সুধা জানে, আমি মরে ভূত হয়ে আমার ঘরের ঘুলঘুলিতে বাসা বেঁধেছি। সে আজকের কথা নয়, আজ থেকে ছ'মাস আগের ব্যাপার। অফিস থেকে আসবার সময় ভিড়ে ভর্তি বাঘমার্কা বাসে ছুটে উঠতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম। পিছনের চাকাটা আমার মাথাটাকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিলো। পকেটে আইডেন্টিটি কার্ড না থাকলে, লোকে বেওয়ারিশ লাশ বলে মর্গে চালান দিতো। কিন্তু তা হয়নি। রাত বারোটার সময় যখন থানার পুলিশ এসে সুধাকে খবর দিলো, তখন সুধা কাটা কলাগাছের মত লুটিয়ে পড়ল।
আমি ঘুলঘুলি থেকে সুধাকে লক্ষ্য করছিলাম আর তাজ্জব বনে যাচ্ছিলাম। আমার স্ত্রী শ্রীমতি সুধারানী দেবী যে আমাকে এতখানি ভালবাসেন, তা কে জানতো! তাহলে কোন শালা মঞ্জু অধিকারীর খপ্পরে পড়ে, ছুটে বাসে উঠতে যায়।
সেদিন সকালেও অফিস থেকে বের হবার সময় সুধা প্রিয় সম্ভাষণ করে দারুণ ঝাঁঝালো গলায় তড়পে উঠেছিলো, আজ সন্ধ্যের মধ্যে না ফিরলে, তোমার একদিন কি আমার একদিন। ছুটি হয় সেই পাঁচটায়, আর বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে ন'টা বাজে। জানি না সেই হাড়-হাভাতে টাইপিস্ট ছুঁড়িটাই তোমার নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে কিনা। আজ এ সিনেমা, কাল ও রেস্টুরেন্ট। বাড়িতে বিয়ে করা বউ একলা এঁদো ঘরে খাবি খাচ্ছে আর উনি কিনা একটা উটমুখো মেয়ের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। লজ্জা করেনা, কী বেহায়া মানুষ বাবা!
সুধাকে দোষ দেব না। সুধা মিথ্যে বলেনি। তবে বলার ডিগ্রিটার চাপান অনেক বেশি হয়ে গিয়েছে। মঞ্জুর চেহারায় একটা আলগা চটক আছে। ছুটির সময় মঞ্জু যখন তার রঙকরা চোখের পালক নাচিয়ে, গালে টোল ফেলে, ঠোঁটে হাসির ঝিলিক তুলে সুরেলা গলায় মিষ্টি করে ডেকে উঠতো, "দেবুদা এক মিনিট!" তখন আমার মনের রাশ আলগা হয়ে যেত। সেই একমিনিটটা যে কোথা দিয়ে দু-তিন ঘন্টা হয়ে যেত, তা ভাবনার বিষয়। অবশ্য তার জন্য আমার কিছু রেস্ত খসত। কিন্তু তার জন্য পরোয়া কে করে। হু কেয়ারস্!
সুধা আঁচ করেছে ঠিকই। এটাও ধরে ফেলল। একদিন মাইনে তুলতে গিয়েছি, যামিনীদা আমাকে চমকে দিলেন। বললেন, দেবু মিত্তির তোমার মাইনে তো তুমি তুলতে পারবে না। আমি খেপে গিয়ে বললাম, আমার মাইনে আমি তুলবো না, তো কি আপনি তুলবেন? জেনে রাখবেন, আমি আসলি কায়েত বাচ্চা, শুধু ফোঁস করি না, দরকার হলে কামড়াইও। যামিনীদা বললেন, তাহলে তুমি ঘরে গিয়ে তোমার মিসেসকে কামড়াও হে। তিনি একটা আর্জি পেশ করেছেন। আমাদের সদাশয় ম্যানেজিং ডিরেক্টর সেটি পড়ে তোমার সংসারে সুখ, শান্তি, প্রেম বজায় রাখতে আমাকে হুকুম দিয়েছেন যে, তোমার মাইনে তুলতে গেলে শ্রীমতি সুধারানী মিত্তিরের উপস্থিতি একান্ত প্রার্থনীয়।
সেদিন রাত্রে বাড়িতে তুলকালাম হয়ে গেল। ফাটাফাটিটা শেষ অবধি হাতাহাতিতে গড়াল না। দুজনেই কিছু না খেয়ে দু'দিকের পাশবালিশ আঁকড়ে শুয়ে পড়লাম। দুজনের গায়ের গন্ধ না শুঁকলে যে ঘুম হয়না, সেকথা সেদিন আর কারও মনে ছিল না।
অফিসে ইজ্জত বলে একটা কথা আছে, সেটা চলে গেল। সেই সঙ্গে মঞ্জু। মঞ্জু যদি কাছে আসত, বলত, দেবুদা এর জন্য আমিই দায়ী, আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন, তাহলে আমি হয়তো বাঁচতাম। কিন্তু সেদিনের সেই দুর্ঘটনার পর থেকে মঞ্জু আমাকে একেবারে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে হাল-আমলের ছোকরা আর্টিস্ট নিরুপম জোয়ারদারের কাঁধে ঝুলে পড়ল। আমার সেকশনের ছেলেছোকরারা আমাকে দেখে মুখ টিপে টিপে হাসত। শালা অজয় দাশগুপ্ত তো একদিন বলেই বসল, আর টাইপ করবে মাল! না, কি-বোর্ডে আঙুল রাখতে দিচ্ছে না অধিকারী।
মনটা বড় খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। ঘরে সুধার সঙ্গে কিচাইন, বাইরে শান্তি নেই। তার ওপর কাজের চাপে দম নিকলে যাবার যোগাড়। একদিন ছুটির পর সন্ধের মুখে মঞ্জু আর নিরুপমকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাসে উঠতে দেখে খেপে গেলাম। মনে হল, ওদের দুজনের একটাকে আজ নিকেশ করে দেব। কিন্তু কে জানত, যমরাজ তাঁর যমদূতকে আমার পেছনেই লাগিয়ে রেখেছেন। আমি লাফিয়ে বাসে উঠতে গিয়ে উঠতে পারলাম না। পেছনের চাকা আমার মাথাটা শ্লেটের মত থেবড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি মরে ভূত হয়ে গেলাম।
তিনদিন বাদে আমাদের অফিসের যামিনীদাকে দেখে সুধা ফুঁপিয়ে উঠল, যামিনীবাবু ওর এ মাসের মাইনে? পেনশন, গ্রাচুইটি?
পরবর্তী পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই নভেম্বর, ২০০৮ দুপুর ১:১৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



