টিউটরিং এজেন্সি থেকে ফোন পেয়েই রাজি হয়ে হয়ে গিয়েছি। বাসা আমার বাসার খুব কাছে। সন্ধ্যায় ইউনিভার্সিটি থেকে আসার সময় পড়িয়ে আসতে পারবো, যাতায়াত নিয়ে চিন্তায় পড়তে হবে না। টিউটরিং এজেন্সি থেকে আগেই সতর্ক করে দেয়া ছিলো, ছাত্রীর মা ভালো ইংরেজি পারে না। একটু সমস্যা হতে পারে। আমি আপত্তি করি নি। ইংরেজি ছাড়াও মানুষকে বুঝতে পারি, মানুষের চোখ আর মুখের ভাষা পড়ে।
নির্দিষ্ট দিনে ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার পথে ঠিকানা দেখে বাসা খুঁজে বের করে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলাম লাল ইটের বিল্ডিংটার দিকে। বাইরে থেকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে, বেশ ছোট এপার্টমেন্টগুলো। ছোট্ট ছোট্ট বারান্দাগুলোতে দড়িতে কাপড় ঝুলানো। কোথাও থেকে ট্যা ট্যা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। হঠাৎ পিলে চমকানো কর্কশ নারী কণ্ঠের চিৎকার। সমান তালে গলা ফাটানো পুরুষ কণ্ঠ। ঝগড়া শুরু হয়েছে কোথাও। সাথে অকথ্য ভাষায় গালাগালি। জিনিস পত্র ভাঙার শব্দ। ঢোক গিলে আস্তে আস্তে প্রধান ফটকের কাছে গেলাম। সিঁড়ির পাশে স্তুপ করে রাখা পুরানো কাপড় চোপড়, পুরোনো পত্রিকা আর একটা ভাঙা চেয়ার সন্তপর্ণে এড়িয়ে গেলাম। ছয় নম্বর বাসাটা দোতালায়। একই ফ্লোরে আটটা বাসা। কলিং বেল নেই। যতটুকু জোড়ে সম্ভব টোকা দিলাম কাঠের দরজায়।
বেশ কিছুক্ষণ টোকা দেয়ার পরে দরজাটা অল্প ফাঁক হলো। এলোমেলো চুলের নিচে কুঁচকানো কপাল দু'টো চোখ প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে উঁকি দিল। 'আমি ডিলেককে খুঁজছিলাম। একশন কোচিং থেকে এসেছি। ডিলেকের টিউটর'। সাথে সাথে দরজা বড় করে খুলে গেল। মহিলা হাতের সিগারেট লুকাতে লুকাতে জোড়ে হাঁক দিলো, 'ডি-লে-ক...' তারপরে বিজাতীয় ভাষায় হাবি জাবি। তারপরে আমার দিকে ফিরে আন্তরিক হাসি দিল, যেটা দেখে এতক্ষণে চেপে বসা দ্বিধাটা এক মুহূর্তে হাওয়া। মহিলা ব্যস্ত ভঙ্গিতে আমাকে ঘরে ডেকে বসতে দিলো চেয়ারে। তখনই ঘরে দ্বিধান্বিত পায়ে হাজির হলো মিষ্টি চেহারার মেয়েটা। চেহারা দেখেই কাছে টানতে ইচ্ছা করে। গোল গাল পূর্ব ইউরোপীয় ফর্সা চেহাড়া। বাদামী চোখ, খাড়া নাক আর পাতলা ঠোঁট। হালকা বাদামী কোঁকড়ানো রেশমী চুল ছেড়ে দেয়া। শুধু দু'চোখে কেমন অস্থিরতা নয় বছরের মেয়েটার। ডেকে পাশে বসালাম। ডিলেকের মাও পাশে বসেছে। আমি আসার পর থেকে ক্রমাগত কথা বলে যাচ্ছে মহিলা, যার বেশির ভাগই আমি বুঝতে পারছি না। কিছু ইংরেজি শব্দ, কিছু তার কুর্দিশ উচ্চারণে ইংরেজি শব্দ, আর অজানা শব্দগুলোর অভাব পূরণের জন্য কুর্দিশ শব্দ। বুঝা সত্যিই কঠিন।
'দিলেক, শি য়ুর টিচার। লিসেন টু হার। নো বিয়িং নটি।'
ডিলেক মাথা কাত করলো।
মহিলা আগের সিগারেট শেষ হতেই ফস করে নতুন সিগারেট ধরালো। টেবিলেই একটা কাগজ টেনে নিয়ে সিগারেটের ছাই ফেলতে ফেলতে বললো, 'য়ু নো, মি সিংগেল মাদার। লাইফ, ভেরি হার্ড। ভেরি হার্ড।' আমার ভেতরে কিছু নড়ে উঠলো। সিগারেটের ধোঁয়ায় নি:শ্বাস চেপে ছিলাম। এবার সেটা ছেড়ে দিলাম।
এভাবেই শুরু। সূচনাই পর্বেই দেবশিশু চেহারার ভীত চোখের মেয়েটার জন্য গভীর মায়া জন্মে গেল। পড়াতে পড়াতে হঠাৎ মেয়েটাকে কুর্দিশ সিঙ্গল মাদারের একমাত্র কন্যা মনে হলো না, মনে হলো পৃথিবীর সমস্যাগ্রস্ত পরিবারগুলোর একজন, যাকে পাওয়া যাবে বাংলাদেশের জেলায় জেলায়। মা টাকে সামনে থেকে সরানো গেল না। বুঝলাম একটু পরে। খুব কষ্টের সংসারে, খুব কষ্টের টাকা দিয়ে পড়তে দিয়েছে মেয়েকে। সামনে থেকে দেখতে চায়, টাকাটা কই যায়। 'মাই গাল, শি ভেরি স্মার্ট। লটস অব ব্রেইন।' অবশ্যই, কিন্তু... ক্লাস ফোরের একটা মেয়ে যখন '৩*২=৬' পারে না, তখন বুঝতে হয়, সমস্যা আছে। যখন অতটুকু ছোট মেয়েটার মাকে আকারে ইংগিতে, স্পষ্ট ভাষায়ও মেয়ের সামনে সিগারেট খাওয়া থেকে বিরত রাখা যায় না, উল্টো ক্ষয়ে যাওয়া দাঁতে লজ্জিত হাসি হেসে বলে, 'আই ফীল ওয়ারিড। দিজ ইজ মাই ফ্রেন্ড। লাই ইজ হার্ড, ভেরি হার্ড', তখন বলার কিছু থাকে না। আট বছরের নিষ্পাপ চেহারা মেয়েটার ডিকশনারির পাশে কলমের আঁচড়ে যখন বড় করে লেখা থাকে 'এক ই এক্স', তখন শঙ্কা হয়।
তৃতীয় দিন পড়াতে গিয়ে শুনি পাশের বাসায় তুমুল চিৎকার। ডিলেকের মা তড়িঘরি করে দরজার কাছে গেল। আড় চোখে তাকিয়ে দেখলাম ডিলেকের মা দরজার ফুটো দিয়ে তাকিয়ে পাশের বাসার সিনেমা দেখে চলছেন। কিছুক্ষণ পরে মুখ আলোতে উদ্ভাসিত করে পাশে চেয়ার টেনে বসলেন। 'পাশের বাড়ির লোকটাকে আমার কোন দিনই পছন্দ হয় নাই। দেখা হলে হাই হেলো বলে না। অভদ্রের জাত। বউয়ের গায়ে হাত তুলে আর প্রতি রাতে চিল্লাচিল্লি জিনিস ছুড়াছুড়ি করে। আজকে মহিলা পুলিশে খবর দিয়েছ।' মহিলার গলায় স্পষ্ট তৃপ্তি। চেয়ারে হেলান দিয়ে যত্ন করে সিগারেট জ্বালালো। আমি অল্প হাসলাম। বিনোদন।
সেদিনই পড়ানো শেষে আমার হাত চেপে ধরে বলে, 'আই হ্যাভ নো মানি টুডে। আই হ্যাড টু বাই মাই সিগারেট। মাই বিল কেইম ২০০ ডলারস। উইল পে য়ু নেক্সট উইক।' আমি ব্যস্ত হয়ে উঠলাম, কোন অসুবিধা নেই!
মহিলার মুখে স্বস্তির ভাবটা দেখে কেন যে এত পরিচিত লাগলো!
মেয়েটা এখন কোথায় আছে জানি না। তিন মাস পড়ানোর পরে হঠাৎ একদিন বাসায় গিয়ে দেখি সারা বাসা ওলোট পালোট। এখানে সেখানে বাক্স ছড়ানো ছিটানো। হঠাৎ এক সকালে উঠে দেখে রান্না ঘরের গরম পানির কল নষ্ট হয়ে সারা ঘরের কার্পেট ভিজে গিয়েছে। থাকতো খুবই স্বল্প ভাড়ায়। তাই প্রতিবেশী বা বাসার অন্যান্য ব্যপারে বাছ বিচার চলতো না। স্বল্প ভাড়ার বাড়িওয়ালা বাসায় এসে শাসিয়ে গিয়েছে, দু'সপ্তাহের মধ্যে বাসা না ছাড়লে পুলিশ ডাকবে। ক্লান্ত চোখ দু'টি তুলে মহিলা বললো, আমি জানি না কোথায় উঠবো। হন্যে হয়ে বাসা খুঁজছি। একটাও সামর্থ্যের মধ্যে না। লাই ইজ হার্ড, ভেরি হার্ড। হাতড়ে সিগারেট বের করে মুখে পুরলো। ডিলেককে একটু আদর করে মহিলার ভেঙে যাওয়া ছবিটা নিয়ে বেরিয়ে আসলাম বাসা থেকে।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



