শিরোনামের কথাটা আমার না। মোটামুটি সবাই জানেন, কথাটা জনপ্রিয় কবি শামসুর রাহমানের কোন একটা কবিতার। আমি কবিতা পড়ি না, তবে বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন মাধ্যমে এই অভাজনের দুই চারটা কবিতার বাক্য শোনা হয়, জানা হয়। এটা তাদের মধ্যে অন্যতম। উনি কবিতায় কতোটা তীব্র তীক্ষ্ণ ভাষা ব্যবহার করেন সে বিষয়েও আমি সবিশেষ অজ্ঞ। তবে, বহুবছর ধরেই এই বাক্যটা বাংলাদেশ নামক দেশটার জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রযোজ্য হয়ে আসছে। আর তার চেয়েও বড় দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, কথাটা সম্ভবতঃ আরো অনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দেশটার জন্য প্রযোজ্য হয়ে থাকবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে অন্য অনেকের মতোই দেশটাকে বদলে দেয়ার বিপ্লবী স্বপ্ন দেখতাম। দেশ নিয়ে আশার কোন সীমা-পরিসীমা ছিল না তখন। এরপরে যতোই দিন গিয়েছে, দেশটাকে নিয়ে আশা-ভরসা দিনকে দিন ফিকে হয়ে এসেছে। বাস্তবতা আমাকে ধীরে ধীরে আকাশ থেকে মাটিতে নামিয়ে এনেছে। এখন আর স্বপ্ন দেখি না, স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দিয়েছি; বলতে পারেন আশাবাদী একজন মানুষ থেকে হতাশাবাদী একজন মানুষে পরিনত হয়েছি। কেন এই পরিবর্তন? আমার মনে হয় না, এই প্রশ্নের উত্তর এইখানে, ব্লগে দেয়ার প্রয়োজন আছে। সবাই জানেন। এখন মোটামুটি একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, আমার এই জীবদ্দশায় আমি দেশের কোন গঠনমূলক কিংবা পজিটিভ পরিবর্তন দেখে যেতে পারবো না। তাহলে কি তবে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য আশাবাদী হবো? বাস্তবতা কি বলে?
একসময়ে আমরা দূর্ণীতিতে এক নাম্বারে ছিলাম। সেসময়ে কিন্তু কোন বেসরকারী খাত বা ব্যক্তির কল্যানে দেশে বর্তমানের মতো এতো টাকা আসতো না। ফলে তখন শীর্ষস্থানীয় দূর্ণীতিগ্রস্থ দেশ হয়েও বর্তমানের মতো এতো এতো বিশাল অঙ্কের দূর্ণীতি আমরা দেখিনি। এখন দেশ-বিদেশ থেকে টাকা দেশে আসছে দেদারছে, আর চৌর্যবৃত্তিও চলছে সমানুপাতিক হারে। দেশের বর্তমান যতোটুকুই অগ্রগতি, তার সিংহভাগ অবদানই বেসরকারী খাতের। সরকারী খাতের তথৈবচ বেহাল অবস্থা, এদের অবদান দেশকে পিছনে টেনে ধরার ক্ষেত্রে। এই অবস্থা থেকে উত্তোরনের কোন চেষ্টাও কারো নাই। এটা নিপাতনে সিদ্ধ একটা ব্যাপার যে, সরকারী কোন খাতই দেশকে দু'পয়সার যোগান দিতে পারে নাই। সরকারী পাটকল বন্ধ করার সাম্প্রতিক উদাহরনই এক্ষেত্রে যথেষ্ট হবে।
আসলে কোনটা রেখে কোনটা বলি। শরীরের কোন একটা অংশ ধরে টান দিলে পুরো শরীরটাই যে এগিয়ে আসে! কি করবো বলেন!! আসলে চুরি, অর্থাৎ দূর্ণীতিই দেশটার সর্বনাশের জন্য সর্বাংশে দায়ী। এমন হরিলুটের মতো চুরি আর কোন দেশে কি হয়? সব রকমের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর অসাধুতার পিছনের কারনই হলো দূর্ণীতি…….সোজা বাংলায় চুরি। এই চোরদেরকে ধরবে কে? যারা ধরবে তারাও যে চোর! ছোটবেলায় দাদার কাছ থেকে ''চোউরা গাও'' অর্থাৎ চোরদের গ্রামের গল্প শুনতাম। যেই গ্রামের সবাই চোর, অর্থাৎ সেই গ্রামের অধিবাসীদের সবার পেশাই চৌর্যবৃত্তি। গোটা বাংলাদেশ এখন সেই চোরদের গ্রামের মতো। সৎ মানুষ দুই চারটা যে নাই, তা বলা যাবে না। তবে তাদের সংখ্যা এতোটাই নগন্য যে, তাদেরকে খুজতে ম্যাগনিফাইং গ্লাসের সাহায্য নিতে হবে এখন।
বেন্জামিন রিচ নামের এক বৃটিশ ভ্লগার / ইউটিউবার আছে। তার নিক হলো ''বল্ড এন্ড ব্যাঙ্করাপ্ট'' (bald and bankrupt) আমি তার ভিডিওগুলো সময় পেলেই দেখি; কারন সে একটা দেশে গিয়ে শুধু বেড়ায়ই না; সেখানকার পরিস্থিতির বিচার-বিশ্লেষণও করে। সম্প্রতি তার একটা ভিডিও দেখলাম। ইউরোপের একটা দেশ মলডোভিয়ার উপরে। আপনারা চাইলে দেখতে পারেন, বাংলাদেশের সাথে বেশ মিল আছে। তবে রিচের সৌভাগ্য, সে বাংলাদেশ এসে এ'ধরনের ভিডিও বানায় নাই; তাহলে খবরই ছিল। সরকারী আপ্যায়নের কিছু স্বাদ হয়তো সে পেলেও পেতে পারতো।
কোন একসময়ে একজন সহব্লগার আমাকে বলেছিলেন, আমি নাকি মাঝে-মধ্যে এমন সব পোষ্ট দেই যেটাতে মন্তব্য করাই নাকি রিস্কি। হতে পারে…….কিন্তু আমি বানিয়ে বানিয়ে তো কিছু লেখি না, যা ঘটে তার উপরেই লেখি। তবে, এখন দেশের সমস্যা নিয়ে তেমন একটা ভাবি না। কারন, বকাউল্লা তার মতো বকে যাবে (পোষ্ট), আর করাউল্লা তার কাজ (চুরি) করতেই থাকবে। কিন্তু ইদানীং একের পর এক এমন কিছু ঘটনা/খবর পড়লাম, যাতে করে মনে হলো, কিছু লেখি। মনের বোঝ একটু হাল্কা হবে। দুর অতীতের কথা বাদ। সাম্প্রতিক অতীতের ক্যাসিনো কান্ড, পাপিয়া কান্ড আর হালের রিজেন্ট কান্ড…...এসব কিসের আলামত? এসব তো একদিনে ঘটে না। এই সরকারের প্রথম মেয়াদে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন ডা. আ ফ ম রুহুল হক। তিনি সিন্ডিকেটের কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ''আমি তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করে এই সিন্ডিকেটের বিস্তারিত জানিয়েছিলাম। তাঁকে প্রমাণ হিসেবে ডকুমেন্ট দিয়েছিলাম। তিনি ব্যবস্থা নিতেও বলেছিলেন।'' জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চলতি বছরের মে মাসে পাঠানো এক নথিতে দেখা যায়, গত ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে মিঠু নামে একজন এই সিন্ডিকেটের মূল নেতৃত্বে। মিঠু এখন দেশের বাইরে৷ তবে তার নিয়ন্ত্রণেই এখনো সিন্ডিকেট চলে। ওই নথিতে সিন্ডিকেটের অংশ হিসেবে একজন সাবেক মন্ত্রী, একজন বর্তমান মন্ত্রী, তার পিএস ও তার ছেলের নামও রয়েছে। নাম রয়েছে একজন অতিরিক্ত সচিবেরও। বর্তমান মন্ত্রী, তার পিএস এবং মন্ত্রীর ছেলে এই সময়ে নানা অর্ডার ও কেনাকাটায় প্রভাব খাটাচ্ছেন বলে নথিতে বলা হয়েছে। এরা তাহলে কতোটা শক্তিশালী যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর গোচরে আনার পরেও এসব বন্ধ হচ্ছে না? ১৫ বছর কি অনেক কম সময়? এদের মূল শক্তির উৎসটা আসলে কি আর এরপরে কোনটা আমাদের সামনে আসবে?
আমাদের দেশের মাথারা বিদেশে চিকিৎসা নিতে যতোটা ডেসপারেট, তাদের এই ডেসপারেসির এক-দশমাংশও যদি দেশের চিকিৎসাখাতের উন্নয়নে ব্যয় করা যেতো, তাহলেই দেশের চিকিৎসাখাত নিজের পায়ে দাড়িয়ে যেতো। তখন বিদেশ থেকে লোক চিকিৎসা নিতে এদেশে আসতো। উনাদেরকেও চিকিৎসার জন্য ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর কিংবা লন্ডনে দৌড়াতে হতো না।
বিবিসি বাংলা'র গত চার তারিখে প্রকাশিত একটা রিপোর্ট পড়লাম। ওই রিপোর্টে ভারতীয় বিএসএফের একটা লিখিত বিবরণীর কথা বলা হয়েছে যেটাতে তারা বলেছে, পাচারের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই কলার ভেলায় বেধে নদীতে গরু ভাসিয়ে দেওয়া হয়। সেগুলি যখন বাংলাদেশের দিকে পাচারকারীরা স্পিড বোটে চেপে নদী থেকে তুলতে যায়, তাতে কখনও কখনও বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডসের সম্মতি থাকে। অর্থাৎ বাংলাদেশের বিজিবি চোরাচালানীতে সহায়তা করছে। আর আনুষ্ঠানিকভাবে তা মিডিয়াতে জানাচ্ছে বিএসএফ!! একটা দেশের বাহিনী কতোটা ইডিয়েট হলে আন্তর্জাতিক রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে আরেক দেশের বাহিনীর বিরুদ্ধে আঙ্গুল তোলে! আরে হারামজাদারা, গরুতো আসে তোদের দেশ থেকে। মুরোদ থাকলে সেটা থামা। তোদের গো-রক্ষাসহ এতো এতো কমিটি আর সরকারী লোকজন কি বাল ফালায় (স্যরি…..শব্দটা না বলে পারলাম না) সেদিকে আগে নজর দে। আর আমাদের বিজিবি বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের মেরুদন্ড শক্ত করে কি কোন আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানিয়েছে? আমার নজরে পড়ে নাই, কারো পড়ে থাকলে জানাবেন প্লিজ।
গত দুই তারিখের আরেকটা নিউজ পড়লাম। করোনার কথা বলে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ গত তিন মাস ধরে বেনাপোল স্থল বন্দর দিয়ে কোন বাংলাদেশী ট্রাককে পন্য নিয়ে সেদেশে ঢুকতে দেয়নি। অথচ ভারতীয় ট্রাক দেদারছে এদেশে ঢুকছে। দ্বীপাক্ষিক সমঝোতাও কিন্তু সেরকমটাই ছিল যে, দু'দেশেরই পন্যবাহী ট্রাক যাতায়াত করবে। অবশেষে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের চাপে পড়ে গত এক তারিখ থেকে বাংলাদেশী বন্দর কর্তৃপক্ষ যখন ভারতীয় ট্রাকের এদেশে ঢোকা বন্ধ করেছে তখন এটা নিউজ হয়েছে। আমাদের ট্রাক যে তিনমাস ধরে ভারতে ঢুকতে পারছে না, তার কোন খবর নাই। তারপরপরই আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সরব হয়েছেন…….আমাদের ট্রাককে কেন ভারতে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না! আরে! এতোদিন কি আপনি ঘুমাচ্ছিলেন? আমার জানতে ইচ্ছা করছে। বাকা মেরুদন্ড কিভাবে সোজা করতে হয় সেটা আমাদের কর্তাদের নেপালের কাছ থেকে এখন শেখা উচিত। সীমান্তে যথাযথ জবাব দেয়া, ভারতীয় টিভি চ্যানেল সেদেশে বন্ধ করাসহ যেসব পদক্ষেপ নেপাল নিয়েছে, সেটা আমাদের কর্তৃপক্ষ নেয়ার কথা ভাবলেও ঘুমের মধ্যে আৎকে ওঠে। কেন এই হীনমন্যতা? কেন??
দূর্ণীতি…...শুধুই দূর্ণীতি; আর এর থেকে সৃষ্ট হীনমন্যতা, শিক্ষাহীনতা, সঠিক পরিকল্পনার অভাব আর সমন্বয়হীনতা থেকে যে অবস্থার সৃষ্টি দেশে আজ হয়েছে, এখান থেকে জাতি সহসা বের হয়ে আসতে পারবে না বলেই আমি এই দেশের কোন ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি না; যেটা পোষ্টের শুরুতেই বলেছি। আপনারা যদি কেউ দেখে থাকেন, তাহলে দয়া করে হাত তোলেন। আর কেন এবং কিভাবে দেখছেন, সেটা বিস্তারিতভাবে আমাদেরকে জানান। তাতে করে যদি একটু আশার আলো দেখতে পারি, মন্দ কি? বাস্তবে পান্তাভাত খেলেও স্বপ্নে পোলাউ-কোর্মা খাওয়া একেবারে খারাপ না। আমার তো দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণ করে এমনটাই মনে হচ্ছে। আপনাদের মতামতটাও একটু জানি তাহলে!!!
শিরোনামের ছবিটা গুগলের সৌজন্যে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুলাই, ২০২০ দুপুর ১:১২