আগের পর্ব
সুধা চোখ বুজে শুয়ে ছিল। শীতল হাওয়ার স্পর্শ পেয়ে বলে উঠল, আঃ! বাঁচলাম। শরীর জুড়োল। আনন্দে আমার হাসি পাচ্ছিল। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তেই আমি আমার উপস্থিতি জানাতে চাই না। আর একটু সময় যাক, সুধার মন যখন একেবারে গলে আসবে, তখন আমি বলব, অহম অয়ম ভোঃ --আমি এসেছি।
সুধা ধীরে ধীরে পাশ ফিরল। পাশবালিশ খুঁজছিল। আমি সুড়ুৎ করে বালিশের মত সুধার বাঁ পায়ে ঠেক দিলাম। সুধার বোজা চোখ খুলে গেল। আশ্চর্য হয়ে তাকাচ্ছে সুধা। বিছানায় পা পড়েনি, অথচ যেন বালিশে পা আছে এমন ভাব। সুধা ধড়মড় করে উঠে বসল। তারপর খেপে গিয়ে বলল, ছিঃ! ছিঃ! ছিঃ! মরে গিয়েও শান্তি হয়নি। এখনো এইসব! লজ্জা করেনা, বেহায়া কোথাকার। যাও না, তোমার সেই উটমুখো ছুঁড়িটার কাছে। সে তোমাকে কোলে নিয়ে স্বর্গে নাচাবে।
সুধার ঝাঁঝ দেখে আমি বিন্দুপ্রমাণ হয়ে গেলাম। লোকের ভাল করতে নেই। আরে, যার জন্যে করি চুরি, সেই বলে চোর! সুধা রাগের গলায় বলল, তুমি ভালমানুষের ছেলে নও। এবার তোমার একটা বিহিত করতে হয়। ঠিক আছে, এবার যেদিন রেগে গিয়ে গয়ায় পিণ্ডি দিয়ে আসব, সেদিন ভূতগিরি বেরিয়ে যাবে।
গয়ায় পিণ্ডি! দু'চোখে আমার জল এসে গেল। আমার এ ভূতজন্ম যদি শেষ হয়ে যায়, তাহলে আমি কী নিয়ে থাকবো!
ক'দিন আমি বিমনা হয়ে থাকলাম। ভূত বলে কি আমার মান অভিমান নেই! আহারে রুচি নেই, মুখটাও কেমন বিস্বাদ। কিছুই ভাল লাগে না। মনে হয় ধড়া-চূড়ো পরে সন্ন্যেসী হয়ে যাই। এ সংসারে যার স্ত্রী বিমুখ তার বেঁচে থাকায় লাভ কী? অবশ্য সুধা যদি আমার স্ত্রী হয়। মরে গেলে কি স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক থাকে, না ডিভোর্সের মত কাটান ছাটান হয়ে যায়?
তিন-চারদিন এভাবে থাকতে থাকতে, একদিন আমি খেপে গেলাম যেন। আমার হাত পা নিশপিশ করছিল। হঠাৎ মনে হল, কার জন্য আমার এই অবস্থা? আমি বাসের তলায় পড়ে চ্যাপ্টা মাথা আর ভূতগ্রস্ত শরীর নিয়ে সুধার গালাগাল খেয়ে মরছি, আমার আমার সেই অফিসফেরতা সাধের মঞ্জু তার চোখে পালিশ মেখে, গালে টোল ফেলে, হাসিতে গড়িয়ে পড়ে নিরুপমের সঙ্গে লদকালদকি করে বেড়াচ্ছে-- এটা সহ্য করা যায় না। এবারে ওদের একটু টাইট দেওয়া দরকার। আমি মরব, আর ও বেঁচেবর্তে সুখে-স্বচ্ছন্দে হেসে খেলে বেড়াবে, এ হয় না, হয়না!
শরীরটাকে ঠিক করে নিতে আমি ঘুলঘুলির ভেতর কষে ডন-বৈঠকি লাগালাম। হাতের গুলি ফোলালাম, পায়ের ডিম। ব্যায়াম করতে করতে যখন মনে হল শরীরটা বেশ জুতের হয়েছে, তখন ঘুলঘুলি ছেড়ে আকাশে হাত-পা মেলে দিলাম। একটা রাতচরা চামচিকে আমাকে দেখেভয়ে চোঁ-ও করে একটা আলো-জ্বালা ঘরে ঢুকে পড়ল। দূরে কোথাও একটা প্যাঁচা ডাকছিল।
কলকাতায় যে প্যাঁচা থাকতে পারে আমার ধারনা ছিলনা। পরে মনে হল ফ্ল্যাটবাড়ির ছোট ছোট কোটরে থাকতে থাকতে এ শহরের তিনভাগ মানুষ প্যাঁচা হয়ে গেছে। দিনের আলোয় তাদের পাত্তা পাওয়া যায় না। রাতে আলো জ্বললে, তারা জোড়ায় জোড়ায় বেরিয়ে পড়ে। বাড়িতে রান্না নেই, যে-কোন দোকানে ঢুকে খেয়ে নেওয়া। রাত ঘন হয়ে নামলে বিছানায় গড়ানো।
কার্জন পার্ক ছাড়িয়ে ময়দান মার্কেটে এসে পড়লাম। এখান থেকে মঞ্জু অন্তত খান ছত্রিশেক শাড়ি কিনেছে আমার পয়সায়। সিনেমা হাউসগুলো পেরিয়ে গেলাম। এসব হাউসে কম সিনেমা দেখিনি আমরা। মঞ্জুর আবার বেশিরভাগ সেক্স আর ভায়োলেন্সের ছবি পছন্দ ছিল। এক একটা ছবি দেখতে দেখতে মঞ্জু যখন ভয়ে আঁতকে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরত, কি আমার হাত কোলের ওপর টেনে নিয়ে খেলা করত, তখন সুধাকে কেমন যেন ফ্যাকাশে, বিবর্ণ, মাটির পুতুলের মত লাগত। মনে হত, মঞ্জুই আমার জীবন, সুধা মরন। কিন্তু শেষকালে ব্যাপারটা পুরো উল্টো হয়ে গেল। আমাকে মঞ্জুর জন্য মরতে হল, সুধা চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারল না।
আমি উড়তে উড়তে মঞ্জুর অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে চলে এলাম। সাতাত্তর নম্বর ঘরের দরজা যথারীতি বন্ধ। ঘরে ব্লু রঙের একটা আলো জ্বলছে। আমি কি-হোল দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, ঘরে দু'জন মানুষ, সামনে সেন্টার টেবিলে তরল পানীয়। এ পানীয়ে অনেকদিন চুমুক দেওয়া হয়নি! গেলাস দেখেই আমার জিবে জল এসে যাচ্ছিল।
আমি হাইজাম্প দিয়ে উপরে উঠে গেলাম। ভেন্টিলেটারের ফাঁক দিয়ে নিজেকে গলিয়ে তাজ্জব। আরে, এ তো নিরুপম নয়, এ তো অজয় দাশগুপ্ত! এরই মধ্যে আর একবার পার্টনার পাল্টেছে মঞ্জু। আমি মনে মনে 'এনকোর', 'এনকোর' বলে বললাম, তোমার হবে মঞ্জু। তুমি যেরকম শাড়ি পাল্টানোর মত পুরুষ পাল্টাচ্ছ, তাতে একদিন তুমি কুইন ক্লিওপেট্রা হয়ে যাবে।
অজয় মঞ্জুর কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে ছিল। ওর কাঁচাপাকা ফ্রেঞ্চকাট দাড়িতে মদের সুবাস। হাত দু'টো ঘুরিয়ে মঞ্জুর পিঠে রাখা। কী একটা কথা বলতে বলতে অজয় হাতের চাপে মঞ্জুর পিঠ বেঁকিয়ে মঞ্জুকে নিজের মুখের ওপর টেনে আনছিল।
আমার হাসি পেল। শালা, একদিন আমাকে খুব আওয়াজ দিয়েছিলি। আজ আওয়াজ দেওয়াচ্ছি। আমি অজয়ের আঙুলের ফাঁকে মাছির মত গলে গিয়ে, মঞ্জুর পিঠে মোক্ষম একটা চিমটি কাটলাম। মঞ্জু চমকে লাফিয়ে উঠে বলল, কি ইডিয়টের মত করছ, পিঠে চিমটি কাটলে কেন?
অজয় পড়ে যেতে যেতে টাল সামলে অবাক হয়ে বলল, আমি!
মঞ্জুর পিঠ জ্বালা করছিল। জায়গাটা লাল হয়ে ফুলে উঠেছে। হাজার হোক ভূতের চিমটি, হবে নাই বা কেন? মঞ্জু বলল, তুমি নয় তো কে আবার! ঘরে কি আর কেউ আছে!
অজয় নিজের নখ দেখল। ম্যানিকিওর করা নখ। চিমটি কাটবার ধার নেই তাতে। অজয় হাত মেলে দিয়ে বলল, তুমি বল, এই নখে চিমটি কাটা যায়?
মঞ্জু রাগে ফুঁসছিল। শাড়ির আঁচলটা কাঁধের ওপর ফিরিয়ে দিয়ে বলল, আমি কিছু দেখতে চাই না। তুমি মাতাল হয়েছ। গেট আউট। আই সে গেট আউট!
অজয় বলল, ইয়ার্কি! আজ তুমি আমার তিনখানা শ'য়ের পাত্তি খসিয়েছ, গেলেই হল।
অজয় মদের গ্লাসের দিকে হাত বাড়াল। আমি গ্লাসটাকে ইঞ্চি আষ্টেক ওপরে তুলে নিলাম। অজয় চোখ বড় বড় করল। তারপর বলল, একি রে বাবা! গ্লাসটা যে শূন্যবিহারী, বাতাসে ভাসছে!
মঞ্জু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিল। রঙ করা চোখের পাতা আর পড়ছে না। আমি গ্লাসটা আরো তুলে এনে মঞ্জুর মাথায় ঢেলে দিলাম। তারপর বোতল তুলে চোঁ করে এক নিমেষে বাকি মাল খেয়ে নিয়ে খিকখিক করে খোনা গলায় হেসে উঠলাম।
মঞ্জু আর অজয় দু'জনে একই সঙ্গে ভূ-ভূ-ভূ করতে করতে মাটিতে জড়াজড়ি করে গড়াগড়ি খেতে লাগল। সে দৃশ্য দেখে হাসিতে আমার পেট ফেটে যাচ্ছিল। আমি হাসতে হাসতে বমি করে ফেললাম...
পরের পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০০৮ সন্ধ্যা ৭:৩৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



