রমার যেদিন জন্ম হলো সেদিন ছিল জষ্টি মাসের দ্বিতীয় সোমবার। সেদিন নতুনের আগমনে অন্য সকলের মতো আমিও আনন্দে নেচে উঠেছিলাম।
রমার বাবা আমাকে রোপন করেছিল ওদের বারবাড়ি উঠোনের পূব কোনে। বড়ো যতন করে রোপন করেছিল আমাকে। গর্ত করে শক্ত মাটিগুলো আগে থেকেই গুঁড়ো করে রেখে দিয়েছিল। আর গর্তের মাটিগুলো ছিল গোবর আর চুলোর ছাই মেশানো। প্রায় দেড়ফুট গর্তের ভেতরে আমাকে রাখা হলো। তারপর রমার বাবা নরম হাতে ধীরে ধীরে গর্তের পাড়ের মাটিগুলো দিয়ে গর্তটি ভরাট করে দেয়। অতপর এক বালতি পানি এনে ছিটিয়ে দিয়ে গর্তের ও পাশের মাটি ভিজিয়ে দেয়। আমি যাতে অল্পতেই হেলেদুলে পড়ে না যাই সেজন্য আমার গা ঘেষে কোপে দেয় আমার সমান এক খণ্ড বাঁশ। তারপর রশি দিয়ে তিন জায়গায় বাঁশের সঙ্গে আমাকে ঢিলে করে বেঁধে দেয়।
আমার কাছাকাছি পাশের বাড়ির জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে একটি জলপাই গাছ। আমার মনে আছে জলপাই গাছ সেদিন আমাকে স্বাগত জানিয়ে বলেছিল, কোনো ভয় নেই ভাই। এবাড়ির মানুষগুলো খুব ভাল। কোনো কষ্ট হবে না তোমার।
তখন অবশ্য আমি আমার ভাইবোনদের কথাই ভাবছিলাম। আমরা একই জায়গায় একসঙ্গে বেড়ে উঠেছি। নার্সারি থেকে রমার বাবা যখন আমাকে নিয়ে আসে তখন আরেক জন নিয়ে যাচ্ছিল আমার অন্য বোনদের। আমরা তখন খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কষ্টে মন খুব খারাপ হয়েছিল। কেননা আমরা জানতাম না কে কেমন মালিকের হাতে গিয়ে পড়ে। মালিক যদি বেখেয়ালি ধরনের হয় তবে কষ্টের সীমা থাকবে না। আমরা বিদায় নিয়ে যে-যার মালিকের বাড়ি চলে গেলাম। আমার মতো যদি ওদের ভাগ্যটা ভাল হতো! আহারে আমার সোনা বোনেরা, জানি না কেমন আছে ওরা।
দুই.
আমার পরিষ্কার মনে আছে, আমাকে যেদিন রোপন করা হয় সেদিন রাতেই রমার জন্ম হয়। আমিই প্রথমে নবজাতকের কান্নার শব্দ শুনেছিলাম। ওর কাঁপা কাঁপা ছোট ছোট কান্নার শব্দের ভেতরে আনন্দ মিশ্রিত ছিল। নইলে কান্নার ভেতরে এত আনন্দ-উচ্ছ্বাস আর মমতা জড়ানো থাকবে কেনো?
সে কান্না ছিল বড় আনন্দের। তার কান্না শুনে প্রতিবেশিরা যখন দৌড়ে এসে ঘরের সামনে ভিড় করে বলাবলি করছিল কী হয়েছে ছেলে না মেয়ে। তখন কেওরের ডালা ফাঁক করে এক মহিলা ফিস ফিস করে বলেছিল মেয়ে হয়েছে গো মেয়ে। চান্দের লাহান। তখন সকলের সঙ্গে আমিও আনন্দে নেচে উঠেছিলাম। নাচের তোড়ে আমার শুকনো পাতার সঙ্গে কয়েকটি সবুজ পাতাও ঝরে পড়ে গিয়েছিল। আহ নতুনেরা কত নতুন আনন্দ নিয়ে আসে পৃথিবীতে!
সেই রমা এর ওর কোল থেকে এক সময় ভেতরবাড়ির উঠোন পেরোলো। তারপর কচি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে এসে আমাকে ষ্পর্শ করে বলেছিল, এতা আমাল আমগাথ, সেদিন আমার পুরো শরীর আনন্দে ভরে গিয়েছিল।
আমার সবুজ পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা রং ধরা আম ঠিকই রমার চোখে পড়ত। সে তখন তার আব্বু ও আম্মুকে আঙুলে দেখিয়ে বারবার বলতো ্ওই যে পাকা আম, ওটা আমার। এখনই পেড়ে দাও। আদরের মেয়ে রমা। ওর আবদার রক্ষা না করে স্বস্তি পেত না কেউ। সে যা চাইত তাই পেয়ে যেতো। রমা মনের সুখে আম খেতো। আমের রস কনুই বেয়ে নিচে পড়ে যেতে চাইলে সে জিহ্বাটা লম্বা করে সুরুত করে একটা টান দিয়ে রসটুকু খেয়ে ফেলতো। এই দেখে আমি ভারি মজা পেতাম।
সেই রমা আমার গোড়ায় শিকড়ে বসে ছোট ছোট মাটির পাতিলে বহুবার ভাত তরকারি পাক করেছে। সে মায়ের মতো খাবার রান্না করে খেয়েছে ও অন্যদের বিলিয়ে দিয়েছে। আমাকেও খাইয়ে দিয়েছে। সে আমার যেমন প্রশংসা করতো তেমনি আবার আমার সঙ্গে অভিমান করতো। কখনো বা মায়ের মতো। তখন খুব গর্ব হতো আমার। আমি যে রমাকে কতটা পছন্দ করি রমা মনে হয় সেটা ভাল করেই বুঝতে পারতো। এমনই শত সহস্র ঘটনার ভেতর দিয়ে রমা কখন যে বড় হয়ে গেছে টেরই পাই নি আমি।
তিন.
আজ রমার বিয়ে।
একমাত্র আদরের মেয়ের বিয়েতে খরচও হবে মেলা। অনেক টাকা যোগাড়-যন্তের ব্যাপার। শেষমেষ রমার বাবা আমাকে বিক্রি করে দিল।
করাতিরা এসে গেছে। ওরা রেৎ দিয়ে করাতের দাঁতে শান দিচ্ছে। রেতের কর্কশ শব্দের ভেতরে আমি রমার বিয়ের সানাইয়ের সুর শুনতে পেলাম। রমার বাবা ছুটে এসে বলল, আমি এক দিনে দুজনকে বিদেয় করতে চাই না। তোমরা বরং কাল এসো, একথা বলে করাতিদের বিদায় করে দিলেন। আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।
বাড়ি ভর্তি মানুষ-বাড়ি ভর্তি আনন্দ। আমি পষ্ট দেখতে পেলাম সেই রমা কারূকাজ করা রঙ্গীন কাপড় মুড়িয়ে ঘোমটা টেনে বসে আছে। সবার মুখে হাসি। শিশুরা আনন্দে ছোটাছুটি করছে। সাজানো বাড়ির ভেতরে ও বাইরে হাসিমুখে মানুষের ব্যস্ত আনাগোনা। এরই মাঝে ধমক খেয়ে কয়েকটা কুকুর ছুটে এসে আমার পাশে এসে দাঁড়ায় আবার চলে যায় সামিয়ানার তলে যেখানে অতিথিদের আদর-আপ্যায়ন চলছে।
চার,
বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল। রমার বিদায়ের পালা। গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসেছে সে। এখন গাড়িতে উঠবে। এরই মাঝে রমা একটি কাণ্ড করে বসল। সে ছুটে এসে আমাকে দুহাতে সম্ভব পেঁচিয়ে ধরে চিঁ চিঁ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। বরপক্ষের লোকেরা অপ্রস্তুত ভাবে তাকিয়ে থাকলেও রমার বাড়ির লোকজনেরা মুখ ঢেকে নীরবে চোখের জল ফেলল। রমা কাঁদল, জল ফেলল কিন্তু কিছুই বলল না। তার চোখের জলধারা অজস্র কথা বলে গেল আমাকে। অতপর একজন মহিলা রমার হাতটি ধরে ধীরপায়ে গাড়িতে নিয়ে বসিয়ে দিল। গাড়িটি ধীরে ধীরে চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে গেল।
রাত পোহাতেই চলে এলো করাতিরা।
আগের দিন ফুলে ফুলে ঢাকা গাড়ি চড়ে রমা গেল শ্বশুর বাড়ি। আজ আমি ঠেলাগাড়িতে রওনা দিলাম ছ’মিলের দিকে। রমার বিয়ের আনন্দের রেশ তখনও আমার চোখে মুখে আলোছায়ার মতো খেলা করছিল।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ৮:৩০