somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

বিএম বরকতউল্লাহ
পড়াশোনা করি। লেখালেখি করি। চাকরি করি। লেখালেখি করে পেয়েছি ৩টি পুরস্কার। জাতিসংঘের (ইউনিসেফ) মীনা মিডিয়া এ্যাওয়ার্ড ২০১১ ও ২০১৬ প্রথম পুরস্কার। জাদুর ঘুড়ি ও আকাশ ছোঁয়ার গল্পগ্রন্থের জন্য অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ শিশুসাহিত্য পুরস্কার ২০১৬।

বড়োদের ছোটোগল্প: লালের বউ সমলা

০৬ ই আগস্ট, ২০২০ সকাল ১০:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

লাল মিয়ার নতুন বউ সমলা, ভোররাতে বদনা হাতে বাইরে গেল। ফিরে এল লাশ হয়ে। ‘আমি মরে গেছি, জলদি দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করেন’ বলেই লাশটা লাল মিয়ার পাশে শুয়ে পড়ল। লাল মিয়া এটা-সেটা বলে, বউয়ের কোনো সাড়া-শব্দ নেই। সে হাত দিয়ে দেখে বউ তার পাথরের মত শক্ত। ভয়ে লাল মিয়ার গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল। সে কী করবে কিছুই বুঝে উঠতে না পেরে এক লাফে মেঝেতে পড়ে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিল।

তার চিৎকার চেচাঁমেচিতে পাড়ার লোকের ঘুম ভেঙ্গে গেল। ‘কী হয়েছে, কী হয়েছে‘ বলতে বলতে লোকজন এসে ভিড় করেছে লাল মিয়ার ঘরের ভেতরে ও বাইরে। লাল মিয়া প্রলাপে-বিলাপে কেঁদে-কেটে হয়রান। খাটে তার বউয়ের লাশ।

কৌতূহলী লোকের কাছে প্রিয়তমা বউয়ের লাশ হওয়ার কাহিনি বয়ান করতে করতে লালের মুখে ফেনা উঠে গেছে।

ময়মুরুব্বীরা লাল মিয়ার বাড়ির বাইরের উঠোনে বসে মেলা সময় ধরে শলা-পরামর্শ করলেন। আর দেরি করা ঠিক হবে না। সিদ্ধান্ত হলো, লাশ দ্রুত কবর দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। দা, কোদাল, বাঁশ, তুস, খেজুর পাতা, কলাপাতা, চাটাই ইত্যাদি নিয়ে গোরস্থানে চলে গেল কয়েকজন। পুরোদমে কাজ শুরু করে দিয়েছে তারা।

দুই.
ভেতর বাড়ির উঠোনের এক কোণায় চৌকি ফেলে এর ওপর মশারী টানা হয়েছে। তার চারপাশে সাদা শাড়ির বেড়া। এখানে লাশের গোসল হবে। মলিন মুখে মহিলারা রান্না ঘরে বড় ডেকচিতে বড়ই পাতা-পানি গরম করছে। একজন অতি বৃদ্ধমহিলা চৌকির কোণায় সাবান আর তোয়ালে হাতে নিয়ে চুপ করে বসে আছেন লাশ ও গরম পানির অপেক্ষায়। দু‘জন শক্ত মহিলা ধরাধরি করে গরম পানির ডেকচিটা দিয়ে গেল বুড়ির সামনে। তিনি লাশের গোসল দিবেন।

একজন দায়িত্বশীল মহিলা এসে ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে আঙ্গুল নেড়ে বলল, ‘ভেতর বাড়িতে কোন পুরুষবেটা থাকতে পারবে না, সবাই বাইরের উঠানে চলে যাও। মহিলার কথায় পুরুষবেটারা নিঃশব্দে চলে গেল বাইরের উঠোনে। মহিলা ঘরে ঢুকে দেখে লাল মিয়া খাটের পায়ায় ক্লান্ত শরীর হেলান দিয়ে এক ধ্যানে বসে আছে। সে লালকে বলে, এই, তুইও বাইরে যা, লাশের গোসল হবে, এখানে কোনো পুরুষবেটা থাকতে পারবে না।‘ এ কথা শুনে লাল মিয়া চোখের পানি ও নাকের পানি এক করে আগড় বাগড় কী সব বলল তা কারোর বুঝার সাধ্য নেই। মহিলাটি কি আন্দাজ করে জানি লালকে বলল, আইচছা তুই এহানেই থাক, লাশের গোসল দিমু। কোন ঝামেলা করবি না কইলাম, বহুত কানছছ, এহন বইয়া জিরাইয়া ল।’ অনুগত লাল মিয়া ঝিম মেরে বসে রইল।

দু‘জন মহিলা লাশের ওপর মশারী টেনে ধরেছে। আর চার শক্তমহিলা মাথার আঁচল কোমরে বেধে লাশ বাইরে আনতে ঘরে গেল। চারজনে চারদিক থেকে ধরাধরি করে লাশটা উপরে তুলতেই তারা শুনতে পেলো, ‘আস্তে ধইরেন গো, ব্যথা পাই, মরছি কোনসময় আর এহন দিবেন গোছল?‘ এ কথা শুনে মশারীধারী ও লাশধারী ছয় মহিলা কপালে চোখ তুলে আচমকা দাঁড়িয়ে গেল। হতভম্ব হয়ে একজন আরেক জনকে বলল, ‘ঘটনা কী, কথা কইল কেডা!‘

কেউ জবাব দিবার আগে পাশে বসা লাল মিয়া ভাঙ্গা গলায় বলল, ‘কেডা আবার, লাশে কথা কইছে।‘ হায় হায় কয় কী! ধড়াম করে মশারীসুদ্ধ লাশটা খাটে ফেলে দিয়ে ছয় শক্ত মহিলা লাফিয়ে গিয়ে উঠোনে আছাড় খেয়ে পড়ে বিরাট হাঙ্গামা বাধিয়ে দিল। ছয় মহিলা চীৎকার চেঁচামেচি করে পাড়া মাথায় তুলল। বাইরের উঠোন ও আশপাশের বাড়ি থেকে স্রোতের মত মানুষ এসে ভিড় করেছে এখানে। ভয়ার্ত ছয় মহিলা কাঁপতে কাঁপতে নাকে মুখে কথা বলে ভিড় ঠেলে উর্দ্ধশ্বাসে ছুটে পালিয়ে গেল। ছয় মহিলার কথা শুনে হতভম্ব লোকজন ভয়ে জানবাজি দৌড়ে যে যার ঘরে গিয়ে খিল এঁটে বসে হাঁপাতে লাগল।

দৌড়ে পেছনেপড়া মহিলা ও শিশুদের ভয়ার্ত চিৎকারে পাড়ার কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে এলোপাতাড়ি ছুটোছুটি করছে। কয়েকজন দৌড়ে কুেলাতে না পেরে লাফিয়ে গাছে উঠে ডালপালা ঝাপটে ধরে ঘাপটি মেরে বসে আছে। মুহূর্তের মধ্যে লাল মিয়ার বাড়ি জনশূণ্য হয়ে গেল। লাল মিয়া একা উঠোনে অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে রইল। ঘরে বউয়ের লাশ-বাইরে লাল মিয়া। মাঝখানে অন্তহীন ভয়ংকর দূরত্ব।

তিন.
সমস্ত ঘটনা শুনে মুরুব্বিরা লোক পাঠিয়ে দিলেন।
অসংখ্য তাবিজ-কবচ, মাদুলি, শুকনো ডালপালা ও সালু কাপড় পরিহিত ও তিন শিস্য পরিবেষ্টিত ঝটাধারী এক ওঝা এসে উপস্থিত। নাম তার দাংশুওঝা। সে জিন-ভূত তাড়ানো ও সাপের বিষ নামানোর মতো বহু রহস্যবিদ্যায় পারদর্শী। তার চলন-বলন, চেহারা-ছুরত, সাঝসজ্জা আর উদ্যোগ-আয়োজন দেখে সবার ভেতরে আশার আলো সঞ্চারিত হলো। সবাই বলাবলি করছে ‘জাত ওঝা রে, এ ব্যাটাই পারবে‘।

ঘরের চার কোণা থেকে চার চিমটি মাটি নিয়ে লাশের শিথানে দু‘ চিমটি রাখল ও লাশের পায়ের পাতায় ঘষলো দু‘ চিমটি। লাশের শিথানে লম্বামতো আঁকাবাঁকা একটা সফেদ লাঠি অবলীলায় খাঁড়া করে রাখল দাংশু। তার নির্দেশে তিন শিষ্য গাল ফুলিয়ে শংখ-শিঙ্গায় ফু দিল। দাংশুর চোখে মুখে রহস্যের ও আতœবিশ্বাসের ভয়ংকর ছাপ ফুটে উঠল। শংখ-শিঙ্গা বাজিয়ে তিন শিস্য কাহিল হয়ে গেল।

দাংশু দুর্বল ও ব্যর্থ তিন শিষ্যকে গালমন্দ করতে করতে ঝোলা থেকে বিন বের করে নিজেই ফু দিল। বেজে উঠল বিন। বিন বাজাতে বাজাতে ঘরের বাইরে চলে এলো দাংশু। খানাখন্দ, গর্ত, ছিদ্র বাদ রাখল না কিছু; সবখানেই লাগিয়ে দিল তন্ত্র-মন্ত্রের ছোঁয়া। আবার ঘরে প্রবেশ করল দাংশু। লাশটা ভালো করে দেখে গাল ফুলিয়ে আবারো বাজাতে শুরু করল বিন। কিছুতেই কিছু হচেছ না। তারপর দাংশু বিন ফেলে উচু নিচু স্বরে, মাথার ঝটা ও হাত বিক্ষিপ্ত করে জ্বিন, ভূত-পেতনী ও সাপের চৌদ্দগোষ্ঠীকে গালাগালি করে ও মন্ত্র-তন্ত্রবানে তুড়ি মেরে লাশের মুখে ফু দিতে গেল। অমনি একটা শব্দ হলো। ঠাস্। থাপ্পড় মারার শব্দ।

লাশের থাপ্পড় খেয়ে দাংশুওঝা গালে হাত দিয়ে একটা চিৎকারে দরজা ভেঙ্গে লাফিয়ে উঠোনে পড়ে হাঁটু ধরে বেশুমার হাঁপাতে লাগল। তার গালে পাঁচটা আঙ্গুলের পষ্ট দাগ। তার মুখ থেকে গলগল করে তাজা রক্ত বেরুচেছ। তার চারপাশে লোকজন সভয়ে এসে ভিড় করেছে। চারদিক থেকে অসংখ্য প্রশ্নের বান তার দিকে। দাংশু কথা বলতে পারছে না। সে হাত ইশারায় কি জানি বলতে চেয়েও বলতে পারল না; কাতরাতে কাতরাতে ঢলে মাটিতে পড়ে বেহুঁশ হয়ে গেল। অবস্থা বেগতিক দেখে তিন শিষ্য একটা মই এনে গুরু দাংশুকে তুলে হন্ হন্ করে এখান থেকে বেরিয়ে উধাও হয়ে গেল। মারাতœক বিপদ আঁচ করে আতঙ্কিত লোকজন ছোটাছুটি করে পালিয়ে গেল।

চার.
লাল মিয়ার আশপাশে কেউ নেই। উপায়হীন লাল মিয়া বহু কষ্টে পাশের নদীতে কলা গাছের ভেলায় বউয়ের লাশ ভাসিয়ে দিল। এবং দু‘হাত তুলে চোখের জলে কাতর স্বরে বলল, ‘দয়াল তুমি সত্য, আমি সত্য, আমার বউ সত্য তবে তার বাঁচা-মরা নিয়ে এত রহস্য কেন? এই আমার প্রিয় বউয়ের লাশ ভাসিয়ে দিলাম নদীতে। তুমি তাকে আমার কাছে আবার ফিরিয়ে দিও। যে-কোনো মূল্যে তাকে আমি ফিরত পেতে চাই দয়াল।‘

পাঁচ.
পরদিন লাল মিয়া ফুরফুরে মেজাজ ফিরে পেল এবং পাত্রীর সন্ধানে চারদিকে লোক পাঠিয়ে দিল।
বিধি বাম! দরজায় ঠক্ঠক্ শব্দে লালের ঘুম ভেঙ্গে গেল।
কে! কে?!
-আমি সমলা।
-সমলা মরে গেছে।
-সমলা মরে গেছে মানে? এই যে আমি দাঁড়িয়ে আছি দরজার সামনে।
লালমিয়া দরজা খুলে দিয়ে হাউ মাউ করে কান্না জুড়ে দিল।



সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০২০ সকাল ১০:৪৬
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×