আগের পর্বগুলো:
মিউনিখের কড়চা.....প্রথম পর্বঃ হোম অফ দ্য মঙ্কস
মিউনিখের কড়চা.....দ্বিতীয় পর্বঃ মানবতার নির্বাসন-কাল – ১
মিউনিখের কড়চা.....তৃতীয় পর্বঃ মানবতার নির্বাসন-কাল – ২
সেই প্রাচীনকালে একটা সিরিজ শুরু করেছিলাম মিউনিখ ভ্রমন নিয়ে। এই জিনিস যে কবে শেষ হবে তা আমার জানা নাই; একমাত্র উপরওয়ালা জানে। কেন জানি আজকাল ছবিওয়ালা কোন পোষ্ট দিতে চরম আলসেমী লাগে। বসে বসে হুদাই একের পর এক ছবি আপলোড করো, এক যাত্রায় ১০টার বেশি আপলোড করা যায় না.........সেটা নিয়ে কায়দা-কানুন করো, তাদের সম্পর্কে কিছু বলো ইত্যাদি ইত্যাদি। অত্যাধিক বোরিং কর্ম। তারপরেও শুরু যখন একবার করেছি, শেষ করা আমার নৈতিক দায়িত্ব, তাই না!! সেইজন্যই দাহাউ কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্প নিয়ে আবার পোষ্টাইলাম। তবে, কষ্ট-মষ্ট করে আর কাটছাট করে কোনমতে এই পার্টটা শেষ করলাম আজকে, টানতে আর ভালো লাগছে না!!!
এই দাহাউ কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পটা হিটলারের স্থাপিত প্রথম তো বটেই, সেইসাথে সবচাইতে দীর্ঘ সময় ধরে পরিচালিত (১৯৩৩-১৯৪৫) ক্যাম্প। ক্যাম্পটা শুধুমাত্র বন্দীদের জন্যই ছিল না, একইসঙ্গে এটা ছিল হিটলারের কুখ্যাত এসএস বাহিনীর ট্রেইনিং গ্রাউন্ড। এখান থেকেই নির্যাতনের উপর গ্র্যাজুয়েশান করা এসএস সদস্যরা জার্মানী আর অধিকৃত জার্মানীর অন্যান্য ক্যাম্পে ছড়িয়ে পড়তো। এই ক্যাম্পেই প্রথম মানব-সন্তানদেরকে গিনিপিগ বানিয়ে বিভিন্ন রকমের মেডিক্যাল এক্সপেরিমেন্টের প্রচলন শুরু হয়। আরো অনেক অনেক প্রথমের সাক্ষী এই ক্যাম্প।
আগের পোষ্টে যেই ''নরকের প্রবেশদ্বার'' দিয়ে ঢুকেছিলাম, সেটা দিয়েই আবার আমরা একসময়ে বের হয়ে এলাম। মনে হলো যেন একটা দমবন্ধকরা গুমোট পরিবেশ থেকে বের হয়ে বুক ভরে শ্বাস নেয়ার মতো জায়গায় ফিরে এলাম। যতোক্ষণ ওই কম্পাউন্ডের মধ্যে ছিলাম, কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। আক্ষরিক অর্থেই ফিরে গিয়েছিলাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই ভয়াবহ বেদনাময় দিনগুলোতে। প্রফেসর সাব আর তার সহধর্মিনীর দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, তাদের অবস্থাও বিলকুল আমার মতোই।
যাক গে, আর বক বক না করে চলেন.............কিছু সচিত্র বর্ণনায় যাওয়া যাক। মানে, ক্যাম্পের বাকী অংশটুকু আপনাদের যথাসম্ভব ঘুরিয়ে দেখাই।
নরকের প্রবেশদ্বার দিয়ে বের হয়ে বর্তমানে যেই বিশাল খোলা জায়গা পাওয়া যায়, তা সেই সময়ে খোলা ছিল না। ছিল কয়েদীদের জন্য ব্যারাক। এখন আর সেই ব্যারাকগুলো নাই। তার বদলে নিঃসঙ্গভাবে দাড়িয়ে আছে একটা খৃষ্টানদের চ্যাপেল, একটা খৃষ্টানদের মেমোরিয়াল আর একটা ইহুদীদের মেমোরিয়াল।
এটা হলো ক্যাথলিক খৃষ্টানদের একটা মেমোরিয়াল। ক্যাম্পের উত্তর দিকে স্থাপিত এই মেমোরিয়ালটার নাম The Catholic Mortal Agony of Christ Chapel.
মেমোরিয়ালের ভিতরের দেয়ালে এই ভাস্কর্যটা করা, যেখানে কাটার মুকুট পড়া যীশু গালে হাত দিয়ে বিষন্নভাবে বসে আছেন আর বিভিন্ন ভাষায় লেখা আছে, ''এই ক্যাম্পের প্রতি তিনজন ভিক্টিমের একজন ছিল পোলিশ''সহ আরো কিছু কথা।
এটা ইহুদীদের মেমোরিয়ালের বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে তোলা ছবি। এই মেমোরিয়ালটা যেই কনসেপ্টে তৈরী করা হয়েছে, সেটা একটু বর্ণনা করি।
মেমোরিয়ালটাতে ঢালু রাস্তা একটা অন্ধকার ঘরের দিকে এগিয়ে গিয়েছে (আলো থেকে নীচে অন্ধকারের দিকে যাত্রা), যার গেইট আর দুই পাশের দেয়াল কাটায় (প্রতীকী বেদনা) মোড়ানো। কিন্তু ঘরের ভিতরে মধ্যখানে মার্বেল পাথরের একটা আলোর বীম আকাশের দিকে উঠে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে (দ্বিতীয় ছবিতে ছাদে আলো ছড়িয়ে পড়া প্রতীকীভাবে দেখানো)। মূল মানে হলো, দাহাউ এর মতো একটা অন্ধকার জায়গাতেও আশার আলো খুজে পাওয়া সম্ভব!!!
এই জায়গাগুলোতে ছিল কয়েদিদের সারি সারি ব্যারাক। কোথায় কতো নাম্বারের ব্যারাক ছিল, সেটা এই রকম সিমেন্টের বেদীর মতো করে লেখা আছে। ৭ আর ১৩ নাম্বার ব্যারাকের সামনে দাড়িয়ে ভাবছিলাম, এই ৭নং ব্যারাকের কয়েদিরা কি নিজেদেরকে লাকী মনে করতো? কিংবা ১৩নং এর কয়েদিরা আনলাকী? নিশ্চয়ই না..........তবে আপনাদের জানিয়ে রাখি ১, ৩ আর ৫নং ব্যারাকের কয়েদিরা নিঃসন্দেহে আনলাকী ছিল। কারন এই তিন ব্যারাকেই বিভিন্ন নিষ্ঠুর মেডিক্যাল এক্সপেরিমেন্টের গিনিপিগ হিসাবে ব্যবহার করার জন্য কয়েদিদেরকে রাখা হতো।
ছবিতে যেই ব্যারাক দু'টা দেখছেন, এই দু'টা শুধুমাত্র বর্তমানে দর্শনার্থীদের জন্য রাখা হয়েছে। তাহলে চলেন, ভিতরে গিয়ে দেখি কিভাবে সেই সময়ে থাকতো কয়েদিরা!!
এই রকমের তিনতলা বাঙ্ক, যার প্রতিটা খোপ একজন কয়েদির বিছানা। এটাই ছিল তাদের ঘুমানোর জায়গা। তবে সংখ্যা বেড়ে গেলে সেই সুযোগটাও থাকতো না; শেয়ার করতে হতো তখন। সেই সময়ের তোলা অন্য ছবিটা দেয়ালের ডিসপ্লে বোর্ড থেকে নেয়া।
হাত-মুখ ধোয়ার বেসিন।
ইনফরমাল কমন রুম। এখানে প্রাকৃতিক কর্মের সাথে সাথে কয়েদিরা নিজেদের মতো করে কিছু সময় ব্যয় করতে পারতো।
ফরমাল কমন রুম।
এই তিনটা আইটেম প্রতিটা কয়েদির জন্য বরাদ্দ ছিল। এগুলো কি কাজে লাগতো সেটা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না!!!
ক্যাম্পের মিউজিয়ামে রাখা এই ট্রলি ব্যবহার করা হতো ক্যাম্প সংলগ্ন ভেষজ বাগানে। তবে এটার আরেকটা কাজও ছিল। ক্ষুধা, তৃষ্ণা আর তীব্র শীতে অসুস্থ হয়ে যাওয়া কিংবা মরে যাওয়া কয়েদিও বহন করা হতো এটাতে। তবে জীবিত অবস্থায় যতোই অসুস্থ হোক, কেউ এটাতে উঠতে চাইতো না। কারন, বোঝায় পরিণত হওয়া চলৎশক্তিহীন চরম অসুস্থদেরকে নাৎসিরা সাধারনতঃ বাচিয়ে রাখতো না।
মিউজিয়ামে প্রদর্শিত একটা স্বস্তিকা চিহ্ন। ইন্টারেস্টিং আর খুবই ইনোভেটিভ, কি বলেন!!!!
ব্রোন্জের তৈরী ভাস্কর্য, যাতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে কাটাতারে ঝুলে থাকা মানবদেহ। ভারতের ''ফেলানী কান্ড'' এর জার্মান সংস্করণ। ভারত সম্ভবতঃ এই ভাস্কর্য থেকেই প্রেরণা নিয়েছে।
পাচটা ভাষায় লেখা........NEVER AGAIN ভাস্কর্য!!! আয়রনি হলো, ইজরায়েল রাষ্ট্রটা এই কথাটার কোন মুল্যই দেয় নাই, কোন শিক্ষাও নেয় নাই। হিটলারের এথনিক ক্লিনজিংয়ের কাজের ব্যাটনটা এখন তাদের হাতে।
এটাই ছিল আমাদের শেষ দ্রষ্টব্য। এখানে একটা ঘটনা ঘটে, যেটা মনে হলে এখনও আমার কিঞ্চিৎ অস্বস্তি হয়। ভাস্কর্যটা দেখতে দেখতে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আমি বলেছিলাম, শালার ইহুদীরা ইতিহাস থেকে কোন শিক্ষাই নেয় নাই। ভবিষ্যতে এদের পরিণতি হবে ভয়াবহ। পাশে দাড়ানো অধ্যাপক সাহেবও ফোস করে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আমার পিলে চমকে দিয়ে বললো, একজন ইহুদী হয়েও তোমার কথার সাথে আমি একমত!!! আমার মাথায় যেন বাজ পড়লো........হালায় কয় কি!!! এই কথা এতো সময় ধরে পেটের মধ্যে ধরে রাখার কোন মানে আছে? আমার অবস্থা দেখে বললো, তোমার লজ্জা পাওয়ার কিছু নাই। এই বিষয়ে তার বক্তব্যটা ছিল এই রকম,
''দেখো একজন ইহুদী হিসাবে আমি প্যালেস্টাইনীদের দুঃখ বুঝতে পারি, কারন আমার বাবাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে একই অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল। তখন আমার বাবা প্রাণভয়ে মাতৃভূমি জার্মানী থেকে পালিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়েছিল। আমি প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতার পক্ষের একজন মানুষ। ইজরায়েল সেখানে যা করছে, তা অবশ্যই যুদ্ধাপরাধ।''
তারপরে বিড়ির প্যাকেট বের করে আমাকে একটা স্টিক দিয়ে ফিচেলমার্কা হাসিতে মুখ ভর্তি করে বললো, ''এইটা ধরাও। তোমার ঝুলে পড়া চোয়াল ঠিক হয়ে যাবে!!!!''
ফটো ক্রেডিটঃ শিরোনামসহ সবগুলো ছবিই আমার মোবাইলে তোলা। শিরোনামের ছবিটা ক্যাম্পের মিউজিয়ামে প্রদর্শিত ''দাহাউ কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পের একটা প্রোটোটাইপ'' এর।