গ্যাস-বিদ্যুৎ আর অবকাঠামোর সঙ্কটে পড়ে কয়েক বছর ধরেই ভুগছে দেশের শিল্প খাত তথা অর্থনীতি। এসবের দামও বাড়ছে দফায় দফায়। এর উপর আছে ব্যাংকঋণের উচ্চ হারে সুদ। আবার বিশ্ববাজার ভালো না থাকায় রফতানিও আশানুরূপ হচ্ছে না। দেশীয় বাজারেও অনেক খাতে দীর্ঘদিন ধরে মন্দাভাব চলছে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য যখন এত সব সমস্যায় হাবুডুবু খাচ্ছে, সেই সময় আবার ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’-এর মতো আঘাত হেনেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি নির্দেশনা। ‘ঋণ শ্রেণীকরণ, প্রভিশনিং ও পুনঃ তফসিলিকরণ’-সংক্রান্ত এই নির্দেশনার কারণে দেশের প্রায় সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বিপর্যয়ের মুখোমুখি। কারণ, ব্যবসায়ীদের অনেকটাই নির্ভর করতে হয় ব্যাংক ঋণের উপর। কিন্তু নতুন নির্দেশনার কারণে অল্পতেই ঋণখেলাপি হয়ে পড়তে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। তাই ব্যবসা পরিচালনা করা তাদের পক্ষে দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। এর কুফল পড়ছে সার্বিক অর্থনীতির উপর।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেসব দেশের অর্থনীতিকে সুরক্ষা দিতে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ ও কৌশল গ্রহণ করে। কিন্তু বাংলাদেশে ঘটছে তার ঠিক উল্টো। একটি বিশেষ গোষ্ঠী বাংলাদেশের শিল্প-কলকারখানা তথা দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ব্যবহার করছে। এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নতুন নতুন নির্দেশনা জারি করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় ঋণ না পেলেও পূর্বের নেয়া ঋণ পরিশোধে চাপ দেয়া হচ্ছে অনৈতিকভাবে। যদিও বিদ্যুৎ ও গ্যাস সঙ্কটের পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিরতায় উৎপাদন কমে যাওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠানের আয় কমে গেছে। এছাড়া ভুল মুদ্রানীতি দিয়ে অর্থনীতিকে চাপে রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে গবেষণা সংস্থা ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’ বলেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশের মুদ্রানীতি ব্যবস্থাপনায় সৃজনশীলতার নিদর্শন রাখার আরও একটি সুযোগ হারাল। এছাড়া যথাযথ দায়িত্ব পালনেও গাফিলতি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দীর্ঘ দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে সোনালী ব্যাংক গ্রাহকদের পাওনা টাকা অনৈতিকভাবে আটকিয়ে রাখলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এতে ব্যাংক এবং গ্রাহকের মধ্যে অবিশ্বাস ও সন্দেহ প্রকট আকার ধারণ করেছে। এর ফলে সঙ্কুচিত হচ্ছে দেশের কলকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য। কমে গেছে বিনিয়োগসহ রফতানি আয়। ঋণ খেলাপির তকমা পরিয়ে দেয়া হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের কপালে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভুল মুদ্রানীতির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ভুল মুদ্রানীতির কারণে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়া শেয়ারবাজারকে অতিমূল্যায়িত করে আবার লাগাম টানতে গিয়ে এক কোটি লোককে পথে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু ভুল সিদ্ধান্তে পুঁজিবাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা সর্বস্বান্ত হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ক্ষতিগ্রস্তরা। একইভাবে হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি-রফতানি বিলের বিপরীতে অভ্যন্তরীণ বিলের উপর ঋণদানে কড়াকড়ি আরোপ করে গার্মেন্ট শিল্পকে সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক দায়িত্ব পালনে অপরিপক্কতার পরিচয় দিয়েছে। ব্যাংকিং খাতের তদারকি করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, ভারতের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে। আর এ কাজটি সহজভাবে করতে ব্যাংকটির নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে বসানো হয়েছে ভারতপন্থী বলে পরিচিত কর্মকর্তাদের। এদের মধ্যে ডেপুটি গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে সীতাংশু কুমার সুর চৌধুরীকে। এক্ষেত্রে সোনালী ব্যাংককে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ব্যাংকটিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে রয়েছে প্রদীপ কুমার দত্ত। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকে নির্বাহী পরিচালক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলো দেখাশোনা করছে সুধীর চন্দ্র দাস, দাসগুপ্ত অসীম কুমার, গৌরাঙ্গ চক্রবর্তী, নির্মল চন্দ্র ভক্ত, শুভঙ্কর সাহা। এছাড়া ঋণ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলোর মহাব্যবস্থাপক হিসেবে রয়েছে অশোক কুমার দে, দেব প্রসাদ দেবনাথ, বিশ্বনাথ সরকার, বিষ্ণুপদ সাহা, খগেস চন্দ্র দেবনাথ, দেবাশীষ চক্রবর্তী, সুকমল সিংহ চৌধুরী, মিহির কান্তি চক্রবর্তী, শ্যামল কুমার দাস প্রমুখ। উল্লেখ্য, অভিযোগ উঠেছে, এরা সবাই হিন্দু। এরা ভারতকেই তাদের প্রধান দেশ বলে মনে করে। এরা ক্ষমতা পেয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে নষ্ট করার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে।
অভিজ্ঞ মহল বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ হিন্দু কর্মকর্তাদের নেয়া অধিকাংশ সিদ্ধান্তের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এতে একদিকে ব্যাংকগুলোতে দেখা দিচ্ছে অস্থিরতা, অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা পড়ছেন বিপাকে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বেসরকারি ব্যাংকগুলো কীভাবে অর্থ ছাড় করছে? এর তদারকি কতটুকু করতে পারছে বাংলাদেশ ব্যাংক? এত তদারকির পরেও কীভাবে হলমার্ক গ্রুপ সোনালী ব্যাংক থেকে তিন হাজার ৮০০ কোটি টাকা নিয়ে গেল? ঘটনার পর অর্থ মন্ত্রণালয় দোষ দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংককে, আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক মন্ত্রণালয়কে! অভিযোগ উঠেছে, বেসরকারি ব্যাংকগুলো লাগামহীনভাবে সুদ নিচ্ছে। তাদের ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ হারে সুদ নেয়ার কথা থাকলেও তারা এখন ১৯ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নিচ্ছে। ব্যাংকের ২০ হাজার কোটি টাকা আটকে রেখেছে মাত্র ১০০ ব্যক্তি। অন্যদিকে গ্রাহকরা ব্যাংকগুলোর কাছে এক হাজার কোটি টাকা পাবে। কিন্তু তারা এই টাকা পাচ্ছে না। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ব্যবসায়ী মহল বৈঠক করেছে। কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে না। গ্রাহকদের পাওনা টাকা দেয়া হচ্ছে না। অতি দ্রুত এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ব্যবসায়ী ও সাধারণ গ্রাহকরা ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
জানা গেছে, সোনালী ব্যাংকটি কোন কারণ ছাড়াই ব্যবসায়ীদের প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে আটকে রেখেছে। এতে একদিকে ব্যবসায়ীদের ঋণের বোঝা বাড়ছে অন্যদিকে টানতে হচ্ছে উচ্চ হারের সুদ। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
এদিকে সোনালী ব্যাংকসহ দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ স্বীকৃত বিলের অর্থ পরিশোধ করছে না দীর্ঘদিন ধরে। এতে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে। ইতিমধ্যে তৈরি পোশাক শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অন্যদিকে ব্যাংক ঋণে সুদের হার বেশির কারণে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ জন্য ঋণের সুদের হার কমিয়ে এনে এবং স্বীকৃত বিলের অর্থ পরিশোধ করার মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে বড় বড় শিল্পোদ্যোক্তারা।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১২:১৮