ইর্ষা, মানুষের একটা সহজাত প্রবৃত্তি। বিজ্ঞজনেরা বলেন, সহনশীল মাত্রায় ইর্ষা থাকা নাকি ভালো। তাতে নাকি আত্মউন্নয়নের রাস্তা খুজে পাওয়া সহজতর হয়। তবে 'সহনশীল' শব্দটা এখন বাস্তবে পাওয়া অত্যন্ত দুস্কর, এটা বই-পুস্তকেই পাওয়া যায়। শুনেছি মহামানবগন নাকি ইর্ষামুক্ত ছিলেন তবে আমাদের মতো আম-আদমীদের মাঝে ইর্ষাহীন মানুষ খুজে পাওয়া বোধকরি সম্ভব না। এই ইর্ষাও আবার স্থান-কাল-পাত্রভেদে বিচিত্র রুপ ধারন করতে পারে। মানুষ সাধারনতঃ ইর্ষান্বিত হয় অন্য আরেকটি মানুষের প্রতি। কিন্ত ঐযে বললাম না, স্থান-কাল-পাত্র! মাঝে মধ্যে এর ব্যত্যয়ও ঘটে। আমার জীবনের এই রকমেরই তিনটা ব্যত্যয় আজ আপনাদের বলবো।
ঘটনা এক (দেশে):
ঢাকায় আমাদের বাসার সামনে একটা বেশ বড় খালি জায়গা ছিল। মালিক বিদেশে থাকতো, তাই জায়গাটা দখলে রাখা বা দেখাশুনা করার জন্য একটা পরিবারকে টিনশেড বাসা করে দিয়ে সেখানে থাকতে দিয়েছিল।
তখন আমি মাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। বাসা থেকে বের হলেই দেখতাম, একটা বেশ বড়সড় বাহারী রংওয়ালা মোরগ, আর চারটা নাদুস-নুদুস মুরগী চরে বেড়াচ্ছে। কেন জানি, মোরগটার অহংকারী চলাফেরা, মুরগীদের উপর খবরদারী আর ভাবসাব আমার মোটেও ভালো লাগতো না। তা, মোরগ তার মুরগীদের নিয়ে থাকতো, আমি আমার কাজ-কামে ব্যস্ত থাকতাম; কোনদিন আমাদের মধ্যে কোন কনফ্লিক্ট হয়নি।
একদিন সকালে কোন একটা ব্যাপারে আমার প্রেমিকার সাথে তুমুল ঝগড়া হলো। সে আমাকে তার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল, আজ থেকে তোমার সাথে সবরকমের মুখ দেখাদেখি, যোগাযোগ বন্ধ। টোটাল ব্রেক আপ। আর কোনদিন আমাকে ফোন করবা না। বলে কট করে আমার মুখের উপর ফোন কেটে দিল! কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হঠাৎ লাইন কেটে দেয়া একটা চরম অপমানজনক ব্যাপার। কাজেই রাগে-দুঃখে-অপমানে আমার তখন দিশেহারা অবস্থা। কঠিন সিদ্ধান্ত নিলাম, আজ থেকে পড়ালেখা সব বন্ধ। নেশাই হবে আমার জীবনের একমাত্র প্রেম! আয়নায় নিজেকে দেখলাম। একজন ব্যর্থ প্রেমিক এবং ভবিষ্যত নেশাখোরের সবরকমের বৈশিষ্ট্যই দেখি আমার মধ্যে বিদ্যমান! কঠিন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য বাসা থেকে বের হয়ে এলাম। বের হয়েই মোরগটার সাথে দেখা। রাগে আমার পিত্তিসুদ্ধো জ্বলে গেল! আমি একজন সামলাতে পারি না, আর এই হারামজাদা চার চারটাকে নিয়ে ঘুরছে!!
পড়ে থাকা একটা ছোট গাছের ডাল তুলে নিয়ে কড়া দাবড়ানি দিলাম। বিকট স্বরে কক কক করতে করতে বীরপুঙ্গব তার প্রেমিকাদের নিয়ে হাওয়া।
এরপর থেকে ওটাকে দাবড়ানি দেয়া আমার মোটামুটি কর্তব্য হয়ে দাড়ালো। ইর্ষা ছাড়াও আরেকটা ব্যাপার আমার মধ্যে কাজ করতো। মুরগীগুলোর সামনে ওর ইজ্জতের ফালুদা বানানো। অর্থাৎ মুরগীগুলো দেখতো, ওদেরকে ফেলে রেখেই ওদের দেখাশুনা করনেওয়ালা কিভাবে ঝেড়ে দৌড় দিচ্ছে। ওটার দৌড় দেখে একটা অনাবিল আনন্দ উপভোগ করতাম। পরবর্তীতে ব্যাপারটা এমন হয়ে গেল যে, আমাকে বাসা থেকে বের হতে দেখলেই মোরগটা ঘাড় উচু করে কক...ককক করতো অর্থাৎ মুরগীদেরকে বলতো, ওই তোরা দৌড়ের জন্য তৈরী হ, বদমাইশ লোকটা বাইর হইছে!!!
ঘটনা দুই (দেশে):
ঢাকায় আমাদের বাসার পাশে একটা দোতলা বাড়ী ছিল একসময়। সেই বাড়ীর বারান্দায় প্রায়ই বিকালে এক সুন্দরীকে দাড়িয়ে থাকতে দেখতাম। তার চেহারা-ছবি ছিল অনেকটা বলিউডের নায়িকা কাজলের মতো। সুন্দরীর কোলে সবসময় একটা কুত্তা থাকতো। লম্বা লম্বা পশমে নাক-মুখ-চোখ সব ঢাকা। ইয়র্কশায়ার টেরিয়ার জাতের সম্ভবতঃ। ওদের ওই জুটিকে দেখলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম, ইচ্ছা করতো... ... থাক, ইচ্ছা বলে আর পেরেশানী বাড়াতে চাই না। মিথ্যা বলবো না, কুকুরটার সৌভাগ্যে খুবই ইর্ষা বোধ করতাম সে সময়।
তবে শোনা কথা, পশু-পাখীর ইন্দ্রিয় নাকি খুবই তীক্ষ হয়। পশমে ঢাকা চোখ দিয়ে কিভাবে আমাকে দেখতো, আল্লাহ জানে। কিন্তু সেই ছোট্টখাট্টো সারমেয়টা আমাকে দেখলেই খেউ খেউ করে খেকিয়ে উঠতো। সম্ভবতঃ বদ কুকুরটা ওর তীক্ষ ইন্দ্রিয়শক্তি দিয়ে বুঝতে পারতো এই দু’পেয়ে জীবটা তার সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্ধী হতে আগ্রহী!!
ঘটনা তিন (ইংল্যান্ডে):
বছর তিনেক আগে আমি অন্য একটা বাসায় ছিলাম। সেখানে আমার মূল দরজার পাশে একটা কোনা মতোন ছিল যেখানে সকাল ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত রোদ থাকতো। এই জায়গাতে রোদের সময়টাতে আমার প্রতিবেশীর একটা বেড়াল শুয়ে থাকতো। সাদা রংএর নাদুস নুদুস একটা পশমী বেড়াল। এ দেশের বেড়ালগুলো মোটামুটি একেকটা নবাব বা তাদেরই বংশধর! খায়, দায় আর শুয়ে থাকে। মানুষজনকে এরা খুব একটা পাত্তা দেয় না। মাঝে মধ্যে হাটলেও এমনভাবে হাটে যে ইচ্ছা করে লাঠি দিয়ে পাছায় একটা বাড়ি দেই! তবে মনের সুপ্ত বাসনা মনেই থাকে। কারন, সম্ভবতঃ এদের কাছে জরুরী সেবার ৯৯৯ নাম্বারটা থাকে যাতে করে যে কোনও ফিজিক্যাল এবিউজের ঘটনা ঘটলে দ্রুত পুলিশকে জানাতে পারে!!
সাপ্তাহিক বা অন্যান্য ছুটির দিনগুলোতে আমি সকালে চায়ের কাপ নিয়ে বের হতাম, একটু আয়েশ করে চা-সিগারেট একসঙ্গে খাওয়ার জন্য। সে অনেক কষ্ট করে একচোখ খুলে আমাকে দেখে আবার চোখ বুজে ফেলতো। মাঝে মাঝে ফোস করে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতো, সম্ভবতঃ চিন্তা করতো; এই মানুষগুলো কত্তো দুঃখী, সবসময় কেমন দৌড়ের উপর থাকে।
যাইহোক, এক শনিবারের সকালে আরামের ঘুম দিচ্ছি, আমার বস ফোন দিল। দু’দিন পর একটা জরুরী প্রেজেন্টেশান আছে, তাই পুরো টিম নিয়ে সে আজই দু’ঘন্টার জন্য বসতে চায়। আমার খুব অসুবিধা না হলে যেন চলে আসি। অনুরোধের মতো শোনালেও যারা চাকুরী করেন, তারা জানেন, এটা আসলে আদেশ আর হুমকির একটা সংমিশ্রণ! মেজাজ চুড়ান্ত খারাপ করেই উঠলাম বিছানা থেকে। চায়ের কাপ হাতে বাইরে এসে বেড়ালটাকে দেখে মেজাজটা আমার সপ্তমে উঠলো। আমার শনিবারেও শান্তি নাই, আর এই ব্যাটা সারা বছরই এভাবে শুয়ে থাকে! আস্তে আস্তে কাছে গিয়ে এদিক ওদিক দেখে নিলাম। তারপর একটু ঝুকি নিয়েই একটা মাঝারী আকৃতির লাথি ঝেড়ে দিলাম ওটার উপর। ব্যাটা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ডানে-বায়ে না দেখেই একটা দৌড় দিল। কিছুদুর গিয়ে ঘুরে দেখলো, কে এই অপকর্মকারী। আমি দাত বের করা একটা হাসি উপহার দিলাম ওকে।
এরপর থেকেই আমরা অলিখিত শত্রু হয়ে গেলাম। আমার দরজা খোলার শব্দ পেলেই সে ঘাড় কাৎ করে দেখতো, কে বের হচ্ছে। আমাকে দেখলেই তৎক্ষনাৎ উঠে চলে যেতো।
আমার ঘটনা তো বললাম, আপনাদের কারো এমন ধরনের কিংবা আরও বিচিত্রতর ঘটনা নাই? থাকলে শেয়ার করেন। জাতি জানুক, ইর্ষা কতো প্রকারের ও কি কি! ইর্ষার বিচিত্রতা সম্পর্কে আমরা অধিকতর অবগত হই!
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০১৮ দুপুর ১:৪১