somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি ভালবাসার গল্প ।

০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.
এস.এস.সি পরীক্ষা শেষ করে টানা
চার মাস পর ক্যাডেট কলেজ থেকে
বাসায় আসলাম। ছুটিতে অনেক কিছু
করার পরিকল্পনা করলাম। কিন্তু
বাসায় এসে আমার মাথায় হাত।
কারন আমি কলেজে থাকা অবস্থায়
আমাদের বাসা চেঞ্জ হয়েছে। নতুন
বাসায় এসে কিছুটা অস্বস্তিতে
পরলাম। কাউকে চিনিনা। বাসায়
এসে কিছুক্ষন ধাতস্ত হওয়ার চেষ্টা
করছি, এমন সময় কেউ একজন বলে উঠল-
– আন্টি……………
একটা মেয়ে দৌড়ে ঘরে এসে ঢুকল।
ঢুকেই আমাকে দেখে লজ্জা পেয়ে
গেল। আর আমি হা করে তার দিকে
তাকিয়ে রইলাম। অপূর্ব!!! চোখ
ফেরাতে পারছি না। মাথায় সেই
বিখ্যাত কবিতা চলে এল-
“প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন
চৈত্র মাস,
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার
সর্বনাশ”।
মনে মনে নিজেকে গালাগালি
দিলাম তার দিকে এভাবে হা করে
তাকিয়ে থাকার জন্য। আম্মুকে ডাক
দিলাম। আম্মু এসে মেয়েটাকে
দেখে খুশি হয়ে গেল।
– আরে তানিয়া, বাইরে কেন?
ভিতরে এস।
– না, আন্টি। থাক। পরে আসব।
– আরে আস তো।
মেয়েটা লজ্জাবনত মুখে ঘরে এসে
বসল। আমি আম্মুর ভয়ে তার দিকে
তাকাতে সাহস পেলাম না। তারপর
ও আড় চোখে দেখার চেষ্টা
করছিলাম। আম্মু বোধহয় আমার কৌতূহল
টের পেয়ে বললেন-
– ওর নাম তানিয়া। এবার
এইচ.এস.সি দেবে। আর ও আমার
ছেলে, তুহিন। এইবার এস.এস.সি
দিয়ে কলেজ থেকে ছুটিতে
এসেছে। (বুঝতে পারলাম আমাকে
নিয়ে আগেও কথা হয়েছে)
মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে
একটা সুন্দর হাসি দিল। আমার হার্ট
বিট বেড়ে গেল। মনে মনে
নিজেকে ধিক্কার দিলাম( এত সুন্দর
একটা মেয়ে অথচ আমার সিনিয়ার,
কেমন রাগ টা লাগে……গররর)
– তোমরা বসে গল্প কর, আমি একটু
আসছি।
আম্মু পাশের ঘরে গেলেন হয়ত কিছু
খাবার নিয়ে আসতে। আমি একটু
অস্বস্তিতে পড়লাম কি নিয়ে কথা
বলব ভেবে। আমার মত সে ও চুপ করে
বসে রইল। আমাদের প্রথম পরিচয়ের
মুহূর্তটা নিরবতা দিয়েই কাটল।
২.
দু’ তিন দিন পার হয়ে গেল এখনো
তার সাথে কোন কথা হয়নি। এক
বিকেলে দেখি আমাদের বাসার
উঠোনে কয়েকজন ক্যারাম খেলছে।
আমি কাছে গিয়ে দেখতে
লাগলাম। একটু পরেই একজন চলে গেল
তার মায়ের ডাকে। বাকিরা সবাই
আমাকে জোরাজুরি করতে লাগল
খেলার জন্য। আমি রাজি হয়ে
গেলাম। যে চলে গেছে তার
জায়গায় গিয়ে দাঁড়াতে দেখি
আমার সাথে জুটি হচ্ছে তানিয়া।
আমি এতক্ষন খেয়াল ই করিনি যে সে
ও খেলছে।
আমি ইন্টার হাউস প্লেয়ার না হলেও
খুব একটা খারাপ খেলি না। তাই একটু
পরেই নিজের কারিশমা দেখান শুরু
করলাম। নিজের ভিতর পার্ট অনুভূত হল
(:))। সে ও অনেক ভাল খেলছিল। প্রথম
সেট জেতার পর তানিয়া আমার
দিকে তাকিয়ে অপূর্ব একটা হাসি
দিল। তারপর আমাকে অবাক করে
দিয়ে তার ডান হাত উঁচু করে একটা
হাই ফাইভ দিল। আমি তার হাতের
স্পর্শে এক মুহূর্তের জন্য অনড় হয়ে
ছিলাম।
– তুমি তো অসাধারণ খেল।
কলেজে কি কম্পিটিশন হয়?
– হ্যাঁ।
– তুমি খেল তাতে?
– আমি ইন্টার হাউস চ্যাম্পিয়ন।
(মিথ্যা বলতে একটু খারাপ
লাগছিল!!!!!!!!!!)
– ওয়াও।
তার মুগ্ধ হওয়া দেখে আমার খুব ভাল
লাগল। কি যে সুন্দর দেখাচ্ছিল! এরকম
সৌন্দর্যের জন্য আমি হাজার টা
মিথ্যা বলতে পারি। আমি আবার
তার দিকে হা করে তাকিয়ে
রইলাম। পাশের একজনের গলা
খাঁকারিতে সম্বিত ফিরে এল।
তারপর আবার খেলায় মনোযোগ
দিলাম। সেদিন সবগুলো খেলাতেই
আমরা জিতেছি। এরপর থেকে
নিয়মিত খেলা হত। আর বেশির ভাগ
খেলাতেই সে আমার জুটি থাকত।
৩.
ইতোমধ্যে আমি বাড়িতে আসার
তিন সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। তার
পরীক্ষা কাছে চলে এসেছে। আর
মাত্র সাত দিন বাকি। তার ভিতর
কোন ভাবান্তর নেই। সে দিব্যি
আছে নিজের মত। আমি মাঝে
মাঝেই তাদের বাসায় গিয়ে বসে
থাকি। তার সাথে গল্প করি। অন্য রকম
এক উন্মাদনা কাজ করে নিজের
ভিতর। তার মায়ের কথায় তাকে
মাঝে মাঝে ইংলিশ টা দেখিয়ে
দিতাম। একদিন তাদের ঘরের সামনে
একটা বেঞ্চে বসে আছি, সে আমার
সামনেই একটা চেয়ারে বসে পড়ছে।
আমি তার একটা বই উলটে পালটে
দেখছিলাম। হঠাৎ সে আমাকে বলে
উঠল-
– বইয়ের ভিতরে মাঝামাঝি
জায়গায় দেখ একটা পাতা আছে।
আমি কিছুক্ষণ খোঁজার পর দেখি এক
জায়গায় একটা গাছের পাতা। তার
মাঝে কিছু লেখা। আমি পাতা টা
কাছে নিয়ে এসে দেখি তাতে
লেখা- “Do you love me?”
আমি হতভম্ব হয়ে তার দিকে
তাকিয়ে রইলাম। কিন্তু কিছু বলার
আগে দেখি তার ছোট ভাই চলে
এসেছে। তাই আর কিছু বলার সুযোগ
পেলাম না। মনে শুধু একটাই প্রশ্ন- “Is
she serious?”
৪.
তানিয়ার পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে।
এতদিনে টের পেলাম আমার মা ওকে
কত টা পছন্দ করে। এমনিতে প্রতিদিন
কিছু রান্না করলেই ওর জন্য পাঠিয়ে
দেয়। একদিন আমাকে জোর করে
পাঠিয়ে দিল ওর পরীক্ষা শেষ হলে
ওকে নিয়ে আসার জন্য। আমি তো
অবাক। আন্টির ও দেখি তাতে সায়
আছে। কি আর করা। যেদিন যেদিন
পরীক্ষা থাকত আমি গিয়ে তাকে
নিয়ে আসতাম। রাস্তায় হেঁটে
আসার সময় অনেক গল্প হত। আমার ভালই
লাগত। আমাদের একটা অদ্ভুত খেলা
ছিল। প্রায় দিন ই আমরা যার যার
বাসার সামনের সিঁড়িতে বসে
চিরকুট চালাচালি করতাম। ডাক
পিওন ছিল পাশের বাসার একটা
বাচ্চা মেয়ে। খুব মজা লাগত এভাবে
চিরকুট পাঠাতে। একদিন তাকে প্রশ্ন
করলাম সেই পাতা টার ব্যাপারে।
“সেদিন যে প্রশ্ন টা করেছিলে
সেটা কার উদ্দেশ্যে ছিল?” সে প্রশ্ন
টা পরে কিছুক্ষণ আমার দিকে
তাকিয়ে থাকল। তারপর কিছু একটা
লিখে আমার কাছে পাঠাল। আমি
কাগজের ভাঁজ খুলে দেখি তাতে
লেখা-
– তোমার উদ্দেশ্যে।
– Are you serious?
– হ্যাঁ। এখন তোমার Answer দাও।
আমি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলাম। কি
উত্তর দেব তাকে? সে আমার থেকে
কমপক্ষে দু’বছরের বড়।(পরে জেনেছি
সে আমার থেকে নয় মাসের বড়)। আর
আমার মা জানতে পারলে আমাকে
মেরেই ফেলবে। আবার তার দিকে
তাকিয়ে আমি চোখ ফেরাতে
পারিনা। মনে মনে তাকে আমি
পছন্দ যে করিনা তা না। কিন্তু তাই
বলে তার সাথে আমার সম্পর্ক হওয়াও
অসম্ভব। আমি তাকে কিছুই বলতে
পারলাম না। নিজেকে কেন
জানিনা খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল।
৫.
ভেবেছিলাম সে হয়ত আমার সাথে
আর কথাই বলবে না। কিন্তু দেখলাম
আমার ধারনা ভুল। সে আগের মতই
আমার সাথে গল্প করছে। আমার খুব
ভাল লাগল তার ব্যাবহারে। সে হয়ত
নিজে থেকেই বুঝতে পেরেছে যে
এ ভালবাসা কোন দিন সম্ভব নয়।
আমাদের বন্ধুত্ব আগের থেকে আরও
ভাল হল। আমাকে সে অনেক কথা বলত
নিজের সম্পর্কে। আমার খুব ভাল
লাগত তার কথা শুনতে।
সেবার আমার জন্মদিনে বছরের প্রথম
বৃষ্টি হয়। বিকেলে আমরা তাদের
নির্মাণাধীন বিল্ডিং এর ছাঁদে
বসে গল্প করছিলাম। হঠাৎ করেই কোন
আগাম সংকেত না দিয়েই মুষলধারে
বৃষ্টি শুরু হল। আমরা তাড়াতাড়ি
নিচে নেমে এসে অসমাপ্ত একটা
রুমে আশ্রয় নিলাম। কেউ কোন কথা
বলছি না। কিছুক্ষণ পরেই বৃষ্টির তেজ
কমে গেল। আমি বাসায় যাওয়ার জন্য
উঠে দাঁড়ালাম। সে কোথা থেকে
জানিনা হঠাৎ একটা টুকটুকে লাল
গোলাপের কলি বের করে আমার
দিকে বাড়িয়ে দিল। তারপর
আমাকে হতভম্ব করে দিয়ে আমার
ঠোঁটে আলতো করে একটা কিস করল।
– Happy Birthday to You.
সে আর কিছু না বলে বেরিয়ে গেল।
আর আমি বজ্রাহতের মত সেই অন্ধকার
প্রায় ঘরে দাঁড়িয়ে রইলাম, হাতে
একটি লাল গোলাপ নিয়ে।
৬.
আড়াই মাস পর আমার এস.এস.সির
রেজাল্ট দিল। A+ পেয়ে ভালই
লাগছিল। তখনও গোল্ডেন এর খবর
আসেনি। আম্মু খুশিতে বাসার আশে
পাশের সবাই কে মিষ্টি খাওয়াল।
বিকেলে তানিয়া কে নিয়ে
হাঁটতে বের হলাম। ওর পরীক্ষা প্রায়
শেষ। আর বোধহয় একটা বাকি আছে।
তাও ৫ দিন পর। আমরা এখন নিয়মিত
বের হই হাঁটতে। ওর সাথে গল্প করতে
খুব ভাল লাগে আমার। কিভাবে যে
সময় টা চলে যায় টের ই পাইনা।
আমার মাথায় যে এত গল্প ছিল আমি
নিজেও আগে টের পাইনি। রাজ্যের
কথা হয় ওর সাথে। গল্পের কোন শুরু-
শেষ নেই।
– আমার রেজাল্টে তুমি খুশি
হওনি?
– অসম্ভব খুশি হয়েছি। আমার খুব
ভাল লাগছে। ইনশাল্লাহ তুমি
গোল্ডেন ও পাবে, দেখ।
– দোয়া কর।
দিঘীর পাড়ে এসে বসলাম। অপূর্ব সুন্দর
একটা জায়গা। আমার খুব ই ভাল
লাগে এখানে এসে বসতে। তার ওপর
ও সাথে থাকলে তো কথাই নেই। শুধু
ওর দিকে তাকিয়েই সময় পার করে
দেয়া যায়। মুগ্ধ হয়ে ওর কথা শুনছি।
“মেমসাহেব” এ পড়া সেই শের এর
অনুবাদ মনে পড়ে গেল-
“তুমি আমার সামনে বসে আছ, আমার
সাথে কথা বলছ।
তুমিই বল তোমাকে দেখব, না
তোমার সাথে কথা বলব”।
ওর ভাল লাগা, না লাগা জিনিস
গুল কেন জানি নিজের সাথে
মিলে যাচ্ছে। না মিললেও নিজের
ভালোলাগাকে পরিবর্তন করতে
ইচ্ছা হচ্ছে।
– কাল আমাকে ঢাকায় যেতে
হবে।
আমার কথা শুনেই ওর মুখটা কাল হয়ে
গেল।
– কেন?
– আব্বু যেতে বলেছে। আমাকে
একটা মোবাইল কিনে দেবে। তাই
পছন্দ করতে যেতে হবে।
– না গেলে হয়না?
ওর কষ্ট আমাকে ছুঁয়ে গেল। খুবই
খারাপ লাগছে। নিজেকে স্বার্থপর
মনে হল খুব। কী দরকার যাওয়ার? নাই
বা গেলাম। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে
পারলাম না। নিজের একটা
মোবাইলের আশা আমার অনেক
দিনের। সে আশাটাকে জলাঞ্জলি
দিতে খুব কষ্ট লাগল।
– আমাকে যেতেই হবে। মাত্র তো
কয়েকদিন। তারপর ই ফিরে আসব
আবার। প্লিজ তুমি আমার উপর রাগ
করে থেক না।
– ধুর পাগল। আমি তোমার উপর রাগ
করব কেন? তুমি যাও কয়েকদিন ঘুরে
আস।
ও না বললেও বুঝতে পারছিলাম কষ্টে
ওর বুক ফেটে যাচ্ছে, কিন্তু মুখে
স্বীকার করছে না। ওর প্রতি
ভালবাসা আমার কয়েকগুন বেড়ে
গেল।
৭.
ভেবেছিলাম ঢাকায় অনেক মজা
হবে। কিন্তু এসে কিছুই ভাল লাগছিল
না। বারবার আসার সময়কার ওর মুখটা
ভেসে উঠছিল। আসার আগে ও আমার
রুমে এসে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে ছিল।
হঠাৎ খেয়াল করে দেখি ওর গাল
বেয়ে পানির ফোঁটা ঝরে পড়ছে।
আমি আশে পাশে কিছু চিন্তা না
করেই ওর মুখটা দু’হাত দিয়ে তুলে ধরে
ওর ঠোঁটে একটা কিস করলাম। আমার
পক্ষ থেকে এই প্রথম ওকে কিস করা।
ওকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকলাম
কিছুক্ষণ। একটু পর ই ও নিজেকে শান্ত
করে নিল। তারপর আমার দিকে
তাকিয়ে জোর করে একটা হাসি
দিল।
– ভাল ভাবে যেও। আর
তাড়াতাড়ি চলে এস। আমি তোমার
অপেক্ষায় থাকব।
আমি কিছুই বলতে পারলাম না। চুপ
করে বসে থাকলাম। একটু পর আম্মু
বাইরে থেকে এলে ব্যাগ নিয়ে
বের হলাম। ও আম্মুর সাথে আমার
পিছনে পিছনে আসতে লাগল। বাস
ছাড়া পর্যন্ত তারা দাঁড়িয়েই ছিল।
জানালা দিয়ে বারবার ঘাড়
ঘুরিয়ে ওকে দেখার চেষ্টা
করছিলাম। আস্তে আস্তে ও দৃষ্টির
আড়ালে চলে গেল। কেন জানিনা
চোখের কোণ বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু
গড়িয়ে পড়ল।
আশা করেছিলাম ঢাকায় এসে
নারায়ণগঞ্জ যাব। ক্লাস 6 এ ক্যাডেট
কোচিং করার জন্য সেই যে
নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে টাঙ্গাইল
এসেছিলাম আর ফেরা হয় নি। আমার
স্কুল জীবনের বন্ধুদের খুব মিস করি।
কিন্তু বিধি বাম। ঢাকায় এসে সাত
দিন থাকলাম, একটা দিন ও বৃষ্টির জন্য
বাইরেই বেরুতে পারলাম না। শুধু
মোবাইল কেনাই সার হল, আর কিছুই
করা হয়নি। সারাদিন ঘরে বসেই
কাটাতে হয়েছে। কি আর করা, ব্যর্থ
মনোরথে আবার বাড়িতে ফিরে
এলাম।(এখন পর্যন্ত ও আমি নারায়ণগঞ্জ
যেতে পারিনি :()।
বাসায় এসে হঠাৎ খেয়াল করলাম
আমার বাসায় তানিয়াকে আর
দেখা যাচ্ছে না কখনো। খুব অবাক
লাগল। ওকে জিজ্ঞেস করাতে কিছুই
বলল না। শেষে আমার ছোট বোনের
কাছে শুনলাম কাহিনী। আমি
যেদিন ঢাকা যাই সেদিন আমার এক
খালাত বোন আসে আমাদের বাসায়।
আমি তার আগমন টের পাইনি। আমার
ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে সে আমাকে
আর তানিয়াকে একসাথে দেখতে
পায়। দুর্ভাগ্যক্রমে আমি তখন
তানিয়া কে কিস করছিলাম। সে
কিছু না বলেই বেড়িয়ে চলে যায়
বাসা থেকে। পরবর্তীতে আমি চলে
গেলে বাসায় এসে আম্মুকে সব কথা
বলে দেয়। আর তারপর আম্মু তানিয়ার
সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দেয়।
তানিয়াও বুঝতে পারে যে কোন
একটা সমস্যা হয়েছে, তাই সে আর
আমাদের বাসায় আসে না। মনে হল
নিজের উপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে
গেল। সব শুনে আমি পাথরের মত চুপ
করে বসে রইলাম। আগের মত বাইরে
বেরাতে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।
মাঝে মাঝে আমি ওদের বাসায়
যেতাম ঠিক ই কিন্তু ও আর আমার
বাসায় আসত না। এদিকে আমার
কলেজে যাওয়ার সময় এসে গেল। না
বলা এক যন্ত্রণা নিয়ে কলেজে
ফিরে গেলাম। এসে কয়েকদিনের
মধ্যেই টের পেলাম জীবনে প্রথম
বারের মত আমি সত্যি সত্যি কাউকে
খুব বেশী ভালবেসে ফেলেছি।
৮.
কলেজে এসে অনেকদিন পর প্রিয় বন্ধু
গুলোকে দেখে খুব ভাল লাগল।
ছুটিতে কে কি করেছে, কে খুব
সুন্দরী এক মেয়ের সাথে পরিচিত
হয়েছে, কে ইতোমধ্যেই প্রেম
নিবেদন করে ফেলছে এসব জানতে
জানতেই কয়েকদিন পার হয়ে গেল।
চির পরিচিত সেই মাঠ আর
একাডেমিক ব্লকে প্রতিদিনের
কর্মব্যস্ততার মাঝে কিছুদিনেই
নিজেকে খুব একা মনে হল। বারবার
ছুটিতে কাটান তানিয়ার সাথের
মুহূর্ত গুল মনে পরতে লাগল। প্রেপ টাইম
এ ক্লাসের বদলে বাইরের বারান্দায়
দাঁড়াতেই বেশী ভাল লাগত।
চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতে
ভাল লাগত। মনে হত চাঁদটাও আমার
মত নিঃসঙ্গ। মাঝে মাঝে মনে হত
হয়ত সে ও আমার মতই চাঁদের দিকে
তাকিয়ে আছে এই মুহূর্তে। দিন গুলো
যেন কাটতেই চাইছিল না। বন্ধুরা
শিঘ্রীই বুঝে ফেলল আমার রোগ টা
কোন জায়গায়। শুরু হল আমাকে
জ্বালান। তবুও যন্ত্রণা গুলো ভালই
লাগত।
সবসময় ওর কথা মনে পড়লেও পরীক্ষা
গুলো কিভাবে জানি ভাল হয়ে
গেল। অথচ পড়া লেখার খাতায় ততটা
দাগ পড়েনি, যতটা গল্পের খাতায়
পড়েছে। বুঝলাম আমি জাতে
মাতালদের দলে হলেও তালে ঠিক ই
আছি এখনও। ক্লাস 11 এর প্রথম টার্ম এন্ড
এ প্রথম ৫ জনের ভিতরে নিজেকে
দেখে খুব ভাল লাগল। এই ভেবে সাহস
বেড়ে গেল যে অন্তত মাকে তো
বলতে পারব যে ওর জন্য আমি নিজের
ক্যারিয়ার নষ্ট করিনি। অনেক
জ্বালা যন্ত্রণা ও দুঃখ-সুখের ভেতর
দিয়ে অবশেষে আবার কলেজ বাসে
উঠে রওনা হলাম নিজের বাড়ির
উদ্দেশে। বাসায় এসে দেখি যার
জন্য আমার এত আকুলতা সে ই চলে
গেছে তার গ্রামের বাড়িতে ছুটি
কাটাতে। শুরু হল আমার অপেক্ষার
দ্বিতীয় প্রহর।
প্রতিটা দিন বাইরে থেকে বাসায়
এলেই রাস্তা থেকে আগে ওর ঘরের
জানালার দিকে তাকাতাম। যখন
দেখতাম জানালা টা বন্ধ, সাথে
সাথে আমার মন খারাপ হয়ে যেত।
বাসায় আর কিছুই ভাল লাগত না।
সারা দিন মন মরা হয়ে পড়ে
থাকতাম। আমার মা বুঝতে পারত কেন
আমার মন খারাপ, কিন্তু এই নিয়ে
কখনো কিছু বলত না। আমিও চাইতাম
না আমার মায়ের সাথে এ নিয়ে
কোন কথা বলতে। অন্য প্রতি বছর
রোজার ছুটিতে বাড়িতে এলে
আমার খুব ভাল লাগত। এক টানা
এতদিনের ছুটির মজাই আলাদা ছিল।
কিন্তু এই প্রথম মনে হল ছুটির আসল
আনন্দের উৎস হারিয়ে গেছে।
এভাবে চলে গেল প্রায় ২০ দিন।
একদিন বিকেলে কেমিস্ট্রি পড়ে
বাসায় আসার সময় দেখি ওর
জানালার পাল্লা দুটো খোলা।
আমার মুখটা সাথে সাথে ১০০ ওয়াট
বাল্বের মত জ্বলে উঠল। দৌড়ে
বাসায় এসেই ওদের ঘরের দিকে
ছুটলাম। ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই
জিজ্ঞেস করল “কেমন আছ?” অজানা
অভিমানে আমার কোন কথা বলতে
ইচ্ছা হল না। ও বুঝতে পারল আমি রাগ
করে আছি। তাই আমার মন ভাল করার
জন্য আমার গালে আলতো করে একটা
চুমু দিল। সাথে সাথে আমার রাগ
গলে পানি। আমরা আবার সেই আগের
মত গল্পে মেতে উঠলাম। আমার যে এ
কয়দিন মন আদৌ খারাপ ছিল তা
নিজের ই মনে থাকল না।
কয়েকদিনের মধ্যেই ওদের রেজাল্ট
দিল। খুব বেশি ভাল না হলেও
খারাপ করেনি। আমার সবচেয়ে ভাল
লাগল যখন ও আমাকে জিজ্ঞেস করল
আমি খুশি হয়েছি কিনা। তখন আমার
মত খুশি আর কেউ ছিল না। এভাবেই
চলতে থাকল আমার অসম ভালবাসা।
৯.
রেজাল্ট দেয়ার কয়েকদিন পর
আমাদের বাড়িওয়ালার ছেলে
শিমুল ঢাকা থেকে বাড়িতে এল।
সেও সেবার এইচ.এস.সি দিয়েছে।
সে আসার পর থেকে হঠাৎ করে
খেয়াল করে দেখি তানিয়া কেমন
যেন বদলে গেল। আমার সাথে আগের
মত তেমন একটা কথা বলেনা। ওকে
বেশির ভাগ সময় ই শিমুলের সাথে
দেখা যেতে লাগল, গল্প করছে।
আমার খারাপ লাগলেও কখনো মুখ
ফুটে কিছুই বলিনি। কেননা আমার
এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে খুব
খারাপ লাগত। নিজেকে কেমন ছোট
ছোট লাগত। কিন্তু দিন দিন তাদের
মেলামেশা বেড়েই চলল। আমি
নিরবে সেসব কিছুই সহ্য করে গেলাম।
ঈদের পরে একদিন সন্ধ্যার আগে আমি
আমার রুমে শুয়ে শুয়ে টিভি
দেখছিলাম। পাশে আমার মা আর
আমার বোন বসে ছিল। হঠাৎ দেখি
তানিয়ার মায়ের পিছনে তানিয়া
আমার ঘরে এসে ঢুকল। তানিয়া এসে
আমার মাথার কাছে বসল। আগে ও
আমাদের বাসায় এলে সবসময় এই
জায়গাতেই বসত। আমার খুব ভাল
লাগল ওকে আবার সেই আগের মত
আমার কাছে বসতে দেখে। একটু পরেই
ও ওর হাত টা পিছনে এনে আমার
বালিশের নিচে রাখল। দেখে
বুঝলাম ওর হাতে কিছু আছে। আমি
আমার মায়ের চোখ এড়িয়ে ওর
হাতে হাত রাখলাম। ও আমার হাতে
একটা কাগজের টুকরো ধরিয়ে দিল।
তারপর কিছু না বলেই ঘর থেকে
বেড়িয়ে গেল। আমি অনেক দিন পর
ওর কাছ থেকে আবার সেই আগের মত
চিরকুট পেয়ে খুব খুশি হলাম।
তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে
পাশের ঘরে এলাম চিরকুট টা পড়ার
জন্য। তাকিয়ে দেখি পেন্সিল
দিয়ে কাগজটাতে কিছু লেখা
আছে। আমি পড়া শুরু করলাম।
“তুহিন, তুমি এস.এস.সি দিয়ে বাসায়
আসার পর আমি তোমাকে একদিন
একটা গাছের পাতা তোমাকে
দেখিয়েছিলাম। তাতে একটা প্রশ্ন
ছিল। তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে প্রশ্ন
টা কার উদ্দেশে ছিল। আমি
তোমাকে বলেছিলাম ওটা তোমার
জন্য। আসলে ওই লেখা গুলো তোমার
জন্য ছিলনা। I am sorry. আমাকে ক্ষমা
করে দিও। আর আমাকে ভুলে যেও”।
আমি হতভম্বের মত তাকিয়ে রইলাম
পেন্সিলে লেখা কিছু শব্দের
দিকে। মনে হচ্ছিল এটা কোন চিঠি
না। এটা আমার Death Note. আমি
আমার বাসার বাইরে এসে তাদের
ঘরের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।
কিছুক্ষন পর সে ঘর থেকে বেরিয়ে
এল। আমার মুখ দিয়ে শুধু একটা কথাই
বের হল- “আপনাকে ধন্যবাদ”।
১০.
হঠাৎ করে জীবন টা খুব ফালতু মনে হল।
মনে হল এ জীবনে বিশ্বাস বা
ভালবাসা বলে আসলে কিছুই নেই। সব
কিছুই মিথ্যে। নিজেকে ধিক্কার
দিতে ইচ্ছা হল। কিন্তু কেন জানিনা
বারবার দোষ গুলো সব ওর দিকে সরে
যাচ্ছিল। ওর প্রতি আমার ঘৃণা তীব্র
থেকে তীব্রতর হতে লাগল। কোন
কারনে ওর সাথে রাস্তায় দেখা
হলেই আমি ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে
নিতাম। মনে হত ওকে দেখলেই আমার
পাপ হবে।
ছুটি শেষ হয়ে এল। যাওয়ার আগের
রাতে আমি আমাদের
বাড়িওয়ালাদের বাসায় গেলাম
বিদায় নিতে। কারন আমার গাড়ি
ছিল খুব সকালে। গেট দিয়ে ঢুকেই
তাদের সামনের রুম এ চোখ গেল।
দেখি তানিয়া ঘুমিয়ে আছে
তাদের বিছানায়। সাথে সাথে
রাগে আমার মাথায় রক্ত উঠে গেল।
ইচ্ছা করছিল গলা টিপে ওকে
সেখানেই মেরে ফেলি। কিন্তু
পারিনি। হয়ত ওকে খুব বেশি
ভালবাসতাম বলেই আমার ঘৃণা
পরাজিত হয়েছিল। আমি আর ঘরে না
ঢুকে কাউকে কিছু না বলেই বের হয়ে
এলাম। এরপর আর কোনদিন আমি ওর
মুখের দিকে তাকাইনি।
মখমুর দেহলভির শের টা মনে পড়ে
যাচ্ছে-
“মহাব্বাত জিসকো দেতে হ্যায়,উছে
ফির কুছ নেহি দেতে।
উছে সাবকুছ দিয়া হ্যায়, জিসকো ইস
কাবিল নেহি সামঝা”
-“জীবনে যে ভালবাসা পায়, সে
আর কিছু পায়না। যে আর সবকিছু পায়,
সে ভালবাসা পায় না”
ঘৃণা মিশ্রিত একটি ভালবাসার
গল্পের এখানেই পরিসমাপ্তি।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

সচিব, পিএইচডি, ইন্জিনিয়ার, ডাক্তারদের মুখ থেকে আপনি হাদিস শুনতে চান?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৪৫


,
আপনি যদি সচিব, পিএইচডি, ইন্জিনিয়ার, ডাক্তারদের মুখ থেকে হাদিস শুনতে চান, ভালো; শুনতে থাকুন। আমি এসব প্রফেশানেলদের মুখ থেকে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, বাজেট,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×