আগের পর্ব
যামিনীদা বললেন, হবে, হবে। আপনাকে নমিনি করা আছে, ভাবনা কি। তবে বুঝতেই পারছেন, একটু দেরি লাগবে।
সুধা চোখ মুছতে মুছতে বলল, তাহলে আমার কী করে চলবে যামিনীবাবু?
সে কথাই ভাবছি। যামিনীদা ভাবনার মুখ করে বললেন, আচ্ছা, আপনি কি গ্রাজুয়েট? গ্রাজুয়েট হলে আপনার একটা হিল্লে হয়ে যাবে। কমপ্যাশনেট গ্রাউন্ডে আপনি একটা চাকরি পেয়ে যাবেন অফিসে।
সুধা ঠোঁট ওল্টালো। গ্রাজুয়েট হলে কি ওই বাঁদরের গলায় মালা দিই যামিনীবাবু! আমার বাবা ওটা ভক্কি মেরেছিলেন।
আজ পাঁচ বছর বাদে এহেন সত্য কথা শুনে আমি পরম পুলকিত হলাম। পেট বগবগিয়ে হাসি উঠল। হাসিটা যে ফোয়ারা হয়ে যাবে কে জানত। যামিনীদা চমকে উঠে বললেন, কে হাসে!
সুধা ঘাড় কাত করে শুনছিল। চোখ ঘুরিয়ে বলল, কে আবার হাসবে, ওই আপনাদের দেবু মিত্তির। অপঘাত মৃত্যু তো! বেঁচে থাকতে আমার হাড়মাস জ্বালিয়ে শান্তি হয়নি। এখন মরে জ্বালাতে এসেছে।
যামিনীদার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে এল। মুখের সামনে তুড়ি দিয়ে যামিনীদা বললেন, এবার তাহলে আসি।
সুধা বলল, আসুন। কিন্তু আমার পাওনা-গন্ডা তাড়াতাড়ি দিতে ভুলবেন না। তাহলে কিন্তু ভূতটাকে আপনার বাসায় পাঠিয়ে দেব। ওই হাসি শুনলেই চিনতে পারবেন।
আমার কেমন মজা লাগছিল। আমি আবার খোনা গলায় হেসে উঠলাম। যামিনীদা তড়াক করে লাফ মেরে, দরজার বাইরে গিয়ে বুকে ক্রশ এঁকে, মনে মনে বললেন, রাম! রাম!
বাছুরের শিঙ উঠলে গাছে ঘষে রক্তারক্তি করে। আমার নতুন শক্তি দেখে আমি নিজেই তাজ্জব। এতদিন শালা কেঁচো হয়ে ছিলাম। ঘরে সুধার ভয়, বাইরে পাঁচজনের। এখন কার পরোয়া! আমি ঘুলঘুলি থেকে লাফ মারলাম। কেউ আমাকে দেখতে পেল না। ঝড়ের বেগে ছুটে ঘরের জানলা-দরজাগুলো পটাপট দুলিয়ে দিলাম। ইচ্ছে হল বাপের আমলের আশিমনি ওই খাটটাকে একটু নাড়াই। ইচ্ছেটাকে কাজে লাগাতেই খাটটা চারপেয়ে দাঁতাল হাতির মত ঘুরে দেওয়াল-আলমারিতে গিয়ে থাক্কা খেল। ঝনঝন করে কিছু কাঁচের বাসন মেঝেয় পড়ে ভেঙে চৌচির।
সুধা ছুটে এসে ঘরে ঢুকল। কেঁদে ফোলা ফোলা চোখ-মুখ। মাথায় রুখু এলোচুল। ক'দিন তেল মাখেনি সুধা, গায়ে খড়ি উঠেছে! পরনের কোরা কাপড়টা খসখসে, বারেবারে খুলে পড়ে যাচ্ছিল। রাগে সুধার চোখ জ্বলছিল। আঁচলের দিকটা গাছকোমর করে বেঁধে নিয়ে সুধা চোখমুখ ঘুরিয়ে বলল, দেখো নিজের জ্বালায় মরে যাচ্ছি, এখন ন্যাকামি ভাল লাগে না। সারাজীবন তো অপাট করে গেলে, এখনও তাই। লজ্জা করে না! নাও, যেখানকার জিনিস, যেমন ছিল, ঠিক তেমনি করে দাও। ভাঙা কাঁচ ঝাঁট দিয়ে কুড়িয়ে ফেল। ঊনিশ-বিশ হলে তোমার বাঁদরামি আমি ঘুচিয়ে দেব।
সুধার চোখমুখ দেখে আমার ভয় হল। বিশ্বাস নেই, কালই হয়ত রাজমিস্ত্রী ডেকে ঘরের ঘুলঘুলি গেঁথে দেবে সুধা। বেশি খেপে গেলে কলিঙ্গ হরিসংকীর্তন সমিতির লোকজন ডেকে এনে, এমন অষ্টপ্রহর নাম সংকীর্তন শুরু করে দেবে যে, খোল-কর্তালের আওয়াজে আমাকে দেশছাড়া হতে হবে। কিম্বা ঘুঁটের জোয়াল দিয়ে ধোঁয়া দিলে আমি কি আর থাকতে পারব? সুতরাং লক্ষী ছেলের মত ঘরদোর সাফ-সুরুত করে, যেমন খাট ছিল তেমনি সাজিয়ে আবার ঘুলঘুলিতে উঠে পড়লাম। লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছিল। বেঁচে থাকতে সুধার সঙ্গে কোনদিন এঁটে উঠিনি, মরেও পারলাম না। কোন স্বামীই বা কোন স্ত্রীর কাছে জিততে পেরেছে! দুনিয়ায় আর যার কাছেই জারিজুরি খাটুক, বউয়ের কাছে কিছু খাটে না। সেখানে আমরা সবাই ঢোঁড়াসাপ।
দিনের বেলা আমার কিছু করার তাগদ থাকত না। শরীরটা যেন ন্যাতা হয়ে আসত, গা ঢিসঢিস। রোদের আলো ফুটলেই ঘুমিয়ে পড়তাম। ঘুম ভাঙতো সন্ধেবেলা। সন্ধের পর রাত যেই একটু ঘন হত, তখন ফূর্তি দেখে কে! তখন গায়ে মত্ত হাতির বল, কী যে করব ভেবে পাই না। সাধে কি আর লোকে আমাদের ভূত বলে। এক একদিন সুধা যখন খাটে শুয়ে শুয়ে গায়ের জামা খুলে ঘামাচি মারত, তখন মনে হত লাফ মেরে সুধার পাশে গিয়ে শুই। কিন্তু সুধার যে মেজাজ, ভয়ে এগোতে সাহস হত না।
অবশ্য মেজাজ হবার কথা। আমি তো পার্থিব জীবন থেকে অকালে বিদায় নিয়েছি। আহা বেচারা, সংসারের সব ভাবনা, দায়িত্ব, একলা ভাবতে হচ্ছে। বেওয়ারিশ বিধবা দেখে, সুধার সম্পর্কের মাসি-পিসি এসে এ বাড়িতে থানা গাড়বার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সুধার কাছে খাপ খুলতে পারেনি। তিনদিনেই তাদের পত্রপাঠ বিদায় দিয়ে বলেছিল, আমার ভাবনা আমি ভাবব। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত তোমরা যদি উড়ে এসে জুড়ে বস, তাহলে তো আমাকে গলায় দড়ি দিতে হয়।
কথাটা শুনে আমার ভালই লেগেছিল। সুধা যদি গলায় দড়ি দেয়, তাহলে আমাকেও আর একলা থাকতে হয় না। এ ঘরে চুটিয়ে দুজনে রাজ্যপাট করতে পারি। পরে ভেবে দেখলাম ওটা কথার কথা। কে আর ইচ্ছে করে সাধের জীবন ছেড়ে, ভূতের সঙ্গে ঘর করতে আসে। সুধাই যদি মরে যেত, আর আমি বেঁচে থাকতাম, তাহলে আমি কি সুধার শোকে বৈরাগী হয়ে ঘুরে বেড়াতাম, না মঞ্জুর মত কাউকে জুটিয়ে এনে দেদার ফূর্তি লোটার চেষ্টা করতাম। শালা বাঁচা মানুষের লজিকই আলাদা। ভূতের ট্র্যাজেডি কে আর বুঝতে চায়!
একদিন দেখি, সুধা আনমনা হয়ে জানলা খুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। বাইরে ঘন মেঘ করছে, বিদ্যুত চমকাচ্ছিল। আমার ভয় হচ্ছিল। তেমন তোড়ে বৃষ্টি এলে, এই ঘুলঘুলিতে ভিজে একশা হয়ে যাব। আমার ছেলেবেলায় সর্দি-কাশির ধাত ছিল। ঠান্ডা লাগলে প্রায়ই জ্বরজারি হত। এখন যদি আবার জ্বর হয়, তাহলে কে দেখবে? মাথায় হাত বুলিয়ে দেবার, কি একটু ভাল কথা বলার লোক নেই। সুধাকে বললে, সুধা শুনবে কি!
আমি নিজের ভাবনা ভাবছি। ঠিক সেই সময় অস্পষ্ট আকটা ফোঁপানির শব্দ কানে এসে বাজল। আমি চমকে তাকিয়ে দেখি, সুধা আমার ফটোর সামনে দাঁড়িয়ে গুনগুন করে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলছে, তুমি কি বেআক্কেলে মানুষ, মরবার আর সময় পেলে না। দেখ, বাইরে কেমন অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। এমন দিনে তোমাকে পাশবালিশ না করে কোনদিন শুয়েছি! বল, এই বয়েসে একলা শুতে কার ভাল লাগে। আমার ভয় করে না বুঝি। সেরকম যদি একটা বিকট বাজ পড়ে, তাহলে ভয় পেয়ে কাকে জড়িয়ে ধরব?
সুধার কথা শুনে আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল। আহা, বেচারী! এই তো সবে তিরিশ বছর বয়স। আমার পূজনীয় শ্বশুরমশাই ভক্কি মেরে থাকলে বত্রিশ। সামনে খাঁ খাঁ দুপুরের মত যৌবন খাঁ খাঁ করছে, এতবড় জীবন পড়ে রয়েছে, আর আমি কিনা স্বার্থপরের মত একলা চলে এলাম। আহা, সুধা কী করবে। সুধার দুঃখে আমার চোখে জল এসে যাচ্ছিল। আমি মনে মনে বললাম, সুধা ভয় নেই, তোমাকে একা থাকতে হবে না। আমি তোমার পাশে এসে শুচ্ছি। তুমি যত খুশি আমাকে পাশবালিশ করে জড়িও, আমি কিচ্ছু বলব না। সারারাত ধরে তুমি মনের সুখে ঘুমিও, আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখব।
সুধা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল। এলো গা। পড়নের শাড়িটা আলগা করে বুকের ওপর ফেলা। আমার চোখ চকচক করে উঠলো। দি ট্র্যাজেডি অব বিয়িং এ ভূত যে কী, আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম। তবু আমার মন মানল না। আমি মশারির ছোট ছোট ফুটোর মধ্য দিয়ে গলে সুধার পাশে গিয়ে গড়িয়ে পড়লাম...
পরের পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই নভেম্বর, ২০০৮ সন্ধ্যা ৬:২৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



