নানা কারণে উৎসাহ খুব কমই ছিল আমার; ফলে দেখাও হয়নি।
যখন জানতে পারলাম, বাংলাদেশ সরকারের সেন্সর র্বোড মাটির ময়না প্রচারের জন্য অনুমোদন দিচ্ছে না। কেননা, সেখানে না কি ইসলাম র্ধমকে কটাক্ষ করা হয়েছে। আর যদি ইসলাম ধর্মের ক্ষতিই হয়, তাহলে তা অবশ্যই ইহুদি-খ্রিষ্টানদের মনোবাসনা পূরণ করে।
হয়তোবা, এসবের কোনো কিছুই নির্মাতা পরিকল্পিতভাবে করেনি। হয়তোবা অজান্তেই তার সৃষ্টি অন্যের ইচ্ছায় ব্যবহার হয়েছে। ... কেননা, এখন তারা সহজেই বোঝাতে পারবে-‘আর এই-ই হলো ইসলাম।’ তথাপি, আমি মাটির ময়না স¤প্রচারে অ-অনুমোদনের ক্ষেত্রে সরকারি মনোভাবের ভীষণ বিপক্ষে, কারণ মানুষের চিন্তা ও সৃষ্টিকর্ম প্রকাশের অধিকার আছে। আমি চেয়েওছি তাই-মাটির ময়না অবশেষে মুক্তি পাক; পেয়েওছে।
ইতোমধ্যে ফিল্ম জগতের সর্বোচ্চ স্কুল-অস্কারে মনোনীত হওয়ার জন্য মাটির ময়না লাইনে দাঁড়িয়েছে। এই দুঃসাহস-ই বা দেখায় কে!
বসে আছি, ঢাকার বইপাড়া আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ ‘বইপত্র’র সামনে। আকাশের সূর্যকে পাশ কাটাতে শুরু করেছি আমরা। মানুষের তারারা একটা একটা করে জ্বলে উঠছে। বইয়ের কীটেরা এসে গেছে। কবিকূল কিচিরমিচির করছে। আজিজ ঝকমকিয়ে উঠেছে। এমন সময় আসলেন নেভি ব্লু জিন্সের শার্ট-প্যান্ট আর ব্র“সলীয় কালো কেডস পরিহিত ঘাড়ে চিরসাথী কাপড়ের ঝোলা আর এক মাথা সাদা-কালো কেশ নিয়ে খিস্তি-খেউড়ের চলমান ডিকশনারি বাংলাদেশ শর্টফিল্মের পুরধাপুরুষ আমাদের প্রিয় খসরু ভাই।
মোহাম্মদ খসরু তার স্বীয় ডিকশনারির পাতা উল্টাতে উল্টাতে বললেন, ‘কোলকাতা ফেস্টিভ্যালেও মাটির ময়না নেয়া হচ্ছে না।’
রাগ হলো। আরো খবর নিয়ে জানতে পারলাম, বুদ্ধদেব বাবুরা নাকি ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষায় বড্ড চিন্তিত। তাই তারা মাটির ময়না এখানে আসুক চায় না। তবে আশ্বস্ত হলাম এ সংবাদ শুনে যে, পাল্টা ফেস্টিভ্যালে মাটির ময়না যাচ্ছে।
এবার আমি রাজি হলাম-কাঁটা সাপের মুণ্ডু, সাপ লুডু খেলা, পাল্টা কথার সূত্রমুখ অথবা বুনোশুয়োরের গো’র লেখক পাল্টা ধারার পাল্টা মুখ, পাল্টা স্রোতের পাল্টা লেখক, হারমজ্জায় গল্পকার সেলিম মোর্শেদের প্রস্তাবে মাটির ময়না দেখতে।
আসলে মাটির ময়না কতোটা আঘাত করেছে ধর্মে, যে বুদ্ধদেব বাবু পর্যন্ত থমকে গেলেন?
নাকি, বঙ্গীয় বাঙালি অথবা বাংলাদেশীরাও যে সিনেমা বানাতে শিখেছে, বাবুরা তা মানতে, বলতে ও দেখতে নারাজ-!
বোঝা দরকার।
মাটির ময়না দেখলাম।
খোদ ল্যাবরেটরিতে বসে।
সবকটি বাল্ব অফ করা। ঘরভর্তি অন্ধকার। পাশের ঘরে বাল্ব জ্বলছে; দরজা সামান্যই খোলা। ফর্সা-রে এসে স্ক্রিন বরাবর আলো-আধারি করে তুলেছে।
পরিচালক বললেন, স্টার্ট-
আমি বসে আছি ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে। হ্যাঁ, সন্ধিক্ষণই বলবো, কেননা মাটির ময়নায় চিত্রিত হয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসের আনন্দ বেদনার এক দুঃসাহসিক ক্ষণ-৬৯, ৭০, ৭১। শুধুমাত্র সংখ্যাতত্ত্বের বিচারেই নয় বরং আরো সেই-ই ‘সময়’ যখন-কে বলা চলে-আমাদের নাভিমূল অথবা সংস্কৃতি লুকিয়ে যাবার সূচনা কাল। আমাদের ভাষা, লোকগান, কবিগান, গৌণধর্ম, বাউল তত্ত্ব ও নৌকা বাইচ সবকিছুই যখন হারাতে আরম্ভ করেছিল-আমরা ভেবেছিলাম। আর যখন আমাদের ভক্তিবাদী মানসে রক্তাক্ত করে ঢুকছিলো রগ-রগে শ্রেফ-ই মুনাফালোভী, ক্ষমতা সর্বস্ব রাজনীতি। সন্ধিক্ষণ আরো এ কারণে যে, পূর্ববাংলায় বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার স্রোতে ৬০ এর দশক দিয়েছিলো অভাবনীয় সংযুক্তি। আর এ জ্ঞান-বন রোপিত হয়েছিলো নিশ্চয় আরো অন্তত ৬০ বছর আগে অর্থাৎ ভারতবর্ষে মুসলমানদের আত্মপরিচয়ের আন্দোলনের প্রথমার্ধে। যখন তারা লড়াই করেছিলো একদিকে ইঙ্গো-সাম্রাজ্যবাদ অন্যদিকে মাড়োয়ারি পুঁজির বিরুদ্ধে। একদিকে যীশু-ই আগ্রাসন অন্যদিকে রামবাদী নিপীড়নের বিরুদ্ধে। ৬০’র দশক যেন সেই উর্বর জমিতে বিকশিত বৃক্ষের পাকা ফসল। যে ফসল বীজ হয়ে পুনরায় রোপিত হবে আমাদের জমিতে। সবে জো এসেছে, যখন প্রয়োজন চাষের আর চাষার। ঠিক, এই ক্ষণটিই ছিল ৬৯, ৭০, ৭১। তখনই বঙ্গীয় মাঠে প্রবেশ করে সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, চানক্য পুঁজি আর বহুজাতিক কোম্পানি। সাধের ৪৭ যখন বঙ্গীয় মোহাম্মদীদের গলার কাঁটা ঠিক এই সময়টিই হলো মাটির ময়না’র আকাশ।
সুবেহ সাদিক। পূর্ব দিগন্তে লাল আভা উঁকি দিবে ভাব। সবুজে ভেসে আছে একটি পরিষ্কার ঐতিহ্য। বিশাল ভীতের প্লাস্টার খসে গেছে। অসহায় ইট তাকিয়ে আছে; ঝরে পড়ছে চুন-সুরকি যেন কোনো বিহারের অবশেষ।
হায় তুলতে তুলতে আড়মোড়া ভেকে একে একে বের হয়ে আসছে গোলটুপি, হাঁটুর নিচ পর্যন্ত পাঞ্জাবি, লুঙ্গি আর চপল পরিহিত ভবিষ্যত। এই মুহূর্তে গন্তব্য তাদের বাঁধানো ঘাট।
‘কয়লা দিয়ে দাঁত মাজতে নেই’ বলে পকেট থেকে নিমের দাঁতন বের করে দিলেন ছোট হুজুর।
আনু পরিষ্কার হয়ে নিলো।
ভেসে এলো আহ্বান-
‘হ্ইা আলাছ ছালাহ
হাই আলাল ফালাহ
আল্লাহ আকবর।’
প্রার্থনা শেষ।
তারপর-
ইকরা;
ইকরা বিছমি রব্বু কাল লাজি খালাক।
শুরু হয়েছে মাথা কুটে কোরআন পাঠ...
ইতস্ত বিক্ষপ্ত বাল্বের মৃদু আলোয় গোটা মাদ্রাসা প্রাঙ্গণ তৈরি করেছে এমন এক অবয়ব-দেখিনি যে ‘নালন্দা’ এ যেন তাই!
এক ব্রিলিয়ান্ট উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে মাটির ময়নার কাহিনী।
শিক্ষার মান নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। থাকতে পারে তার দার্শনিক ভিত্তি নিয়েও। সমাজে এ বিতর্ক চলছেও। অনেকে জোরগলায় মাদ্রাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে রাজনীতিও করছে কেননা তা অধিক পরিমাণে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি শূন্য, পশ্চাৎপদ, অ-প্রগতিশীল, ফলে তা বন্ধ হওয়ায় উচিৎ।
জবাবে ভাবুক বাঙালি মুসলমানের মন বলেছিলেন, একটু বিজ্ঞানের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে আধুনিক করে নিয়ে কি মাদ্রাসাও দিতে পারে না অনেক...। কেননা সেখানে যে, সমাজের অভাবী এতিমেরা পড়ে! আমরা কি তাদের সে সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করবো?
অন্যদিকে সরাসরি পাল্টা অভিযোগ এনে দৈন্য গান বললেন, আমাদের সমাজের কথিত আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোই বা কতোটুকু বৈজ্ঞানিক। বরং তা কি কলোনি ব্যবস্থারই সেবাদাসত্ব করছে না। বিজ্ঞানমনস্ক, বৈজ্ঞানিক, আধুনিক এসব কথা বলে কি প্রতিষ্ঠানসমূহ সত্য কাজ থেকে সরে গিয়ে সাম্রাজ্যবাদ প্রেমিক কলোনিয়াল মানসিকতারই জন্ম দিচ্ছে না? এসব বিতর্ক এড়িয়ে গেলেও মাটির ময়নায় পরিষ্কার চিত্রিত হয়েছে শিক্ষার প্রতি অনুরাগ, আকুতি, কান্না যে মাদ্রাসার আছে সে কথা। আর চিত্রিত হয়েছে মানুষের জীবনে প্রতিক্ষেত্রে ডিসিপ্লিনের প্রয়োজনীয়তা আর ফুটে উঠেছে পরিকল্পনার সংস্কৃতিতে নিজেকে চালনার গুরুত্ব। সকাল সকাল শয্যা ত্যাগ এবং সকাল সকাল শয্যা গ্রহনের তাগিদ প্রতিষ্ঠায় মাদ্রাসার মোয়াল্লিমের দায়িত্ব পালন দর্শককে আকৃষ্ট করতে তাই পুরোমাত্রায় সফল হয়েছে।
এই মাদ্রাসায় ভর্তি করেছে এক সময়কার আধুনিক মানুষ কাজী সাহেব তার ছেলেকে।
ডাক নাম-আনু।
দশ-বারো বছরের এক গ্রাম্য বালক।
ধর্মপ্রাণ বাবার দু’ছেলেমেয়ের মধ্যে সে বড়; একমাত্র ছেলে।
আনুর বাবারা দু’ভাই, ছোটচাচার নাম মিলন। সে সমান স্মার্ট; বড়ভাই কাজী সাহেবের ঠিক বিপরীত। বলা চলে, কমিউনিস্ট। ছাত্র রাজনীতি করে।
একই পরিবারে দু’টি মতের সহাবস্থান।
এ-বাংলার কোনো নতুন ঘটনা না বরং অজানা কাল থেকে বয়ে আসা বৈশিষ্ট্য, কেননা এই সমাজে বেদ-চার্বাক একই সাথে অবস্থান করেছে। কৃষ্ণ-বৌদ্ধ তথা ঈশ্বর ভজনা ও নিরঈশ্বরবাদ চর্চা গলাগলি চলেছে। দাদু, কবীরের পাশাপাশি নিজামউদ্দিন আউলিয়া থেকেছে। মহাপ্রভু গৌরাঙ্গ-আউলচাঁদ-লালনের সাথে গীতা-কোরআনের ভক্তি সমানে থেকেছে। ধর্মীয় রাষ্ট্র কায়েমের আন্দোলনের পাশে কমিউনিস্ট ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম সমানে চলে আসছে। এসবই আমাদের বৈশিষ্ট্য তথা সংস্কৃতি। মাটির ময়নার প্রতিটি সিকোয়েন্সে তারিক মাসুদ সে সত্যই তুলে ধরেছেন।
ফি বছর গ্রামে অনুষ্ঠিত কবিগান, বাউল গান, নৌকা বাইচ, ধর্মমত নির্বিশেষে নারী-পুরুষের উপস্থিতিতে তৈরি হতো যে প্রাণমেলা আনু সে মেলায় অংশ নিতো ছোট চাচার হাত ধরে।
মাদ্রাসায় আলিফ, বে, তে, ছে পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আনুর দু’চোখে সে সব স্মৃতিই ভেসে উঠছে।
হ্যাঁ, স্মৃতিই-
কেননা এখন থেকে ওসব অনুষ্ঠান আনুর জন্য নাযায়েজ। কোনো কিছুই তার ভালো লাগছে না এখন। কিন্তু সে যে মানুষের বাচ্চা-
যে ভাবেই হোক সে পরিবেশকে শাসন করবেই-আনুও তাই বন্ধু হয়ে গেল রোকনের।
রোকন আনুর বয়সী এক এতিম। তার কাছে কিন্তু ‘রেশনাল’ প্রমাণ দেয়া খুব বেশি জরুরি হয়নি বরং মানুষ যে একাধারে শিল্পী, স্রষ্টা-সে যে খেলে, ‘বিরাটও শিশু আনমনে।’ আপন ভূবনে হারিয়ে গিয়ে।
এই যে মানুষের শ্বাশত স্বভাব, চিরন্তন বৈশিষ্ট্য, রোকন চরিত্র এ কথাই স্মরণ করে দিয়েছে।
মাদ্রাসার অদূরেই জঙ্গলের ভেতরে এক পোড়োবাড়িতে স্থাপিত হয়েছে রোকনের বিশ্ববিদ্যালয়। হয়তো কেউ কেউ বলবে গবেষণাগার। আর আনুই মাদ্রাসার একমাত্র ছাত্র, যে রোকনের জগতে প্রবেশ করার অনুমতি পেয়েছে; যেন-‘কে’ তার হাবিবকে এনেছে ‘আরশ’ দেখাতে।
আনু যেমন অভিভূত, তেমনি বিস্মিত। সে এখান থেকে যেতে চায় না। আনু অব্যক্ত ভাষা দিয়ে বলে ফেলে-তার বাবার পছন্দ-অবদমন...
বুদ্ধিমান নির্মাতা তারিক মাসুদের উদারতা এখানেই যে, গদ্য দিয়ে সবকিছু শেষ করে দেননি। দর্শকের স্বাধীনতাকে সীমাহীন করেছেন। আনুর অব্যক্ত কথার জবাবে বাবা কাজী সাহেব তাই ঠাণ্ডা অথব নীরব, গোমড়ামুখ, গোঁ ব্যক্তিত্ব দিয়ে এ কথাই বোঝাতে চায়-সেও জীবনের কোনো এক অধ্যায়ে কথিত আধুনিক ছিলো।
উদার, মুক্তমনা ছিলো।
কিন্তু রাজনীতি, আর রাজনীতি আশ্রিত ধর্ম আর মদদপুষ্ট ধার্মিকেরা তাকে তার আধুনিকতাকে এমনভাবে কোনঠাসা করে ভোগ করতে থাকলো যে, আধুনিকতা তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারে কোনো ভূমিকা-ই রাখতে পারলো না। কিন্তু কাজী সাহেবের ভেতরে নিদ্রা থাকা বিলুপ্তপ্রায় ধর্ম জেগে ওঠে; সে-ই স্বীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সু-সংহত করে।
এই ধর্ম-ই হলো ইসলাম।
রাজনীতি হলো মুসলিম লীগ।
ভাগ হলো সবকিছুই-
লোকাচার, বিশ্বাস, মূল্যবোধ এমনকি মাটি... ভারত ও পাকিস্তান।
কাজী সাহেবের এখন নতুন পরিচয়, সে ‘পাকিস্তানি’। সুতরাং সেই স্বোপার্জিত পাকিস্তানে একজন মুসলমান বঞ্চিত হবে এ কথা যেমন সে ভাবতে পারে না তেমনি পাকিস্তান ভাঙতে হবে (!) সে কল্পনাও করতে পারে না। আর সে কারণেই-
ছোটভাই মিলনের মিছিল সহ্য হয় না। কেননা; তার মুষ্টিবদ্ধ হাত ৪৭-এ কাজী সাহেবকে যে পাকিস্তানি হতে বাধ্য করেছিলো, তারই পক্ষে কথা কয়...
আবার মিলনের কণ্ঠস্বর, যে জীবনের মতোই সত্য ছিলো, সে দিকগুলো খুঁতহীনভাবে উঠে এসেছে মাদ্রাসার মোয়াল্লেম ও ছোট হুজুরের চিন্তিত কথোপকথনে-যেমন, ছোট হুজুর বলছেন-
‘পাকিস্তান জন্মের আগেও তো এ দেশে ইসলাম ছিলো’
‘ইসলাম কি পাকিস্তানরা এনেছে যে পাকিস্তান ভেঙে গেলে ইসলাম চলে যাবে?’
বড় মিষ্টি এ জিজ্ঞাসা!
অর্থাৎ ৪৭-এ যে অমোঘ সত্য সামনে এসেছিলো কাজী সাহেবদের, ঠিক আজ ৭০, ৭১-এ যেন সেই একই ধরনের সত্য হাজির হয়েছে মিলনের খিড়কিতে। ৪৭-এর সত্য ছিলো ধর্মীয় সংস্কৃতির জাতীয়তার আদলে আর ৭১ এসেছে বঙ্গীয় নৃ-জাতি গোষ্ঠীর সংস্কৃতিক ব্যঞ্জনায়।
মাটির ময়না খোলাশা করেছে, সত্যের নানাপিঠ। সমাজের দ্বান্দ্বিক দিক। সত্যও যে আপেক্ষিক-সে সত্য। সময়ের সত্য সর্বসময়ের জন্য সত্য নাও থাকতে পারে; যেমনভাবে ৪৭-এর সত্য ৭১-এ পরাভূত হয়েছে। থতমত হয়েছে; বুঝে উঠতে পারেনি-আত্মস্থ করতে পারেনি উত্তর সময়। এ অবস্থায় চিৎকারে শব্দ থাকে না, রাগ মলিন হয়ে যায়, বাক্যে বর্ণ থাকে না, সবকিছু ঝরে পড়ে, মুড়ি বয়ে লিখতে হয় -স্বীয়ত্যাগ।
ওই আসছে পাকিস্তানিরা (হানাদার বাহিনী)। ঢাকায় মিছিলে গুলি চলেছে ... অনেক মানুষ মারা গেছে। মিলনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ড্যা-ড্যা-ড্যা শব্দ। মানুষের ছোটাছুটি। ঘর ছেড়ে পালাও। আনুর বাপ চল! ওরা আমাদের হত্যা করবে কিন্তু আমাদের বাঁচতে হবে। ...
নীরবে দৃঢ় প্রত্যয়ে ওজু করে, আঙ্গুলের ফাঁকে পানি ঢুকায় কাজী সাহেব।
আনু আর তার মা ছুটে পালায় মানুষের পিছু পিছু। বাঁশবাগানে খোলা আকাশের তলে।
আগুন নিভে যায়। ফিরে আসে আনুরা।
আনুর বাপ- আনুর বাপ!
আব্বা- আব্বা, তুমি কই!?
শব্দ নেই। বিধ্বস্ত ভাঙাচোরা, ঝলসে যাওয়া গৃহে একটি, পোড়া কাগজ হাতে অসহায় বসে আছে। জীবনের চেয়েও, সন্তান-স্ত্রীর চেয়েও প্রিয় আলিফ, বে, তে, ছে’র করুণদশা নিয়ে কাজী সাহেব বসে আছে।
নতুন সব সময়ই গতিময়। গতি, সত্য মিথ্যা ভাবার সময় দেয় না। আনুর মা নতুনের পক্ষে; সিদ্ধান্ত তার সঠিক না বেঠিক হয়েছে-এ প্রশ্ন এখন আর কোনো অর্থ বহন করে না।
সে আকুতি জানায়- আনুর বপ চল। এ-গাঁ ছেড়ে চলো আমরা চলে যায়।
আনুরও একই সুর ‘আব্বা চলো-।’
আনুর মা পা বাড়াল। মা’র আঁচল ধরে আনুও।
কাজী সাহেব ঠায়-বিমূঢ় যেন, মুহুর্ত ভাবার অবকাশ চাই-
তাহলে কি আদর্শ, নীতি, ধর্ম, আল্লাহ বিশ্বাস এ সবের-চে বড় সত্য সম্পদ-ক্ষমতা-ভোগ!?
কাজী সাহেবের ভ্যাবা-চ্যাকা কাগজে ফুটে উঠেছে-অন্তত চরম মত সত্য না; জোর কষ্টের, এ সত্য প্রথম বার বুঝেছিল যখন একমাত্র আদরের মেয়ে চিরদিনের জন্য চলে যায়। তখনই সে ত্যাগ করে হোমিওপ্যাথি। এমনকি পকেট থেকে টাকা বের করে হাতে ধরিয়ে দেয় রোগীকে শহরে যেয়ে এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার জন্য। মানব মনের চলমান দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া এমনি ভাবে চিত্রিত হয়েছে নানা দৃশ্যে-মাটির ময়না’য়।
এমনি বুদ্ধিমত্ত্বা ও মমতা দিয়ে নির্মাতা জানিয়েছেন, নিয়মে ব্যাত্যয় ঘটালে অথবা স্রোতের উজানে অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মান, যে ফল বয়ে আনে না বরং আকাংখাকেই মাটি করে দেয় রোকনের পরিণতি তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ধারাবাহিক অবদমন শেষ পর্যন্ত রোকনের মস্তিষ্কে জ্যাম উৎপাদন করে, বিকার করে তোলে। ফলে উদ্দেশ্য মাদ্রাসার যত মহৎই হোক না কেন!
নিশ্চয় রোকন-অবস্থা সৃষ্টি তৈরি লক্ষ নয়!!
তা হলে, পরিবর্তন হও।
সময়কে স্বাগত জানাতে শেখ-
পরিষ্কার সাবধান বাণী অথচ অ-আরোপিত। কোন কিছু চাপিয়ে না দিয়েও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বঙ্গীয় সমাজের খুঁটিনাটি অসাঢ়তা।
ঈদুল-আযহা। সকাল থেকেই আনন্দের ব্যস্ততা; উৎসব চারিদিক। সময় হয়েছে প্রিয় বস্তু উৎসর্গের। খঞ্জর উঁচিয়ে হাটুর নিচ পর্যন্ত জুব্বা এগিয়ে চলেছে। জানালার ধারে বাঁধা স্বাস্থ্যবান গরুটিকে সকলে মিলে ঠেলে ধরল মাটির সাথে, সেকি কাবু করা যায়! অত বড় গরু, যে বাঁচতে চায়। জোর কসরতের এক পর্যায়ে- আল্লাহু আকবর শেষে আড়াই বার চললো। উষ্ণ লালে মাটি ভিজে ... । মা তাড়াতাড়ি জানালা বন্ধ করে দিল, কেননা মেয়ে জড়িয়ে ধরেছে।
কাঁপতে কাঁপতে ‘ওখানে কি হচ্ছে, মা?’
‘কিছুনা’-
কিছুতো বটেই, অথচ অবুঝকে যা বলতে পারল না মা। কিন্তু দর্শককে কি সব কথা বলা হয়ে যায়নি-? কী নির্মমতা!!
আর দেখিয়ে দিয়েছে, মধ্যবিত্ত ঠুনকো মূল্যবোধের কচ্কচানি। যে মূল্যবোধ আরো কিছুটা আগেই ভেঙ্গে যাওয়ার কথা ছিল, যদি বিকাশের রাস্তায় বার বার ছন্দপতন না ঘটত।
গোঁড়া ধার্মিকের গৃহ-কারায় আজীবন বন্দি আনুর মা যখন মস্তিষ্কের ভেন্টিলেশন প্রয়োজনে কাছে পায় মিলনকে, যে তার খেলার সাথীও বটে। সেই ছোট্টো অবস্থায় স্বামীবাড়ী এসে যাকে পেয়েছিল। হই-হুল্লোড়ে খেলার ফাঁকে তার একবার শাড়ি খুলে গিয়েছিল, সে-কি লজ্জায় না পেয়েছিল সে। মুহুর্তের আনন্দে নষ্টালজিয়ায় ফিরতে বলে দেবরকেও কিন্তু মিলন ফিরতে পারে না। মধ্যবিত্ত নামক কাঁটাতারের বেড়া যেন সামনে এসে দাঁড়াল। সে তখন বে-রসিক বিপ্লবের তত্ত্ব হাজির করল।
আনুর মা’র মস্তিষ্কের জানালা বন্ধ হয়ে গেল। সেই জ্যাম-ই থেকে গেল। কাজী সাহেব আর মিলন জানি একই জিনিস। আসলে, মতবাদ মানেই চরমপন্থা আর তাই-ই তো মৌলবাদ।
১২ জানুয়ারি, ০৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




