somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নাগরিক কবিয়াল শিরোনামহীন

২৬ শে অক্টোবর, ২০১৭ সকাল ১০:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




১.
‘হাসিমুখ থেকে আবার হাসিমুখ, নাগরিক কোলাহল থেকে নাগরিক উপকূল, জানালা থেকে জেব্রা ক্রসিং, শহুরে দেয়াল থেকে ধূসর খেয়াল, ইচ্ছে ফড়িং, রঙহীন ফড়িং বা যান্ত্রিক ফড়িং’-এ সবই ভাবনার নতুন আমেজে আমাদের সামনে ফুটে উঠেছে শিরোনামহীন ব্যান্ডের বদৌলতে। এই নগরের হয়ে, নগরকে আপন মনে ধারণ করে, নগরের আনন্দ-বেদনা-বিরহ-হতাশা বুকে বয়ে বেড়িয়েছে এই ব্যান্ড দল। যান্ত্রিক এই শহরকে বিভিন্ন ভঙ্গিতে, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণে, বিভিন্ন মননে দেখার যে ঐকান্তিক শক্তি তা এই ব্যান্ড দলের অন্যতম গীতিকার জিয়াউর রহমান জিয়ার ছিল। শিরোনামহীনকে বলা যায় এই নগরের বা শহরের নাগরিক কবিয়াল। কবিতার ছন্দ ও সুরের গাঁথুনিতে ব্যান্ড দলটি যেভাবে এই নগরকে উপস্থাপন করেছে তারা তা সত্যিই প্রশংসনীয়।
প্রথম অ্যালবাম জাহাজী’র ‘হাসিমুখ’ গানটিতে উঠে আসে রাস্তা, নীরবতা, এবং নাগরিক ও তার আনন্দধারার কথা।

“প্রতিটি রাস্তায় প্রতিটি জানালায়
হাসিমুখ, হাসিমুখে আনন্দধারা
……………………………………
হারিয়ে যেতে চাই, তোমাদের রাস্তায়,
অনেক অজানা ভীড়ে স্বচ্ছ নিরবতায়,
রোদ উঠে গেছে চেনা এই নগরীতে নাগরিক জানালা
হাসিমুখে একাকার।
আনন্দ উৎসব চেনাচেনা সবখানে,
এরই মাঝে আমাদের ছুটে যাওয়া দরকার।”


শিরোনামহীন-এর পাঁচটি অ্যালবামের চারটিতেই এই শহরকে নিয়ে গান ছিল। শহরের প্রতি অগাধ ভালোবাসা আর একে ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করার প্রয়াসে তারা সব সময় ছিল অটুট। যান্ত্রিক শহর বা নগরীকে নিয়ে আমাদের দেশের ব্যান্ড সঙ্গীতের ইতিহাসে এতো বেশি গান আর কেউ লিখেনি।
‘পাখি’ গানে উঠে আসে নাগরিক কোলাহল, শহুরে দেয়াল, ব্যস্ত জনপথ, ব্যস্ত মানুষের কথা।

“কিছু সুর তুমি এনে দাও পাখি নাগরিক কোলাহলে
তুমি গান গাও, তুমি শীষ দাও এই শহুরে দেয়ালে
তুমি ভুলে যাও এই শহরের যত ব্যস্ত জনকথা
আমি এসেছি তোমার কাছে এনে দাও স্বাধীনতা।”



২.
নগর তথা শহরের পাশাপাশি গ্রামীণ মেঠোপথ, গ্রামীণ জনপদ, প্রকৃতিকেও উপস্থাপনে তাদের সহজাত ভিন্ন আঙ্গিক ছিল চোখে পড়ার মতো। স্থাপত্য, দালান, ট্রাফিক, রাজপথ, কোলাহলকে নিজেদের গানে ধরে রাখার এক অদ্ভুত দ্যোতনাময় খেয়াল এ ব্যান্ড দলটির মধ্যে লক্ষ্য করা যায়।
‘শহরের কথা’ গানে উঠে আসে অদ্ভুত সব ভাবনার কথা। সেই ভাবনাগুলো ঘুরে ফিরে আসে যানজট আর দালান-কোঠার দাপটে ঢেকে যাওয়া আকাশ, গানের শরীরে নির্লিপ্ত শহরের ছবিতে।

“রাস্তায় একফালি নিঃশ্বাস
অন্ধ শহরে ছুটে চলা বাস
হাউজিং জ্যামে আকাশ অল্প
শহর মানেই গ্রামের গল্প।”


একঘেঁয়ে প্রেম ভালোবাসাকে পাশ কাটিয়ে একটি ব্যান্ড দলের নিরন্তর নগরীর প্রতি দায়বদ্ধতার চিরন্তন প্রচেষ্টা আমাদের মনে করিয়ে দেয় একটি সুন্দর নগরী গড়ে তোলার জন্য আমাদের সবারই যেমন সুদৃষ্টি প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চেষ্টাও। মজার ব্যাপার হল, একাধিকবার একাধিক গানে নগরীর উপস্থাপনশৈলী শ্রোতাদের মনে কোনো ধরনের বিরক্তি আনেনি বরং প্রতিবারই নতুন কিছুর স্বাদ পেয়েছেন শ্রোতারা।
‘আবার হাসিমুখ’ গানে উঠে আসে নাগরিক ঢেউয়ে উপচে পড়া মানুষ, বুকের ভেতরে ডানা ঝাপটানো পাখির আর্তনাদ, রোদ্দুরে ছুটে চলা ঝলমলে দিন, প্রজাপতির উড়ে বেড়ানোর কথা।

“বৃষ্টি ভেজা সুখ-দুখ, খোলা জানালায় হাসিমুখ
উড়ছে কিছু প্রজাপতি-মেঘ মনের জানালায়।
জানালায় ছিল রোদ্দুর, মেঘ ভেসে গেল বহুদূর
নগরের প্রিয় চিরকুট-সব জীবন ছেড়ে পালায়।
তুমি চেয়ে আছ তাই আমি পথে হেটে যাই,
হেটে হেটে বহুদূর, বহুদূর যেতে চাই।”


৩.
বৃষ্টিস্নাত এই শহরের রূপ কি? বৃষ্টির আনন্দ-বেদনার রং কি? এই সবই ব্যান্ড দলটি তুলে আনে ‘বৃষ্টিকাব্য গানে’। যান্ত্রিক ফড়িংয়ের সাথে রিক্সার পেইন্টিংয়ের মেলবন্ধন, অসহায় রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে পাওয়া, কাশফুল বনে ছুটে যাওয়া, রিমঝিম বৃষ্টিতে উত্তাল মনের আস্ফালন- সবই যেন এক একটি ফ্রেমে বাঁধানো ছবি।

“আজ জানালার বাইরে একঝাঁক বৃষ্টি রিমঝিম রিমঝিম
বইছে বাতাস, কাশফুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে
রাস্তার সিগন্যালে কন্ডাকটর জেব্রা ক্রসিং
অনেকদিন হেরে যাওয়া মন দিলো ধুয়ে!

রাজপথে ছুটে যায় যান্ত্রিক ফড়িং আর রিক্সায় আঁকা পেইন্টিং
নাগরিক বৃষ্টির ছাতে রবীন্দ্রনাথ অসহায়
তাই কন্ডাকটর জেব্রা ক্রসিং।”


কিশোরীর সুনিপুণ হাতে সুতোয় বোনা সবুজ গ্রাম, রং তুলিতে আঁকা বাংলার অবিরাম মুখচ্ছবি, রিমঝিম বৃষ্টি, কুয়াশার চাদরে ঢাকা শহর, সূর্যের রংয়ে আঁকা রাজপথ-এ সবই আমাদের বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। শিরোনামহীন নিজেদের নিপুণ গঠনশৈলীর মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ’ গানে তুলে ধরেছেন।

“যখন এক চোখে ঘুম ঘুম, এক চোখে নীল রাত
আমায় ভাবিয়ে যায়
যখন এক হাতে রোদ্দুর এক হাতে গোলাপ
সবুজ ছুঁয়ে ভাবায় আমায়
একদিকে নীল নীল, এক দিকে কাশফুল, দুচোখ যেখানে শেষ
এক প্রান্তে সবুজ, এক প্রান্তে লাল,
আমার বাংলাদেশ।”


৪.
১৯৯৬ সালে গড়ে উঠা এই ব্যান্ড দল গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আমাদের উপহার দিয়েছে অসংখ্য গান, অসংখ্য সুর, অসংখ্য আনন্দ-বেদনার লাল-নীল কাব্য। ‘হাসিমুখ’, ‘ক্যাফেটেরিয়া’, ‘বৃষ্টিকাব্য’, ‘বন্ধ জানালা’, ‘পাখি’, ‘ইচ্ছে ঘুড়ি’, ‘জাহাজি’, ‘বাংলাদেশ’, ‘বুলেট কিংবা কবিতা’, ‘শহরের কথা’, ‘আবার হাসিমুখ’, ‘শনশন যদিও কাশবন’-এইসব গান আমাদের কানে বাজবে প্রতিনিয়ত, এই সব সুর আমাদের বার বার আবেগতাড়িত করে তুলবে।
গানে গানে নগরের প্রতি শিরোনামহীন-এর দায়বদ্ধতাই আমাদের মনে করিয়ে দেয় নগরের জনপথ, নৈসর্গিক সৌন্দর্য, চেনা-অচেনা আরও কতশত নাগরিক ছবি। নগরের এ সব ছবি ও ভাবনার সম্মিলন আমাদের মুগ্ধ করে প্রতিনিয়ত। মুগ্ধতার এমন সম্মোহনে আমাদের সবার মাঝে টিকে থাকবে এই নগর, টিকে থাকবে নাগরিক কবিয়াল শিরোনামহীন।


লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে অক্টোবর ২০১৭ তে আইস টুডে’র এই লিংকে।
http://icetoday.net/2017/10/নাগরিক-কবিয়াল-শিরোনামহীন/






বিনয় দত্ত
কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও গণমাধ্যমকর্মী
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে অক্টোবর, ২০১৭ সকাল ১০:৫৪
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×