somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্যারালাল ইউনিভার্সঃ বাস্তব নাকি কল্পনা?

২৯ শে এপ্রিল, ২০১৯ দুপুর ১২:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




১৯৫৪ সালের জুলাই মাসের একদিন। দিনটি ছিল প্রচন্ড গরম। অন্যান্য দিনের মতোই ব্যস্ত জাপানের টোকিও এয়ারপোর্ট। ইওরোপ থেকে আসা একটা বিমান অবতরন করলো। যাত্রীরা ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে যার যার গন্তব্যে চলে যাচ্ছে; এরইমধ্যে হঠাৎ ছন্দপতন ঘটলো রুটিন কার্যকলাপে। এক যাত্রীকে নিয়ে অদ্ভুত ধরনের সমস্যায় পড়লো ইমিগ্রেশানের কর্মকর্তারা।

যাত্রী একজন শেতাঙ্গ ইওরোপিয়ান। এসেছে ইওরোপ থেকে। পাসপোর্টও দিয়েছে, আর সেটা নকলও মনে হচ্ছে না। কিন্তু সমস্যা হলো, পাসপোর্ট ইস্যুকারী দেশ হচ্ছে 'ট্যোরেড'! এমন কোন দেশের নাম কর্মকর্তারা কেউ ইহজীবনে কখনও শোনেনি। ফলে, যাত্রীকে একটা রুমে বসানো হলো আরো জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। উর্ধতন কর্মকর্তারা এলেন। যাত্রীতো এই ঝামেলার কারনে মহাখাপ্পা! সে জানালো, এবারেরটা নিয়ে এই বছরে এটা তার তৃতীয়বার জাপানে আগমন। গত পাচ বছরে সে একাধিকবার এমন ভ্রমন করেছে, কিন্তু কখনও তাকে এমন ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয়নি। তার কাছে ইওরোপের বিভিন্ন দেশের মুদ্রা পাওয়া গেল। সমস্যা আরো জটিল আকার ধারন করলো তখন, যখন যে কোম্পানী ভিজিটে সে এসেছে তাদের সাথে যোগাযোগ করা হলো। তারা জানালো, এমন কোন লোককে তারা কোম্পানী ভিজিটে আমন্ত্রণ জানায়নি। সে যেই কোম্পানীর হয়ে কাজ করে বলেছে, সেই কোম্পানীটি খুজেই পাওয়া গেল না। এমনকি যে হোটেলে ভদ্রলোক তার রিজার্ভেশান আছে বলে জানালো, তারাও ভদ্রলোককে সনাক্ত করতে পারলো না।

ভদ্রলোকের মাতৃভাষা ফ্রেন্চ, কিন্তু জাপানীসহ আরো কয়েকটা ভাষায় তার দখল রয়েছে। তাকে যখন একটা ম্যাপ দেয়া হলো তার দেশ কোথায় দেখানোর জন্য, তখন সে আক্ষরিক অর্থেই আশ্চর্য হয়ে গেল। কারন, ফ্রান্স আর স্পেনের মাঝে যেখানে সে তার দেশ দেখাচ্ছে, সেখানে 'ট্যোরেড' নামে কোন দেশ নেই। আছে এন্ডোরা। সে বার বার বলতে থাকলো, এটা কিভাবে সম্ভব? গত প্রায় এক হাজার বছর ধরে এই দেশটা আছে! এই ম্যাপ নিশ্চয়ই ভুল!

এহেন পরিস্থিতিতে কর্মকর্তারা এয়ারপোর্ট-সংলগ্ন একটা বহুতল হোটেল ভবনের উপরের দিকে একটা রুম বরাদ্দ করলো তার জন্য। সেই রুমে কোন ব্যালকনি ছিল না। বাইরে দু’জন সার্বক্ষনিক গার্ড রাখা হলো। তার বিভিন্ন দেশের ভিসা-সম্বলিত পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স আর অন্যান্য কাগজ-পত্র রেখে দেয়া হলো আরো তদন্তের জন্য।

পরদিন দেখা গেল, সেই রুমে কেউ নেই। তার কাগজ-পত্র যেই ভল্টে রাখা হয়েছিল, সেখানে কোন কাগজ-পত্রও নেই। মানুষটাসহ সবকিছুই একদম উবে গিয়েছে কর্পুরের মতো।

আরেকটা ঘটনা বলি, ১৯০৫ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে রুটি চুরি করতে গিয়ে এক লোক ধরা পরে। এতে অবশ্য আশ্চর্যের কিছু নাই, চৌর্যবৃত্তি এই পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন পেশা! তবে, আশ্চর্যের বিষয় হলো, সে জানিয়েছিল যে তার দেশের নাম 'লিজবিয়া'।

এবার আরেকটা ঘটনা। ১৮৫১ সালে জার্মানীর ফ্র্যান্কফুর্ট আন ডের ওডেরে উদভ্রান্তের মতো এক লোককে পাওয়া গিয়েছিল। তার দাবী অনুযায়ী, সে এসেছে 'লাক্সারিয়া' নামের একটা দেশ থেকে, যেটা 'সাক্রিয়া' মহাদেশের অন্তর্ভূক্ত!

উপরের এই তিনটি ঘটনাই মনে করা হয় যে প্যারালাল ওয়ার্ল্ড বা অল্টারনেট ডায়মেনশানের কারনে ঘটেছিল। প্যারালাল ওয়ার্ল্ড, যাকে প্যারালাল ইউনিভার্সও বলা হয়ে থাকে; বেশিরভাগ বিজ্ঞানীই একে এখন পর্যন্ত একটা হাইপোথিসিস হিসাবে দেখতেই পছন্দ করেন। তবে, এর উপস্থিতিতে বিশ্বাস করেন এমন বিজ্ঞানীও নেহায়েত কম নেই বর্তমানে।

এই প্যারালাল ওয়ার্ল্ড এর ব্যাপারটা আসলে কি? প্রথমেই যে প্রশ্নটা বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানীদের চিন্তায় এসেছে তা হলো আমরা যে মহাবিশ্বের অন্তর্ভূক্ত, সেটাকি আসলেই আনপ্যারালাল বা ইউনিক বা অদ্বিতীয়? অনেকেই বলছেন, না; আমাদের পাশাপাশি আরো মহাবিশ্বও রয়েছে। যেখানে আমরা এখানে যা যা করছি তার সবই ঘটছে......তবে সেটা বিকল্প বাস্তবতায়।

আচ্ছা, এসব নিয়ে চিন্তা যখন করছিই, আরেকটু গভীরে যাই। এস্ট্রোনমিতে একটা ধারনা বা তত্ত্ব আছে, নাম 'মাল্টিভার্স'। এই তত্ত্বে বলা হচ্ছে অনেকগুলো ইউনিভার্সের কথা যেগুলোতে সবকিছু একইভাবে ঘটছে। সহজভাবে বললে, এই যে আপনি এখন আমার লেখা পড়ছেন। সবক'টা ইউনিভার্সেই আরেক 'আপনি' আরেক 'আমার' লেখা পড়ছে। মজার ব্যাপার না! তবে সেগুলোতে ব্লগের নাম সামু না হয়ে হামু, খামু কিংবা মামু'ও হতে পারে। হু নৌজ!!

মাল্টিভার্স তত্ত্বটা কিন্তু শুধু তত্ত্বেই সীমাবদ্ধ নেই। এর কিছু প্রমানও হাজির করেছেন বিজ্ঞানীরা। তবে, সেগুলো বেশ গোলমেলে। সেগুলোতে না গিয়ে বরং ব্যাপারটা ভালো করে বোঝার জন্য এই বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টির সবচেয়ে প্রচলিত ধারনার উপর অতি সংক্ষেপে একটু চোখ বুলাই। প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছর আগে বিশ্বব্রহ্মান্ডের সবকিছু একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এককে সীমাবদ্ধ ছিল। যে কোনও কিছু ঘটার জন্য একটা ট্রিগার বা উপলক্ষ্য লাগে। এমনি কোন এক অজানা কারনে এটা হঠাৎ প্রসারিত হতে শুরু করে এবং বর্তমানের এই তিন-মাত্রার মহাশুন্য আর এর মধ্যস্থিত সবকিছুর সৃষ্টি হয়। এটাই হলো সেই বিখ্যাত বিগ-ব্যাং থিওরী। এই থিওরীর সাথে সাথে আরেকটা প্রশ্নও সামনে চলে এসেছে। সেটা হলো, এই বিপুল বিশ্বব্রহ্মান্ডে আমরা কি আসলেই একা?

উপলব্ধির সুবিধার জন্য একটা উদাহরন দেই। মনে করেন, আপনাকে একটা বিশাল গামলা দিয়ে ঢেকে দেয়া হলো। আপনি এখন যা-ই দেখবেন, সবই এই গামলার ভিতর, এর বাইরের কোনকিছু দেখা আপনার সাধ্যাতীত। আমাদের এই বিশ্বজগতটার অবস্থানও এমনি একটা উপুর করা বিশাল গামলার ভিতরে বলে মনে করা হয়। ফলে, মানুষের লব্ধ বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর জ্ঞান এর বাইরের কোন কিছু দেখতে এখন পর্যন্ত অপারগ। এর বাইরে আদৌ কিছু আছে কিনা, আমরা তাও জানিনা। কাজেই এ’সংক্রান্ত সবকিছুর ভিত্তিই অনুমান, তবে বলাইবাহুল্য, সেগুলো যুক্তিনির্ভর।

অনেক মতবাদের ভিড়ে পাচটা জনপ্রিয় মতবাদ আছে মাল্টিভার্সের উপস্থিতির পক্ষে। সবগুলো নিয়ে বলতে গেলে পোস্টের আকার হয়ে যাবে বিশাল। তাই সেদিকে না যাওয়াই ভালো। বিশ্ববিখ্যাত ইংলিশ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং মাল্টিভার্স নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন। উনি তার শেষ গবেষণাপত্রে (২০১৮ সালের মে মাসে প্রকাশিত) মাল্টিভার্স নিয়ে কি বলেছিলেন দেখি। ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সাক্ষাৎকারে উনি বলেছিলেন, আমরা বলছি না যে আমাদের এই মহাবিশ্বই একমাত্র মহাবিশ্ব। বরং আমাদের গবেষণা এই ধারণা দেয় যে, সম্ভাব্য মাল্টিভার্সের সংখ্যা পূর্বানুমানের চাইতে অনেক কম। উল্লেখ্য, উনি উনার পূর্বের মাল্টিভার্সের 'নো বাউন্ডারী থিয়োরী' (অসীম সংখ্যক মাল্টিভার্স) থেকে বের হয়ে এসে এই বক্তব্য দেন। উনি অবশ্য বলেছেন যে, এটা ধরে নিয়ে এবং মাধ্যাকর্ষনের সূত্রসমুহ ও কোয়ান্টাম মেকানিকসের মধ্যে সমন্বয়সাধনের মাধ্যমে আরও অনেক অনেক কাজ করতে হবে, অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।

মানুষ জন্মগতভাবেই অত্যন্ত অনুসন্ধিৎসু মনোভাবসম্পন্ন সৃষ্টি। সেই প্রাচীণকাল থেকেই মানুষের মনে একের পর এক প্রশ্ন এসেছে। এই প্রশ্ন মাথায় নিয়ে তারা কিন্তু বসে থাকেনি। এটার উত্তর খুজে খুজে বের করেছে। এই উত্তর বের করার প্রক্রিয়াতে আরো অনেক নতুন প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। সুতরাং, সামগ্রিকভাবে এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। মানব-সভ্যতা যতেদিন টিকে থাকবে, এই প্রক্রিয়াও ততোদিন চালু থাকবে। "আজ যেটা অসম্ভব কষ্ট-কল্পনা মনে হচ্ছে, কাল সেটাই হবে বাস্তবতা", এই পরিস্থিতিতে এর পূর্বেও মানুষ বহুবার পড়েছে, ভবিষ্যতেও পড়বে। প্রতিবারই মেধা দিয়ে সে পরিস্থিতি থেকে মানুষের সফল উত্তোরণ ঘটেছে। মহাবিশ্বের এই পাজলও এর বাইরে নয়। ব্ল্যাকহোলের মতো খুব শীঘ্রই হয়তো আমরা মাল্টিভার্সের অকাট্য প্রমান হাতে পেয়ে যাবো।

অত্যন্ত জটিল এবং বিশাল একটা বিষয়কে খুবই সংক্ষেপে এবং সহজভাবে বলা আসলেই অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। আমি চেষ্টা করেছি। স্বীকার করছি, এতে সাফল্যের সম্ভাবনা খুবই কম। তাই মন্তব্যে কঠিন কঠিন প্রশ্ন করে আমাকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করবেন না.......প্লিজ। আপনারা সবাই জানেন, আমি একজন মফিজ; অত্যন্ত সাধাসিধা গোবেচারা 'হরিপদ পাল' টাইপ ব্লগার। এখানে অনেক জ্ঞানী-গুনী ব্লগার আছেন যারা চাইলে আরো অনেক ভালোভাবে এর ব্যাখ্যা দিতে পারবেন।

আশা করছি, আমার ব্যর্থতা অন্যদেরকে সফলতার পথ দেখাবে। :)


ছবিঃ চিরাচরিত গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে এপ্রিল, ২০১৯ বিকাল ৩:৩৩
৩৯টি মন্তব্য ৩৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×