শুরুতেই একটা গল্প বলি, শোনেন। এটা তিন বন্ধুর গল্প।
বাবুল, মিলন আর ভাস্কর তিন বন্ধু। বাবুল আর মিলন ছাপোষা টাইপের মানুষ। ওদিকে ভাস্কর বেশ পয়সাওয়ালা এবং ক্ষমতাশালী। বাবুলের একদিন হঠাৎ শখ হলো, সে একটা গাড়ি কিনবে। বিষয়টা ভাস্করের পছন্দ হলো না। সে মনে মনে ভাবলো, ব্যাটা ফকিরের পোলা…..জাতে ওঠার শখ হইছে! সে বিভিন্নভাবে বাবুলকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করলো। এদিকে বাবুল এডামেন্ট, গাড়ি একটা সে কিনবেই। শখ বলে কথা! যাই হোক, কোন একদিন এক শুভক্ষণে সে গাড়ি কিনে বাসায় নিয়ে আসলো। গ্যারেজ যেহেতু নাই, গাড়ি সে রাতে তার বাসার সামনেই পার্ক করে রাখে।
একদিন ভাস্কর মিলনকে ডেকে বললো, শোন…….বাবুল যে গাড়ি কিনছে, এইটা তোরে টক্কর দেওয়ার জন্য। তোরে দেখানো যে, ও তোর চেয়ে বেশী কামিলদার। তুই এক কাম কর। এই স্ক্র-ড্রাইভার নে। কয়দিন পর পরই রাত্রে ওর গাড়ির চাক্কা পাংচার কইরা দিবি। দেহি, শালার পো কয়দিন গাড়ি চালায়।
দু‘দিন পর পরই চাকা পাংচার হয়! বাবুল অতিষ্ঠ হয়ে এলাকার নাইটগার্ডের সাথে বন্দোবস্ত করলো, রাতে গাড়ি পাহারা দেওয়ার। ভাস্কর দেখলো, এখন তো আর চাকা পাংচার করা যাবে না! সে তখন নতুন ফন্দি আটলো। নিজের গ্যারেজে পড়ে থাকা একটা লক্কর-ঝক্করমার্কা গাড়িকে ঘষামাজা করে চকচকে করে তুললো। তারপরে মিলনকে বললো, নে…..আমার এই সুন্দর গাড়িটা তোরে দিলাম। টাকা আস্তে-ধীরে শোধ করিস। বাবুইল্লা শালা তোর সামনে দিয়া গাড়িতে ঘোরে! তোরও তো একটা ইজ্জৎ আছে! এখন থিকা তুই-ও ওর সামনে দিয়া গাড়িতে ঘুরবি!!
মিলন গাড়িটা নিয়ে যাওয়ার পরে ভাস্কর একদিন বাবুলকে ডেকে বললো, শোন, তোর গাড়ির চাকা মিলনই পাংচার করতো। তোর গাড়ি কেনা সহ্য করতে পারে নাই। তুই নাইটগার্ডের সাথে কন্ট্রাক্ট করনে আর পাংচার করতে পারে না, আবার তোর গাড়ি চড়া সহ্যও করতে পারে না। তাই বহু অনুরোধ কইরা আমার কাছ থিকা আমার এক্সট্রা গাড়িটা কিনছে।
এখন বলেন তো! ভাস্কর বাবুলের কেমন বন্ধু?
আচ্ছা, একটা কিউ দেই। বাবুলকে বাংলাদেশ, মিলনকে মিয়ানমার আর ভাস্করকে ভারত কল্পনা করেন দেখি! কোন ক্যাল্কুলেশান কি করা যায়? কেউ কেউ হয়তো বলবেন, কিছুটা তো অবশ্যই করা যায়; কিন্তু বিষয়টা ঠিক পরিস্কার না। এবার বরং একটু ঝেড়ে কাশেন! ওকে, ঝেড়েই কাশি তাহলে।
সপ্তাহ দুয়েক আগে হঠাৎ করেই একটা খবর পড়লাম। খবরটি হলো, কক্সবাজারের দক্ষিণে কুতুবদিয়া দ্বীপের পেকুয়াতে সাবমেরিন ঘাটি করার কাজ চীনকে দিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এ সিদ্ধান্তে গভীর উদ্বিগ্ন ভারত। বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে সাবমেরিন কিনেছে জানি, কিন্তু খবরটা পড়ে বাংলাদেশের সাবমেরিন ক্রয়ের অদ্যোপান্ত, আর এ'সংক্রান্ত বিচার-বিশ্লেষণ পড়ার ইচ্ছে হলো। তবে, মোটামুটি হতাশ হলাম। এটা নিয়ে পোষ্টের শেষের দিকে কিছু কথা বলার ইচ্ছা পোষণ করছি।
এখন আসি ভারতের উদ্বিগ্নতার বিষয়ে। কেন তারা উদ্বিগ্ন? বাংলাদেশকে ভারত কি তার সামরিক প্রতিপক্ষ মনে করে? মনে করার প্রশ্নই আসে না; কারন, দু'দেশের সামরিক সক্ষমতার তফাৎ আকাশ আর পাতালের। তাহলে? বাংলাদেশ যখন প্রথম সাবমেরিন কেনার ঘোষণা দেয় তখন ভারতের নীতি-নির্ধারক, সামরিক বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে ভারতীয় মিডিয়া সবাই লম্ফ-ঝম্ফ শুরু করে দেয়, যেন বিরাট সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে। এমনকি একটি টকশোতে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত বীণা সিক্রি ও দুই জন সামরিক বিশ্লেষক বাংলাদেশের সাবমেরিন কেনা ভারতের জন্য কতটা হুমকি তা নিয়ে কথাও বলেছেন। আমরা আমাদের টাকায় আমাদের সমুদ্র রক্ষার জন্য নৌকা কিনবো, সাবমেরিন কিনবো নাকি বিমানবাহী জাহাজ কিনবো; সেটা একান্তই আমাদের ব্যাপার। ভারতের মাথাব্যাথার তো কারন দেখি না। তাহলে কি তারা চুরি করে আমাদের এলাকায় ঢুকে কোন অকাম-কুকাম করে? চীনকে সাবমেরিন ঘাটি করার কাজ দেয়াতে আবারও শুরু হয়েছে দৌড়-ঝাপ।
হনুমানদের কাজই হলো অকারণে লম্ফঝম্ফ করা। সে তারা করতেই পারে; করুক। চলেন আমরা বরং বাংলাদেশের সাবমেরিন কেনার সময়টাতে ফিরে যাই। বাংলাদেশের হঠাৎ সাবমেরিন কেনার ইচ্ছা হলো কেন? সাবমেরিনকে একটা কৌশলগত অস্ত্র বলা হয়ে থাকে এর ভূমিকার জন্য। এমন মনে করার কোন কারণ নেই যে, সাবমেরিন দিয়ে শুধু শত্রু জাহাজ ধ্বংস করা হয়। যুদ্ধের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল সাপ্লাই চেইন ধ্বংস করা, যেটা সহজেই সাবমেরিন দিয়ে করা যায়। তাছাড়া যুদ্ধের অনেক বড় একটি অংশ 'ভীতি'। এক স্কোয়াড্রন মাল্টিরোল বিমান যতটুকু ভয় জাগাতে পারে শত্রুর মনে, একটা সাবমেরিন তার থেকে অনেক বেশি ত্রাস সৃষ্টি করতে সক্ষম। সামরিক বিশ্লেষকরা এটা খুব ভালো করেই জানে।
ভারতের দুশ্চিন্তা হয়ত একটু কম হতো যদি বাংলাদেশ সাবমেরিন চীন থেকে না কিনে অন্য দেশ থেকে নিতো। কিন্তু চীন থেকেই সাবমেরিন সংগ্রহ করেছে আবার চীনকে দিয়েই ঘাটি নির্মাণ করছে বাংলাদেশ। ভারত স্বাভাবিকভাবেই মনে করছে, এর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে চীনের উপস্থিতি আরো বৃদ্ধি পাবে। ভারতের আরেকটা ভয়, চীন-বাংলাদেশ নৌ-মহড়া। আমাদের নৌবাহিনী যেহেতু এ'বিষয়ে নতুন, কাজেই সক্ষমতা যাচাই এবং প্রশিক্ষনের জন্য এর কোন বিকল্প নাই। আর মহড়া হলে স্বাভাবিকভাবেই সেটা চীনের সাথেই হবে। এটা হলে চীনা যুদ্ধ জাহাজ এবং সাবমেরিনের আনাগোনা এ'অন্চলে বেড়ে যাবে। আর কে না জানে, যে কোনও যুদ্ধে এলাকা পরিচিত হওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটাও ভারতের মাথাব্যাথার আরেকটা কারন।
আর মৎস্য, খনিজসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ তো আছেই। যখন-তখন বাংলাদেশের সমুদ্র সীমায় ঢুকে চুরি করা কঠিন হয়ে যাবে না!! নেপাল বা ভুটানের মতো ল্যান্ড লকড দেশগুলো ভাল করেই জানে সমুদ্র একটা দেশের জন্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। ভারত বাংলাদেশের তিন দিক ঘিরে রাখলেও সমুদ্রের কারণে বাংলাদেশের উপর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। সে'কারনেই সমুদ্র বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মোদ্দা কথা হলো, গৃহকর্তা বাড়ির নিরাপত্তার জন্য কুত্তা কিনলে চোরের কখনওই তা পছন্দ হবে না।
ভারত শুধু হনুমানিয় লম্ফঝম্ফ করেই ক্ষান্ত হয়নি। তড়িঘড়ি করে মিয়ানমারকে আগবাড়িয়ে এন্টি-সাবমেরিন টর্পেডো সাপ্লাই দিয়েছে। তারপরে ভাবলো, বাংলাদেশের সাবমেরিনের জন্য এটা যথেষ্ট না, তাই তারা মিয়ানমারকে একটা সাবমেরিনও গছিয়েছে। তাদের নিজেদের প্রযুক্তি চীনের কাছে খোলাসা হয়ে যাওয়ার ঝুকি উপেক্ষা করা দেখেই তাদের মরিয়াভাবের প্রমান পাওয়া যায়। আশাকরি, আপনারা প্রথমে বলা প্রতিকী গল্পটার মাজেজা বুঝতে পেরেছেন। মনে রাখতে হবে, ভারত রাষ্ট্র হিসেবে যতটা বড়, মনের দিক থেকে ততোটাই ছোট। এমন বৈপরিত্য সচরাচর দেখা যায় না।
সে যাক। এখন ব্লগারদের কেউ কেউ বলতে পারেন, বাংলাদেশ যে রিফার্বিশ করা সাবমেরিন কিনেছে, অফিশিয়ালী সেটা প্রায় বাতিলযোগ্য মাল। তাহলে জেনে রাখেন, বলা হচ্ছে এ'দুটো মূলতঃ ট্রেনিংয়ের কাজে লাগানো হবে। নৌবাহিনীর দক্ষতা চলে এলে তখন আরো কয়েকটা পরিপূর্ণ এ্যাটাক সাবমেরিন কেনা হবে। তাছাড়া, ড্রাইভিং শেখার জন্য কেউ বিএমডাব্লিউ কেনে না। ধ্বজভঙ্গ গাড়িই কেনে। কেউ বলবেন, এই ক্রয়ে নিশ্চিত দূর্ণীতি হয়েছে…...আমি বলবো, সেটা তো আমাদের ট্র্যাডিশান; হলে হোক, তবুও আমাদের সাবমেরিনের দরকার আছে। অনেকে বলবেন, সাবমেরিন কি কিনতেই হতো? ২৪ বছরের পুরানো মাল কিনে ১৫০০ কোটি টাকা জলে ফেলা হলো না তো? তাহলে শুনে রাখেন, সাবমেরিন জলেই থাকে, জলেই চলাফেরা করে। সুতরাং টাকাটা জলেই গেছে........ক্ষতি কি? কানাডার বেগমপাড়ায় যাওয়ার থেকে বঙ্গোপসাগরের জলে যাওয়াও আমার কাছে উত্তম!
মিডিয়া যে কোনও দেশের নীতি-নির্ধারনের ক্ষেত্রে বিরাট একটা ফ্যাক্টর; ঠিক যেমনটা বিরোধী দল। মিডিয়াকে ফোর্থ এস্টেট বা চতুর্থ শক্তি এমনি এমনি বলা হয় না। এরা একটা দেশের জনমত গঠন কিংবা জনগনকে মোটিভেট করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে, যদি চায়। এরা এদের প্রচার সক্ষমতার কারনে রাজনৈতিক বা যে কোনও নীতিনির্ধারনী ইস্যুগুলিকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে সরকারের উপর যেমন চাপ সৃষ্টি করতে পারে, তেমনি সরকারকে অনেক ইস্যুতে ভাবতেও বাধ্য করতে পারে। সরকার তাদের বিভিন্ন কৌশলগত স্বার্থ চিন্তা করে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়, কিন্তু তা দিনশেষে দেশ বা আপামর জনসাধারনের জন্য কতোটা সঠিক বা কল্যানকর সেটা কার্যকরীভাবে তুলে ধরার দায়িত্ব মিডিয়ার। প্রশ্ন হলো, আমাদের দেশের মিডিয়া এই দায়িত্ব কতোটা পেশাদারিত্বের সাথে পালন করছে?
সাবমেরিন কেনা আমাদের দেশের জন্য একটা বিরাট ঘটনা। এটা আমাদের নৌবাহিনীকে একটা ত্রি মাত্রিক শক্তিতে পরিনত করেছে। এটা নিয়ে দেশের প্রধান প্রধান প্রচার-মাধ্যমগুলোতে যে পর্যায়ের বিশ্লেষনমূলক প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়া উচিত ছিল, তা হয়নি। অন্ততঃ গত দু'সপ্তাহ ঘাটাঘাটি করে আমার তাই মনে হয়েছে। কেন হয় নি? বলিউডের নায়ক-নায়িকারা কি খায়, কি পরে; তাদের সন্তানরা কি খায় কি পরে এসব নিয়ে লিখতে তো কারো কার্পন্য দেখি না। এ'ব্যাপারে আমাদের সাংবাদিকদের ধৈর্য্য এবং উৎসাহ অসীম। এই এনার্জি তারা দেশীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিতে ফোকাস করার ক্ষেত্রে দেখাতে পারেন না কেন? কেন আমাদের সাংবাদিকদের কেউ ভারতপন্থী, কেউ পাকিস্তানপন্থী; কেউবা চীন, আম্রিকা বা রাশিয়াপন্থী! এদের সবার বাংলাদেশপন্থী হতে বাধা কোথায়?
ফিরে আসি আবার শুরুর গল্পে। ভাস্করের মতোন তস্কর যার বন্ধু, তার শত্রুর কোন প্রয়োজন নাই। এটা বাবুল যতো দ্রুত সম্ভব বুঝতে পারবে ততোই মঙ্গল…….তার জন্য, তার পরিবার-পরিজনদের জন্য।
তথ্য এবং ছবিটা গুগল থেকে। বি এন এস নবযাত্রা'র ছবি।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:১৫