সিডনী আসার প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠলাম সপ্তাহ দু'য়েকের মধ্যেই। ততদিনে বাসা নিয়ে নিয়েছি আমরা। তারপরের দিনগুলো ছিল তীব্র মন খারাপের, খারাপ লাগার... প্রতি মুহুর্তে অসহ্য রকমের অসহায়ত্বে ছুটে দেশে চলে যেতে ইচ্ছে করত। মাঝে মাঝে মনকে জোড় করে অন্য ভাবনা ভাবাতাম। ঘুম বিশ্বাসঘাতকতা করত। চুরি করে দেখিয়ে দিত ভিকারুননিসার দেয়ালগুলো। বন্ধুদের আড্ডার একটু খানি। প্রিয় টিচারগুলোর ঝাড়ি। বড় ফুপির গায়ের গন্ধ। রিকশায় উড়তে থাকা। ঘুম থেকে উঠে দেখতাম বালিশ ভিজে গেছে। মানুষ এবং ভাষাগত যোগ্যতার অভাবে নিজের ভাবনাগুলো বলতে না পারার অসহ্য কষ্টে সারাদিন মরতাম। রাতে আবারও সেগুলোর ফিরে আসা। এক বিন্দু সুখ ভাবনা আসত না দেশের কথায়। তীব্র, অন্ধকার কষ্ট।
ছয় মাসের মাথায় দেখলাম, এভাবে পারছি না আমি সত্যি। অর্থহীন অনুভূতির সুইচ বন্ধ করতে না পারলে আমি মরেই যাব। তখন জোড় করে সমগ্র বাংলাদেশকে তালাবদ্ধ করলাম দৃষ্টিসীমানার বাইরে। বন্ধুদের চিঠি, ছবি, গানের সিডি, ক্যাসেট, বাংলা বই সব সরিয়ে রাখলাম। বাংলা গান শুনব না, বাংলা অক্ষর পড়ব না, পড়ব না, পড়ব না। ইয়া মোটা সাতশ পৃষ্ঠার রুটস এনে সেটা গুলে খাওয়ার চেষ্টা করলাম।
বছর ঘুরে একটু থিতু হওয়ার পরে ইয়ার ইলেভেনে 'আইডেন্টিটি' পড়ার সময় একবার বলা হয়েছিল একটা ক্রিয়েটিভ পিস লিখতে। জমা দেয়ার আগের দিন রাত এগারোটায় বসে ভাবছি কি নিয়ে লিখা যায়, কি নিয়ে লিখা যায়। ভেবে দেখলাম, কিছু লিখতে হলেই আমাকে অনুভূতি ঢালতে হবে। আমি ফরমায়েশি লেখা লিখতে পারি না। আর অনুভূতির আধার, আমার মনের সেই একটা ঘর খুললেই সাথে সাথে পেয়ে যাব লেখার উপাত্ত। ঘুমে চোখ লেগে আসছে। মিস র্যামজির মুখের দিকে তাকিয়ে খুলে ফেললাম অনুভূতির বোতল। তীব্র বেগে বেড়িয়ে আসা অনুভূতিগুলো দেখে একটু স্বস্তি পেলাম। ততদিনে অনুভূতিগুলোয় একটু রঙ লেগেছে। কালো কালো অনুতাপ আর অসহ্য অনুভূতির জায়গা করে নিয়েছে একটু সুখ সুখ বেদনাময় নস্টালজিয়া। !@@!82238 পাঠিয়েছিলাম এক বন্ধুকে। পরের দিন মেইল চেক করে দেখি একটা কবিতা বসে আছে ইনবক্সে। আমার বলা না বলা অনুভূতিগুলো তখন কবিতার অক্ষরে অক্ষরে। আজকে অনেক দিন পরে আমার ফাইলগুলো ঘাটতে গিয়ে পেলাম কবিতা। আগাগোড়া পড়ে তখন যেই অনুভূতি হয়েছিল... নরম ভাল লাগার অনুভূতি তাই ফিরে আসল অনেক, অনেক দিন পরে। সেদিন কবিতা পড়েই বাসন্তী সূতীর শাড়িটার ভাজ খুলে পড়ে ফেলেছিলাম সেই দিন, অনেক দিন আগে, মনে আছে। এক একটা দিন সব সুন্দর ব্যপারগুলো সবার সাথে শেয়ার করতে মন চায়। নিজে কখনও কবিতা লিখি নি। লিখব বলে বিশ্বাসও করি না। তাই সেদিন পাওয়া কবিতাটায় পাঠকদের দিতে চাই আমার এখনকার সৌন্দর্য অনুভূতি...
একটি অবরোধ ব্যারিকেডহীন মধ্য দুপুরের খোঁজে
আমি ভেজা কদমের দেশ ছেড়ে আকাশে উড়াল দিলাম।
নীল জল সরোবর পেরিয়ে
দারুচিনি এলাচের গন্ধ ভেঙে
উড়তে থাকলাম অবিরাম--
যতদিন না
দখিনা বাতাসে দেঁৗড়ে এলো অচেনা কথার রেশ,
আর তৃণভূমি উপচে পড়া দুধেল গাভীর ডাক।
এখানে প্রশস্ত সড়কের পাশে বৃথায় খোঁজা
চেনাজানা উনুন আর উচ্ছৃষ্টের ঘ্রাণ
পরিচিত শব্দের লোভে উবু হয়ে কান পাতি,
নি:শব্দ সন্তরণে ভাসে ক্রিক্রেট ব্যাটের গান।
বহুদিন আর বটের জানালায় চোখ রাখি না,
দেখি না আকাশে অাঁচড়ে ফেরা মেঘের গোল্লাছুট
আর কৃষ্ণচূড়া বিকেলের কোলাহল নেই বলে
বাসন্তি শাড়িটার ভাঁজে ভাঁজে জমছে দেখি
সারি সারি ন্যাপথলিনের ভীড়।
মসৃন কংক্রীটের ওপর আমার স্বচ্ছন্দ পদঘাত দেখে
দু'হাত মেলে এগিয়ে এলো স্বর্ণকেশী স্বপ্নদল।
অলংঘ্য ভবিষ্যত পানে শক্ত পায়ে এগুবার কালে
দমকা বাতাসে হঠাৎ উড়ে আসে কাঁঠাল চাঁপার ঘ্রাণ
আমি থমকে দাঁড়াই।
গন্ধে কিভাবে চোখ ভিজে উঠে, বুঝতে পারি না।
হৃদয়ের খাঁচা খুলে উড়িয়ে দিই অতীতের কবুতর।
স্মৃতিকে চাপড়ে দিয়ে গোধুলি আলোয়
উড়ে যায় পাখি,
বহুদূর ফেলে আসা এক ভেজা জোছনার দেশে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


