখন জীবনকে ব্যাখ্যা করতে থাকেন, তখন ইউনিটির রেশ নিয়ে এইসব অভিজ্ঞতা উঠে আসে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন বলতেন, শুরুর আগেও শুরু থাকে। ব্যাপারটা আসলে তেমনই অনেকটা। ধরা যাক, আমরা যখন নাচ দেখি তখন কেবল নাচ, মুদ্রা, ভঙ্গি ও সঙ্গতির বাইরেও আরো কিছু থাকে। প্রশ্ন হলো সেটা কী? সেটা অধ্যবসায়। হয়তো স্টেজে এইটুকু পারফর্ম করার আগে তাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চর্চা করতে হয়েছে। আমরা আসলে সেই বিষয়টার দিকেই বারবার তাকাতে চাই। কবিতা সম্ভবত তাকায়ও। রেওয়াজ, চর্চা, অধ্যবসায় যাই বলুন না কেন অভিজ্ঞতা এর ভেতর দিয়েই কবিতায় উঠে আসে বলে কবিতার অভিজ্ঞতাকে আর কটকটে বাস্তবতাসর্বস্ব মনে হয় না। মনে হয় ঐকতানের ভেতর দিয়ে উঠে আসা সুর।
আমার মনে হয়, বুদ্ধি, আবেগ বা অভিজ্ঞতার বাইরে থেকেও এই চর্চা বা রেওয়াজ বা অধ্যবসায় আজকের কবিতায় অন্যতম ভূমিকা রাখে।
০০.
বিশ্বসাহিত্যের প্রেক্ষিতে বাংলা কবিতার স্থান এভাবে নির্ণয় করা সম্ভব না। এটাকে নিতে হবে কেস স্টাডি হিসাবে। পোয়েট টু পোয়েট কমপেয়ার করতে হবে। টোটালিটি দিয়ে টোটালিটিকে বিচার করতে হবে। তারপরও আসলে এভাবে বলা যাবে না। কেননা কবিতা তো আর টেস্ট ব্যাটসম্যানদের র্যাংকিং নয়। পয়েন্টের ভিত্তিতে, পারফরমেন্সের ভিত্তিতে কাউকে আগে, কাউকে পরে করে নিলেন। আমরা আমাদের স্বকীয়তা নিয়েই আছি। প্রত্যেক ভাষার কবিতাই নিজের নিজের অবস্থানে আছে।
০০.
প্রকৃত কবিতার সৃষ্টি হয় অভ্যন্তরীণ এক চূড়ান্ত ও বিশুদ্ধ নৈরাজ্য থেকে- এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
কবিতার সৃষ্টি নিয়ে তো অনেকে অনেক কথা বলেছেন। কনশান, আনকনশান, সাবকনশাস, স্পিরিটাস মুন্ডি ইত্যাদি অনেক কিছুই কবিতার পেছনে মূল প্রক্রিয়ায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে বলেও অনেকে বলেছেন। সাহিত্যের একেক যুগে, একেক মতবাদের ভিত্তিতে কবিতা সৃষ্টির প্রক্রিয়া নিয়ে একেক মতবাদ এসেছে। এগুলোর মাঝে সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো ওয়ার্ডসওয়ার্থের তত্ত্বটি যেটিতে তিনি বলেছিলেন, ংঢ়ড়হঃধহবড়ঁং ড়াবৎভষড়ি ড়ভ ঢ়ড়বিৎভঁষ ভববষরহমং ৎবপড়ষষবপঃবফ রহ ঃৎধহয়ঁরষরঃু. আজকের যুগে এসে কেবল ফিলিংয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে কবিতাকে আর ব্যাখ্যা করা যায় না। কবিতা সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে তো অবশ্যই নয়। কবিতায় যাকে আধুনিকতার অন্যতম জায়ান্ট বলা হয়, সেই এলিয়ট আবার ইমোশনের ভূমিকাকে একরকম অস্বীকার করেই বলেছিলেন, কবিতা আসলে ইমোশনের টার্নিং লুজ নয়। এর পর অবশ্য সেই অর্থে সমাদৃত কোন প্রক্রিয়ার কথা সেইভাবে শোনা যায় নি। কিন্তু তারপরও বলা যাবে না প্রক্রিয়ার চিহ্নায়ন নেই। প্রচারণা নেই। বহু জন বহুভাবে এটা করছেন। হালকা বা ভারী কথায় এই প্রক্রিয়াকে চিহ্নিত করার চেষ্টা হচ্ছে। বলা যায় অনেকটা এই কারণেই চূড়ান্ত বা বিশুদ্ধ বা নৈরাজ্য শব্দগুলোর সাথে আমি একমত নই। তবে অভ্যন্তরীণ শব্দটার সাথে একমত। একটা আলোড়ণ তো থাকেই। কেবল কবিতা নয় যে কোন সৃষ্টির পূর্বশর্ত হচ্ছে আলোড়ন। ভেতরে ভেতরে সেই আলোড়ন হয়তো কবিকে তাড়িয়ে বেড়াতে থাকে। কবিতা লেখার সময়ে হয়তো ওটাই কাজ করতে থাকে। এই বিষয়ে নির্দিষ্ট কিছু বলা সম্ভব নয় যেহেতু প্রক্রিয়াটি কংক্রিট নয়।
০০.
আমি শুধু সমকালের কথা বলি না। প্রাচীন কাল থেকেই বাংলা কবিতার একটা অবস্থান ছিলো। স্বতন্ত্র অবস্থান। প্রাচীন ইংরেজী সাহিত্যের সাথে তুলনা করলেও দেখা যায়, ওখানে যখন নায়কোচিত কাহিনি রচিত হতো, তার কাছাকাছি সময়েই বাংলা সাহিত্যের মূল সুরে উঠে এসেছে সমাজবাস্তবতা এবং দর্শন। সমকালীন প্রেক্ষাপট থেকে তুলে আনা দৃশ্য ও অনুসঙ্গের ভেতর দিয়ে উপজীব্য হয়ে উঠেছে দর্শন কখনো কখনো। তারপরের সময়টাতে মানবিকতার বিষয়টাকে ধরা যায়।
আধুনিক যুগ পর্যন্ত এমন স্বাতন্ত্র্য ছিলো। পরবর্তীতে যেহেতু মিল্টন থেকে শুরু করে এলিয়ট পর্যন্ত কবিদের সৃষ্ট ধারণার বলয়ে থেকে অনেকে সাহিত্য চর্চা বিশেষত কাব্যচর্চা করেছেন, তাই কবিতা হয়ে পড়ে অনেকটাই ইংরেজী তথা পাশ্চাত্যের কবিতার অনুপ্রাস। কেবল ইংরেজী নয় কারণ শেষের দিকে যখন পঞ্চপা-ব বাংলা কবিতায় আধুনিকতার পাশ্চাত্য নির্যাস নিয়ে এসেছেন তখন ইংরেজীর পাশাপাশি ফরাসি, ইতালিয়ান, রাশান কবিদের প্রভাবও তাদের খানিকটা নাড়া দিয়েছে। ফলে ঐ সময়টার কবিতা আসলে একটা কম্পোজিট আধুনিকতার দিকে আমাদের নিয়ে গেছে। দুই একজন যে অন্য ধারায় যাবার চেষ্টা করেননি তাও নয়। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তো রবীন্দ্রপূর্ব মাইকেলের কাছাকাছি ভাষাভঙ্গিকেই চর্চা করেছেন অংশত। তারপরও আজকাল পাঠ্যপুস্তকের বাইরে এসে এখনো তারা পাঠকের প্রতিবেশী হতে পারেন নি। আর হতে পারবেন বলেও মনে হয় না। অবশ্য পাঠকের প্রতিবেশী হওয়াতেই যে কবির চরম সার্থকতা নিহিত এটাও আমি বলতে চাইছি না। তারা মাস পিপলের জন্য সাহিত্য করেননি। তারা সাহিত্য করেছেন ক্লাস পিপলের জন্য। ফলত সেই সময়টাতেও তারা একটা ক্লাসে আটকে ছিলেন এবং আশ্চর্যজনকভাবে এখনো তারা সেখানেই আছেন। দুঃখের বিষয় হলো সেই ক্লাস এখন আরো সীমিত হয়ে এসেছে। সাহিত্যের অধ্যাপক, ছাত্র, কয়েকজন নিবিষ্ট কবি ছাড়া আর বাকীরা তাদের ধারে কাছেও যান না। “ওনাদের কবিতা বুঝি না” এমন বলে সরে দাঁড়ান। তাহলে কার কবিতা বোঝেন? তারা জীবনানন্দের কবিতা বোঝেন অথবা বোঝার ভান ধরে থাকেন। আসলে সবটাই ছদ্মবেশ। জীবনানন্দও তারা বোঝেন না। পঞ্চপা-বের মধ্যে একমাত্র জীবনানন্দই একটা বিশেষ কোয়ালিটি তার নিজের কবিতায় জুড়ে দিতে পেরেছিলেন, ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত নাকি অনিচ্ছাকৃত এটা আমি জানি না, তিনি তার কবিতায় কেবল বোধ বা বুদ্ধি নয়, অনুভূতিও জুড়ে দিয়েছিলেন। ফলে এখনো তার কবিতায় একটা ডুয়ালিটি সমানভাবে ধরা পড়ে? কী সেটা? সেটা হলো অনুভূতি আর বোধের ডুয়ালিটি।
চিন্তাশীলতায় অনভ্যস্ত মানুষ জীবনানন্দের এই অনুভূতির বিষয়টায় আপ্লুত হয়ে যায়। আমি কিন্তু মনে করি থিম বা কনটেন্টের জায়গায় জীবনানন্দ অন্য চারজনের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। বরং উল্টো। অন্যরাই তার চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু সেই এগিয়ে থাকাও পাশ্চাত্য নির্ভর এগিয়ে থাকা। জীবনানন্দও পাশ্চাত্য নির্ভর। তবে পাশ্চাত্যকে তিনি অন্যদের চেয়ে বেশি আত্তীকরণ করে নিতে পেরেছিলেন। অন্যরা পারেননি।
তাহলে ব্যাপারটা এই দাঁড়াচ্ছে যে, ওই সময়টা পর্যন্ত বিশ্বকবিতার প্রলম্বিত চাষাবাদ হয়েছে আমাদের কবিতায়। তারপরে পঞ্চাশ থেকে শুরু করে বর্তমান সময় অব্দি যে আঙ্গিক ও ভাবনধারা তৈরি হয়েছে তা এক অর্থে স্বতন্ত্র বাংলাদেশের কবিতার। উত্তরাধুনিকার যুগে কবিরা তাদের নিজের নিজের ব্যাখ্যা নিজের নিজের কাছে দিতে সক্ষম হয়েছেন। যুগ বিভাজনের কথা যদি ধরি তাহলে মনে হয়, পঞ্চাশ পরবর্তী সময় থেকেই বাংলাদেশের কবিতা আলাদা হয়ে উঠতে থাকে। প্রাথমিক অবস্থা থেকেই খুব বেশি জীবনানন্দমুখি হওয়ার কারণেই হয়তো কনটেন্ট বা থিম কবিতায় গৌণ হয়ে পড়তে থাকে। কবিতা থেকে চিন্তা বিসর্জিত হতে থাকে। একটা পর্যায়ে এমনও হয়েছে কবিতা হয়ে উঠেছে শব্দ ও বাক্যের বুনন মাত্র। এখনো কারো কারো কবিতা যে সেই বুননের ভেতরেই নেই তাও বলা যায় না। পাঠের ভালোলাগা আর পাঠান্তে প্রাপ্ত চিন্তার ভালোলাগা এক না। মাঝে মাঝে ভয় হয়, আমরা কেবল পাঠের ভালোলাগাতেই আটকে যাচ্ছি না তো?
আর আসলে সমকালের বাংলা কবিতা খুব শক্তিশালী এটাও আমি নিজের কাছে দাবী করতে পারি না। এখনো যখন নাজিম হিকমতের কবিতা পড়ি, যখন তাকে বলতে শুনি,
If half my heart is here, doctor,
the other half is in China
with the army flowing
toward the Yellow River.
And, every morning, doctor,
every morning at sunrise my heart
is shot in Greece.
And every night, doctor,
when the prisoners are asleep and the
infirmary is deserted,
my heart stops at a run-down old house
in Istanbul.
(Angina Pectoris)
আমি চমকে উঠি। ব্যক্তিহৃদয়ের ব্যথার সাথে এত বড় বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের সংযুক্তি কীভাবে সম্ভব! এটাই কবিতা; এটাই কবিতার শক্তির জায়গা! অবশ্য একমাত্র বৈশ্বিকতা দিয়েই যে এখানে পৌঁছানো সম্ভব তা নয়। একেকজন একের তরিকায় এখানে যাবার চেষ্টা করেন। আমাদের ভাষায় কতজন কবি এটা পেরেছেন? নিজেদের কবিতাকে খাটো করে দেখছি না বলেই হয়তো সান্ত¦না লালন করতে চাই। আসলে কি এটাও অসুখ নয়!
একবার ভেবে দেখুন তো, আমাদের কতজন কবির কবিতা ইংরেজিতে অনুদিত হয়েছে। হাতে গোনা। বিশ্বের দরবারে সমকালীন কবিতা নিয়ে হাজির হতে হলে একটা বৈশ্বিক ভাষার মধ্য দিয়ে সেখানে যেতে হবে। এক্ষেত্রে ইংরেজির চলটাই বেশি। অন্য ভাষার কথা না হয় বাদই দিলাম। আর অনুবাদের পর যা থাকে তা-ই আসলে কবিতার কনটেন্ট। অন্তঃশক্তি। অনুবাদের পর জীবনানন্দকে যেমন ইয়েটসের এক্সটেনশন মনে হয়, বিষ্ণু দেকে এলিয়টের; ঠিক তেমনই বর্তমানের কবিতা অনুদিত হলে তা কি স্বকীয়তা অর্জন করতে পারবে কি না তা দেখতে হলে আগে চাই প্রমিত অনুবাদ। আমাদের অনুবাদক কই। অনুবাদও যে সাহিত্যের একটা অংশ এটা আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারলাম কই।
হয়তো এসকল কারণেই আমাদের কাক্সিক্ষত অবস্থানে আমরা নেই।
০০.
আধুনিকতা বা উত্তরাধুনিকতা সম্পর্কে এভাবে বিস্তারিত বলার মানে হলো চর্বিত চর্বণ করা। কেননা আমি যে কথাগুলো বলবো সেই কথাগুলো হাজার হাজার বার বলা হয়ে গেছে। হাজার হাজার শিল্পী, সাহিত্যিক তাদের প্রবন্ধ, নিবন্ধ, আলোচনায় এসব কথা বলে গেছেন। তারপরও আমি যে বলতে পারি না তাও নয়। সেক্ষেত্রে হয়তো কাট পেস্ট করে লেখা একাডেমিক ফরম্যাট দাঁড়িয়ে যাবে। সেই ফরম্যাটের দিকে আমি যেতে চাই না। আধুনিকতা বা উত্তরাধুনিকতা যাই বলুন না কেন, দুটোই আসলে যুগের দৃষ্টিভঙ্গি। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সময়কে দেখার চোখের বিষয়। দুটোই আসলে মনোভঙ্গি। শিল্পের সবক্ষেত্র নিয়ে আমি কখনোই মাথা ঘামাইনি। কেবল কবিতার বিষয়গুলো নিয়েই মাথা ঘামিয়েছি। আমাদের মনে রাখতে হয় আধুনিকতার যুগ সৃষ্টির পেছনে যারা মূখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন ( প্রেরণার দিক থেকে ) তারা হলেন, ডারউইন, মার্কস, ফ্রয়েড প্রমুখ। তো এদের প্রেরণা হিসাবে নিয়ে কবিতায় জ্ঞান, সময়কেন্দ্রিকতা, নৈতিক অবক্ষয়ের প্রকাশ, সুচারু টেকনিক ইত্যাদি দিয়েই আধুনিকতার যাত্রা শুরু হয়। আমাদের দেশেও তিরিশের দশকের সুবাদে সেই কবিতার ঢেউ খেলে গিয়েছিলো। তারপর এলো উত্তরাধুনিকার ঢেউ। তবে এটা আর আধুনিকতার মতো এতো জোরালো হতে পারে নি। কিন্তু এখানেও প্রেরণার উৎস হিসাবে কয়েকজন ব্যক্তি ও তাদের মতবাদ কাজ করেছে। যেমন, পাবলভ, দেরিদা প্রমুখ। আর প্রকৃতপক্ষে সময় দিয়ে আধুনিকতা বা উত্তরাধুনিকতাকে আটকানো যায় না। এখন তো অনেকের মতে, উত্তরাধুনিকতার যুগ; তাই বলে সব কবিই যে উত্তরাধুনিকতার ধারার কবিতা লিখছেন এটা বলা যাবে না বা দাবী করা যাবে না। বিষয় ভিত্তিক উল্লম্ব কবিতা যারা রচনা করছেন তারা তো এখনো সেই আধুনিতার যুগের কবিতাই লিখছেন। যদি তাদের কবিতা আমাকে টানে তা হলেই হলো। আবার বিষয় বিশ্লিষ্ট, আনুভূমিক কবিতা যারা লিখছেন তারাও যে সবাই ভালো কবিতা লিখছেন এটাও তো বলা যাবে না। মূল কথা হলো যে যাই লিখুক, যে তত্ত্বের ভেতর থেকেই লিখুক, ভালো কিছু লেখার সুযোগ তার আছে। আমার তো মনে হয়, এই দুই যুগ পেরিয়ে আমরা চলে এসেছি এমন একটা যুগে যখন লেখার ওজনটাই বিষয়। তত্ত্বটা নয়।
আধুনিকতা বা উত্তরাধুনিকতা আমাদের এই জায়গায় নিয়ে এসেছে।