১২ জুন ২০১৫ তারিখের ট্রলার যাত্রার ভয়ঙ্করতা দেখার তখনও অনেক কিছু বাকি। প্রকৃতি আমাদের নিয়ে নিষ্ঠুর খেলায় মেতে ওঠেছে। মাঝ নদীতে ট্রলারটি কলার মোচার মত দুলছে। একটা বড়সড় ঢেউ নিমিষেই উল্টে দিতে পারে ট্রলারটিকে। সাতাশ জন যাত্রীর ভাগ্য পেন্ডুলামের মতই দুলছে। উত্তর আকাশের মেঘ ভয়ঙ্কর কালো রূপ ধারণ করে গোটা আকাশ ছেয়ে ফেলেছে। বাতাসের দাপট আরও বেড়েছে। সৃষ্টিকর্তার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ ছাড়া কারও যেন কিছুই করার নেই। সৃষ্টিকর্তার কাছে মনে মনে একটি আবেদন করে রাখলাম। যদি দুনিয়ায় আমার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে থাকে তবে সম্মানজনক মৃত্যুই যেন হয়।
এই সমাজে অনেক লোক আছে যারা স্রোতের প্রতিকূলে চলতেই ভালোবাসেন। স্রোতের বিপরীতে চলতে গিয়ে ভয়ঙ্কর বিপদের মুখোমুখি হন। সেই বিপদকে পাশ কাটিয়ে চলতেই থাকেন। এই সাহসী মানুষগুলোর জন্যই দেশ ও সমাজ এগিয়ে যায়। ট্রলারের মাঝিকে এখন আমার সেই সাহসী কান্ডারী বলেই মনে হচ্ছে। সাতাশটি জীবনের সমস্ত ভার নিজের কাঁধে নিয়ে ট্রলার মাঝি শক্ত হাতে হাল ধরে আছে। প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে এগিয়ে আসা ঢেউকে কখনও পাশ কাটিয়ে, কখনো বা ঢেউয়ের মাথায় ট্রলারটিকে তুলে দিয়ে দক্ষতার সাথে লড়াই করে চলেছে।
কালো মেঘে ঢেকে থাকা আকাশ এবার ট্রলারের উপর ভেঙে পড়ার উপক্রম। বাতাস যেন মেঘকে উড়িয়ে আমাদের ট্রলারের দিকেই ধেয়ে নিয়ে আসছে। নদীতে ঢেউয়ের তোড়, বাতাসের দাপট, মেঘের গর্জন সব কিছুই ভীতিকর। কিন্তু আমার মনে কোনো ভয় জাগছে না। আমি ট্রলারের যাত্রীদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি। আমার বামপাশে মধ্যবয়স্ক এক দম্পতি। স্ত্রীটি ডানহাতে শক্ত করে স্বামীর হাত ধরে আছে। ভাবখানা এমন ট্রলারডুবি হলেও স্বামীর হাত ধরেই ডুববে। স্ত্রীটি বিড়বিড় করে দোয়াদরুদ পড়ছে। স্বামীটি শক্ত মুখে বসে আছে। লোকটির মনে কি তোলপাড় চলছে তা ভাবার চেষ্টা করছি।
কিশোর বয়সী কয়েকজন শ্রমজীবী ট্রলারে ওঠেছিল একেবারে শেষ মুহূর্তে। তাদের হাতে ছিল মৌসুমের শেষ ফল লিচু। হাত থেকে ছুটে গিয়ে পলিথিন ছিঁড়ে লিচুগুলো ট্রলারের মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। একজন চারটি মুরগী নিয়ে ওঠেছিল। মৃতপ্রায় মুরগী চারটির পাগুলো একত্রে বাধা। ট্রলারের প্রচণ্ড দুলুনিতে মুরগীগুলো ক্ষণে ক্ষণে ডানা ঝাপটে জীবনের প্রতি সাড়া দিচ্ছে। ট্রলারের মাঝামাঝি বামপাশে আপাদমস্তক কালো বোরকায় আবৃত এক মহিলা। বমি করতে করতে মহিলাটি সেখানেই শুয়ে পড়ল। পাশেই তার স্বামী নির্বিকার চোখে তাকিয়ে আছে। কিছুই যেন করার নেই। চঞ্চল বাচ্চাদুটো এই দম্পতিরই। বাচ্চা দুটো বমি করে নেতিয়ে পড়েছে অনেক আগেই। ট্রলারের ভারসাম্য রক্ষায় নড়াচড়ার ও উপায় নেই। ট্রলারের মেঝেতে গাদাগাদি করে থাকা মানুষগুলো জীবনেরআশা ছেড়ে দিয়ে পাথরের মূর্তির মত চুপচাপ বসে আছে।
প্রকৃতি এবার তার সর্বশেষ অস্ত্র নিয়ে হাজির। প্রচণ্ড বাতাসের সাথে বৃষ্টি শুরু হলো। ট্রলার মাঝির সহযোগী ঝটপট একটি বড় মোটা পলিথিন বের করে আনল পাটাতনের নিচ থেকে। হাতে হাতে ধরে সবার মাথার উপর দিয়ে পলিথিনটি শামিয়ানার মত করে টানানো হলো। ট্রলারের সামনে গলুইয়ের উপর বসা মৌলভী টাইপের সেই যুবক পর্যন্ত পলিথিন পৌঁছায়নি। স্থির দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে সামনের পানে। মনে হচ্ছিল দিক নির্দেশনা দিয়ে ট্রলারটিকে সেই চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
সাদা মোটা পলিথিন মাথার উপর ধরা। বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা তীরের ফলার মত পলিথিনের উপর এসে পড়ছে। পলিথিনের নিচে আমরা ঢাকা পড়ে গেছি। মোটা পলিথিন ভেদ করে বাইরে দৃষ্টি যাচ্ছে না। ট্রলারের ইঞ্জিনের গর্জন শতগুণ বেড়ে গিয়ে কানের পর্দা ফাটিয়ে দিচ্ছে। তবুও এই মাঝ নদীতে ট্রলারের প্রচণ্ড শব্দটিকেই একমাত্র আপন মনে হচ্ছে। এখন ইঞ্জিনটিই ট্রলারের প্রাণ। ইঞ্জিনটি বন্ধ হয়ে গেলে ঢেউয়ের তোরে আর বাতাসের দাপটে মুহূর্তেই ট্রলারটি উল্টে যাবে।
মৃত শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে রাখা মায়ের দিকে দৃষ্টি দেই। কখন যেন শিশুটিকে তিনি পাটাতনে শুইয়ে দিয়েছেন। পরম মমতায় আঁচল দিয়ে মরদেহটিকে ঢেকে রেখেছেন। মৃত শিশুটির উপর খানিকটা ঝুঁকে বসে আছেন। আঁচলের পাশ দিয়ে মাঝে মাঝে শিশুটির মুখ বের হয়ে যায়। রক্তশূণ্য ফ্যাকাশে সাদা মুখটা। মৃতদের মুখ এমনই হয় বুঝি। ট্রলারটি ডুবে গেলে আমরা সবাই মরে যাব। মরে গেলে রক্ত শূণ্য হয়ে আমাদের সবার চেহারাই বুঝি এমন হয়ে যাবে। জীবন আর মৃত্যুর মাঝামাঝি অবস্থায় এমন ভাবনা আমায় পেয়ে বসে।
ইঞ্জিনের ধোঁয়ায় পলিথিনের ভিতরটা ভরে গেছে। স্বাভাবিক শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ট্রলার একবার ডান কাত একবার বাম কাত হয়ে সামনে এগিয়ে চলছে। বাইরের কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে অনন্ত যাত্রা। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। তেড়ে আসা বিশাল আকৃতির ঢেউগুলি দেখতে হচ্ছে না। কিন্তু ঢেউয়ের আঘাতে ট্রলারের দুলে ওঠা দেখে ঢেউয়ের বিশালতা টের পাচ্ছি। একবার মনে হলো ট্রলারসমেত আমরা ঢেউয়ের পাহাড়ে উঠে পড়েছি। পতনের সময় পেটে কেমন শূন্যতা অনুভূত হলো। পাখির পালকের মত হালকা মনে হলো শরীরটা। উঁচু থেকে পতন হলে এমনই বোধহয়। নাগরদোলায় যারা চড়েছেন তারা পরিস্থিতিটা উপলব্ধি করতে পারবেন। চোখ বন্ধ করে শেষবারের মত সৃষ্টিকর্তার নাম স্মরণ করে প্রস্তুত হয়ে রইলাম। ট্রলারটি বুঝি ঢেউয়ের চূড়া থেকে নিচে ছিটকে পড়ে উল্টে গেল!
ট্রলার মাঝির দক্ষ পরিচালনায় ঢেউয়ের বিশাল আঘাতটি সামাল দেওয়া গেছে। একের পর এক ঢেউ আঘাত হানছে আর ট্রলারটি লাফাচ্ছে। মনে হচ্ছিল কোনো শিশু আনমনে একটি কাগজের নৌকা নিয়ে খেলছে। আমরা ভিতরে এতগুলো যাত্রী আছি শিশুটির সেদিকে যেন কোনো খেয়াল নেই। ভয়ঙ্কর এই অবস্থার মধ্যেও আমার সেই গানটির কথা মনে পড়ে গেল। নজরুল গীতিটি চরম সত্য হয়ে ধরা দিল আমার মনে। 'খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে, বিরাট শিশু আনমনে ...
প্রায় আধাঘন্টা প্রচণ্ড বৃষ্টি ঝরিয়ে মেঘ কিছুটা হালকা হতে থাকলো। বাতাসের দাপটও ক্রমশঃ কমতে লাগল। মেঘ কেটে গিয়ে পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়া সূর্য দেখা দিয়েছে। পলিথিনটা সরিয়ে মুক্ত বাতাসে আবার শ্বাস নিলাম। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে এখনও। এতক্ষণে তীরের দেখা পাচ্ছি। সামনে ভোলার ইলিশা ঘাট। আরও প্রায় পনের মিনিট লাগবে ঘাটে পৌঁছুতে। ঢেউয়ের প্রবলতা অনেকটা কমেছে। ট্রলারটি তেমন আর দুলছে না। বৃষ্টিধোয়া আকাশ আর নদীটাকে খুবই পবিত্র লাগছে। বেঁচে আছি দেখে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করছি। সবার মাঝে প্রাণচাঞ্চল্যতা ফিরে এসেছে। মৃত্যুভয়ে ভীত সবার কঠিন মুখগুলোতে ধীরে ধীরে স্বাভাবিকতা ফিরে আসছে। প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে টিকে থাকাটা বেশ আনন্দের। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে ভিজে বেঁচে থাকার আনন্দ উপভোগ করতে করতে ইলিশা ঘাটে ট্রলারটি ভিড়ল। ততক্ষণে সূর্য পশ্চিম পাটে অস্ত গিয়েছে। ঘাটের কাছাকাছি কোনো এক মসজিদের মাইক থেকে মাগরিবের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে ...আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ...